মুক্তিযুদ্ধে পাইকগাছা উপজেলা (খুলনা)
পাইকগাছা উপজেলা (খুলনা) খুলনা জেলার অন্তর্গত। ১৯৭১ সালে বর্তমান কয়রা উপজেলা পাইকগাছা থানার অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাইকগাছার রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ড ১৯৭১ সালে প্রধানত পাইকগাছা বাজারকেন্দ্রিক ছিল। ১৯৭০-৭১ সালে এখানকার সকল আন্দোলন- সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ-এর বর্ষীয়ান নেতা লুৎফর রহমান মনি এমএনএ। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে সাবেক ছাত্রনেতা ও ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত এম এ গফুর এমএনএ ও শেখ মাহতাব উদ্দিন মনি মিয়ার নেতৃত্বে পাইকগাছা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ সময় লুৎফর রহমান মনি এমএনএ ঢাকা থেকে এলাকায় এসে সংগ্রাম পরিষদকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার উদ্দেশ্যে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে পরিষদের সঙ্গে যুক্ত করেন। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে পাইকগাছায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক কর্মকাণ্ড শুরু হয়।
২৫শে মার্চের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নির্দেশ অনুযায়ী পাইকগাছাসহ দক্ষিণ খুলনায় মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র কার্যক্রম শুরু হয়। স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের বন্দুক ও বাশের লাঠিসহ অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এভাবে একটি শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী গড়ে ওঠে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা যাতে এলাকায় প্রবেশ করতে না পারে, তার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। এম এ গফুর এমএনএ-এর উদ্যোগে শেখ মাহতাব উদ্দিন মনি মিয়াকে পাইকগাছার থানা প্রশাসক নিয়োগ করা হয় এবং অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে এম এ গফুর নিজে ভারতে যান। ৩১শে মার্চ লুৎফর রহমান মনিও প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের জন্য কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে নিয়ে ভারতে যান।
পাইকগাছায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন লুৎফর রহমান মনি এমএনএ, এম এ গফুর এমএনএ, শেখ মাহতাব উদ্দিন মনি মিয়া, স ম বাবর আলী, শেখ শাহাদাৎ হোসেন বাচ্চু, শেখ বেলাল উদ্দিন বিলু, মো. সোহরাব হোসেন সানা, আবুল কালাম আজাদ, আব্দুস সালাম মোড়ল, রুহুল আমীন গাজী, শেখ কামরুজ্জামান টুকু (মুজিব বাহিনীর প্রধান) প্রমুখ। আর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন আবুল কালাম আজাদ। জুন মাস থেকে পাকবাহিনী পাইকগাছায় আসা-যাওয়া শুরু করে। কিন্তু এখানে তাদের কোনো ক্যাম্প ছিল না। তারা খুলনা শহর থেকে গানবোটে করে এসে বিভিন্ন এলাকায় হত্যা-নির্যাতন চালিয়ে আবার খুলনায় চলে যেত। তবে রাজাকারদের তিনটি ক্যাম্প ছিল। কপিলমুনি বাজার ক্যাম্প, গড়ুইখালী ক্যাম্প ও পাইকগাছা স্কুল ক্যাম্প। এসব ক্যাম্প থেকে তারা এলাকায় বিভিন্ন তৎপরতা চালাত এবং এবং পাকবাহিনীকে সহায়তা করত।
পাইকগাছায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতায় যারা নেতৃত্ব দেয় তাদের মধ্যে শাহজাহান চেয়ারম্যান, আ. গণি মোড়ল (শান্তি কমিটি), মফিজ মোল্লা (শান্তি কমিটি), মোহাম্মদ আলী শিকারী (রাজাকার কমান্ডার), আফসার আলী (রাজাকার), সৈয়দ ফকির (রাজাকার), মওলানা আইন উদ্দিন (রাজাকার), শেখ আব্দুল মতলেব ওরফে মতি মিয়া (রাজাকার), মালেক কারিকর (রাজাকার), দাউদ গাজী (রাজাকার), মশিয়ার রহমান গাজী (রাজাকার), মিনহাজ মোড়ল (রাজাকার) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
পাইকগাছায় মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক এবং অন্যান্য স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। শান্তি কমিটির সেক্রেটারি ছিল আ. গণি মোড়ল (কপিলমুনি) এবং রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ছিল মোহাম্মদ আলী শিকারী। কপিলমুনি বাজার, গড়ুইখালী ও পাইকগাছা স্কুল ক্যাম্প থেকে রাজাকাররা সাধারণ মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাত। কপিলমুনি বাজার ক্যাম্পের রাজাকাররা প্রথমেই ডা. ফণীভূষণ নাথ, উমাপদ দে এবং চৈতন্য মল্লিককে ধরে এনে ফুলতলা নামক স্থানে কপোতাক্ষ নদের ঘাটে হত্যা করে এবং লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। ২৭শে জুলাই শাহজাহান চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে তারা শেখ মাহতাব উদ্দিন মনি মিয়া, গাজী শামসুর রহমান, মনোহর, নুনু বৈরাগী এবং ছাত্রলীগ কর্মী মিজানুর রহমানকে ধরে এনে হত্যা করে। কপিলমুনির মনি সিং, জ্ঞান সিং, নরেণ সিং, কানু পোদ্দার, ডা. তারাপদ, জিতেন্দ্ৰ নাথ সিং, শান্তিরাম সাধু প্রমুখকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করে। কপিলমুনি ক্যাম্পে দেড় সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করে। আরো এক হাজার মানুষকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল, যার প্রমাণস্বরূপ একটি তালিকা পাওয়া গেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্যাম্পটি কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্প বধ্যভূমি নামে পরিচিত।
পাইকগাছা স্কুল ক্যাম্পে রাজাকাররা নির্বিচারে নারীনির্যাতন চালাত। এজন্য ক্যাম্পে ৬টি কক্ষ নির্ধারিত ছিল। রাজাকাররা সন্ধ্যার সময় বিভিন্ন বাড়িতে হানা দিয়ে মেয়েদের ধরে এনে রাতভর ধর্ষণ করত। কাউকে-কাউকে দিনের পর দিন ক্যাম্পে আটকে রেখে ধর্ষণ করত। কারো কারো আত্মীয়-স্বজন টাকার বিনিময়ে মেয়েদের ছাড়িয়ে নিয়ে যেত। অন্যদের কয়েকদিন ধর্ষণের পর হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হতো। নভেম্বরের শেষদিকে রত্না নামের এক হিন্দু বালিকাকে ধরে এনে রাজাকাররা রাতভর ধর্ষণ করে। এতে তার মৃত্যু হলে সকালে পেট কেটে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। তার ভাসমান লাশ এলাকার মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। স্থানীয় মুসলিম লীগ, শান্তি কমিটি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীরা নারীনির্যাতনে যোগ দিত। যুদ্ধের পর রাজাকারদের কাছে পাওয়া কয়েকটি ডায়রি, মুক্তি পাওয়া নির্যাতিত কয়েকজন নারীর জবানবন্দি এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার থেকে নারীনির্যাতনের অনেক লোমহর্ষক বিবরণ জানা যায়।
মার্চের পর খুলনা শহর পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে যায়। এরপর থেকে তারা গানবোটে করে খুলনার বিভিন্ন নদী ও খালে টহল দিত এবং নদীতীরবর্তী গ্রামগুলোতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে লোকজনদের হত্যা করত। ফলে নদীর পারের মানুষ আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে চলে যায়। এ সুযোগে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর লোকেরা গ্রামগুলোতে লুণ্ঠন চালায় এবং পরিত্যক্ত বাড়িঘর ও সম্পত্তি দখল করে। পাইকগাছা শান্তি কমিটির সেক্রেটারি আ. গণি মোড়লের নেতৃত্বে কমিটির সদস্যরা কপিলমুনি বাজারের হিন্দু বাড়িঘর লুট করে। ফলে ধনী হিন্দুদের অনেকেই বসতবাড়ি ছেড়ে ভারতে চলে যায়। জীবন রক্ষায় ভারতগামী ১১ জন সাধারণ মানুষকে কপিলমুনি বাজার থেকে আটক করে শান্তি কমিটির লোকেরা খুলনায় পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। পাকবাহিনী তাদের গল্লামারীতে নিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনা গল্লামারী গণহত্যা নামে পরিচিত। এরপর শান্তি কমিটি কপিলমুনির বিনোদবিহারী সাধুর বাড়ি দখল করে দেড় শতাধিক রাজাকার নিয়ে একটি শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করে এবং ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়।
গড়ুইখালীতে রাজাকার ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার কয়েকদিনের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানকার কমান্ডারকে একটি বাড়িতে জিম্মি করে ক্যাম্পের রাজাকারদের অস্ত্র সমর্পণে বাধ্য করেন। অস্ত্র সমর্পণের পর রাজাকারদের এলাকা ত্যাগ করতে বলা হয়। চলে যাওয়ার সময় তারা তাদের হাতে বন্দি দশজন লোককে গোপনে নিয়ে লঞ্চে ওঠে। লঞ্চ থেকে একজন নদীতে লাফিয়ে পড়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হলেও বাকিদের খুলনায় পাকসেনাদের হাতে তুলে দেয়া হয়। তাদের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
১৮ই সেপ্টেম্বর বাঁকার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ খবর পান যে, রাজাকাররা ক্যাম্প আক্রমণ করতে আসছে। এ খবর পেয়ে তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে বোয়ালিয়া খেয়াঘাটে এম্বুশ করেন। কপিলমুনির দিক থেকে রাজাকারদের বহনকারী একটি লঞ্চ খেয়াঘাটের কাছাকাছি এলে মুক্তিযোদ্ধারা লঞ্চটিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। এতে ভয় পেয়ে রাজাকাররা লঞ্চ থেকে দ্রুত নেমে জঙ্গলের মধ্যে পালিয়ে যায়। এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে পরের দিন ১৯শে সেপ্টেম্বর পাকসেনা বোঝাই একটি গানবোট ও রাজাকার বোঝাই একটি লঞ্চ বোয়ালিয়ায় আসে। গানবোটের শব্দ শুনেই আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা খেয়াঘাটের নিকটবর্তী একটি বাড়িতে অবস্থান নেন। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা গানবোট ও লঞ্চের ছাদ থেকে খেয়াঘাটের দিকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি ছোড়েন। কিন্তু এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করেন। পাকবাহিনী ও রাজাকারদের গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেক মোড়ল, মো. কামরুল ইসলাম, মো. এনায়েত আলী, মো. আবু তালেব মোড়ল, মো. আয়েন উদ্দিন গাজী ও শংকর কুমার অধিকারী শহীদ হন। এরপর পাকসেনা ও রাজাকাররা গ্রামে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালায়। তারা বাঁকার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পসহ কয়েকটি বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং অনেককে ধরে নিয়ে যায়। শত্রুদের গুলিতে আহত ছিদ্দিকুর রহমানকে ভারতে নিয়ে চিকিৎসা করানো হলে তিনি বেঁচে যান, কিন্তু চিরকালের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেন।
নভেম্বরের দিকে পাইকগাছায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এ সময়ের মধ্যে কপিলমুনি ব্যতীত অন্য সকল রাজাকার ক্যাম্প পর্যায়ক্রমে মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। সবশেষে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ডিসেম্বর মাসের প্রথমদিকে কপিলমুনি ক্যাম্প আক্রমণ করেন। তিনদিন একটানা যুদ্ধের পর রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে। এর ফলে খুলনা শহর ও তৎসংলগ্ন এলাকা ব্যতীত খুলনা জেলার প্রায় সমগ্র অঞ্চল শত্রুমুক্ত হয়। পাইকগাছা উপজেলা শত্রুমুক্ত হয় ৮ই ডিসেম্বর।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- মো. রহমত উল্লাহ গাজী, বীর প্রতীক (পিতা শহর আলী গাজী, গড়ইখালী)। পাইকগাছার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুল মালেক মোড়ল (পিতা শাহেদ আলী মোড়ল, শ্রীকণ্ঠপুর; ১৯শে সেপ্টেম্বর বাঁকার যুদ্ধে শহীদ), মো. কামরুল ইসলাম (পিতা গোলাম আকবর সরদার, শ্রীকণ্ঠপুর; ঐ), মো. এনায়েত আলী (পিতা মো. মানিক মোড়ল, বাঁকা; ঐ), মো. আবু তালেব মোড়ল (পিতা ফরিদ উদ্দিন মোড়ল, বাঁকা; ঐ), মো. আয়েন উদ্দিন গাজী, (পিতা মো. নাজেম গাজী, বাঁকা; ঐ) এবং শংকর কুমার অধিকারী (পিতা অনিল কৃষ্ণ অধিকারী, বাঁকা; ঐ)।
পাইকগাছা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে বাঁকায় নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিফলক। এছাড়া পাইকগাছা সদরে রয়েছে শহীদ কামরুল মেমোরিয়াল বিদ্যালয় ও শহীদ গফুর মিলনায়তন। [মোল্লা আমীর হোসেন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড