You dont have javascript enabled! Please enable it!

পলাশডাঙ্গা যুদ্ধ (ভাঙ্গুরা, পাবনা)

পলাশডাঙ্গা যুদ্ধ (ভাঙ্গুরা, পাবনা) সংঘটিত হয় ১১ই নভেম্বর। এতে ১৩০ জন পাকসেনা, শতাধিক মিলিশিয়া ও রাজাকার নিহত হয়। পলায়নরত পাকসেনাদের ধরে সাধারণ মানুষ পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের হাতে তুলে দেয়। ক্যাপ্টেন সেলিম মাহমুদসহ ১৪ জন পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করেন।
পাবনা জেলায় পলাশডাঙ্গা নামে কোনো স্থান নেই। তবে নওগাঁ যুদ্ধ-এর পর সিরাজগঞ্জের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও জননেতা আব্দুল লতিফ মির্জা পলাশডাঙ্গা যুবশিবির-কে স্মরণীয় করে রখার জন্য নওগাঁর নাম দেন পলাশডাঙ্গা। ফলে নওগাঁ যুদ্ধ পলাশডাঙ্গা যুদ্ধ নামে অভিহিত হয়। এ- যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের পরিচালক আব্দুল লতিফ মির্জা। তাঁর সঙ্গে সহ-অধিনায়ক ও গ্রুপ কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন খায়রুজ্জামান গেদু মিয়া, ম ম আমজাদ হোসেন, লুৎফর রহমান অরুণ, বিমল দাস, গাজী সোহরাব হোসেন, গাজী আব্দুর রহমান, মো. গোলজার হোসেন, মো. আব্দুস সামাদ, মো. আসাদুজ্জামান ও মো. আব্দুল আজিজ মির্জা।
পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের সঙ্গে পাকসেনাদের একাধিক যুদ্ধ হয়। তবে সবচেয়ে ভয়াভহ যুদ্ধ সংঘটিত হয় তাড়াশ থানার নওগাঁতে। নওগাঁ মূলত তাড়াশ, উল্লাপাড়া ও চাটমোহর থানার সীমান্ত গ্রাম। নওগাঁর সঙ্গে চাটমোহর, উল্লাপাড়া ও তাড়াশ থানা সদরের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল একেবারে অনুন্নত। নওগাঁর অবস্থান চলনবিলে হওয়ায় এর চারদিকের বিস্তীর্ণ এলাকা বছরের অধিকাংশ সময় জলমগ্ন থাকত। ফলে পাকসেনাদের পক্ষে এখানে আসা কঠিন ছিল। কৌশলগত কারণে পলাশডাঙ্গা বাহিনীর সদস্যরা ঘনঘন শেল্টার পরিবর্তন করতেন। এরই ধারাবহিকতায় ১০ই নভেম্বর তাঁরা প্রতাপ বাজার থেকে শেল্টার পরিবর্তন করে নওগাঁ বাজারে আসেন। গোপন সংবাদ পেয়ে পাকসেনারা এখানে আসা পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা করে। পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত পাকবাহিনী তাঁদের নির্মূল করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করে। এ লক্ষ্যে ক্যাপ্টেন সেলিম মাহমুদের নেতৃত্বে তিন কোম্পানি পদাতিক সৈন্য ও মিলিশিয়া বাহিনীসহ তিন শতাধিক রাজাকারআলবদর ১১ই নভেম্বর ভোর রাতে নওগাঁ আসে। তখন রমজান মাস হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা সেহরি খেয়ে বিগ্রামে ছিলেন। পাকসেনারা নওগাঁ বাজারে ঢুকে আলহাজ্ব আব্দুস সাত্তারের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চায়। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান তাঁর জানা ছিল। তিনি অতি দ্রুত পাকবাহিনী আসার খবর লতিফ মির্জার কাছে পৌঁছে দেন। চিরকুটে লেখা ছিল, “লতিফ তোমাদের ওপর হামলা করার জন্য নওগাঁ বাজারে অনেক আর্মি এসছে। তোমরাও তৈরী হও। যে কোন সময় হামলা হতে পারে। এ তথ্য পাওয়ার পর লতিফ মির্জা ও লুৎফর রহমান অরুণ অন্য কমান্ডারদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। পাকিস্তানি হানাদারদের সংখ্যা ছিল তিনশতাধিক। অপরদিকে গেরিলাদের দলে ছিলেন ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১০০ জন ইপিআর ও পদাতিক-বিমান-নৌ বাহিনীর সদস্য এবং পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের ৫ শতাধিক যোদ্ধা। পাকবাহিনীর হাতে ছিল মেশিনগানসহ ভারী অস্ত্র। পক্ষান্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল দুই ইঞ্চি মর্টার, হালকা মেশিনগান, একনলা বন্দুক, হ্যান্ড গ্রেনেড, এসএলআর ও থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল।
১১ই নভেম্বর ভোর ৫টা থেকে একটানা বিকেল ৩টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। আব্দুল লতিফ মির্জার নির্দেশ মোতাবেক মুক্তিযোদ্ধারা ১৫০ জন করে তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে নওগাঁ বাজার থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। দুপক্ষের গুলির শব্দে সমস্ত চলনবিল অঞ্চল প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা ধানক্ষেতের আল, পুকুরের পাড়, গাছের আড়াল এবং নিচু এলাকায় পজিশন নেন। সাধারণ মানুষও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেয়। যুদ্ধের প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। পাকবাহিনীর পাঞ্জাব ও বেলুচ রেজিমেন্ট, মিলিশিয়া বাহিনী এবং স্থানীয় রাজাকাররা তিন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। তাড়াহুড়ো করে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় গেরিলারা তাদের দলনেতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এছাড়া হালকা অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সামনের দিকে এগিয়ে গেলে এলএমজি বাহিনী পেছনে পড়ে যায়। এতে বিশৃঙ্খল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। অপরদিকে পাকসেনারা ভারী মেশিনগান দিয়ে অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে যুদ্ধের কোনো বিকল্প ছিল না। কারণ নওগাঁ বাজার উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক জলদ্বারা বেষ্টিত ছিল। পূর্বদিকের স্থল ভাগের কাঁচা সড়কে পাকসেনারা পজিশন নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। তাই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছু হটার অর্থ ছিল নিশ্চিত মৃত্যু। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করাকে শ্রেয় মনে করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ যুদ্ধের পর বেলা ১২টার পর থেকে পরিস্থিতি বদলে যায়। একের পর এক পাকসেনা নিহত এবং অন্যরা পালাতে শুরু করে। বেলা ২টার দিকে পাকসেনারা তীব্র কাউন্টার আক্রমণে পড়ে। যুবশিবিরের সাহসী যোদ্ধা মনসুর আলী ২৫-৩০ জন গেরিলা নিয়ে পাকবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। কোম্পানি কমান্ডার লুৎফর রহমান অরুণের পরনে ছিল খাকি পোশাক। পাকসেনারা অরুণকে নিজেদের লোক মনে করে জলদি তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে বলে। পাকবাহিনী থেকে তিনি মাত্র ২০-৩০ গজ দূরে ছিলেন। অরুণ সেনাবাহিনীর সদস্য হওয়ায় ভারী অস্ত্র চালাতে পারতেন। তিনি এলএমজি দিয়ে পাকসেনাদের ওপর ব্রাশ ফায়ার করেন। এতে অনেক পাকসেনা মারা যায় এবং যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। প্রচণ্ড গুলিবর্ষণে শত্রুপক্ষের গানার নিহত হওয়ায় তাদের মেশিনগান থেমে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা এবার পূর্ণোদ্যমে শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। ভয়াভয় এ-যুদ্ধে ১৩০ জন পাকসেনা, শতাধিক মিলিশিয়া ও রাজাকার নিহত হয়। পলায়নরত পাকসেনাদের ধরে সাধারণ মানুষ পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের হাতে তুলে দেয়। ক্যাপ্টেন সেলিম মাহমুদসহ ১৪ জন পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। ক্যাপ্টেন সেলিম মাহমুদকে অধিনায়ক লতিফ মির্জার কাছে হাজির করা হয়। তাঁর কাছে পাকবাহিনী সম্পর্কে তথ্য জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু ক্যাপ্টেন সেলিম তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে। পরে ক্যাপ্টেন সেলিমকে হত্যা করা হয়। বাকি পাকসেনারা ব্রহ্মগাছার কাছে নিহত হয়৷ পলাশডাঙ্গা যুদ্ধের ফলে মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ লাভ করেন। ১টি মেশিনগান, ৮টি এলএমজি, ৩২টি চাইনিজ স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ৩০টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, ১টি এইচএসজি, ২টি দুই ইঞ্চি মর্টার, ৮ বস্তা গোলাবারুদ ও ৪টি ওয়ারলেস তাঁদের হস্তগত হয়। এ-যুদ্ধ ও লতিফ মির্জার নেতৃত্বের খরব বিবিসি ও ভয়েজ অব আমেরিকা থেকে প্রচারিত হয়। পলাশডাঙ্গা যুদ্ধের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। [মো. ছাবেদ আলী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!