You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে পত্নীতলা উপজেলা (নওগাঁ)

পত্নীতলা উপজেলা (নওগাঁ) ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ- সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হলেও বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্র শুরু করে। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে পত্নীতলার মানুষ সর্বাত্মকভাবে সে আন্দোলনে যোগ দেয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করতে থাকলে বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এ লাখো জনতার সমাবেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানান। তাঁর এ আহ্বানে পত্নীতলার ছাত্র ও যুব সমাজ স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয় এবং গ্রামে-গ্রামে লোকজনদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করে। এভাবে এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি হয়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫শে মার্চ রাতে ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড চালায়। ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে তারা গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু ওয়ারলেস বার্তার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁর এ ঘোষণার পর সমগ্র দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এর ধারাবাহিকতায় পত্নীতলার যুবসমাজও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ভারতের বালুরঘাটের শিবতলীতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আব্দুল জলিলের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে ভারতের বাঙ্গালীপুর-মধুপুর, পারিলা, গৌরবাগান, খড়সডাঙা, বালুরঘাট-কামারপাড়া ও প্রতিরাম সাব-ক্যাম্পে যোগ দেন। সেখান থেকে অনেকে ৭ নং সেক্টরের অধীন শিলিগুঁড়ি হেডক্যাম্পে গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মো. সাদেক উদ্দীন আহম্মেদ (পিতা রহিমদ্দীন মণ্ডল, পাটিচরা; পত্নীতলা <ছাত্রলীগ>এর সেক্রেটারি), সুকুমার চন্দ্র দাস (পিতা গোপাল চন্দ্র দাস, চাঁদপুর, নজিপুর), সন্তোষ কুমার দাস (পিতা খিতিশ চন্দ্ৰ দাস, চাঁদপুর, নজিপুর), সুবিমল চন্দ্র দাস (পিতা সুধীর চন্দ্র দাস, যতনি-পত্নী, চকদূর্গারায়াম), কাজী রফিকুল ইসলাম (পিতা কাজী নবীর উদ্দীন, চাঁদপুর, নজিপুর), কাজী বদিউল ইসলাম (পিতা কাজী নবীর উদ্দীন, চাঁদপুর, নজিপুর), মো. সায়েছ হোসেন (পিতা কফিল উদ্দীন, চাঁদপুর, নজিপুর), কাজী আকতার হোসেন (পিতা কাজী আব্দুল মজিদ, চাঁদপুর, নজিপুর), মো. জাফর আলী (পিতা আজির উদ্দীন, ছোট মহারন্দী), সাদেকুল ইসলাম (পিতা সাকিম উদ্দীন, নোধনী), মো. বিএসএ হুমায়ন কবির চৌধুরী (পিতা আলহাজ্ব আব্দুল করিম চৌধুরী, খিরশীন), মো. ইসমাইল হোসেন (পিতা মো. তছির উদ্দীন, পাটিচরা), মো. সোলায়মান আলী (পিতা অছিম উদ্দীন মণ্ডল, পাটিচরা), মো. আমজাদ হোসেন (পিতা আমীর উদ্দীন মণ্ডল, মেহেরুল), মো. আকবর আলী (পিতা মজির আলী, হাট শাউলী), মো. মমতাজুর রহমান (পিতা আফছার আলী সরদার, গাহন), মো. মজিবর রহমান (পিতা মনজিলা মণ্ডল, পদ্মপুকুর) ছিলেন উল্লেখযোগ্য। মো. সাদেক উদ্দীন আহম্মেদ ভারতে গিয়ে আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে প্রথমে বাঙ্গালীপুর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। এরপর উত্তর প্রদেশের চাকাটা আর্মি হেডকোয়ার্টার্সে ট্রেনিং নিয়ে পাঙ্গাতে কমান্ডারের দায়িত পান এবং বাংলাদেশে এসে ৭ নং সেক্টরের মেজর নুরুজ্জামানের অধীনে ডা. আব্দুল খালেক (শিশা, পোরশা, নওগাঁর)-এর নেতৃত্বে যুদ্ধ করেন। সন্তোষ কুমার দাস ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে ট্রেনিং শেষ করে তরঙ্গপুর ৭ নং সেক্টর থেকে অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশে এসে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন। সুবিমল চন্দ্র দাস ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে ট্রেনিং শেষ করে ভারতের কালিয়াগঞ্জ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ একশত মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। সুকুমার চন্দ্র দাস পত্নীতলায় পাকসেনাদের আগমনের খবর পেয়ে ২৫শে এপ্রিল ভারতে যান। ভারতের বালুরঘাটের শিবতলীতে গিয়ে তিনি আব্দুল জলিলের সঙ্গে দেখা করে তাঁর নেতৃত্বে বাঙ্গালীপুর ক্যাম্পে যোগ দেন। সেখানে একমাস ট্রেনিং-এর পর রায়গঞ্জ ক্যাম্পে আরো একমাস উচ্চ প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। আলহাজ্ব আমজাদ হোসেন ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে ট্রেনিং শেষ করে দেশে এসে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক ছিলেন আব্দুল জলিল। আঞ্চলিক কমান্ডার ছিলেন ওহিদুর রহমান (রসুলপুর, আত্রাই) এবং গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন মো. সাদেক উদ্দীন আহম্মেদ (মুজিব বাহিনী)।
এছাড়া আরো যাঁরা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন- আফাজ উদ্দীন (ডাসনগর), আবু তাহের (মান্দাইন), আবুল কালাম (মহারন্দি), সোলায়মান আলী (সম্ভুপুর), মনজুর এলাহী (কমলাবাড়ি), নাজিম উদ্দীন (আখিড়া) ও মনছুর আলী (ভারতের সাদুল্লাপুর), মজিবর রহমান (পদ্মপুকুর)। ১২ই এপ্রিল সকালে পাকবাহিনী পত্নীতলায় প্রবেশ করে এবং নজিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও পত্নীতলা থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
এরপর মুসলিম লীগ-এর সদস্য মো. খয়ের উদ্দীন আহম্মেদ, ডা. আ. মজিদ (নজিপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান), মো. খাদেমুল ইসলাম, মো. হায়দার আলী মীর (অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা), মো. মজিবর রহমান সরদার (পাটিচরা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান), আ. সামাদ চৌধুরী, লাল মোহাম্মদ (জামায়াতে ইসলামী-র পত্নীতলা শাখার সাবেক আমির) প্রমুখ তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এদের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি, রাজাকার -আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠিত হয়। শান্তি কমিটির সদস্য ছিল ইয়াকুব আলী (অবসরপ্রাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ সেক্রেটারি), মো. লুৎফর রহমান (রাইগাঁ কলেজ) প্রমুখ। রাজাকার বাহিনীর নেতৃস্থানীয় ছিল মো. গিয়াস উদ্দীন, শাহাজাহান আলী (আকবরপুর রাজাকার কমান্ডার), মো. গছির ঠিকাদার এবং মো. ইয়াসিন আলী।
পত্নীতলার ১১টি ইউনিয়ন মিলিয়ে রাজাকারদের এক বিশাল বাহিনী গড়ে উঠেছিল। এ বাহিনীর সদস্যরা হলো: পত্নীতলা- মো. আব্দুল মান্নান, মো. ইমাজ উদ্দীন, মো. ফজলুর রহমান, মো. জিল্লুর রহমান, মো. দসির উদ্দীন, মো. শাসসুদ্দিন মিয়া, মো. আজিম উদ্দীন, মো. গোল ফিরোজ, মো. বেসোর আলী, মো. গুলজার আলী, মো. জালাল উদ্দীন, মো. মজিবর রহমান, মো. আব্দুল খালেক; নজিপুর- আবুবকর সিদ্দিক, মো. আব্বাস, গিয়াসউদ্দিন, মো. চেরু মেকার, মো. মোসলেম উদ্দীন, মো. অসিম উদ্দীন, মো. জসিম উদ্দীন, মো. অসিম উদ্দীন, মো. খয়বর আলী, মো. মোজাহার আলী, মো. লুৎফর রহমান, মো. আব্বাস উদ্দীন, মো. মছির উদ্দীন, মো. ওবাইদুল, মো. মতিউর রহমান, মো. আব্দুল গফুর (রাধুনী), মো. সলেমদ্দীন (রাধুনী); আকবরপুর- শাহাজাহান আলী (কমান্ডার), মো. শফি উদ্দীন, মো. আব্দুস সাত্তার, মো. বাপু (শনু), মো. সমে, মো. হাইবাবু, মো. মজিবর রহমান, মো. সুলতান, আব্দুর রশিদ, মো. সোবহান, মো. আজির উদ্দীন, মো. আবুল কাশেম, মো. নুরুল ইসলাম, মো. মোস্তফা, মো. সালেহ, মো. মোহসিন আলী, মো. মোস্তফা, মো. ইসলাম, মো. ইদ্রিস আলী মৌলবী, মো. নাজিম উদ্দীন; শিহাড়া— ইব্রাহীম হোসেন, মো. সালেহ উদ্দীন, মো. ওমর আলী, মো. চয়েন উদ্দীন, মো. মোমের আলী, মো. লুৎফর রহমান, মো. আব্দুর রশিদ, মো. রমজান আলী, মো. ইয়াকুব আলী, মো. রুস্তম আলী, মো. জয়নাল আবেদীন, মো. আব্দুর রহমান, আব্দুস সালাম, মো. মনসুর আলী, মো. আব্দুল লতিফ, মো. সাদেকুল ইসলাম; নিৰ্মইল— মো. মোসলেম উদ্দীন (মসল), মো. আব্বাস আলী, মো. ইসমাইল হোসেন; মাটিন্দর- মো. লুৎফর রহমান, মো. আইজুল হক, মো. নেছমুল হক, মো. নূর জামান, মো. আব্দুল হামিদ, মো. আবুল কালাম, মো. মোজাফ্ফর হোসেন, মো. আবুল হোসেন, মো. হোসেন আলী, শিশ মোহাম্মদ, মো. আব্দুস সাত্তার; আমাইড়— তায়েব আলী (প্রধান), মো. বেলাল হোসেন, মো. রেজাউল করিম, মো. মোজাহার আলী, লুৎফর রহমান, মো. কফিল উদ্দীন, মো. খোকা, মো. ফরিদ, মো. দবির উদ্দীন, মো মজিবর রহমান, দোস্ত মোহাম্মদ; পাটিচরা- মো. গিয়াস উদ্দীন, মো. ইব্রাহিম হোসেন, মো. মজিবর রহমান; দিবর- মো. আফসার আলী (কমান্ডার), আলহাজ্ব ফয়েজ উদ্দীন, মো. ইব্রাহিম হোসেন, মো. খলিল উদ্দীন, মো. কছিম উদ্দী মো. ইব্রাহীম হোসেন, মো. ফজির উদ্দীন, মো. সোলাইমান আলী, মো. আশরাফ আলী, মো. সাদেক আলী, মো. মোস্তফা হোসেন, মো. আব্দুল রহমান, মো. ইসমাইল হোসেন (ভগু), মো. হুমায়ন কবির, মো. আব্দুল হক, মো. হিববর রহমান, মো. জয়নাল আবেদীন, মো. জাফর আলী, মো. আইজার রহমান; কৃষ্ণপুর- মো. আব্দুল মজিদ, মো. হাবিবর রহমান, মো. সুলতান দফাদার; ঘোষনগর- লুৎফর রহমান, মো. রমজান আলী, মো. খোকা, মো. জয়নাল আবেদীন, মো. কফির উদ্দীন, মো. আব্দুল গফুর মণ্ডল, মো. কফিল উদ্দীন, মোজাহার আলী, আতাব আলী এবং মো. খাজামদ্দিন। আলবদর বাহিনীর নেতৃস্থানীয়রা হলো- মো. আবু বক্কর সিদ্দিক, ডা. কামরুল আহসান বাবলু, মো. আজাহার আলী, মো. মোজাহার আলী, মো. ওবায়দুল ইসলাম, মো. ইব্রাহিম হোসেন, মো. সিরাজ উদ্দীন, মো. আইজার রহমান এবং মো. জাফর আলী। আলশামস বাহিনীর সদস্য ছিল মো. ইসমাইল হোসেন প্রমুখ। পাকবাহিনীর সঙ্গে মিলে এসব স্বাধীনতাবিরোধী এলাকায় হত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটায়। পাকবাহিনী নজিপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিস এবং চাঁদপুর, কাঞ্চন, মাহমুদপুর, আইয়াম ও ইছাপুর (আজমতপুর) গ্রামসহ হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চালায়। ৩০শে নভেম্বর পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা নির্মইল ইউনিয়নের হালিমনগরে প্রায় অর্ধশত আদিবাসীকে হত্যা করে, যা হালিমনগর গণহত্যা নামে পরিচিত।
পত্নীতলা উপজেলায় পাকবাহিনী নজিপুর উচ্চ বিদ্যালয়, পত্নীতলা থানা এবং ডাকবাংলো নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত। এসব স্থানে তারা তাদের দোসরদের সহায়তায় হত্যা, নির্যাতন ও নারীনির্যাতন চালাত। আত্রাই নদীর পাড়েও হত্যাকাণ্ড চলত।
পত্নীতলা উপজেলায় তিনটি বড় গণকবর রয়েছে। সেগুলো হলো— দুর্গাপুর গণকবর, হালিমনগর গণকবর ও দিবর দিঘি গণকবর। ১২ই অক্টোবর দুর্গাপুর যুদ্ধে শহীদ পাঁচজনকে দুর্গাপুরে কবর দেয়া হয়। ৩০শে নভেম্বর হালিমনগর গণহত্যায় শহীদদের হালিমনগরে সমাহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকহানাদার ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যুদ্ধের এক পর্যায়ে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শত্রুর হাতে ধরা পড়েন। নির্যাতনের পর তাদের হত্যা করে মাঠে ফেলে রাখা হয়। পরবর্তীতে স্থানীয়রা তাঁদের দিবর দিঘির পাড়ে গণ করব দেয়। এছাড়া শিহাড়া ইউনিয়নের শিহাড়া বাজারের দক্ষিণ পাশে দুজন অজ্ঞাতনামা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, খাড়ির পাশে কয়েকজন আদিবাসী ও আকবরপুর ইউনিয়নের মধইল বাজারের ঈদগাহ মাঠের পশ্চিম পাশে একজন অজ্ঞাতনামা শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর এবং আমন্ত (পরানপুর) গ্রাম ও আমাইড় ইউনিয়নের গগনপুর আদিবাসী পাড়ায় গণকবর রয়েছে বলে জানা যায়।
পত্নীতলা উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। সুবিমল চন্দ্ৰ দাস নওগাঁর মহাদেবপুর, পত্নীতলা ও ধামইর হাট এলাকায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর বাহিনী মহাদেবপুর থানায় টেলিফোনের তার কেটে এবং বিভিন্ন স্থানে গুরুত্বপূর্ণ কালভার্ট-ব্রিজ ধ্বংস করে পাকবাহিনীর যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। গগনপুর নামক স্থানে রাস্তায় মাইন পুঁতে পাকবাহিনীর ট্রাক ও ভ্যানগাড়ি ধ্বংস করে দেয়। তাঁরই নেতৃত্বে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শিশুগ্রাম পাকক্যাম্প অপারেশন – পরিচালিত হয়। প্রায় ১১ ঘণ্টাব্যাপী এ-যুদ্ধে বহু পাকসেনা নিহত হয় এবং ক্যাম্পটি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। এ অপারেশনে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সন্তোষ কুমার দাস ৪১ জন গেরিলার একটি দল নিয়ে ভারতীয় সেনাদের সহযোগিতায় নওগাঁর মাতাজিহাট রাজাকার ক্যাম্প, খেলনা দিঘির পাড় রাজাকার ক্যাম্প এবং আগ্রাদ্বীগুন-রামচন্দ্রপুর পাকসেনা ক্যাম্প আক্রমণ করে সেগুলো ধ্বংস করে দেন। সুকুমার চন্দ্র দাস প্রথম অপারেশন পরিচালনা করেন পাগলা দেওয়ানে। এরপর ভোলাহাট থানায় গিয়ে সেখান থেকে মুশরি ভুজা-দলদলিয়ায় অপারেশন পরিচালনা করেন। কমান্ডার মো. সাদেক উদ্দীন আহম্মেদ ৭ নং সেক্টরের মেজর নুরুজ্জামানের অধীনে এবং ডা. আব্দুল খালেকের নেতৃত্বে নওগাঁর মহাদেবপুর, পোরশা, নিয়ামতপুর, সাপাহারসহ পত্নীতলার বিভিন্ন স্থানে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তাঁর নেতৃত্বে আলহাজ্ব আমজাদ হোসেন মজিবর রহমান (পাটিচরা, বর্তমান উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার), নাজিমুদ্দীন, আব্দুর রহিম, তাজীমুদ্দীন ও অবনী চন্দ্রসহ ১০ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে দেশে প্রবেশ করে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যান। একটি দল মাটিন্দর ও আকবরপুর ইউনিয়নে এবং অপরটি নজিপুরে অবস্থান নেয়। এরপর তাঁরা শিবপুর হাট রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে ক্যাম্পটি দখল করেন। ১২ই অক্টোবর আমাইড় ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। এতে দুজন মুক্তিযোদ্ধা ও তিনজন গ্রামবাসী শহীদ হন। অপরদিকে হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের কয়েকজন হতাহত হয়।
এটি দুর্গাপুর যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৭ই ডিসেম্বর পত্নীতলা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। কমান্ডার সাদেক উদ্দীন আহম্মেদ কমান্ডার মুজিবর রহমানসহ সহযোগী যোদ্ধাদের নিয়ে পত্নীতলা থানায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- কমলাকান্ত (পিতা শশীকান্ত, উত্তররামপুর; ১০ই জুলাই শহীদ), মোজাফ্ফর রহমান (পিতা ছয়েফ উদ্দীন মণ্ডল, বড়মহারন্দী; ১৩ই জুলাই শহীদ), আবু বক্কর সিদ্দিক (পিতা তছির উদ্দীন, আমাইপুকুর; ঐ), প্রতাপ চন্দ্র মহন্ত (পিতা প্রসন্ন কুমার মহন্ত, কাশিপুর; ঐ), লাল মোহাম্মদ (পিতা কছিম উদ্দীন, তকিপুর; ৫ই আগস্ট শহীদ), নইমুদ্দীন (পিতা চেকু মণ্ডল, উষ্টি; ২৫শে সেপ্টেম্বর শহীদ), আবুল কাশেম (পিতা ওসমান আলী, বড়মহারন্দী; ঐ), নূরুল ইসলাম (পিতা কমির উদ্দীন, মাটিন্দর; ঐ), ওমর আলী (পিতা মীর বক্স মণ্ডল, তকিপুর; ঐ), বাবুলাল মণ্ডল (পিতা কছিম উদ্দীন, মাটিন্দর; ঐ), মতিলাল বর্মণ (পিতা সুরেন্দ্রনাথ বর্মণ, মাটিন্দর; ঐ), নমির উদ্দীন (পিতা মংলু মণ্ডল, ছোটমহারন্দী; ঐ), মো. নজরুল ইসলাম (পিতা বশির উদ্দীন, ঘোষনগর; ১২ই অক্টোবর দুর্গাপুর যুদ্ধে শহীদ), মো. মফিজ উদ্দীন (পিতা দুখু মণ্ডল, কোতোয়ালী; ঐ), আব্দুল জব্বার (ছোটচাঁদপুর), তমিজ উদ্দীন (পিতা সামসুদ্দীন, তেপুকুরিয়া), আব্দুল মান্নান (পিতা কিবরিয়া, আমন্ত) এবং আশরাফ আলী (পিতা নজির উদ্দীন, আবাদপুর)।
নজিপুর সাপাহার সড়কে আত্রাই নদীর ওপর শহীদ আবু বক্কর সিদ্দিক এবং শহীদ প্রতাপ চন্দ্র মহন্তর নামে সিদ্দিক- প্রতাপ সেতু নির্মিত হয়েছে। নজিপুর পুরাতন বাজার থেকে চকনিরখীন মোড় পর্যন্ত সড়কটি শহীদ আব্দুল জব্বার এবং নজিপুর গার্লস স্কুল থেকে নতুনহাট পর্যন্ত সড়কটি শহীদ আব্দুল মান্নানের নামে নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া হালিমনগর গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে হালিমনগর স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। [বুলবুল চৌধুরী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!