পঁচিশ মাইল যুদ্ধ (বীরগঞ্জ, দিনাজপুর)
পঁচিশ মাইল যুদ্ধ (বীরগঞ্জ, দিনাজপুর) সংঘটিত হয় ৫ ও ৬ই ডিসেম্বর। পাকবাহিনী ও যৌথবাহিনীর মধ্যেকার এ-যুদ্ধে উভয় পক্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে। তবে শেষ পর্যন্ত পাকবাহিনী পালিয়ে যায় এবং যৌথবাহিনী বীরগঞ্জ দখল করে।
দিনাজপুর-পঞ্চগড় মহাসড়কের বীরগঞ্জ থেকে প্রায় ১৫। কিলোমিটার উত্তরে এবং ঠাকুরগাঁও থেকে ১৭ কিলোমিটার – দক্ষিণে পঁচিশ মাইল নামক জায়গাটি অবস্থিত। দিনাজপুর থেকে এর দূরত্ব পঁচিশ মাইল হওয়ার কারণে এ নাম। স্থানটি – বীরগঞ্জ উপজেলার ৯নং সাতোর ইউনিয়নের প্রাণনগর গ্রামের অন্তর্ভুক্ত। এখানে নিয়মিত যাত্রীবাহী বাস থামার কারণে একটি বাজার গড়ে উঠেছে। বেশকিছু দোকানপাট হয়েছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় জায়গাটি এরকম ছিল না। লোকজনের বসবাসও ছিল কম।
পঁচিশ মাইলের কাছাকাছি বিহারিদের একটি কলোনি ছিল, যা ৫নং কলোনি নামে পরিচিত ছিল। এখানে বিহারিদের শতাধিক পরিবার বসবাস করত। এছাড়া নিকটবর্তী চৌপুকুরিয়া, দগড়াই খাটিয়াদিঘি এবং মরিচা গ্রামেও জনবসতি ছিল। এসব গ্রামে বেশকিছু বিহারি পরিবারের বসবাস ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানকার বিহারি রাজাকার সোনা মিয়া, আফজাল, আখতার, আশরাফ প্রমুখ পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় ব্যাপক গণহত্যা চালায়।
পঁচিশ মাইল থেকে অর্ধ কিলোমিটার দক্ষিণে নর্ত নদীর ওপর নির্মিত কুটিরপুল সেতু বীরগঞ্জের সঙ্গে ঠাকুরগাঁওর সড়ক যোগাযোগ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডিসেম্বর মাসে যৌথবাহিনীর অগ্রযাত্রা ঠেকানোর লক্ষ্যে পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকাররা কুটিরপুল সেতু ভেঙ্গে দিয়ে পুলের এক-দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে বটতলী নামক স্থানে অবস্থান নেয়। অপর দিকে মিত্রবাহিনী পুলের উত্তরে পঁচিশ মাইলসহ প্রাণনগরের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেয়। ৩রা ডিসেম্বর যৌথবাহিনী পঞ্চগড়ের বোদা থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে অগ্রসর হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিনা যুদ্ধে পিছিয়ে গেলে ঠাকুরগাঁও শত্রুমুক্ত হয়। এদিন রাতেই মিত্রবাহিনী ঠাকুরগাঁও থেকে ৫ কিমি দূরে বীরগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়ে একটি সেগুন বাগানের ভেতর অবস্থান নেয় এবং শত্রুবাহিনীর ওপর হামলার নতুন পরিকল্পনা তৈরি করে। অপরদিকে পাকিস্তানি বাহিনী সেগুন বাগান থেকে প্রায় ১২- ১৩ কিলোমিটার দূরে পঁচিশ মাইল এলাকায় ডিফেন্স নিয়ে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করে। ৫ই ডিসেম্বর আর্টিলারি বাহিনী নিয়ে মিত্রবাহিনী আরো সামনের দিকে অগ্রসর হয়। পঁচিশ মাইলে অবস্থান নেয়া পাকসেনারা প্রবল প্রতিরোধের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় এবং নর্ত নদী পার হয়ে পিছিয়ে যায়। এসময় তারা যৌথ বাহিনীর অগ্রযাত্রা ঠেকাতে নদীর ওপর কুটিরপুল সেতু ভেঙ্গে দেয়। ৬ই ডিসেম্বর খোচাবাড়ি হয়ে বীরগঞ্জের কবিরাজ হাটের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় নর্ত নদীর পাড়ে যৌথবাহিনী প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়। পাকিস্তানি বাহিনী নর্ত নদীর দক্ষিণে বটতলীসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ট্যাংক ও কামানসহ অবস্থান নেয়। পক্ষান্তরে যৌথবাহিনী পঁচিশ মাইলসহ বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেয়।
৬ই ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর ইঞ্জিন কোর ক্ষতিগ্রস্ত কুটিরপুল মেরামত করে। এরপর তাঁরা আর্টিলারি হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ট্যাংক ও কামান ধ্বংস করে এগিয়ে যেতে থকেন। এদিন মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর বিমান হামলাও চালানো হয়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস হয়ে আসে এবং তারা পালিয়ে যেতে থাকে। মিত্রবাহিনী ক্রমেই কবিরাজ হাট হয়ে বীরগঞ্জের দিকে এগিয়ে যায় এবং বীরগঞ্জ দখল করে নেয়। এ-সময় উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। উভয় পক্ষে হতাহতের ঘটনাও ঘটে। যৌথবাহিনীর ক্রম অগ্রাভিযানে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বিহারিরা সৈয়দপুরে পালিয়ে যায়। দুজন রাজাকার ধরা পড়লে মুক্তিবাহিনী তাদের হত্যা করে। [আজহারুল আজাদ জুয়েল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড