পয়ারী গণহত্যা (ফুলপুর, ময়মনসিংহ)
পয়ারী গণহত্যা (ফুলপুর, ময়মনসিংহ) সংঘটিত হয় ১৯শে জুলাই, ৩১শে জুলাই ও ১২ই আগস্ট। ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর থানার পয়ারী গ্রামের চৌধুরী বাড়িতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা তিনবার গণহত্যা সংঘটিত করে। এতে অনেক নারী, পুরুষ ও শিশু প্রাণ হারায়। পয়ারীর চৌধুরীদের ভূ-সম্পত্তি দখলের জন্য স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য, রাজাকার ও আলবদররা পাকসেনাদের সহায়তায় গণহত্যা চালায়। গণহত্যায় নিহতদের কয়েকজনকে চৌধুরী বাড়ির পুকুরপাড়ে গণকবর দেয়া হয়।
১৯শে জুলাই বিকেলে ১০-১৫ জনের এক দল পাকিস্তানি সৈন্য পয়ারী চৌধুরী বাড়িতে হানা দেয়। তাদের দেখে বাড়ির কাজের লোক আব্দুল মজিদ দৌড় দিলে পাকসেনারা গুলি করে তাকে হত্যা করে। এদিন তারা চৌধুরী বাড়ি থেকে এডভোকেট যতীন্দ্র চন্দ্র রায় (বওলা, ফুলপুর)-কে আটক করে নিয়ে যায়। যতীন্দ্র এ বাড়ির পারিবারিক আইনজীবী ছিলেন। তিনি চৌধুরী বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁকে পাকিস্তানি সেনারা সরচাপুর গোদারাঘাট ক্যাম্পে নিয়ে হত্যা করে তাঁর লাশ কংস নদীতে ভাসিয়ে দেয়। একই দিন পয়ারী গোকুল চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রিয় সাধন সরকার ও কালিশ চন্দ্র বণিককে আটক করে সরচাপুর গোদারাঘাট পাকক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে পাকিস্তানি সেনারা নির্যাতন শেষে কংস নদীর তীরে তাঁদের গুলি করে হত্যা করে।
৩১শে জুলাই একদল রাজাকার ও বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা পয়ারী চৌধুরী বাড়িতে হানা দেয়। তারা প্রথমে বাড়ি থেকে অজিত কুমার চৌধুরী ওরফে ভানু চৌধুরী ও বাড়ির সকল নারী ও পুরুষকে আটক করে। বাড়ির কাজের লোকদেরও তারা বাদ দেয়নি। আটকের পর তাদের ওপর চরম শারীরিক নির্যাতন চালায়। নির্যাতন শেষে তিনআনী বাড়ির পুকুরপাড়ে নিয়ে অজিত কুমার চৌধুরীকে প্রথমে হত্যা করে। পরে চৌধুরী বাড়ির কাজের লোক অমূল্য চন্দ্র দে, জগদীশ ও হরেন্দ্রকে হত্যা করে। এ হত্যকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয় আলবদর কমান্ডার এ কে এম রফিকুল হুদা ওরফে মনু মিয়া, এ কে এম সামছুল হুদা ওরফে সুরুজ মিয়া, পয়ারী ইউনিয়নের শান্তি কমিটির সভাপতি আমজাত আলী (আমজাত চেয়ারম্যান), বিহারি ইদ মাসুদ, আনোয়ার, নাঈম, আব্দুল জব্বার, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বিএসসি ও আবু সিদ্দিক। এদিন হত্যাকাণ্ডে আরো অংশ নেয় হাজিজুল ইসলাম (হাফিজ চেয়ারম্যান), আবু বক্কর (ইমাদপুর), আবু সিদ্দিক (পূর্ব বাখাই), আবু বক্কর (বাতিকুড়া), আনসার মোতালেব (কাকনী), পুলিশ মোতলেব (আমুয়াকান্দা), বদিউর রহমান বনু (বরইকান্দি), আফরোজ (আমুয়াকান্দা), তৈয়ব আলী (ইমাদপুর), সিদ্দিক (দর্জিপয়ারী), শহরত (দর্জিপয়ারী), মহরত (দর্জিপয়ারী), আব্দুল আজিজ (গোদারিয়া)-সহ রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল।
১২ই আগস্ট পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের একটি বিশাল দল পয়ারী চৌধুরী বাড়িতে আবারো হামলা করে। এদিন তারা ১৩ জন শিশু-নারী-পুরুষকে আটক করে। তাদের মধ্যে ৫ জন শিশু ও মহিলা এবং ৮ জন পুরুষ ছিলেন। শিশু ও নারীদের আটআনী বাড়িতে জড়ো করে তাদের ওপর নির্যাতন চালায়। নির্যাতন শেষে গুলি করে নিশা রানী চৌধুরী, মালতী প্রভা চৌধুরী, গৌরী রানী রায়, চতুর্থী ও বিশুকে হত্যা করে। বাড়ি থেকে পুরুষদের আটক করে সরচাপুর গোদারাঘাট পাকক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নির্যাতন শেষে তাদের কংস নদীর পাড়ে গুলি করে হত্যা করে। এখানে নিহতরা হলেন- হীরেন্দ্র কুমার চৌধুরী, ডা. জীতেন্দ্র চন্দ্র চৌধুরী ওরফে লঘু চৌধুরী, শান্তিপদ রায়, অবনী ভট্টাচার্য (পোস্ট মাস্টার), উপন্দ্রে চন্দ্র দে (ডাকপিয়ন), নরেশ (কাজের লোক), হরেন্দ্র ও রাম চরণ দে। এদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন হীরেন্দ্র কুমার চোধুরীর স্ত্রী সুভাষিণী রানী চোধুরী। তিনি পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় ভারতের শরণার্থী শিবির-এ আশ্রয় নেন। এ গণহত্যায় নিহত ৫ জন শিশু, মহিলা ও ১ জন পুরুষকে চৌধুরী বাড়ির পূর্ব পাশের পুকুরপাড়ে ২টি গণকবরে সমাহিত করা হয়। গণকবরগুলো সংরক্ষিত হয়নি। [আলী আহাম্মদ খান আইয়োব]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড