পটিয়া থানা শান্তি কমিটি হেডকোয়ার্টার্স অপারেশন (পটিয়া, চট্টগ্রাম)
পটিয়া থানা শান্তি কমিটি হেডকোয়ার্টার্স অপারেশন (পটিয়া, চট্টগ্রাম) পরিচালিত হয় জুলাই মাসের শেষদিকে। চট্টগ্রাম জেলার পূর্ব চন্দনাইশ চৌধুরী পাড়ায় খায়ের আহমদ চৌধুরী (পিতা রহমত আলী)-র বাসভবন ছিল পটিয়া থানা শান্তি কমিটি-র হেডকোয়ার্টার্স। খায়ের আহমদ ছিল এ কমিটির আহ্বায়ক। হাবিলদার আবু মোহাম্মদ ইসলাম (পিতা হামিদ হোসেন) ও আবুল বশর (পিতা মাওলানা মো. ইছহাক)-এর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা এ বাসভবনে অপারেশন পরিচালনা করেন।
খায়ের আহমদ চৌধুরী পটিয়া থানা শান্তি কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হওয়ার পর চট্টগ্রাম জেলা শান্তি কমিটির আহ্বায়ক মাহমুদুন্নবী চৌধুরী (১৯০৮-১৯৯৫)-র নিকট থেকে ১২টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল নিয়ে তার বাসভবন থেকে কমিটির কর্মতৎপরতা শুরু করে। রশিদুজ্জামান চৌধুরী নামে তার এক ভ্রাতুষ্পুত্র ছিল। চাচা খায়ের আহমদ চৌধুরীর প্ররোচনায় পড়ে সে পটিয়া থানা শান্তি কমিটির সদস্য হয় এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষে কর্মতৎপরতায় যোগ দেয়। যোগ দিয়েই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাবিলদার আবু মোহাম্মদ ইসলামকে হত্যার পরিকল্পনা করে। মুক্তিযোদ্ধারা এটি টের পেয়ে খায়ের আহমদ চৌধুরীর বাসভবনে অপারেশন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন।
ঘটনার দিন রাতে হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। তার মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা দক্ষিণ গাছাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জড়ো হন। তাঁরা সংখ্যায় ছিলেন ৩২ জন। এখান থেকে রাত প্রায় ১০টার দিকে তাঁরা খায়ের আহমদ চৌধুরীর বাসভবনের সামনে পৌঁছে দেখেন বাসভবনের দরজায় ৩ রাজাকার পাহারারত। তারা হলো- রশিদুজ্জামান চৌধুরী, অলি আহমদ (পূর্ব চন্দনাইশ), মোখতার আহমদ (চৌধুরীপাড়া) এবং কবির আহমদ (চৌধুরীপাড়া)। বাসভবনের ভেতরে আরো দালাল ও রাজাকার ছিল। তারা হলো— আহমদ হোসেন (চৌধুরীপাড়া), নূর আলী মিয়া সওদাগর (টাকখাইয়ার পাড়া, গাছবাড়িয়া), ইসলাম চৌধুরী (চৌধুরীপাড়া), মনির আহমদ (চৌধুরীপাড়া), খুইল্যা মিয়া (চৌধুরীপাড়া), বাচা সওদাগর (চৌধুরীপাড়া), গফফার মৌলবি, আবদুল আলিম (বুলারতালুক), লেদু মেম্বার (বুলারতালুক), আবদুল মোনাফ (বুলারতালুক), সালেহ আহমদ ভেন্ডার (চৌধুরীপাড়া) প্রমুখ।
রশিদুজ্জামান চৌধুরী দরজায় এসে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে ফায়ার করলে পাহাররত তিন রাজাকারসহ অন্য দালাল ও রাজাকাররাও ফায়ার করে। ফলে মুক্তিযোদ্ধারাও তাদের দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। প্রায় তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পর অধিকাংশ দালাল ও রাজাকাররা পলিয়ে যায়। খায়ের আহমদ চৌধুরীও তখন বাসভবনে ছিল। সে তার আরেক ভ্রাতুষ্পুত্র ওয়াহিদুজ্জামান চৌধুরী (পিতা সালেহ আহমদ ভেন্ডার)-কে সঙ্গে নিয়ে পালাতে সমর্থ হয়। তবে পাহারাদার তিনজন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কাছ থেকে ৩টি রাইফেল উদ্ধার করেন। কিন্তু তাদের একজন মোখতার আহমদকে বাঁধার সময় অপর দুজন অলি আহমদ ও কবির আহমদ পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা বাসভবনের ভেতরে প্রবেশ করে রশিদুজ্জামান চৌধুরী, খোরশেদুজ্জামান চৌধুরী (পিতা খায়ের আহমদ চৌধুরী) ও রোকেয়া (পিতা সালেহ আহমদ ভেন্ডার) নামে এক যুবতিকে দেখতে পান। তারা পালাতে পারেনি রশিদুজ্জামান চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে নেয়ার হুমকি দিলে হাবিলদার আবু মোহাম্মদ ইসলাম, আবুল বশর ও অন্য একজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে গুলি করেন। এতে রশিদুজ্জামান নিহত এবং খোরশেদুজ্জামান ও রোকেয়া আহত হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা বাসভবন থেকে বাকি ৯টি রাইফেলসহ অনেক গুলি উদ্ধার করেন।
এ অপারেশনে অংশগ্রহণকারী ৩২ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে কয়েকজন হলেন: কমান্ডার হাবিলদার আবু মোহাম্মদ ইসলাম (পিতা হামিদ হোসেন, কানাইমাদারি, বরকল), ডেপুটি কমান্ডার আবুল বশর (পিতা মাওলানা মো. ইছহাক, ভাইখলিফাপাড়া, উত্তর হাশিমপুর), দেলওয়ার হোসেন (কুমিল্লা), আইয়ুব আলী (পিতা হামিদ হোসেন, কানাইমাদারি), মো. আবুল কাশেম (পিতা মো. এনু মিঞা, পশ্চিম পাঠানদণ্ডি), আবুবকর চৌধুরী (পিতা কবির আহমদ চৌধুরী, কানাইমাদারি), আবদুল জব্বার (পিতা দুলা মিয়া চৌধুরী, কানাইমাদারি), মো. ইছহাক মিয়া (পিতা মো. এনু মিয়া, পশ্চিম পাঠানদণ্ডি), মনছফ আলী (পিতা আবদুর রশিদ, কানাইমাদারি), এস এম গফুর (পিতা ছৈয়দুল হাকিম, কানাইমাদারি), আছহাব মিয়া (পিতা মতিউর রহমান, মধ্যম চন্দনাইশ), আসহাব মিয়া (পিতা কেরামত আলী, গাছবাড়িয়া), মো. ইছহাক মিয়া (পিতা আলতাফ মিয়া, হাশিমপুর), মোখলেসুর রহমান (বৈলতলী), নুরুল ইসলাম (পিতা হামিদ হোসেন, কানাইমাদারি), মোহাম্মদ ইউছুপ ওরফে ইঞ্চিয়া (পিতা খুইল্যা মিয়া, পশ্চিম হারলা), আবুল কালাম আজাদ (পিতা আহমদ হোসেন, হারলা), আবদুল আলিম (পিতা ওবাইদুর রহমান), ফোরক আহমদ (পিতা আবদুর রশিদ, দক্ষিণ জোয়ারা) প্রমুখ। [শামসুল আরেফীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড