You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে পলাশ উপজেলা (নরসিংদী) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে পলাশ উপজেলা (নরসিংদী)

পলাশ উপজেলা (নরসিংদী) স্বাধীনতার পূর্বে পলাশ ছিল নরসিংদী মহকুমার (বর্তমানে জেলা) একটি ইউনিয়ন। স্বাধীনতার পরে ১৯৮৩ সালে বর্তমান গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার চারটি ইউনিয়ন ঘোড়াশাল পৌরসভা, চরসিন্দুর, গজারিয়া ও জিনারদী এবং নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়ন নিয়ে পলাশ থানা গঠিত হয়।
৬৯-এর গণআন্দোলন, ৭০-এর জাতীয় নির্বাচন এবং তৎপরবর্তী অসহযোগ আন্দোলন-এ পলাশ উপজেলার জনগণের ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- জাতির উদ্দেশে স্বাধীনতার দিকনির্দেশনামূলক যে ভাষণ দেন, তাতে সারা দেশের মতো পলাশ উপজেলার সর্বস্তরের মানুষও মুক্তির চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়। স্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাদের সংগঠিত করেন। এভাবেই তারা আসন্ন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মানসিকভাবে তৈরি হয়।
স্থানীয় ছাত্র-যুবকরা জিনারদী ইউনিয়ন পরিষদ প্রাঙ্গণ, চরনগরদী বাজার খেলার মাঠ, ঘোড়াশালের পুবালী ও বাংলা জুট মিলস মাঠ, নরসিংদীর ভেলানগর, পাঁচদোনার নেহাব ও চরসিন্দুর কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রক্ষিণ গ্রহণ করে। অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য ও আনসার সদস্যরা এসব স্থানে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ভেলানগর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন নরসিংদী কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন আবদুর রউফ। নেহাব কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য সিরাজ উদ্দীন আহমেদ (নেভাল সিরাজ)। জিনারদী ও চরনগরদী কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য মুসলেহ উদ্দিন মৃধা। চরসিন্দুর কলেজ মাঠ কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন নাজমুল আহসান, রুহুল আমিন, মফিজ উদ্দিন ভূঁইয়া, নূর ইসলাম মাস্টার প্রমুখ। এছাড়া আরো যাঁরা প্রশিক্ষণ কাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, তাঁরা হলেন- জিনারদীর আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক, শামছুল ইসলাম ভূঁইয়া, কাজী সালেহ উদ্দিন (রতন মিয়া), আবদুল হাই খান, আবদুস ছালাম, ন্যাপ- নেতা আবু সিদ্দিক পাঠান, জামাল উদ্দিন মৃধা, যোগেশ চন্দ্র চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, ছাত্রলীগ নেতা মো. মোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া, আবদুল কাদির মিয়া, আবদুল মান্নান, আবদুস ছাত্তার মিয়া, ছাত্র ইউনিয়ন- নেতা কার্তিক কুমার চ্যাটার্জী, মো. এনামূল হক ভূঁইয়া, যুথিকা চ্যাটার্জী, আবদুল মান্নান বিএসসি প্রমুখ।
প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন পরামর্শ ও আর্থিক সহযোগিতা দান করেন ময়েজউদ্দিন আহমেদ এমপিএ (কালিগঞ্জ থানা), আহমেদুল কবির এমপিএ (ন্যাপ নেতা এবং দৈনিক সংবাদ পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক), বিজয় ভূষণ চ্যাটার্জী এমএনএ (ন্যাপ নেতা) এবং আবদুর রহমান (শ্রমিকনেতা)।
পাকবাহিনী ৪ঠা ও ৫ই এপ্রিল নরসিংদী বাজার ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিমান থেকে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে। এতে বাজার ও গ্রামগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হয়। এলাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো তছনছ হয়ে যাওয়ায় প্রশিক্ষণার্থী ও নেতৃবৃন্দের অনেকে ভারতে চলে যান। ভেলানগর কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা ক্যাপ্টেন আব্দুর রউফ ও হাবিবুল্লাহ বাহারের নেতৃত্বে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের একটি বিশাল বাহিনী ভারতের আসাম রাজ্যের তেজপুর প্রশিক্ষণকেন্দ্রে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেয় এবং অস্ত্রসহ দেশে ফিরে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁরা সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন— ময়েজউদ্দিন আহমেদ (বড়হরা, কালিগঞ্জ), আহমেদুল কবির (মিয়াপাড়া), হাবিবুল্লাহ বাহার (ভেলানগর), আবদুর রহমান (নোয়াখালী, ঘোড়াশালের শ্রমিকনেতা), বিজয় ভূষণ চ্যাটার্জী (গয়েশপুর), এমদাদ আলী মোল্লা (পারুলিয়া), আবদুল হাই খান (চরনগরদী), কাজী সালেহ উদ্দিন খান (রতন মিয়া) (চরনগরদী), আবদুস সালাম মিয়া (পারুলিয়া), আবদুল আউয়াল ভূঁইয়া (গজারিয়া), হারিছুল হক চৌধুরী (নোয়াকান্দা), সিরাজ মাস্টার (নোয়াকান্দা), হাবিবুর রহমান (গজারিয়া), নাজমুল আহসান (বালিয়া), রুহুল আমিন (চরসিন্দুর), নুরুল ইসলাম মাস্টার (চলনা) প্রমুখ।
২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট-এর পর ঢাকার পিলখানা থেকে কয়েকজন ইপিআর সদস্য পলাশে পালিয়ে আসেন। ৪ঠা ও ৫ই এপ্রিল তাঁরা স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে নিয়ে পাঁচদোনা ও ছনপাড়ায় পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করেন।পাকবাহিনী ৯ই ও ১০ই এপ্রিল দ্বিতীয়বার নরসিংদী বাজার ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিমান থেকে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে। তারা পাঁচদোনায় ব্যাপক প্রতিরোধযুদ্ধের সম্মুখীন হয়। এক পর্যায়ে প্রতিরোধযোদ্ধারা স্থান ত্যাগ করলে ১০ই এপ্রিল রাতে পাকহানাদার বাহিনী নরসিংদীতে প্রবেশ করে এবং দখল করে নেয়। একই সময় তারা পলাশ উপজেলায় প্রবেশ করে জিনারদী রেল স্টেশন ও জিনারদীর পূর্বপাশে রেল ব্রিজের নিচে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরে ঘোড়াশাল বাংলা জুট মিলস, ঘোড়াশাল রেল স্টেশন ও পলাশ সার কারখানায়ও ক্যাম্প করে।
পলাশে স্বাধীনতাবিরোধী শীর্ষস্থানীয়দের মধ্যে সৈয়দ শামছুর রহমান (শাজাহান মিয়া) (চরনগরদী; মুসলিম লীগ নেতা ও জিনারদী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান), মাহবুবুর রহমান খান (এম আর খান) চরনগরদী; শ্রমিকনেতা), শামসুল হক ওরফে ফজলু মিয়া (গয়েশপুর; মুসলিম লীগ নেতা ও জিনারদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান), সামসুদ্দিন ওরফে সামা মেম্বার (মুসলিম লীগ নেতা ও ঘোড়াশাল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য), হেলাল উদ্দিন মাওলানা (আটিয়া; ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ঘোড়াশাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান)-এর নাম উল্লেখযোগ্য। সৈয়দ শামছুর রহমানের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। রাজাকারদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিল শামসুল হক (ফজলু মিয়া), সাহাজ উদ্দিন মেম্বার, সামসুদ্দিন ওরফে সামা মেম্বার, হেলাল উদ্দিন মাওলানা প্রমুখ।
সৈয়দ শামছুর রহমানের নেতৃত্বে পাকবাহিনী পলাশে হত্যা, গণহত্যা, নারীনির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। তারা জিনারদী ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়, গয়েশপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে গণহত্যা চালায় এবং বিভিন্ন গ্রামে, বিশেষ করে, জিনারদী ও ঘোড়াশালে অনেক নারীকে নির্যাতন করে। পলাশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় জিনারদী ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত বরাব অঞ্চল, পারুলিয়া গ্রাম, জিনারদী গ্রাম ও জিনারদী বাজার।
জিনারদী ইউনিয়নের জিনারদী রেলস্টেশন ক্যাম্প ও ঘোড়াশাল রেলস্টেশন ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র। সৈয়দ শামছুর রহমান, শামসুল হক (ফজলু মিয়া), এম আর খান প্রমুখের নেতৃত্বে বিভিন্ন গ্রামের নিরীহ লোকদের ধরে এনে এখানে নির্যাতন করা হতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় জিনারদী ইউনিয়নের গয়েশপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বহু লোককে হত্যা করে কবর দেয়া হয়। সে কারণে এটি গয়েশপুর উচ্চ বিদ্যালয় বধ্যভূমি ও গণকবর নামে পরিচিত।
পলাশ উপজেলায় নেভাল সিরাজের নেতৃত্বে একটি স্থানীয় বাহিনী গড়ে ওঠে, যা নেভাল সিরাজ বাহিনী নামে পরিচিত। এছাড়া হাবিবুল্লাহ বাহারের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ এখানকার মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ছিল।
পলাশ উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি যুদ্ধের ঘটনা ঘটে। একদিন পাকসেনারা চরনগরদী বাজারের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন ধানক্ষেতে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে তাদের আক্রমণ করে। এ-যুদ্ধে ময়মনসিংহের মনির হোসেন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁকে চরনগরদী বাজারের পাশে সমাহিত করা হয়। ১২ই ডিসেম্বর পলাশ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
পলাশ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- সুধীর বণিক (পিতা বৈকুণ্ঠ বণিক, জিনারদী), মো. সাদেকুর রহমান চৌধুরী (পিতা আব্দুল মালেক চৌধুরী, তারগাঁও), মো. শামীম মিয়া (পিতা মো. মোহর আলী, হাসানহাটা), মো. আলী আকবর (পিতা মো. রহম আলী মুন্সী, ডাঙ্গাবাজার), মো. আবদুল মোতালেব (পিতা মো. আহাদ বক্স, কান্দাপাড়া) এবং মো. বুরুজ মিয়া (পিতা মো. আহাদ বক্স, ইছাখালী)।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে পলাশ সদর উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। এছাড়াও পলাশে একটি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স রয়েছে। [সুরমা জাহিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড