You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাইকড়া গণহত্যা (আত্রাই, নওগাঁ)

পাইকড়া গণহত্যা (আত্রাই, নওগাঁ) সংঘটিত হয় আগস্ট মাসের মাঝামাঝি কোনো এক শনিবার। এ গণহত্যায় ৮ জন মানুষ শহীদ হন। ৭১-এর ২৫শে মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দেশব্যাপী বাঙালিদের ওপর পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় আগস্ট মাসে পাকসেনারা নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার পাইকড়া গ্রামে গণহত্যা চালায়।
পাইকড়া গ্রাম উপজেলা সদর থেকে পশ্চিমে প্রায় ১৩ কিমি দূরে অবস্থিত। উপজেলা সদর থেকে সড়ক পথে এ গ্রামে যাওয়ার কোনো সুব্যবস্থা ছিল না। এ গ্রামে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের বেশি বসবাস ছিল। এখানে একটি বড় বাজার আছে। এ বাজারে ব্যবসায়ী এবং বিত্তবান লোকেরা বসবাস করত। আত্রাই উপজেলার কুখ্যাত রাজাকার মো. জান বক্স (জানা) এবং হাটকালুপাড়া ইউনিয়নের কচুয়ার সফিউদ্দিন পাকবাহিনীকে ঐ গ্রামে নিয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার উদ্দেশ্যে। আত্রাই পুরাতন রেলওয়ে স্টেশন ক্যাম্প থেকে হানাদার পাকসেনারা ৪-৫টি নৌকা নিয়ে ভোরে পাইকড়া গ্রামে প্রবেশ করে। নৌকাগুলোর মধ্যে ২টি পাইকড়া হাটে, একটি গ্রামের শুরুতে এবং অপরটি শেষে ভেড়ায়। অতঃপর পাকবাহিনী এক সঙ্গে গোটা গ্রাম আক্রমণ করে। গ্রামের লোকজন শত্রুদের আগমনের খবর আগেই পাওয়ার কারণে অনেকে বিভিন্ন এলাকায় এবং আবার কেউ- কেউ জঙ্গলে পলায়ন করে। হানাদার বাহিনী প্রথমে প্রায় শতাধিক গ্রামবাসীকে ধরে সরদার পাড়ায় দুটি লাইনে দাঁড় করায়। অতঃপর সবার লুঙ্গি খুলে দেখে কে মুসলমান আর কে হিন্দু। এরপর তারা পাইকড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে প্রায় ২৫-৩০ জনকে হত্যার উদ্দেশ্যে একত্রিত করে। তাদের মধ্য থেকে ৮ম শ্রেণির ছাত্র আজাহার আলী (১৪) পালানোর জন্য জঙ্গলের দিকে দৌড় দেয়। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে কাঁটার সঙ্গে সে আটকে গেলে পাকবাহিনী তাকে গুলি করে হত্যা করে। পাকবাহিনী স্কুল মাঠে নিমাইচন্দ্র দাস ওরফে মংলা মিস্ত্রী, সুরেন্দ্রনাথ প্রামাণিক (৬০), গুপেশ্বর ওরফে উপেন্দ্রনাথ (৪৮), পলান চন্দ্র দাস (৪০), বৌদ্ধদেব প্রামাণিক বুধু (৩৫) এই ৫ জনকে গুলি করে হত্যা করে। তারা হলধর চন্দ্র হালদার (৭০) ও ভবানী চরণ (৭০)-কে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। হত্যা শেষে তারা পাশের পুকুরের ধারে লাশগুলো ফেলে দেয়। বুধু প্রামাণিক পাকবাহিনীর ভয়ে রাজশাহী জেলার বাগমারা উপজেলার কামারখালি গ্রাম থেকে পাইকড়া গ্রামে বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। গণহত্যা শেষে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহায়ক রাজাকাররা গ্রামের অসংখ্য ঘরবাড়ি লুটপাট শেষে প্রায় অর্ধ শতাধিক বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। ঐদিন পাকসেনারা বিকেল ৩টা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে। তারা পাইকড়া গ্রাম পরিত্যাগ করার পর কয়েকজন গ্রামবাসী নিহত স্কুল ছাত্র আজহার আলীকে পুরাতন কাপড় দিয়ে সমাহিত করে। বিকেল ৩টার পর পাকবাহিনী নৌকাযোগে পাইকড়া থেকে গজমতখালি গ্রামে যায় এবং সেখানে নতুন করে ক্যাম্প স্থাপন করে। তারা আত্রাই ক্যাম্প থেকে নৌকাযোগে গজমতখালি ক্যাম্পে যাতায়াত করত। এ ক্যাম্প থেকে তারা তাদের এ দেশীয় দালাল রাজাকারদের সহযোগিতায় আশপাশের গ্রাম পাইকড়া, বড়াইকুড়ি, বিহানালী, বেড়াবাড়ি ও কচুয়ায় নির্যাতন এবং লুটতরাজ চালাত। পাইকড়া গণহত্যায় শহীদ গ্রামবাসীরা হলেন- সুরেন্দ্রনাথ প্রামাণিক (পিতা শ্রীকৃষ্ণ সুন্দর প্রামাণিক), গুপেশ্বর (শ্বশুর রায়চরণ), নিমাই চন্দ্ৰ দাস (পিতা জয়চন্দ্র দাস), বৌদ্ধদেব প্রামাণিক বুধু (পিতা নীলকান্ত দাস), পলান চন্দ্র দাস (পিতা ভবানী দাস), ভবানীচরণ প্রামাণিক (পিতা সাধুচরণ প্রামাণিক), হলধর চন্দ্র হালদার (পিতা শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র হালদার) ও আজাহার আলী শেখ (পিতা আফতাব উদ্দীন শেখ)। পাইকড়া গ্রাম গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে কোনো স্মৃতিফলক কিংবা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়নি। [চিত্তরঞ্জন মিশ্র]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!