You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে পটুয়াখালী সদর উপজেলা - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে পটুয়াখালী সদর উপজেলা

পটুয়াখালী সদর উপজেলা বঙ্গোপসাগরের পাড়ে ঝড়- ঝঞ্ঝা ও জলোচ্ছ্বাসের শিকার এবং গভীর অরণ্যে ঘেরা একটি জনপদ। সুদীর্ঘ কালের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, সংগ্রাম ও যুদ্ধের অতীত ঐতিহ্য রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলীয় এ এলাকার মানুষের। ১৯৬৯ সালের ১লা জানুয়ারি পটুয়াখালী জেলায় উন্নীত হয়। তখন পটুয়াখালী সদরসহ ১০টি থানা ছিল এ জেলার অধীন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর সকল আন্দোলন- সংগ্রামের মতো বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধেও পটুয়াখালীবাসী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী ভাষণের পর থেকে জেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে জেলা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে। তার আগে ফেব্রুয়ারি মাসেই জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ে সংগ্রাম পরিষদ এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার জন্য ৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন এডভোকেট কাজী আবুল কাসেম (জেলা আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি), সাধারণ সম্পাদক আশরাফ আলী খান (জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) এবং সদস্য ছিলেন হাফিজুর রহমান ওরফে ফোরকান মিয়া (আওয়ামী লীগ নেতা), এডভোকেট মো. আবদুল বারী (আওয়ামী লীগ নেতা), আবদুল করিম মিয়া (ভাসানী ন্যাপ-এর কেন্দ্রীয় নেতা), সৈয়দ আশরাফ হোসেন (জেলা ন্যাপের সভাপতি) ও কমরেড মোকসেদুর রহমান (কমিউনিস্ট পার্টির নেতা)। পটুয়াখালী সদর থানা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে এডভোকেট আবদুল বারী ও নূরুল হক তালুকদার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা পটুয়াখালী সংগ্রাম পরিষদের কাছে পৌঁছায় ২৬শে মার্চ সকালে। তাৎক্ষণিকভাবে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ জেলা প্রশাসক আবদুল আউয়ালের সঙ্গে এক জরুরি বৈঠকে বসেন। বর্তমান মহিলা কলেজে জেলা সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করা হয়। এরপর পরিষদ পাশের সরকারি জুবিলী স্কুল মাঠে ৩০০ মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করে। পুলিশ লাইন থেকে রাইফেল ও গুলি এনে মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া হয়। তখন থেকে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। ২৬শে এপ্রিলের পূর্ব পর্যন্ত এ প্রশিক্ষণ চলে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পটুয়াখালী জেলা ছিল ৯নং সেক্টরের অধীন। এ জেলার ১০টি থানা নিয়ে গঠিত হয় পটুয়াখালী সাব-সেক্টর। এর আওতাধীন পটুয়াখালী ও গলাচিপা নিয়ে গঠিত ইউনিটের কমান্ডার ছিলেন কে এম নুরুল হুদা এবং ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন হাবিবুর রহমান শওকত।
পাকবাহিনী পটুয়াখালী দখল করার পর প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তাঁরা সংগঠিত হয়ে চারটি মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করেন। সেগুলো হলো শাহজাহান ফারুকের নেতৃত্বাধীন ফারুকী বাহিনী, গাজী দেলোয়ার হেসেনের নেতৃত্বাধীন দেলোয়ার বাহিনী, কাজী আবদুল মতলেবের নেতৃত্বাধীন মতলেব বাহিনী এবং ক্যাপ্টেন জলিলের নেতৃত্বাধীন জলিল বাহিনী। এ চারটি বাহিনীর যোদ্ধারা হানাদারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
২৬শে এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হানাদারদের জঙ্গিবিমান পটুয়াখালীতে বেপরোয়া বোমাবর্ষণ শুরু করে। এক নাগারে কয়েক ঘণ্টা বোমা হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি ছত্রীসেনারা সামরিক হেলিকপ্টারে কালিকাপুর এলাকায় অবতরণ করে। এরপর তারা প্রচণ্ড আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র জনতার ওপর, চালায় নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত করে শহরের বাণিজ্যিক এলাকা পুরান বাজার। এর করুণ পরিণতি যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুক্তিকামী মানুষের লাশ। ঐদিনের গণহত্যায় অর্ধশতাধিক লোক শহীদ হন। এ ঘটনা পটুয়াখালী সদর গণহত্যা নামে পরিচিত। পাকসেনারা সেদিন জেলা প্রশাসক মো. আবদুল আউয়ালকেও গুলি করে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেল দিয়ে সহায়তা করা। এরপর তারা সার্কিট হাউজ ও পুরাতন জেলখানায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
পটুয়াখালী সদর উপজেলায় শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী সক্রিয় ছিল। পটুয়াখালী জেলা শান্তি কমিটির সদস্য ছিল মশু মিয়া, মহিউদ্দিন, আলাউদ্দীন সিকদার প্রমুখ। পটুয়াখালী জেলার রাজাকার কমান্ডার ছিল মো. আফাজ উদ্দীন এবং পটুয়াখালী সদর উপজেলার রাজাকার কমান্ডার ছিল মো. সুলতান আহমেদ।
পটুয়াখালী জেলাসদর থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে একটি নিভৃত এলাকা ইটবাড়িয়া ইউনিয়ন। পটুয়াখালী শহর পতনের এক সপ্তাহ পর ৪ঠা মে বেলা ১১টার দিকে পাকবাহিনীর একটি গানবোট বোর্ড স্কুলসংলগ্ন পায়রা নদীর পাড়ে ভেড়ে। তারপর পাকসেনারা পাড়ে নেমে গ্রামের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ও বেয়নেট চার্জ করে ২৪ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এটি ইটবাড়িয়া গণহত্যা নামে পরিচিত। এরপর তারা স্থানীয় দালালদের সহায়তায় ঘরে- ঘরে তল্লাশি চালিয়ে কিশোরী, যুবতী ও গৃহবধূদের ধরে এক জায়গায় জড়ো করে এবং তাঁদের মধ্য থেকে ৩০-৩৫ জনকে সার্কিট হাউজ ক্যাম্পে নিয়ে যায়৷ সেখানে তাঁদের ওপর চালানো হয় পৈশাচিক নির্যাতন। তাঁদেরই ১৪ জন নিজেদের বীরাঙ্গনা হিসেবে পরিচয় দেন। পটুয়াখালীতে ২৬শে এপ্রিল একটি বড় গণহত্যা সংঘটিত হয়, যা পটুয়াখালী সদর গণহত্যা নামে পরিচিত।
ইটবাড়িয়া ঘটনার এক সপ্তাহ পর ১১ই মে দুপুরের দিকে একই ইউনয়নের হিন্দু অধ্যুষিত বল্লভ গ্রামে পাকবাহিনী প্রবেশ করে। ঐ এলাকায় কোনো লোকজন না পেয়ে তারা ৪৩টি বাড়ি লুণ্ঠন শেষে অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত করে। এরপর ২৩শে মে (৮ই জ্যৈষ্ঠ) তারা লোহালিয়া ইউনিয়নে একটি গণহত্যা চালায়, যা লোহালিয়া গণহত্যা নামে পরিচিত। এদিন তারা উত্তর লোহালিয়া, পালপাড়া ও কুড়িপাইকা এলাকার ১৯ জনকে হত্যা করে। কুড়িপাইকার জেলেপাড়া থেকে ধরে আনা ১৪ জনকে পালেরডাঙ্গা খালপাড়ে ব্রাশ ফায়ার করে লাশ খালে ফেলে দেয়া হয়। তাঁদের মধ্যে দুজন বেঁচে যান।
পটুয়াখালী সার্কিট হাউজ ক্যাম্প ছিল পাকহানাদারদের নির্যাতনকেন্দ্র এবং পুরাতন জেলখানা ছিল বন্দিশিবির। বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজনদের সার্কিট হাউজে ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন করা হতো। বন্দিদের পাঠানো হতো পুরাতন জেলখানায়। সেখানেও দফায় দফায় নির্যাতন করা হতো। তাদের অনেককে রাতের বেলা জেলখানার অভ্যন্তরে গুলি করে কিংবা বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে সেখানেই মাটিচাপা দেয়া হতো। এটি পুরাতন জেলখানা গণহত্যা নামে পরিচিত।
পটুয়াখালী সদর উপজেলায় দুটি গণকবর রয়েছে— মাদবারবাড়ি গণকবর ও পটুয়াখালী ডিসি বাংলো গণকবর। পটুয়াখালী দখলের দিন পাকবাহিনী মাদবারবাড়ির ১৭ জনসহ যে অর্ধশতাধিক লোককে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে, তাঁদের মাদবরবাড়িতে কবর দেয়া হয়। ঐদিনই তারা নির্বিচারে গুলি চালাতে- চালাতে শহরে প্রবেশ করে সরকারি কর্মচারী কোয়ার্টার্স- এর সিঁড়ির নিচ থেকে সশস্ত্র ৬ জন আনসার এবং জেলা তথ্য অফিসারকে ধরে ডিসি বাংলোর উত্তর পাশে নিয়ে হত্যা করে পরে স্থানীয় লোকজন তাঁদের সেখানেই কবর দেয়। এছাড়া পুরাতন জেলখানার অভ্যন্তরে একটি গণকবর আছে। তুলাতলা এলাকার বধ্যভূমিটি নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে। পটুয়াখালী শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে সড়কযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন মাদারবুনিয়া গ্রামে ১১ই আগস্ট দুপুরে শাহজাহান ফারুকীর নেতৃত্বাধীন ৩৪ সদস্যের একটি মুক্তিযোদ্ধা দলের ওপর পাকসেনারা অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এসময় শত্রুপক্ষের ৩ জন গুলিবিদ্ধ হলে তারা পিছু হটে। প্রায় একঘণ্টা গোলাগুলির পর মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি ফুরিয়ে এলে এবং জেলাসদর নিকটবর্তী হওয়ায় তাঁরাও ঐ এলাকা ত্যাগ করেন। এছাড়া, মুরাদিয়ার গাবতলী এলাকায় হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। পটুয়াখালীর সাবেক পৌর চেয়ারম্যন রাজা মিয়ার হত্যাকারী এক পাকসুবেদার নৌকাযোগে পালিয়ে যাওয়ার সময় মৌকরন এলাকায় মতলেব কাজী বাহিনীর হাতে সে ধরা পড়ে এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর গুলি করে হত্যা করা হয়।
যুদ্ধের শেষদিকে দেশের বিভন্ন অঞ্চল যখন একের পর এক শত্রুমুক্ত হচ্ছিল, তখন পটুয়াখালী সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারাও এ এলাকাকে শত্রুমুক্ত করার উদ্যোগ নেন। তাঁরা ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে শহরের চারদিকে অবস্থান নেন। এ অবস্থা টের পেয়ে মেজর ইয়ামিনের নেতৃত্বাধীন পাকবাহিনী নিষ্প্রদীপ কারফিউ জারি করে ৭ই ডিসেম্বর রাতে লঞ্চযোগে পালিয়ে যায়। পরদিন ৮ই ডিসেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করতে শুরু করলে রাজাকার ও আলবদররা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালাতে থাকে। ফলে বিনা বাঁধায় মুক্তিযোদ্ধারা শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা করা হয়। এভাবেই দীর্ঘ ৮ মাস অবরুদ্ধ থাকার পর পটুয়াখালী সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
পটুয়াখালী সদর উপজেলায় যেসব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা যায়, তাঁরা হলেন— সিপাহি হক (পিতা আক্কেল আলী মোল্লা, থানাপাড়া রোড), আমজাদ হোসেন সিকদার (পিতা মো. তমিজ উদ্দিন সিকদার, জুবিলী স্কুল রোড), তোজোম্বার আলী গাজী (পিতা হাসান আলী গাজী, সেহাকাঠী), আব্দুল হক তালুকদার (পিতা আক্কেল আলী তালুকদার, বাদুরা) এবং হাবিলদার হাফিজ উদ্দিন সিকদার (আবদুর রহমান সিকদার, পটুয়াখালী সড়ক উপবিভাগ-১)।
পটুয়াখালী জেলা শিল্পকলা একাডেমি সংলগ্ন পশ্চিম পাশে সরকারি উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে “শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিসৌধ’। কালিকাপুর এলাকায় মাতবরবাড়ি গণকবর ও ডিসির বাংলোর উত্তর পাশে ৬ আনসারসহ ৭ শহীদের গণকবর রয়েছে। এছাড়া পটুয়াখালী টাউন কালিকাপুর চৌরাস্তায় মুক্তিযুদ্ধ স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। [কাজল বরণ দাস]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড