You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটিশ নাগরিক পল কনেট

পল কনেট (জন্ম ১৯৪০) ব্রিটিশ নাগরিক, ৭১-এ তরুণ শিক্ষক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্রিটিশ নাগরিকদের মধ্যে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী, Action Bangladesh-এর প্রধান প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ Friends of Liberation War সন্মাননায় ভূষিত। তিনি ১৯৪০ সালের ২০শে অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬২ সালে ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। পরবর্তীতে তিনি ডার্থমাউথ কলেজ থেকে রসায়নে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন (১৯৮৩)। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক ও ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ। তিনি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতা করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল ৩০। তখন তিনি পেশায় স্কুল শিক্ষক। তিনি ছিলেন সংবেদনশীল মনের অধিকারী একজন মানবতাবাদী তরুণ। তিনি মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভক্ত ছিলেন। তরুণ বয়সে তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন। নাইজেরিয়ার বায়াফ্রা সংকট (১৯৬৭-১৯৭০)-এর পর সেখানে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তিনি বিপন্ন মানুষের জন্য ত্রাণ তৎপরতায় নিজেকে যুক্ত করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্বিচার গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন, ১ কোটি বাঙালির শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ শরণার্থী শিবির-এ মহামারী আকারে কলেরার প্রাদুভাব ও অন্যান্য কারণে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু, পাকিস্তানি হানাদার কবলিত বাংলাদেশের মানুষের জীবনে চরম ভয়, ভীতি ও বিপর্যস্ত অবস্থা ইত্যাদি পল কনেটকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। তিনি নিজেকে নিষ্ক্রিয় রাখতে পারলেন না। তাঁর কাছে বাংলাদেশের সংগ্রাম ছিল ন্যায়, মানবিক আদর্শ ও গণতন্ত্রের পক্ষে। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ছিলেন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত মেজরিটি পার্টির নেতা।
পল কনেট বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালনে বেশ কিছু ইংরেজ সহকর্মীসহ এগিয়ে আসেন। ২০শে এপ্রিল Peace News, Peace Pledge Union, The Young Liberals ইত্যাদিসহ সমমনা মোট ৭টি সংগঠনের সমন্বয়ে Action Bangladesh নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতারা ছিলেন তাঁর স্ত্রী এলেন কনেট- (২৮), লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের স্নাতকোত্তর <মেরিয়েটা প্রকোপ, পিস নিউজের সম্পাদক রোজার মুডি প্রমুখ। তাঁরা অপারেশন ওমেগা- নামে আরো একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল ভারতে বাঙালি শরণার্থী ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিপন্ন মানুষের মধ্যে ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনা করা। উভয় সংগঠনে প্রায় ২৫০ জন নিয়মিত কর্মী ছিলেন। মেরিয়েটা প্রকোপ সংগঠনের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর লন্ডনের ক্যামডেন টাউনের ৩৪ স্ট্র্যাটফোর্ডের বাড়িটি ছিল এর অফিস। ব্রিটিশ লেবার পার্টির এমপি ব্রুস ডগলাস-ম্যান, পিটার শোর, মাইকেল বার্নস, টনি বেন, রবার্ট সিলকিন, স্যার ক্রিস্টোফার মে হিউ প্রমুখের সার্বিক পরামর্শক্রমে তাঁরা তাদের তৎপরতা চালিয়ে যান। এছাড়া অক্সফাম, ওয়ার অন ওয়ান্ট, সেভ দ্য চিলড্রেন ফান্ড, ক্রিস্টিয়ান এইড ইত্যাদি ব্রিটিশ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে তাঁরা ঘনিষ্ঠ হয়ে কাজ করেন। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, শরণার্থীদের জন্য মানবিক সাহায্য, পূর্ব বাংলা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রত্যাহার ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি। এ লক্ষ্যে প্রবাসী বাঙালি ছাড়াও ব্রিটিশ নাগরিকদের মধ্যে গণসচেতনতা বৃদ্ধির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেন। তাঁদের কর্মতৎপরতার মধ্যে ছিল প্রচারপত্র প্রকাশ ও বিতরণ, দৈনিক পত্রিকায় এডভারটাইজমেন্ট, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ ও বাংলাদেশ প্রশ্নে তাঁদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিকট পত্ৰ যোগাযোগ, পাকিস্তান ও সেদেশের সমর্থনকারী রাষ্ট্রের দূতাবাসের সম্মুখে অবস্থান কর্মসূচি, সভা-সমাবেশ ও র্যালির আয়োজন, বাঙালি শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ সামগ্রী প্রেরণ ইত্যাদি। পল কনেটের উদ্যোগে ১৩ই মে ও ৩০শে জুন দ্য টাইম্স পত্রিকায় দুটি এবং ১১ই জুন ও ৩০শে জুলাই দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় দুটি মোট ৪টি বড় আকারের বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। দ্য টাইম্স পত্রিকার প্রথম বিজ্ঞাপনে যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ১২ জন পার্লামেন্ট সদস্যসহ ২০৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম প্রকাশ করা হয়। ৩০শে জুনের বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা বন্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পদক্ষেপ আহ্বান ও স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের পক্ষে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উত্থাপিত দুই শতাধিক সদস্যের স্বাক্ষর স্থান পায়। অপরদিকে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার ১১ই জুনের বিজ্ঞাপনে ‘পাকিস্তানের সমস্যা অভ্যন্তরীণ’ সামরিক কর্তৃপক্ষের এ দাবি চ্যালেঞ্জ করে বলা হয় “Pakistan: This৷s The Moment To Show That Man৷s More Than ‘An Internal Problem’।” ৩০শে জুলাইয়ের বিজ্ঞাপনে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি গণহত্যার প্রতিবাদ ও স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আহ্বানে ১লা আগস্ট ট্রাফালগার স্কোয়ারে অনুষ্ঠেয় সমাবেশে সর্বস্তরের মানুষকে যোগদানের আহ্বান জানানো হয়।
এপ্রিল মাসে প্যারিসে পাকিস্তান এইড কনসোর্টিয়ামের সভা চলাকালে পল কনেট পাকিস্তানের একটি পতাকা হাতে নিয়ে পাকিস্তান হাইকমিশনের একেবারে কাছে গিয়ে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদ করেন এবং ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণ করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের পতাকা হাতে মেরিয়েটা প্রকোপ। এরপর ১লা আগস্ট পল কনেটের উদ্যোগে ও একশন বাংলাদেশ-এর ব্যানারে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণকালের বৃহৎ জনসমাবেশ। তাতে সমগ্র ব্রিটেন থেকে বাঙালিরা ছাড়াও প্রচুর সংখ্যক ইংরেজ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে কমপক্ষে ২০ হাজার লোকের সমাগম ঘটে। পল কনেট, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, লুলু বিলকিস বানু, শন ম্যাকব্রাইড-, লর্ড ব্রুকওয়ে, পিটার শোর, রেজ প্রেন্টিস, ব্রুস ডগলাস-ম্যান, জন স্টোনহাউজ, লর্ড গিফোর্ড প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। পাকিস্তানে বন্দি অবস্থায় সামরিক আদালতে বিচারাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আইনি সহায়তা দানে শন ম্যাকব্রাইডকে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের অনুমতি না দেয়ায় সভায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার তীব্র নিন্দা করা হয়। সভায় পল কনেট তাঁর বক্তব্যে বলেন (বঙ্গানুবাদ), ‘বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের পাশে রয়েছেন বিশ্বের সকল দেশের, সকল ধর্মের, সকল বর্ণের মুক্তিকামী মানুষ। এই যুদ্ধ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির নয়, এই যুদ্ধ স্বাধীনতা হরণকারীদের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষের। আপনাদের এই আদর্শের সংগ্রামের সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ একাত্মতা ঘোষণা করছি।’
পল কনেটের উদ্যোগে কলকাতায় বাঙালি শরণার্থী ও বাংলাদেশে অবরুদ্ধ মানুষের সাহায্যার্থে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে অপারেশন ওমেগা নামে বিভিন্ন সময় একাধিক টিম প্রেরণ করা হয়। পল কনেট নিজেও অনুরূপ একটি টিম নিয়ে ২দিন পায়ে হেঁটে ও ২দিন নৌকায় চড়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। অন্যান্য টিমকে হয় পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশে বাধা দিয়ে ফিরিয়ে দেয়, নয়তো তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনে। পাকিস্তানি বাহিনীর এরূপ আচারণ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায় এবং জনমত তাদের বিপক্ষে যায়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু পল কনেটকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ২০১৩ সালের ১লা অক্টোবর Friends of Liberation War সন্মাননায় ভূষিত করা হয়। পল কনেটের বর্তমান বয়স ৭৮ বছর। স্ত্রীসহ তিনি বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। পল কনেট ও এলেন কনেট দম্পতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি খুবই অনুরক্ত। মুক্তিযুদ্ধের পরে ১৯৭২ সালে তাঁদের একটি পুত্র সন্তান জন্ম নিলে তার নাম রাখা হয় পিটার উইলিয়াম মুজিব কনেট। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, ঢাকা, ইউপিএল ১৯৯০; আবদুল মতিন, স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালী, লন্ডন, র্যাডিকেল এশিয়া পাবলিকেশন্স ১৯৮৯; শেখ আবদুল মান্নান, মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের বাঙালীর অবদান, ঢাকা, জ্যোৎস্না পাবলিশার্স, ১৯৯৮; Harun-or-Rashid, “British perspectives, pressures and publicity regarding Bangladesh, 1971″, Contemporary South Asia 1995, Oxford, 4(2), 139-149; The Guardian (London), 8 October 1971;৷bid., 8 December 1971. https://en.wikipedia.org/ wiki/Paul_connet; www.londoni.co/index.php/23-history-of- bangladesh / 1971; Dhaka Tribune, 27 February 2019; www.bangla.bdnews24.com, 27 February 2019; দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৭শে ফেব্রুয়ারি ২০১৯।

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!