You dont have javascript enabled! Please enable it! ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী (কুমিল্লা আদর্শ সদর) - সংগ্রামের নোটবুক

ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী (কুমিল্লা আদর্শ সদর)

ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী (কুমিল্লা আদর্শ সদর) মুক্তিযুদ্ধের একটি বিশেষ বাহিনী। এ বাহিনীর সদস্যরা দেশের অভ্যন্তরে এবং ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন।
১৯৭১ সালের ২রা মার্চ অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে ছাত্র ইউনিয়ন-এর উদ্যোগে পাড়া-মহল্লা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয় প্রথমে শরীরচর্চা ও ডামি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। পরে ঢাকার উপকণ্ঠে সাভার ও বেরাদিয়ায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। দেশের অন্যত্রও ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়।
২৫শে মার্চের কালরাতের পর কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে প্রথমে ঢাকায় এবং পরে নরসিংদীর রায়পুরায় বসে যুদ্ধে কৌশলগত পশ্চাদপসরণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এতে ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র সংগঠনের ছাত্র-যুবকদের একাংশকে দেশের অভ্যন্তরে রাখার এবং বৃহৎ অংশকে প্রথমে মুক্তাঞ্চল এবং পরে ভারতে পাঠানোর পরিকল্পনা করা হয়। দেশের বাইরে সীমান্ত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের জমায়েত এবং থাকার জন্য বেশ কয়েকটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। সেসব ক্যাম্পে সামরিক প্রশিক্ষণের পূর্বপ্রস্তুতিমূলক প্রশিক্ষণ ছাড়াও রাজনৈতিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়। ক্যাম্পগুলো হলো- ত্রিপুরা: ক্রাফট হোস্টেল, কর্তাবাড়ি, বড় দোয়ালী স্কুল, আগরতলার সন্নিকটস্থ পাহাড়ি এলাকা, সোনামুড়া, গোকুলনগর ও ধর্মনগর (অস্থায়ী); আসাম: করিমগঞ্জ হিন্দু স্কুল ও ব্যালট; মেঘালয়: তুরা ও বারেঙ্গা পাড়া; পশ্চিমবঙ্গ : অশোকনগর, গঙ্গারামপুর, বালুরঘাট, মানিক নগর ও বশির হাট। এসব ক্যাম্প থেকে এফএফ মেরিন কমান্ডোসহ বিভিন্ন বাহিনীতে ৪০০০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা পাঠানো হয়। আসামের তেজপুরে ডেল্টা সেক্টরের অধীনে বিশেষ গেরিলা বাহিনীতে প্রশিক্ষণের জন্য ১৫০০ জনের মতো সদস্য পাঠানো হয়। প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষণ কমান্ডার ছিলেন ওসমান গনি, দ্বিতীয় ব্যাচে মনজুরুল আহসান খান এবং তৃতীয় ব্যাচে গোলাম মর্তুজা খান। প্রশিক্ষণের পর গেরিলা যোদ্ধাদের আগরতলার বাইখুরায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়। পরে ১০০০ জনের মতো গেরিলা যোদ্ধাকে দেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হয়। দেশের বিভিন্ন মুক্ত এলাকায়ও গেরিলাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। সেসব এলাকার মধ্যে মানিকগঞ্জে ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বে এবং রায়পুরায় আব্দুল হাই, শামসুল হক, ইদ্রিস হাওলাদার এবং জাহের চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুক্ত এলাকায় প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৫০০০ জন। সামগ্রিক কাজ পরিচালনার জন্য নেতা ও সংগঠক ছিলেন আনুমানিক ১০০০ জন। গেরিলা বাহিনীতে নারী সদস্য ছিলেন আনুমানিক ৫০০ জন। ১৭ই ডিসেম্বর সকাল ১০টায় ঢাকার নবাবগঞ্জ এলাকা থেকে ঐ অঞ্চলের গেরিলারা একত্রিত হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেন এবং পাকবাহিনী কর্তৃক ধ্বংসকৃত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে প্রথম শপথ গ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বলাই-এর ক্যান্টিনে গেরিলা বাহিনীর অফিস স্থাপিত হয় এবং সায়েন্স এনেক্স বিল্ডিং-এ গেরিলারা অবস্থান নেন। অন্যান্য এলাকার গেরিলা যোদ্ধারাও স্ব-স্ব জেলা, মহকুমা ও থানা সদরে প্রবেশ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১৭ই জানুয়ারি অস্ত্র জমা দেয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানালে ৩০শে জানুয়ারি ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা কমান্ডের পক্ষ থেকে দেশব্যাপী অস্ত্র জমা দেয়া হয়। ঢাকা সদর এবং নারায়ণগঞ্জ মহকুমার গেরিলারা ঢাকা স্টেডিয়ামে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দেন। অন্যান্য অঞ্চলের গেরিলারা নিজ-নিজ মহকুমা হাকিমের কাছে অস্ত্র জমা দেন। ঢাকা স্টেডিয়ামের অনুষ্ঠানে যেসব অস্ত্র ও গোলা-বারুদ জমা দেয়া হয়, সেগুলোর মধ্যে ছিল- ৩০৩ রাইফেল ২৬৩টি, এলএমজি ১০টি (প্রতিটির সঙ্গেএক্সট্রা ব্যারেল), স্ট্যান্ডগান ৩৯টি, এসএলআর ৬টি, হান্ড গ্রেনেড ২৩১টি (৩৬টি হাই এক্সপ্লোসিভ), এইচএমজি ১টি, জিএফ রাইফেল ২টি, মর্টার ১টি, টিয়ার গ্যাস রাইফেল ১টি, এসকেএস ৭টি, সিটিএন ৭০ বক্স, বান্ডালিয়ান্স ৩৬৫টি (প্রতিটি ৫০ রাউন্ড), এলএমজি ১০১টি, জিসি ৩টি, মর্টার শেল (২২ ইঞ্চি) ১৭ পাইল (প্রতিটিতে ৩টি করে), এইচএমজি (রাউন্ড) ৬ বক্স, ফ্লিং বক্স ৮৭টি, ওয়ারলেস এরিক্সল ১টি এবং খুচরা রাউন্ড ও অন্যান্য বিস্ফোরক। [হিলাল ফয়েজী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড