পদ্মারচর গণহত্যা (চারঘাট, রাজশাহী)
পদ্মারচর গণহত্যা (চারঘাট, রাজশাহী) সংঘটিত হয় ১৩ই এপ্রিল। এতে প্রায় ৪০০ নিরীহ মানুষ হত্যার শিকার হয়।
পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল ১৩ই এপ্রিল সারদার প্রতিরোধ ভেঙ্গে চারঘাট আসে এবং চারঘাট বাজার ও থানা সদরের বিভিন্ন মহল্লায় ঢুকে গণহত্যা চালায়। তারা চারঘাট সিও অফিসে ঢুকে আনসার সদস্য ইছাহাক আলী ও সাইদুর রহমান সাজুসহ কয়েকজনকে হত্যা করে। পাকিস্তানি বাহিনীর আগমনের সংবাদ পেয়ে চারঘাট সদর ও আশপাশের গ্রামের অনেক মানুষ এবং এমনকি পুঠিয়া ও নাটোর থেকেও অনেকে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ভারতে যাওয়ার জন্য পদ্মার চরে আশ্রয় নেয়। হানাদার বাহিনী পদ্মার চরে আশ্রয় গ্রহণকারী মানুষদের নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে এবং লাশগুলো গানপাউডার ছিটিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
পদ্মারচর গণহত্যায় কত মানুষ শহীদ হন তা নিরূপণ করা কঠিন। কারণ দূরদূরান্ত থেকে অনেক মানুষ এখানে আশ্রয় নেয়ায় তাদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে সেদিন পদ্মারচরে প্রায় ৪০০ জন গণহত্যার শিকার হন। তন্মধ্যে যাদের পরিচয় জানা গেছে, তারা হলেন— কুঠিপাড়ার আজগর আলি (৫৫) (পিতা ইয়ারোশ আলি), ফাঁকি (২৮) (পিতা দুলু শেখ), শরিফ উদ্দিন (২৫) (পিতা নূর মোহাম্মদ), রফিক (১৮) (পিতা নূর মোহাম্মদ), আ. রশিদ (১৮) (পিতা সোবহান), জবান আলি (২৮) (পিতা হাচেন মোল্লা), ইছব আলী (৩০) (পিতা হাচেন মোল্লা), মুন্নাফ আলি (২০) (পিতা হাচেন মোল্লা), ইসমাইল হোসেন (৬০) (পিতা আহম্মেদ মোল্লা), শামসুজ্জামান (৫২) (পিতা আহম্মেদ মোল্লা), মুনা মালাকার (৩২) (পিতা নারায়ণ মালাকার), নিপেন্দ্রনাথ পাল (৫৮) (পিতা লক্ষ্মী পাল), নারায়ণ পাণ্ডে (৬৫) (পিতা প্রসাদ পাণ্ডে), কালু মালাকার (৩২) (পিতা নারায়ণ মালাকার), আলী (২৮) (পিতা আয়েন উদ্দিন), আহম্মদ আলি মোল্লা (পিতা নাসের মোল্লা), সারফান শেখ (৮৫) (পিতা বাবু শেখ), আ. সোবহান (৮০) (পিতা তেথু ঢুলি), রাজেন (৫৫) (পিতা বোদি ঢুলি), নারায়ণ চন্দ্র তেয়ারি (৬৫) (পিতা সর্বনারায়ণ তেয়ারি), আমির হোসেন (৩৫) (পিতা আলেপ মিস্ত্রী), আলমগীর (৩০) (পিতা হারু শেখ), নবির উদ্দিন (৫৫) (পিতা নেরু শেখ), হারু শেখ (৬০) (পিতা ইদু চৌকিদার), আ. করিম (৩২) (পিতা হারু শেখ), হারেজ আলি (৫০) (পিতা আব্দুর রশিদ), মজিবুর রহমান (৩০) (পিতা হারেজ আলি), মনসুর আলি (৩২) (পিতা রহমত শেখ), রইচ উদ্দিন (৩২) (ফয়েজ উদ্দিন), আ. রশিদ (৩৫) (পিতা কালু খা), শুকুর আলি (৫৫) (পিতা নয়ন চৌকিদার), মজিবার রহমান (৩০) (পিতা শুকুর আলি), লালু মিয়া (৩০) (পিতা দবির মিস্ত্রী), আব্দুর রাজ্জাক (পিতা গারফান আলি), আব্দুর রাজ্জাক (পিতা গারফান আলি), ইসমাইল হোসেন (৭০) (পিতা মো. ইব্রাহিম), সালাউদ্দিন (৩৫) (পিতা সুলতান আলি), দুঃখু মালাকার (পিতা নারায়ণ মালাকার), সুরেন রায় (৫৮) (পিতা গ্রেনচন্দ্র রায়), বেলু পাণ্ডে (পিতা বরদা পাণ্ডে), ডা. ইমতাজ (৭৫) (পিতা লালু চাঁদ), আ. বারি (৪৫) (পিতা ফাকু মণ্ডল), গৌড়শহরের মোজাহার (৪০) (পিতা ফকির মিস্ত্রী), আ. সামাদ (৫০) (পিতা খোকা মালি), সাইফুদ্দিন সুজা (৪০) (পিতা আমির হোসেন), ফয়েজ উদ্দিন (৫০) (পিতা আমির হোসেন), তমেজ উদ্দিন (৫৫) (পিতা আমির হোসেন), অভিলাষ ঘোষ (৬৫) (পিতা মেঘা ঘোষ), দ্বিগেন ঘোষ (৭০) (পিতা জগেন্দ্রনাথ ঘোষ), চিত্তরঞ্জন ঘোষ (৩০) (পিতা সুরেন ঘোষ), ময়েজ শাহ (৪৫) (পিতা ইমান শাহ), দুরুল হক (পিতা জমসেদ আলি), ইসরাইল (৩২) (পিতা আফছার আলি), মহাব্বেল হোসেন (৩০) (পিতা গফুর সাহা), সইরুদ্দিন (৫৫) (পিতা সওদাগর মিস্ত্রী), হাবিবুর রহমান (৫০) (পিতা গফুর), ওয়াজেদ আলি (৪৫) (পিতা ইসাহাক মিয়া), আক্কেলপুরের লাল চাঁদ (৫০) (পিতা হোসেন আলি), আয়েজ উদ্দিন মীর (৭৫) (পিতা শুভন মীর), আমির হোসেন (৫০) (পিতা দেলজান মিস্ত্রী), নিতাই চন্দ্র পাল (৪৫) (পিত দেবেন পাল, সারদা বাজার), সুইপারপাড়ার সুজালাল (৩৫) (পিতা সাধুরাম), জংগু রাম (৫৫) (পিতা সাধুরাম), মিশ্রী লাল (৪৫) (পিতা শুকলাল), দুঃখু রাম (৫১) (বানু রাম), লালটু (৩৫) (পিতা গণেশ), সাধন (৩৬) (পিতা লালুয়া), বুধুয়া (৪০) (পিতা ঝগড়), মতিলাল (৪১) (পিতা শুকলাল), লুৎফর (৪৫) (পিতা শুকুর, কুঠিপাড়া), থানাপাড়ার আজিজুল আলম (৫৫) (পিতা আ. মজিদ), খায়রুল আলম পরাগ (২৫) (পিতা আজিজুল আলম), শফিকুল আলম পান্না (১৭) (পিতা সামসুল), মহাসিন আলি মুন্সি (৪৫) (হাজি উমিদুল), আব্দুল কদ্দুস শেখ (৪০) (পিতা নাসির উদ্দিন মণ্ডল শেখ), ডা. আব্দুল মালেক মানু (৪০) (পিতা হাজি আ. হামিদ), জবদুর রহমান খলিফা (৫০) (পিতা মনছুর রহমান), তনজুর রহমান (৪৭) (পিতা মনছুর রহমান), আতাউর রহমান খলিফা (১৭) (পিতা আব্দুর রহমান), হেনা (১৭) (পিতা আব্দুস সাত্তার), করিম উদ্দিন খলিফা (৫০) (পিতা সোবহান মহলদার), সমসের উদ্দিন (৩৮) (পিতা এরাজ ঘরামি), সিদ্দিক খলিফা (৩৮) (পিতা আনার আলি), ওয়াজ উদ্দিন খলিফা (৪০) (পিতা রওশন খলিফা), পচু (১৮) (পিতা আব্দুস ছালাম), তজাম উদ্দিন (১৮) (পিতা হাবিবুর রহমান), মর্তুজা (২০) (পিতা ইদ্রিস খলিফা), আব্দুল হক ওরফে হকা (১৮) (পিতা ইদ্রিস খলিফা), হাফিজুল হক (২০) (পিতা আব্দুল হামিদ শেখ), আকরাম খলিফা (৩০) (পিতা রওশন খলিফা), খালেক খলিফা (৩৫) (পিতা রহমান বক্স), আব্দুর রহমান (৬০) (পিতা মহিলাল), মনছুর রহমান (৩৫) (পিতা জয়েন মিস্ত্রী), আনছার উদ্দিন (১৫) (পিতা মুনসুর), কলিমুদ্দিন কালু (৩০) (পিতা জয়েন মিস্ত্রী), আব্দুল হাকিম খলিফা (২২) (পিতা নইমুদ্দিন), মাজেদুল হক (২০) (পিতা আব্দুল হামিদ), আজিজুল হক (১৮) (পিতা সাবের সবজি), আব্দুল মজিদ খলিফা (৪৫) (পিতা নসরু খলিফা), আজিজুল হক (৫৫) (পিতা আব্দুল হামিদ), আ. হামিদ মেকার (৪৫) (পিতা সৈয়দ খলিফা), আ. জব্বার মেকার (৪০) (পিতা পিতা সৈয়দ খলিফা), মোস্তফা খলিফা (২২) (পিতা নজির হোসেন), এসলাম মোল্লা, আজিমুদ্দিন শেখ (৪৩) (পিতা কফিল উদ্দিন), উসমান মোল্লা (৪৭) (পিতা রফিক মোল্লা), ইসলাম মোল্লা (৪৫) (পিতা রফিক মোল্লা), মোসারফ মোল্লা (৩৮) (পিতা সুরাপ মোল্লা), খলিল মোল্লা (২০) (পিতা ওসমান মোল্লা), রেজাউল খলিফা পচা (১৯) (পিতা ময়জুদ্দিন), আশরাফ খলিফা সুকটা (৩২) (পিতা হযরত খলিফা), আব্দুল জলিল খলিফা (৩০) (পিতা মকবুল হোসেন), রহিম উদ্দিন খলিফা (২২) (পিতা হাতেম আলি), ইসলাম খলিফা (৪৫) (পিতা হামজু), নুরুল হক খলিফা (২৩) (পিতা সোবহান খলিফা), সাউদ খলিফা (২০) (পিতা সুবহানি), সাহেব উদ্দিন খলিফা (৬০) (পিতা ইব্রাহিম), আকরাম (৩৫) (পিতা রওশন খলিফা), আশরাফ খলিফা (৪০) (পিতা হযরত খলিফা), মোস্তফা খলিফা (৪৫) (পিতা নাজির হোসেন), আব্দুস সামাদ খলিফা (২৭) (পিতা খালেক খলিফা), মসলেম খলিফা (কালু) (৩৫) (পিতা আহমেদ সরদার), মজিবর শেখ (৩৫) (পিতা শুকুর শেখ), আব্দুল গনি (৪০) (পিতা সমের খানসামা), ইমাম উদ্দিন ইমু (৩৮) (পিতা মমের খানসামা), ইনু (১৮) (পিতা ইদ্রিস খলিফা), হোসেন আলি (৪৫) (পিতা বাহার আলি শেখ), জালাল উদ্দিন (জালু) (১৮) (পিতা আলাউদ্দিন), মজিবর রহমান (সদু) (৩৫) (পিতা কলিমুদ্দিন), আব্দুস ছাত্তার কেষ (৪৫) (পিতা এছার উদ্দিন), আব্দুল হাকিম খলিফা (২০) (পিতা নইমুদ্দিন (লাবু), আব্দুল ওহাব মালী (৩৫) (পিতা সোবহান শেখ), আজিম উদ্দিন মালী (৫৫), ইসরাইল হোসেন (১৮) (পিতা আজিমুদ্দিন), হায়াত আলি (হিন্) (৩২) (পিতা জসিম উদ্দিন), মোজাম্মেল হক (কান্দু) (২৭) (পিতা রোস্তম আলি), আনোয়ার হোসেন (খোকা) (১৮) (পিতা আজগর আলি), আব্দুস সোবাহান (৩৫) (পিতা আজগর আলি), আ. জলিল (৩০) (পিতা আজগর আলি), আব্দুস সালাম খলিফা (পিতা সামাদ), মুনজিল রহমান (২২) (পিতা আ. সামাদ), মোজাম্মেল হোসেন (মজা) (৬০) (পিতা আজগর আলী), আব্দুল বারী (৬০) (পিতা আছের উদ্দিন), মহাসিন আলি (৫৫), মফিজ উদ্দিন (৫০) (পিতা হযরত খলিফা), আলি (৫০) (পিতা কাদের), মোক্তারপুরের ফরমান আলি (৭০) (পিতা এজার গাইন), সাত্তার আলি (৭০) (পিতা মফিজ উদ্দিন), হামেদ আলি (৬০) (পিতা এমাজউদ্দিন), আজিজুল হক (৪০) (পিতা এসলাম উদ্দিন খলিফা), তৌহিদ (পিতা রমজান আলি), চারঘাট বাজারের সাইদুর রহমান সাজু (৩০) (পিতা কাশেম আলী), বিনয় সাহা কর্মকার (২৩) (পিতা বিষ্ট সাহা), জগা সাহা (পিতা শ্রীরাম সাহা), কিশোরি সাহা (পিতা অক্ষা সাহা), মাজের আলি (পিতা নাদের আলি), মেরামতপুরের আজের আলি (পিতা লালু প্রামাণিক), সেকান্দার আলি (পিতা ছইর উদ্দিন), আবু সামা (পিতা সৈয়দ আলি), আ. ওহাব প্রামাণিক (পিতা হাজি মেছের আলি প্রামাণিক), তাহের হোসেন (পিতা ফকির মুহাম্মদ), এলাহি বক্স (পিতা কাছের সরকার), মিয়াপুরের গোলাম ইয়াজদানি (পিতা এরশাদ প্রামাণিক), খেতাব উদ্দিন সরকার (পিতা মন্দির সরকার), বসির উদ্দিন (পিতা ফকির মণ্ডল), গোপালপুরের ময়েজ উদ্দিন (পিতা আবু শাহ), লালু প্রামাণিক (পিতা গুই প্রামাণিক), ফাজিল উদ্দিন (পিতা জাদব আলী, পিরোজপুর), আ. জলিল (পিতা কেদার ভাংগী, তালবাড়িয়া), ষষ্টি মিস্ত্রী (পিতা কার্ত্তিক মিস্ত্রী, মিলিক পওড়া), আজাহার আলি (পিতা শাহাদত মোল্লা, অনুপমপুর), বিন্দাবন (পিতা রাখাল ঘোষ, ইউসুফপুর), বজলুর রহমান (পিতা বাইতুল্লাহ বিশ্বাস, ইউসুফপুর), কার্তিক (পিতা শিবেন, জোত্ত কার্তিক), রওশন (পিতা উসমান, কালাহাটি), মমিন (পিতা মজির, রামচন্দ্রপুর), বেলাল (পিতা হাবিল উদ্দিন, রামচন্দ্রপুর) প্রমুখ। এসব শহীদদের স্মরণে একটি নামফলক নির্মাণ করা হয়েছে।
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চারঘাট ডাকবাংলোর পাশে পদ্মা নদীর তীরে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে পুঁতে রাখে। নিহতদের মধ্যে যাদের নাম জানা যায়, তারা হলেন- চারঘাট থানা পাড়ার মহসিন, চারঘাট মারিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ময়েজ উদ্দিন, কালুহাটি গ্রামের রওশন আলী সরকার, সরদহ ট্রাফিক মোড়ের আব্দুল কুদ্দুস, চারঘাট থানা পাড়ার শহীদ শিবলীর পিতা ও এক ভাই। মহসিন চারঘাট থানা পাড়ায় নারীনির্যাতন করার প্রতিবাদ করায় পাকিস্তানি সৈন্যরা বেয়নেট চার্জ করে তাকে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধা ময়েজ উদ্দিন ১৬ই সেপ্টেম্বর বাড়িতে এলে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। রাজাকাররা তাকে হত্যা করে চারঘাট ডাকবাংলোর পাশে পদ্মা নদীর তীরে পুঁতে রাখে। পহেলা জুন ভারতের কাজীপাড়া ক্যাম্প থেকে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলম শিবলী, আফছার উদ্দিন ও রিয়াজ উদ্দিন এক অপারেশনের জন্য চারঘাট আসেন। কিন্তু পাকিস্তানি দালাল ইদ্রিস আলী ও তাজদ্দিন তাঁদের ধরে ফেলে। চারঘাট শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান জয়েনউদ্দিন সরকার তাঁদের পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেয়। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যা করে লাশ পদ্মা নদীতে ফেলে দেয়। শিবলীর মা পাকিস্তানি বাহিনীর অনুমতি নিয়ে শহীদ শিবলীর লাশ নদী থেকে তুলে এনে থানাপাড়ার নিজ বসতভিটায় কবর দেন। শিবলী ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শিবলীর পিতা ও এক ভাইকে হানাদাররা এপ্রিল মাসে হত্যা করে। [মো. মাহবুবর রহমান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড