You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.26 | নোয়াপুর গণহত্যা (চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা) - সংগ্রামের নোটবুক

নোয়াপুর গণহত্যা (চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা)

নোয়াপুর গণহত্যা (চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা) সংঘটিত হয় ২৬শে জুলাই। এদিন একই পরিবারের ৪ জনসহ মোট ৭ জনকে হত্যা করে দখলদার হানাদাররা।
নোয়াপুর চৌদ্দগ্রাম উপজেলার চিওড়া ইউনিয়নের ভারত সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম। কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় ৩৬ কিলোমিটার এবং চৌদ্দগ্রাম থানা থেকে ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে গ্রামটি অবস্থিত। নোয়াপুরের উত্তরে পাথড্ডা, দক্ষিণে চিওড়া ও চরপাড়া, পূর্বে সুজাতপুর এবং পশ্চিমে রামপুর গ্রাম। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চৌদ্দগ্রাম থানা অংশ থেকে আমজাদের বাজার স্টেশন পার হয়ে সুজাতপুর রাস্তার মাথা। সুজাতপুর রাস্তার মাথা থেকে এক কিলোমিটার পশ্চিমে গেলেই নোয়াপুর মজুমদার বাড়ি। এ বাড়িতেই গণহত্যাটি সংঘটিত হয়।
মজুমদার বাড়ির লোকজন ছিল রাজনীতি-সচেতন। এ বাড়ির অনেকেই আওয়ামী লীগ-এর রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এ বাড়ির মফিজুর রহমান বাবলু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী একজন ছাত্রনেতা এবং তোফায়েল আহমেদের কমিটিতে ডাকসুর একজন সদস্য। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনিসহ মজুমদার বাড়ির বেশ কয়েকজন ছাত্র-যুবক ভারতে যান এবং সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
মফিজুর রহমান বাবলুর মামা কাজী জহিরুল কাইয়ুম ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। তিনি ন্যাশনাল এসেম্বলির মেম্বারও ছিলেন। পরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি হন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কাজী জহিরুল কাইয়ুম মাঝে-মাঝে চৌদ্দগ্রামে যেতেন স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করার জন্য। তাঁর বাড়ি ছিল নোয়াপুরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম চিওড়ায়। নিরাপত্তার কারণে তিনি নিজ বাড়িতে অবস্থান করতেন না। থাকতেন বোনের শ্বশুর বাড়ি মজুমদার বাড়িতে। ২৬শে জুলাইয়ের কয়েকদিন আগে তিনি মজুমদার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। স্থানীয় রাজাকাররা এ খবর চৌদ্দগ্রাম থানার পাকিস্তানি আর্মিদের জানিয়ে দেয়। হানাদার বাহিনীর রাজাকারদের সহযোগিতায় ২৬শে জুলাই মজুমদার বাড়িতে গিয়ে গণহত্যা চালায়।
ঘটনার দিন দুপুর বেলা কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নোয়াপুর গ্রামে হানা দেয় পাকিস্তানি আর্মিরা। গ্রামে ঢুকেই তারা প্রথমে মন্তু মিয়া নামে একজনকে হত্যা করে। এরপর তারা মজুমদার বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং ঐ বাড়ি থেকে ৪ জনকে আটক করে। তারা হলেন- মাস্টার আব্দুল খালেক মজুমদার, নুরুল আলম মজুমদার, আমিনুর রহমান মজুমদার ও মাস্টার শফিকুর রহমান মজুমদার। আমিনুর রহমান মজুমদার ও মাস্টার শফিকুর রহমান মজুমদার ছিলেন আপন ভাই। বাকিরা চাচাতো ভাই।
ঐদিন বিকেল ৩টার দিকে এই ৪ জনকে মজুমদার বাড়ির পুকুরপাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি আর্মিরা। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কয়েক বছর আগে ফেনীর গোলাম হোসেন নামে এক কলেজছাত্র মজুমদার বাড়িতে লজিং থাকতেন। লেখাপড়া শেষে তিনি মুক্তিযুদ্ধের আগের বছর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসেন। কিন্তু ফেনীর নিজ বাড়িতে অবস্থান করা নিরাপদ নয় ভেবে গোলাম হোসেন মজুমদার বাড়িতে আশ্রয় নেন এবং মনস্থির করেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার। ২৬শে জুলাই তিনিও গণহত্যার শিকার হন। গণহত্যা চালানোর সময় মজুমদার বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল রফিকুল ইসলাম নামে এক কৃষক। তাকেও গুলি করে হত্যা করে হানাদাররা। পরে সন্ধ্যার দিকে স্থানীয়রা শহীদদের মৃতদেহ দাফন করে।
নোয়াপুর গণহত্যায় শহীদরা হলেন- মাস্টার আব্দুল খালেক মজুমদার (পিতা ফজলুর রহমান মজুমদার, নোয়াপুর), নুরুল আলম মজুমদার (পিতা (পিতা হোসেন আলী মজুমদার দারোগা, নোয়াপুর), আমিনুর রহমান মজুমদার (পিতা শওকত আলী মজুমদার, নোয়াপুর), মাস্টার শফিকুর রহমান মজুমদার (পিতা শওকত আলী মজুমদার, নোয়াপুর), মাস্টার গোলাম হোসেন (সদি, ফেনী), মন্তু মিয়া (পিতা লাল মিয়া, নোয়াপুর) এবং রফিকুল ইসলাম (নারায়ণকড়া, চৌদ্দগ্রাম)।
২০০৭ সালে নোয়াপুর গণহত্যায় শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার স্থানের পাশে নোয়াপুর শহীদ স্মৃতি পাঠাগার ও মিলনায়াতন নির্মাণ করা হয়। এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. আনোয়ারুল ইকবাল। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে কুমিল্লা জেলা পরিষদ। প্রকল্পের জন্য জমি দান করে শহীদ শফিকুর রহমান মজুমদারের পরিবার। [বাশার খান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড