পশ্চিম রাজারামপুর গণহত্যা (বিরল, দিনাজপুর)
পশ্চিম রাজারামপুর গণহত্যা (বিরল, দিনাজপুর) সংঘটিত হয় ১৯শে মে। দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার এ গণহত্যায় ২৫ জন গ্রামবাসী শহীদ হন।
দিনাজপুর শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পুনর্ভবা নদীর পশ্চিম পাড়ে বিরল উপজেলার অবস্থান। এর উত্তর-পূর্বে কাহারোল ও উত্তরে বোচাগঞ্জ উপজেলা এবং পশ্চিমে ভারত। উপজেলার ফুলবাড়ী হাট থেকে উত্তরে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে তুলাই নদীর তীরে হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিম রাজারামপুর গ্রামটি অবস্থিত। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে এ গ্রামকে যাঁরা নেতৃত্ব দিতেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রূপচাঁদ রায়। তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের ভয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে পালানোর বিরোধী ছিলেন। সবাইকে তিনি বাড়িঘরে থেকে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও বাঁচতে পারেননি।
পাকবাহিনী ১৩ই এপ্রিল সন্ধ্যার দিকে দিনাজপুর শহরের কাছাকাছি পৌঁছলে স্থানীয় জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ- কেউ পুনর্ভবা নদী পার হয়ে বিরলের দিকে এবং কেউ-কেউ সদর থানার কমলপুর ও খানপুর এলাকা হয়ে ভারতীয় সীমান্তের দিকে আশ্রয় নেন। এরপর দিনাজপুর শহর পাকসেনাদের দখলে চলে যায়। রাজারামপুর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে ফুলবাড়ী হাটে পাকসেনাদের ক্যাম্প স্থাপিত হয়। ক্যাম্প স্থাপনের পর থেকে তারা সড়ক ও সেতু পাহারা দেয় এবং এলাকার জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। স্থানীয় রাজাকাররা সংগঠিত হয়ে তাদের সহায়তায় আশপাশের এলাকাগুলোতে হামলা চালাতে শুরু করে। আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য তারা বহু ঘরবাড়িতে আগুন দেয়। ফুলবাড়ী হাটে ক্যাম্প স্থাপনের পর থেকেই রাজারামপুরবাসী আশঙ্কা করছিল যে, তাদের গ্রামে হামলা হতে পারে। এজন্য তারা ঘটনার দু-তিন দিন আগ থেকেই রাত জেগে পাহারা দিচ্ছিল। এমনি অবস্থায় ১৯শে মে ভোররাতে কয়েকজন রাজাকার ও একদল পাকসেনা অতর্কিতে গ্রামটি ঘিরে ফেলে। তারা এ গ্রামের ১৮ জন ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের ৭ জনকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের কেউ আর ফিরে আসেননি। হানাদাররা তাদের হত্যা করে তুলাই নদীতে ভাসিয়ে দেয়। পশ্চিম রাজারামপুর গণহত্যায় শহীদরা হলেন: রূপচাঁদ রায় (পিতা ডুডুয়া মোহন রায়, পশ্চিম রাজারামপুর), মনোমোহন রায় (পিতা ডুডুয়া মোহন রায়, ঐ), চন্দ্রমোহন রায় (পিতা ডুডুয়া মোহন রায়, ঐ), অবিনাশ চন্দ্র রায় (পিতা ডুডুয়া মোহন রায়, ঐ), জগদীশ চন্দ্র রায় (পিতা রূপচাঁদ রায়, ঐ), হেমবাবু রায় (পিতা রূপচাঁদ রায়, ঐ), হরিমোহন রায় (পিতা পালানু বর্মণ, ঐ), যতীন্দ্র চন্দ্র রায় (পিতা হরিমোহন রায়, ঐ), যোগেন্দ্রনাথ রায় (পিতা হরিমোহন রায়,ঐ), সবিন্দ্ৰ নাথ রায় (পিতা সীতারাম রায়, ঐ), খগেন্দ্র নাথ রায় (পিতা নেথুরাম রায়, ঐ), নলিনী কান্ত রায় (পিতা নেথুরাম রায়, ঐ), খগেন্দ্র নাথ রায় (পিতা দিনুরাম রায়, ঐ), মাধব চন্দ্র রায় (পিতা দিনুরাম রায়, ঐ), রশন চন্দ্র রায় (পিতা দয়াল চন্দ্র রায়, ঐ), থেলুরাম রায় (পিতা যাদবচন্দ্র রায়, কেশবপুর), নকলি রাম রায় (পিতা যাদবচন্দ্র রায়, ঐ), কুথারু চন্দ্র রায় (পিতা কাঞ্চিয়ারাম রায়, ঐ), মহিরাম রায় (পিতা শংকরাম রায়, খোদ শিবপুর), রমণী কান্ত রায় (পিতা ফলিয়া রাম রায়, ফতেহাট), মো. আইনউদ্দীন (পিতা হেজ মোহাম্মদ, পশ্চিম রতনৌর), মো. আব্দুল সাত্তার (পিতা নেফাতুল্লা সরকার, নোনাগ্রাম), মো. লুৎফর রহমান (পিতা নিশীর মোহাম্মদ, গগনপুর), সুপচাঁদ রায় (পিতা সুবানু চন্দ্ৰ রায়, আটঘেরা) এবং মো. মুনিরুজ্জামান সরকার (পিতা মো. জমিরউদ্দিন সরকার, বেলবাঁশ, ছাতইল ইউপি)। হত্যাকাণ্ডের ৪-৫ দিন পর রাজাকাররা আবারো পশ্চিম রাজারামপুর গ্রামে হামলা চালায় এবং প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে ঢুকে ধান-চাল, গরু-বাছুর ইত্যাদি লুট করে নিয়ে যায়। তারা অনেক নারীর সম্ভ্রমহানিও করে।
পশ্চিম রাজারামপুর গণহত্যায় শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-এর দিনাজপুর জেলা কমিটি ২০১৩ সালে ফুলবাড়ী হাট উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শহীদদের নামসম্বলিত একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করে। [এম এ কাফি সরকার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড