পটুয়াখালী সদর গণহত্যা (পটুয়াখালী সদর)
টুয়াখালী সদর গণহত্যা (পটুয়াখালী সদর) ২৬শে এপ্রিল সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিমান হামলায় সংঘটিত এ গণহত্যায় শতাধিক বেসামরিক মানুষ শহীদ হন।
বাংলাদেশের অন্যান্য শহরের তুলনায় পটুয়াখালী সদরের গণহত্যা ছিল ভিন্ন প্রকৃতির। হানাদাররা এখানে মানুষজন ধরে এনে হত্যার পরিবর্তে বিমান হামলার মাধ্যমে তাদের হত্যা করে। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কায় ২৫শে এপ্রিল গোলাম আহাদ চৌধুরী এমএনএ-র নেতৃত্বে মানস দত্ত (৭০), নূরুল ইসলাম মাদবর (৭২)-সহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা লঞ্চ টার্মিনালের পন্টুনটি শিকল কেটে মূল টার্মিনাল থেকে আলাদা করে দেন, যাতে নদীপথে এসে হানাদার বাহিনী পন্টুন ব্যবহার করে সহজে পটুয়াখালী শহরে প্রবেশ করতে না পারে। পটুয়াখালীর এ গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা মানস দত্ত, নূরুল ইসলাম মাদবর (১৯৬৭-৬৮ সালে পটুয়াখালী সরকারি কলেজের ছাত্রলীগ-এর সভাপতি) প্রমুখ। পাকবাহিনীর মধ্যে পূর্ব থেকে ধারণা তৈরি হয় যে, তাদের পক্ষে পটুয়াখালীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, কারণ দেশের অন্যান্য স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এখানে অনেক শক্তিশালী। ২৬শে এপ্রিল পটুয়াখালী শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি জঙ্গি বিমান এসে প্রথমে চক্কর দিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর তারা প্রথমে লঞ্চঘাট, পরে মাদবর বাড়ি, বড়বাড়ি, ডিসির বাংলো এলাকা, লাউকাঠী ও টিএন্ডটি এলাকায় বিমান থেকে বোমা ও গুলিবর্ষণ করে। বিমান হামলার পরিপ্রেক্ষিতে শহরের রাস্তা-ঘাট জনশূন্য হয়ে পড়ে। মানুষজন শহর থেকে পালিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে চলে যায়। বিমান হামলায় অনেক বাড়িঘরে আগুন ধরে যায়। অনেক ঘরবাড়ি মাটিতে মিশে যায়। হামলার সময় ডিসি-র বাংলোর দক্ষিণ দিকে বি-টাইপমুখী রাস্তার পশ্চিম পাশে ৬ সদস্যবিশিষ্ট আনসার বাহিনীর একটি দল পাকবাহিনীর হেলিকপ্টার দেখে গুলি ছোড়ে। পাকবাহিনী হেলিকপ্টার থেকে তাদের সবাইকে গুলি করে হত্যা করে এবং তারা হেলিকপ্টার থেকে নেমে তাদের সেখানেই গর্ত করে মাটিচাপা দেয়। বিমান হামলার এক পর্যায়ে পাকিস্তানি ছত্রী সেনারা বহালগাছিয়া খালের দক্ষিণ পাশে অবতরণ করে। শহরের কালিকাপুর এলাকার শতশত মানুষ প্রাণভয়ে মাদবর বাড়ির দক্ষিণ পার্শ্বস্থ বহালগাছিয়া খাল পার হয়ে হেতালিয়া গ্রামে আশ্রয় নেয় তাদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা রয়েছে এটি ভেবে সেখানে আশ্রয় নেয়া সব মানুষের ওপর পাকিস্তানি ছত্রী সেনারা নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। তাদের অতর্কিত আক্রমণে নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ বহুসংখ্যক মানুষ শহীদ হন। এরপর হানাদার বাহিনী মাদবর বাড়িসহ অনেকগুলো বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। হানাদার বাহিনী বড়বাড়ির সন্নিকটে এবং লাউকাঠীতে নদীপথে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য নৌকাযোগে পারাপাররত সাধারণ মানুষের ওপর বিমান থেকে গুলি করে নির্বিচারে হত্যা করে। হানাদার বাহিনীর এ বিমান হামলায় শহরের কয়েকটি স্থানে শতাধিক মানুষ শহীদ হন। দূর-দূরান্তের হওয়ায় সকল শহীদের পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। যাদের পরিচয় জানা গেছে, তারা হলেন— লঞ্চঘাট এলাকায় একজন পানের দোকানদার, একজন ঘাট কুলি, এখানকার বাসিন্দা শংকর দুয়ারিসহ ৪ জন, মাদবর বাড়ির মোহাম্মদ হাসেম মাদবর, আ. কাদের মাদবর, হযরত আলী মাদবর, আ. লতিফ মাদবর, আ. করিম মাদবর, তোজমান আলী মাদবর, আফেজউদ্দীন মাদবর, আনোয়রা বেগম, মোসাম্মৎ লালবরু বেগম, মোসাম্মৎ পিয়ারা বেগম, মোসাম্মৎ ফুলবানু বেগম, মোহাম্মদ আজাহার (রাজমিস্ত্র), আ. রাজ্জাক (শিশু), বাবুল, আ. গণি, খোকন (শিশু), মোসাম্মৎ তসলিমা (শিশু), সামসুন্নাহার, মানিক বরু, বড়বাড়ি এলাকায় ফজলুর রহমান (পিতা মোহাম্মদ ইসহাক), সোবহান (পিতা হোসেন আলী হাওলাদার), মো. মোস্তাফিজুর রহমান (পিতা আব্দুল জব্বার মিয়া), মো. জাহাঙ্গীর হোসেন (পিতা আব্দুল জব্বার মিয়া), মো. মোশাররফ হোসেন (পিতা আব্দুল জব্বার মিয়া), জেবুন্নেছা বেগম (পিতা আব্দুল জব্বার মিয়া), মো. আবু তালেব হাওলাদার (পিতা শাহাদাত আলী মুন্সি), হোসেন হাওলাদার (পিতা আকবর আলী হাওলাদার), ফজলুল করিম (পিতা হাসেম হাওলাদার), আব্দুল মান্নান হাওলাদার (পিতা আব্দুর রহমান হাওলাদার), ডিসি-র বাংলো এলাকায় ৬ জন আনসার সদস্য এ পি সি আলী আহমদ খাঁ (পিতা মোবারক খাঁ, আরামগঞ্জ), শাজাহান হাওলাদার (পিতা এফরান উদ্দিন হাওলাদার, মেহেরপুর), আব্দুল মজিদ (পিতা বালু খাঁন, সুধীরপুর), আ. রশিদ হাওলাদার (পিতা হামেজউদ্দিন হাওলাদার, বিপিনপুর), পি সি আনোয়ার হোসেন (পিতা সৈয়দ জালালউদ্দীন, আলীগঞ্জ), আ. খালেক (পিতা আসমতআলী খাঁ, নাচনাপাড়া) প্রমুখ। গণহত্যার পর কয়েকজন শহীদদের লাশ তাদের স্বজনরা নিজনিজ বাড়িতে নিয়ে সমাহিত করেন। বাকি শহীদদের সমাহিত করা হয় পটুয়াখালী শহরে। পরবর্তীতে ৪টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণে তাদের নামফলকসহ মাদবর বাড়ি এলাকায় ১৯ শহীদের গণকবর, বড়বাড়ি এলাকায় একটি ও ডিসি-র বাংলো এলাকায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। [ইব্রাহীম খলিল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড