পাঁচগাঁও গণহত্যা (রাজনগর, মৌলভীবাজার)
পাঁচগাঁও গণহত্যা (রাজনগর, মৌলভীবাজার) সংঘটিত হয় ৭ই মে। এতে ৮৩ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হন। মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর থানার পাঁচগাও একটি সমৃদ্ধ গ্রাম। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর সিলেট শহর ও অন্যান্য জায়গা থেকে অনেকে এ গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করে। মে মাস থেকে পাঁচগাঁওবাসীকে স্থানীয় – রাজাকাররা হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন করে আসছিল। স্বাধীনতাবিরোধীরা এক রাতে রমণ ঘোষ, রমেশ চন্দ্র ঘোষ ও সুখেশ চন্দ্র দেবের বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে কয়েক লক্ষ টাকার মালমাল লুণ্ঠন করে। তবু মানুষ আতঙ্কে বাড়ি না ছেড়ে গ্রামের নিরাপত্তা জোরদারের জন্য ৪- ৫ জনের দল করে রাত জেগে পাহারার ব্যবস্থা করে।
এ অবস্থায় রাজাকাররা মৌলভীবাজারে অবস্থিত পাকসেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। রাজাকার আলাউদ্দীনের প্ররোচনা ও সহায়তায় ৭ই মে রাতে মৌলভীবাজার শহর থেকে পাকসেনাদের একটি দল পাঁচগাঁও-এ হানা দেয়। ভোর ৪টার সময় দুটি জিপে ৪০-৫০ জন পাকসেনা ও রাজাকার গ্রামে ঢোকে। তারা লীলা নাগের পৈতৃক বাড়িতে বসে গণহত্যার ছক তৈরি করে। এরপর বাড়ি-বাড়ি ঢুকে ঘুমন্ত লোকজনকে ধরে গ্রামের সাবেক জমিদার হিরণ বাবুর দিঘী পাড়ে জড়ো করে। সিলেটসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে আশ্রয় নেয়া লোকজনও পাক হায়েনাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। তারা মহিলা ও শিশুদের বের করে বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। নরপশুরা ধৃত লোকগুলোকে টেনে-হিঁচড়ে এক স্থানে জড়ো করে। অনেকের পরনের ধুতি খুলে উলঙ্গ অবস্থায় শক্ত করে বেঁধে নিয়ে আসে। জোড়া করে পা-বাঁধা জীবন্ত মানুষগুলোকে জমিদার বাড়ির দিঘীতে নিক্ষেপ করে। গুলি করে অনেককে দিঘীর জলে ছুড়ে ফেলে। এমন নারকীয় গণহত্যার পর পুরো গ্রাম পুরুষ-শূন্য হয়ে যাওয়ায় পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকজন এসে দিঘীতে জাল ফেলে হাত-পা বাঁধা ৫৯টি লাশ উদ্ধার করে। পরে দীঘির পশ্চিম পাড়ে একটি গর্ত করে মৃতদেহগুলোকে মাটিচাপা দেয়া হয়। এদিন মোট ৮৩ জনকে হত্যা করা হয়।
পাঁচগাঁওয়ের পৈচাশিক গণহত্যায় নিহতদের মধ্যে যাদের নাম জানা গেছে, তারা হলেন— পাঁচগাঁও গ্রামের কৃষ্ণ চক্রবর্তী, হিরন্ময় দাশ, পুতুল চন্দ্র অধিকারী, অভয় চন্দ্র দেব, ললিতা দাশ, সুরেন্দ্র মালাকার-১, নরেন্দ্র মালাকার, গোপেশ চন্দ্র মালাকার, নগরী মালাকার-১, লঙ্গু মালাকার, রস মালাকার, সুবল মালাকার, সুকেশ মালাকার, উপেন্দ্র মালাকার, নরেন্দ্র শব্দকর, নিরদ শব্দকর, বিমল মালাকার, বীরেশ মালাকার, টুনা সাধু, পুতুল মালাকার, সুরেন্দ্র মালাকার-২, রবি মালাকার, আদাই মালাকার, রমন মালাকার-১, লাল মালাকার, ঈরেশ মালাকার-১, উমেশ মালাকার, ঈরেশ মালাকার-২, কুমার মালাকার, নগেন্দ্র মালাকার, রমন মালাকার-২, রঞ্জন মালাকার, নিত্য রানী মালাকার, নগরী মালাকার-২, গোপাল শব্দকর, অভি শব্দকর, রমন শব্দকর, কুটি শব্দকর, মনাই শব্দকর, শ্যাম শব্দকর, বীরেশ শব্দকর, উপায় শব্দকর, হরেন্দ্র শব্দকর, ব্রজেন্দ্র শব্দকর, পরেশ শব্দকর, নরাই শব্দকর, শার শব্দকর নরেশ চন্দ্র দেবনাথ, নবরাম শব্দকর ও নিত্যবালা শব্দকর; খানিকুল গ্রামের সনাতন নমঃশূদ্র, পরেশ নমঃশূদ্র, বসন্ত নমঃশূদ্র, পিয়ারী নমঃশূদ্র ও জ্যোতি নমঃশূদ্র; পশ্চিমভাগ গ্রামের শান্ত চক্রবর্তী, বিনোদ চক্রবর্তী এবং সিলেটের কুমুদ চন্দ্র নাগ। এ নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে গেলেও মারাত্মকভাবে আহত হন সাধু শব্দকর, শুক্ল বৈদ্য, চরিত্র শব্দকর প্রমুখ। এদের কেউ হাতে-পায়ে, কেউ শরীরের অন্যত্র গুলিবিদ্ধ হন।
পাকসেনারা চলে যাবার সময় রাজাকাররা পাঁচগাও-এ আশ্রয় নেয়া এবং স্থানীয় আরো বেশ কয়েকজনকে ঘাতকদের হাতে তুলে দেয়। তারা হলেন- রাজনগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক অমূল্য চরণ দাস (মাখন বাবু), হিরন্ময় দাশ (ব্রিটিশ আমলের সামরিক অফিসার), নিখিল রঞ্জন চক্রবর্তী (মৌলভীবাজার কলেজের ছাত্র), রসময় চক্রবর্তী (১), বিনোদ চক্রবর্তী, দেবেন্দ্র ভট্টাচার্য, খোকা ভট্টাচাৰ্য, কৃষ্ণকান্ত চক্রবর্তী, রসময় চক্রবর্তী (২), নরেশ চন্দ্র নাথ ও উপেন্দ্র মালাকার। বর্বররা তাদের নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে মরদেহ মনু নদীতে ফেলে দেয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাদের মরদেহের কোনো সন্ধান মেলেনি। পাঁচগাঁও গণহত্যার যারা শিকার তাদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। [জয়নাল আবেদীন শিবু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড