মুক্তিযুদ্ধে পরশুরাম উপজেলা (ফেনী)
পরশুরাম উপজেলা (ফেনী) স্থানীয় প্রভাবশালী জমিদার পরশুরাম মজুমদারের নামানুসারে এ জনপদের নাম হয় পরশুরাম। ১৮৭৯ সালের ৭ই মে পরশুরাম থানা সৃষ্টি হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বৃহত্তর নোয়াখালী জেলায় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সবকটি আসনে আওয়ামী লীগ- প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে সারাদেশে আওয়ামী লীগের বিশাল জয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। পাকিস্তানের। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু ১লা মার্চ আকস্মিকভাবে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এ সংবাদ শোনার পরপরই সমগ্র বাংলাদেশের ন্যায় পরশুরাম উপজেলার স্বাধীনতাকামী মানুষও প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং পরশুরাম বাজারের প্রধান-প্রধান সড়কে মিছিল সহকারে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। বিক্ষুব্ধ জনতার মিছিলে চতুর্দিক প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা এই জনপদ। ২রা মার্চ ঢাকা শহরে পূর্ণ দিবস সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। একই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলার ছাত্র-জমায়েতে উত্তোলিত হয় বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত জাতীয় পতাকা। এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সর্বাত্মক প্রস্তুতি গহণের জন্য গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এ পরিষদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পরশুরামেও দেলোয়ার হোসেন দুলাল, মমতাজ উদ্দিন প্রমুখের নেতৃত্বে গঠিত হয় পরশুরাম ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।
৩রা মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সমগ্র দেশের ন্যায় পরশুরামেও সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এদিন থেকে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ইতোমধ্যে অত্র অঞ্চলের আওয়ামী লীগ নেতা খাজা আহমেদ এমএনএ, এ বি এম আলী অপি ও অন্যরা ঢাকা থেকে ফেনীতে ফিরে আসেন। জেলা হেডকোয়ার্টার্স মাইজদীতে আবদুল মালেক উকিল এমএনএ-র নেতৃত্বে গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। ঢাকার কেন্দ্রীয় নির্দেশনা এবং জেলা সদরের সংগ্রাম পরিষদের পরামর্শ মোতাবেক ফেনী মহকুমা ও পরশুরাম থানায় স্বাধীনতার পক্ষের সকল কর্মসূচি যথাযথভাবে পালিত হতে থাকে। তখন জনতার মিছিলের স্লোগান ছিল ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘জয় বাংলা’, ‘আপোষ না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘আমার দেশ তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’।
এদিকে কেন্দ্র থেকে খবর আসে যে, ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান)এ বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন এবং আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। সমগ্র দেশের মতো পরশুরামবাসীও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনা ও তা থেকে নির্দেশনা পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। এদিন বিকেল ২টা থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য জনতা অপেক্ষা করছিল। কিন্তু রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারিত হয়নি। এতে মুক্তিকামী জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে কর্মরত বাঙালি কর্মচারীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পরদিন ৮ই মার্চ সকাল ৯টায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারিত হয়। ঐ ভাষণ ছিল মুক্তিপাগল বাঙালির নিকট স্বাধীনতার বার্তা ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা।
১৬ই মার্চ থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উদ্যোগে শুরু হয় বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনার নামে প্রহসন। একদিকে চলছে প্রহসনের আলোচনা, অপরদিকে চলছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সামরিক আক্রমণের গোপন প্রস্তুতি। প্রতিদিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আকাশ ও নৌ পথে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সৈন্য, অস্ত্র ও গোলাবারুদ এনে জড়ো করা হচ্ছিল।
২৩শে মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। এদিন সমগ্র বাংলাদেশের মতো পরশুরামেও বাড়িঘর, যানবাহন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়। ২রা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত পরশুরাম থানায় কেন্দ্রীয় কর্মসূচির নির্দেশনা অনুযায়ী সকল কর্মসূচি পালিত হতে থাকে। সে-সময় অত্র থানার আমিনুল করিম, খোকা মিয়া ও এ এফ কে সাফাদার এমপিএ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ সামরিক বাহিনীর ছুটিতে আসা ও অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সৈনিক, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা পরশুরাম হাইস্কুল মাঠ, সুবার বাজার, গুথমা, শালধর, বিলোনিয়া ও কালিকাপুরে যুদ্ধের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ছুটিতে আসা পঞ্চম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক মিজানুর রহমান, সুবেদার ইমাম হোসেন, আবদুর রহিম, মাহমুদ অফিন্দি, কমান্ডার মোহাম্মদ ইসহাক (নৌবাহিনী), নুরুল ইসলাম (আনসার), সুবেদার মেজর আবদুল হালিম মাহমুদ প্রমুখ প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
২৫শে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স পিলখানা (জিগাতলা) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হিংস্র বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ হামলার কথা বঙ্গবন্ধু আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি পাকসেনাদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সেই বার্তা ইপিআর ওয়ারলেসের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশে প্রেরণ করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল করিম গ্রহণ করেন। তিনি ২৬শে মার্চ সকালে নোয়াখালী সার্কিট হাউসে এক সভা ডেকে নোয়াখালীর সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি আবদুল মালেক উকিল এমএনএ-সহ উপস্থিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকদের বার্তাটি সম্পর্কে অবহিত করেন। পরবর্তীতে সেই ঘোষণা বার্তা ফেনী মহকুমাসহ সকল থানায় জানিয়ে দেয়া হয়।
২৬শে মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলেও পরশুরামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রবেশ করে এপ্রিল মাসের ২৩ তারিখ। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য ফেনী ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জাহাজে আসা অস্ত্রশস্ত্র ও গোলা-বারুদ পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়ার জন্য সড়ক ও রেল পথে ফেনীকে ব্যবহার করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ছিল না। এদিকে ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিকে আরো বেগবান করে তোলে। এলাকার ছাত্র-যুবকরা যুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য দলে- দলে ভারতে যেতে থাকে।
থানার বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও ঈদগাহ মাঠে চলে ডামি বন্ধুক ও লাঠি দিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ। থানা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি ওয়াহিদুর রহমান সাংগঠনিক কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। লে. কর্নেল জাফর ইমাম, বীর বিক্রম- (পিতা এডভোকেট শেখ ওয়াহিদ উল্লাহ, নোয়াপুর, পরশুরাম) ছিলেন বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা ও কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকা নিয়ে গঠিত রাজনগর সাবসেক্টরের কমান্ডার এবং ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক। তিনি ২৬শে মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে তিনি ঢাকা থেকে কুমিল্লার কসবা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। সেখানে গিয়ে তিনি মেলাঘরে ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশারফের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেদিন সেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী-ও উপস্থিত ছিলেন।
মেলাঘর থেকে লে. কর্নেল জাফর ইমামকে পাঠানো হয় পরশুরামের বিলোনিয়া সেক্টরে। তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন আকবর ও ক্যাপ্টেন আমিনুল হক। বিলোনিয়ায় এসে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ও বিলোনিয়া সেক্টরের বিএসএফ কমান্ডারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং এ অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত হন। তিনি যেহেতু আগে থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পদাতিক বাহিনীর একজন দক্ষ অফিসার ছিলেন, সেহেতু এ সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনায় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথভাবে সংগঠিত করতে সক্ষম হন। স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি ছাত্র, শ্রমিক, প্রাক্তন ইপিআর, বাঙালি সৈনিক, পুলিশ, আনসার যাঁরা ইতোমধ্যে ভারত থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয়ে এসেছেন, তাঁদের নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তিনি ভারত সীমান্তের রাজনগর ও বড় কাছারীতে ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করেন এবং এখান থেকে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা অভিযান শুরু করেন। ফেনীর দিকে মুখ করে তিনি ডিফেন্স তৈরি করেন। এখান থেকে তাঁরা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট অস্ত্রশস্ত্র ও গোলা- বারুদ সরবরাহ করতেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে মো. আব্দুল রশীদ এমএনএ, শহীদ উদ্দিন ইসকান্দার এমপিএ, এ এফ কে সফদার এমপিএ, নুরুল হক, অধ্যাপক মো. হানিফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, তালেব আলী, ছাত্রনেতা মাহমুদুর রহমান বেলায়েত প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা এ অঞ্চল সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। বিশেষ করে পরশুরামের বিলোনিয়ায় বারবার পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে তাঁদের যুদ্ধ করতে হয়। বিভিন্ন সময়ে তাঁদের পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান হামলা মোকাবেলা করতে হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ফেনীর পরশুরাম ও বিলোনিয়া ছিল সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। বিলোনিয়া যুদ্ধের রণকৌশল বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিসহ বিশ্বের বহু দেশের সামরিক কলেজে পড়ানো হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালে পরশুরাম থানা ছিল ২নং সেক্টরের অধীন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন খালেদ মোশাররফ (এপ্রিল-অক্টোবর) এবং মেজর এ টি এম হায়দর (অক্টোবর-ডিসেম্বর)। সাব- সেক্টর (রাজনগর) কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল জাফর ইমাম, বীর বিক্রম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন শহীদুল ইসলাম, বীর প্রতীক- ও লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামান, বীর বিক্রম। মহকুমা জোন ডি-এর মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) অধিনায়ক ছিলেন জয়নাল আবেদীন ভিপি ওরফে ভিপি জয়নাল এবং পরশুরাম থানা কমান্ডার ছিলেন জয়নাল আবেদীন ও ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন দেলোয়ার হোসেন দুলাল।
৪ঠা এপ্রিল বাঙালি সৈনিক, ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও ছাত্র-জনতা সম্মিলিতভাবে বিলোনিয়া চেক পোস্টের পশ্চিমে পাকিস্তানি ইপিআর ঘাঁটিতে আক্রমণ করে ঘাঁটিটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। এতে ২ জন বাঙালি ইপিআর শহীদ হন। তাঁরা হলেন- মো. রৌশন ও আজিজুল হক। তাঁদের পরশুরাম মাদ্রাসা সংলগ্ন স্থানে দাফন করা হয়।
২৩শে এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নোয়াখালী জেলার ফেনী মহকুমায় প্রবেশ করে এবং সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীতে তারা পরশুরামের সালদা বাজার ও পরশুরাম মাদ্রাসায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
উপজেলায় পাকবাহিনীর সহযোগী ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কনভেশন মুসলিম লীগের সভাপতি শামছুদ্দিন আহম্মেদ, সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহমদ, কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি নুর আহম্মদ চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক গোলাম মহিউদ্দিন খোন্দকার, জামায়াতে ইসলামী-র মকবুল আহমেদ, নেজামে ইসলামী-র মাওলানা ইব্রাহীম প্রমুখ। এদের সহায়তায় – রাজাকার <আলবদর ও আলশামস বাহিনী এবং শান্তি কমিটি গঠিত হয়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার আলবদর ও আলশামস বাহিনী ১৩ই জুলাই পাকিস্তানি মেজর ইফতেখারের নেতৃেত্ব ও স্থানীয় শান্তি কমিটির সহযোগিতায় উত্তর গুথমা চৌধুরী বাড়ির বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজবাহ উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী মিহির-এর পিতা আমিনুল ইসলাম চৌধুরী ও তাদের বর্গাচাষী শঙ্কুর মিয়াসহ কয়েকজনকে ধরে এনে পরশুরাম হাইস্কুলের বন্দিশিবিরে আটকে রেখে নির্মমভাবে হত্যা করে। একইভাবে ১২ই আগস্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর মীর হোসেন, এসপি শফিকুল হোসেন চৌধুরীর ভাই রফিকুল হোসেন চৌধুরী ও সিরাজুল হোসেন চৌধুরীসহ আরো কয়েকজনকে এবং শলিয়া গ্রামের অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজন দিনমজুরকে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ড
পরশুরাম হাইস্কুল গণহত্যা নামে পরিচিত। ১২ই আগস্ট পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা সম্মিলিতভাবে পরশুরাম থানা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আমিনুল করিম মজুমদার খোকা মিয়ার শলিয়াস্থ বাড়ি এবং কোলাপাড়া গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আনোয়ারুল হকের বাড়িতে আগুন দেয়।
পরশুরাম হাইস্কুল হানাদারদের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহৃত হতো। উপজেলায় একটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেটি হলো- পরশুরাম মালিপাথর গণকবর। পরশুরাম উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা বিলোনিয়া। এখানে একাধিকবার যুদ্ধ হয়েছে। বিলোনিয়া যুদ্ধ- এতই গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত ছিল যে, ১৯৭৩ সনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২১ জন ব্রিগেডিয়ার ও জেনারেল পদমর্যাদার সামরিক অফিসার এবং পরিদর্শক দল বিলোনিয়া পরিদর্শনে আসেন। তাঁরা এই যুদ্ধের নায়ক সাব-সেক্টর কমান্ডার জাফর ইমাম, বীর বিক্রম, মোখলেস, ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদ, ক্যাপ্টেন মো. মাহফুজ মিজান ও সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট দিদারের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনার কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করেন। ৮ই নভেম্বর পরশুরাম উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলা খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- সুবেদার ফয়েজ আহমেদ, বীর উত্তম- (পিতা জবেদ আলী, পশ্চিম অলকা), রমজান আলী, বীর বিক্রম- (পিতা লাল মিয়া, মির্জানগর), নায়েক সুবেদার আব্দুর রউফ মজুমদার, বীর প্রতীক, বীর প্রতীক- (পিতা আনু মিয়া মজুমদার, জঙ্গলঘোনা) এবং নায়েক সিকান্দার আহমেদ, বীর প্রতীক, বীর প্রতীক- (পিতা আলী আহম্মদ, পূর্ব অলকা)।
এ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যাঁদের নাম- পরিচয় পাওয়া গেছে, তাঁরা হলেন- ফয়েজ আহমেদ, বীর উত্তম (১৩ই ডিসেম্বর সিলেট শহরের উপকণ্ঠে এম সি কলেজ সংলগ্ন পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষা ঘাঁটি আক্রমণে শহীদ), রমজান আলী, বীর বিক্রম (২রা নভেম্বর অপারেশনে যাওয়ার পথে পাকিস্তানি বাহিনীর এম্বুশে পড়ে শহীদ), নায়েক সিকান্দার আহমেদ, বীর প্রতীক (২২-২৩শে নভেম্বর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বান্দুয়া-পাঠাননগর যুদ্ধে শহীদ), ফজল হক (পিতা আলী আহম্মদ, আলকা), মুসলিম মিয়া (পিতা হামিদ উল্ল্যাহ, চিথলিয়া), জানু মিয়া (পিতা মোবারক আলী, খালিপাথর), আবদুল সাত্তার (পিতা হাজী আশ্রাফ আলী, মালিপাথর), কালা মিয়া (পিতা মকবুল আলী, মালিপাথর), রুস্তম আলী (পিতা ফয়জুর রহমান, পূর্ব বসিকপুর), আইয়ুব আলী (পিতা এয়ার আহম্মদ, দক্ষিণ আনন্দপুর), মোশারফ হোসেন (পিতা সুজত আলী, ধনিয়া), নুর আহম্মদ মজুমদার (পিতা নুরুল হক মজুমদার, ধুবাচল), ক্যাপ্টেন সামছুল হক (মির্জানগর), মোয়াজ্জম হোসেন (পরশুরাম ইউনিয়ন), গোলাম মোস্তফা (ঐ), আজিজুল হক (ঐ, ইপিআর), মো. রৌশন (ঐ, ইপিআর) এবং নুর আহম্মদ হাফেজ (পিতা কালা মিয়া, মনিপুর)। উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে রয়েছে রৌশন আলী, মোয়াজ্জম হোসেন প্রমুখ ৫ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর ও স্মৃতিস্তম্ভ (পরশুরাম থানা কমান্ড এটি নির্মাণ করে), মালিপাথরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সেকান্দর আলী, বীর প্রতীকের সমাধি এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি। [মো. ফখরুল ইসলাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড