মুক্তিযুদ্ধে পঞ্চগড় সদর উপজেলা
পঞ্চগড় সদর উপজেলা ১৯৭১ সালে পঞ্চগড় জেলা ছিল না। তখন পঞ্চগড় ছিল বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার অন্তর্গত একটি থানা। সঙ্গত কারণেই এ উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলির সঙ্গে ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলা সদরের ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততা ছিল।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের রায় বানচাল করতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নানা ষড়যন্ত্র শুরু করলে সারা দেশের ন্যায় ঠাকুরগাঁও মহকুমার প্রতিটি থানা শহর গর্জে ওঠে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরু থেকেই শহরের পাশাপাশি দূরবর্তী জনপদসমূও উত্তাল হতে থাকে। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র-জনতার সমাবেশে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন এবং ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠের খবর এখানকার ছাত্র-জনতার মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। কেন্দ্রীয়ভাবে গৃহীত প্রতিটি কর্মসূচি পঞ্চগড় সদরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে পালিত হতে থাকে। নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য মোশাররফ হোসেন চৌধুরী, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম ও কমর উদ্দীন আহমেদসহ স্থানীয় সংগঠক ও সমমনা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দিকনির্দেশনায় ছাত্র- জনতা স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের খবর সারা দেশের মতো এ অঞ্চলেও বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ে। থানায়-থানায় গড়ে ওঠে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও জয় বাংলা বাহিনী। আওয়ামী লীগ – এ-সকল সংগঠনের মূল দায়িত্বে থাকলেও কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ-সহ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, বিভিন্ন যুব সংগঠন ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ- সময় আন্দোলনের কর্মসূচি সঠিকভাবে এগিয়ে নেয়ার জন্য বিভিন্ন থানায় কতিপয় অগ্রণী নেতা-কর্মী এসব সংগঠনের সভাপতি, সম্পাদক, আহ্বায়ক, সদস্য-সচিব অথবা মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেন। জাতীয় পরিষদ সদস্য মোশাররফ হোসেন চৌধুরী তাঁর নির্বাচনী এলাকার পঞ্চগড় সদর উপজেলা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে উপস্থিত থেকে জনগণকে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। চলমান এ সংগ্রাম দেশপ্রেমিক প্রতিটি দল ও মানুষের অংশগ্রহণে সর্বজনীন সংগ্রামে পরিণত হয়। সবদলীয় সংগ্ৰাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন কমর উদ্দিন আহমেদ এমপিএ এবং সম্পাদক ছিলেন এডভোকেট বশিরুল আলম। ছাত্র সংগ্ৰাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন তৈয়ব হোসেন ও সম্পাদক ছিলেন নাজিম উদ্দীন আহম্মদ। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর আহ্বায়ক ছিলেন গোলাম মোস্তফা প্ৰধান।
মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন-এর তীব্রতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকায় পাকিস্তানি প্রশাসন কার্যত অচল হয়ে পড়ে। সারা দেশের মতো পঞ্চগড়েও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে থাকে। কোনো-কোনো সাংগঠনিক দপ্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতা পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। পঞ্চগড় শেরে বাংলা পার্ক এবং পঞ্চগড় থানা চত্বরে ছাত্রনেতা নাজিম উদ্দীন আহম্মদ এবং এস এম লিয়াকতের নেতৃত্বে বিপুল ছাত্র-জনতার ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়। আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন মিজানুর রহমান বাবলু, রেজাউল ইসলাম প্রমুখ।
পঞ্চগড় সদরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা হলেন- আওয়ামী লীগের এডভোকেট বশিরুল আলম, এডভোকেট সামসুজ্জোহা, আব্দুল হামিদ খান, এস এম নুরুল হক, আনোয়ার হোসেন সরকার, ইয়াছিন আলী, মোজাম্মেল হক বসুনিয়া, মো. সুলতান মোহাম্মদ হাদু, হাবিবুর রহমান, খবিরউদ্দিন আহাম্মদ, গোলাম মোস্তফা প্রধান, আব্দুল জব্বার, মজিবর রহমান তহশিলদার, দাহিরউদ্দিন আহম্মদ, হেলাল উদ্দিন, বাঘা কমান্ডার, আমিরুল ইসলাম, আব্দুল জলিল মাস্টার, জহিরুল প্রধান প্রমুখ; ন্যাপের আব্দুস সোবহান, আবু আরেফ, আব্দুল জব্বার, দেলোয়ার হোসেন সরকার প্রমুখ; ছাত্রলীগের নজিম উদ্দীন আহম্মদ, এস এম লিয়াকত আলী, শামসুজ্জোহা খন্দকার রবি, এনামুল হক, আব্বাস আলী, নুরুল ইসলাম, আব্দুল মজিদ বাবুল, জহিরুল ইসলাম, সায়খুল ইসলাম, ইউসুফ আলী বাবু, মোখলেছুর রহমান মিন্টু, রেজাউল করিম বসুনিয়া, আব্দুস সাত্তার, আব্দুল ওয়াদুদ প্রমুখ।
বিভিন্ন নিয়মিত বা আধাসামরিক বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সেনাসদস্য এবং সাধারণ ছাত্র-জনতাই ছিল সংগ্রামের মূল শক্তি। সুসজ্জিত পাকবাহিনীকে মোকাবেলা করার কোনো সশস্ত্র পূর্বপ্রস্তুতি তখন পর্যন্ত ছিল না। তবে প্রতিরোধযুদ্ধ যখন অনিবার্য হয়ে ওঠে, তখন জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অস্ত্রপ্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। স্থানীয় পর্যায়ে পরিচালিত এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনা, পুলিশ ও আনসার সদস্য প্রশিক্ষকের ভূমিকা পালন করেন। পঞ্চগড় থানা সদরে সংগ্রাম পরিষদের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় অস্ত্র প্রশিক্ষণ। থানা প্রাঙ্গণ ও পার্শ্ববর্তী ঈদগাহ মাঠে দলে-দলে ছাত্র-যুবকরা এ প্রশিক্ষণে অংশ নেন। এখানে প্রশিক্ষক ছিলেন সাবেক সেনাসদস্য আব্দুর রশিদ, ফাহিম উদ্দীন ওরফে ফই কমান্ডার, আব্দুল মজিদ এবং আনসার কমান্ডার হেলাল উদ্দিন। পঞ্চগড় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুস সামাদ প্রশিক্ষণ কার্যে সার্বিক সহযোগিতা করেন। থানা এবং আনসারদের হেফাজতে থাকা বেশকিছু রাইফেলস প্রশিক্ষণ কাজে ব্যবহৃত হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা ও রংপুর জেলার কিছু এলাকা নিয়ে গঠন করা হয় ৬নং সেক্টর। এর কমান্ডার ছিলেন এম কে বাশার। তিনি সর্বউত্তরের মুক্তাঞ্চল তেঁতুলিয়ায় বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। এ-সময় কমান্ডিং অফিসার হিসেবে সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন, ক্যাপ্টেন নজরুল প্রমুখ পঞ্চগড় অভিমুখী যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধ পরিচালনার কাজকে সুসংহত করতে ৬নং সেক্টরকে ভাগ করে তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড়, বোদা, দেবীগঞ্জ, আটোয়ারী, ঠাকুরগাঁও ও খানসামা থানা নিয়ে সাব-সেক্টর ৬/এ গঠিত হয়। এ সাব-সেক্টরের কমান্ডিং অফিসার নিযুক্ত হন সুবেদার মেজর কামিজ উদ্দিন। এর আওতাভুক্ত চারটি কোম্পানি ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’ ও ‘ডি’-র কমান্ডার নিযুক্ত হন যথাক্রমে সুবেদার হাফিজ উদ্দিন, সুবেদার খালেক, সুবেদার মুরাদ আলী এবং সুবেদার আবুল কাশেম। পাকবাহিনীর সর্বউত্তরের ঘাঁটি অমরখানা ও জগদলের আওতাভুক্ত বিভিন্ন একালাকে কেন্দ্র করে এ কোম্পানিগুলোর যুদ্ধ পরিকল্পনা সাজানো হয়। এদিকে ভারতের প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকার মুরতি প্রশিক্ষণ শিবির থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইউনিটগুলো জুন মাসের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে রণাঙ্গনে প্রবেশ করতে থাকে এবং যুদ্ধ পরিচালনায় নতুন মাত্রা লক্ষ করা যায়। ৬/এ সাব-সেক্টরের আওতায় পঞ্চগড়ের বিভিন্ন সীমান্তে যে-সকল গেরিলা ইউনিট যুক্ত হয়, সেগুলোর মধ্যে অমরখানার নিকটবর্তী চাউলহাটি ইউনিট ভিতরগড়, মণ্ডলহাট, তালমা, শালমারা, মহারাজা দিঘি, মধুপাড়া, সোনারবান, হাড়িভাসা এসব এলাকায় অনেকগুলো সফল অপারেশন পরিচালনা করে। প্রধানত ছাত্র ও যুবকদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এ গেরিলা ইউনিটে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন নুরুল হক ও মাহবুব আলম। অন্য দুটি ইউনিট হলো শহরের পশ্চিমে মীরগড় সীমান্তবর্তী থুকরাবাড়ি ইউনিট এবং পঞ্চগড়ের পূর্বে চিলাহাটি সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকায় হেমকুমারী ইউনিট। হেমকুমারী ইউনিটের কর্ম এলাকা মূলত পঞ্চগড় সদরের বাইরে ছিল। থুকরাবাড়ি ইউনিটের গেরিলারা পঞ্চগড় সদরের পশ্চিম অংশে বহু সফল অপারেশন পরিচালনা করেন। এ ইউনিটে বিভিন্ন পর্যায়ে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন তরিকুল আলম, আবু তাহের ও শামসুল আলম।
বিভিন্ন বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র, নিশ্চিহ্ন অথবা অকার্যকর করা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অন্যতম লক্ষ্য। বৃহত্তর দিনাজপুরের ক্ষেত্রেও একই নীতি অনুসরণ করা হয়। মার্চের শুরু থেকেই এ অঞ্চলের বাঙালি সেনাদের কাছে পশ্চিমা ষড়যন্ত্র স্পষ্ট হতে থাকে। দ্বিধাগ্রস্ততা কাটিয়ে তাঁরা দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়ে ওঠেন। তাঁরা বুঝে নেন- হয় বিদ্রোহ, নয়ত মৃত্যু, মাঝামাঝি কোনো পথ নেই৷ তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড়, বোদা, আটোয়ারী দেবীগঞ্জসহ পার্শ্ববর্তী অন্যান্য থানায় হাজারো মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে তখন চরম উত্তেজনা। সর্বউত্তরের এই থানাগুলোতে সে-সময় জেলা সদর দিনাজপুর এবং মহকুমা সদর ঠাকুরগাঁওএর ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সে কী ঘটে, তা নিয়ে ছিল ব্যাপক কৌতূহল। অবশেষে সেই অনিবার্য সময় আসে। ঠাকুরগাঁও ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সে ২৮শে মার্চ রাত ১০টার পর বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করে পশ্চিমা সেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাঙালি সেনাদের কাছে আগেই খবর ছিল যে, ঐ রাতে তাঁরা আক্রান্ত হতে পারেন। ফলে আক্রান্ত হবার আগেই তাঁরা শত্রুদের আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ২৮শে মার্চ থেকে ৩০শে মার্চ পর্যন্ত বাঙালি সেনাদের হাতে বহু পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। ইপিআর ৯ম উইং ঠাকুরগাঁওএর উইং কমান্ডার ছিল পাঞ্জাবি মেজর মোহাম্মদ হোসেন এবং সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিল ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম। মেজর মোহাম্মদ হোসেন ৩০শে মার্চ বেলা ৩টা নাগাদ তার কোয়ার্টারে নিহত হয়। ক্যাপ্টেন নাবিদ সপরিবারে সৈয়দপুর সেনা ছাউনিতে পালিয়ে যাওয়ার সময় ঠাকুরগাঁও থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে খোঁচাবাড়ি এলাকায় জনসাধারণের হাতে ধরা পড়ে। বিদ্রোহী বাঙালি সেনাদের হাতে সোপর্দ করা হলে তারও একই পরিণতি হয়। ইপিআর ঠাকুরগাঁওএর বাঙালি সেনাদের এ সাফল্য জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্ৰাণ সঞ্চার করে।
ইপিআর ৯নং ঠাকুরগাঁও শাখার অধীনে ৫টি কোম্পানি এবং ১টি সাপোর্ট প্লাটুন ছিল। হেডকোয়ার্টার্সে ছিল ‘ডি’ কোম্পানির কমান্ডার সুবেদার এম এ হাফিজ। ‘এ’ কোম্পানির অবস্থান ছিল রুহিয়ায়। এর কমান্ডার ছিল পাঞ্জাবি সুবেদার কালা খান। ‘বি’ কোম্পানি ছিল চিলাহাটিতে। একজন অবাঙালি বিহারি এর কমান্ডার ছিল। ‘সি’ কোম্পানি ছিল তেঁতুলিয়ায়। কমান্ডার ছিল পাঞ্জাবি 1 নায়েক সুবেদার মীর খান। পঞ্চগড়ে ছিল “ই” কোম্পানি।
কমান্ডার ছিল নায়েক সুবেদার আব্দুল খালেক। সীমান্ত জুড়ে ইপিআর ঠাকুরগাঁও উইং-এর আওতাধীন ৩৪টি বিওপি বা সীমান্ত ফাঁড়ি ছিল। এ-সকল ফাঁড়িতে কর্মরত পাকিস্তানি সেনাদের সকলেই ২৯শে মার্চ সংশ্লিষ্ট ফাঁড়ির বাঙালি সেনা এবং স্থানীয় জনসাধারণের হাতে নিহত হয়। ইপিআর ঠাকুরগাঁও উইংএর এ অপারেশনে ১১৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এর মধ্যে ইপিআর ১০৪ জন। অন্যদের মধ্যে সেনাবাহিনীর ৮ জন এবং বিমান বাহিনীর ৩ জন। এদের অধিকাংশই ছিল কমিশন, জুনিয়র কমিশন ও বা নন-কমিশন প্রাপ্ত অফিসার।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাদের বাঙালি নিধনের উত্তরে যে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়, ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের। পুলিশ সদস্যদের সাহসী প্রতিরোধ তার অন্যতম। জেলা, মহকুমা ও থানা শহরগুলোতেও পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যরা একইভাবে প্রতিরোধ সংগ্রামে যুক্ত হন। পঞ্চগড় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন খন্দকার আব্দুস সামাদ।। তিনি ঢাকায় সৈন্যদের অতর্কিত আক্রমণের খবর পেয়েই থানার ৫ জন অবাঙালি সিপাহিকে নিরস্ত্র করে ঠাকুরগাঁও জেলখানায় পাঠিয়ে দেন। থানার বাঙালি সিপাহিরা স্থানীয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেন। এপ্রিলের প্রথম দিকে থানা ক্যাম্পাসে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, ইপিআর ও পুলিশ একযোগে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কাজ করেন। এলাকার অন্যান্য থানা যথা— তেঁতুলিয়া, বোদা, দেবীগঞ্জ ও আটোয়ারীর পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যগণও স্থানীয় ছাত্র-জনতার সঙ্গে যোগ দেন।
প্রতিরোধ সংগ্রামকে বেগবান করতে প্রতিটি এলাকায় ছাত্র-জনতার সঙ্গে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ, ইপিআর, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যরা একযোগে কাজ করেন। সে-সময় পঞ্চগড় শহর সংলগ্ন করতোয়া নদীর ওপর লোহার তৈরি একটি পুরাতন সেতু ছিল। সেতুটির শহরসংলগ্ন অংশে নদীর পাড় ধরে স্থানীয় ছাত্র-জনতা একটি প্রতিরোধব্যূহ গড়ে তোলে। এর অংশ হিসেবে তৈরি করা হয় বেশ কিছু বাংকার। এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় পঞ্চগড় ইপিআর-এর দায়িত্বে নিয়োজিত সুবেদার হাশেমের। তত্ত্বাবধানে। পঞ্চগড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে চলমান কর্মকাণ্ড সমন্বয় করার জন্য একটি নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র খোলা হয়৷ বর্তমান জেলা পরিষদ ভবনের উত্তরে আইয়ুব খানের তথাকথিত বেসিক ডেমোক্রেসির চিহ্ন ‘বিডি হল’ নামে পরিচিত একতলা একটি ভবনে এ কেন্দ্র চালু হয়। এখানে টেলিফোন সংযোগ দিয়ে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ করার ব্যবস্থা নেয়া হয়। স্থানীয় নেতৃবৃন্দের প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় বিভিন্ন স্থানে ডিফেন্সের দায়িত্বে নিযুক্ত লোকজনসহ অগ্রবর্তী যোদ্ধাদের পরিবার-পরিজনদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর যোগান দেয়া। অস্ত্রের মজুদ বৃদ্ধি করার বিষয়টি ক্রমান্বয়ে সামনে চলে আসে। সঙ্গত কারণেই নেতৃবৃন্দ এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সম্ভাব্য সকল উপায়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। আওয়ামী লীগ নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলামসহ তখনকার ছাত্রনেতা নাজিম উদ্দিন আহমেদ প্রমুখের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন গুদাম ও ব্যক্তিবর্গের নিকট থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করে স্থানীয়ভাবে একটি রসদভাণ্ডার গড়ে তোলা হয়। রসদপত্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রের একাংশ স্টোররূপে ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন মাধ্যমে সংগৃহীত অস্ত্রশস্ত্রও এখানে সংরক্ষণ করা হয়।
প্রতিরোধযোদ্ধাদের অভিযানকে দেশের উত্তর ভূখণ্ডে সুসংহত করার ক্ষেত্রে বড় বাধা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সৈয়দপুর সেনা ছাউনি। ভারী অস্ত্রশস্ত্রের মজুদসহ সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর এ ঘাঁটি দখলে আনা সহজ ছিল না। তেঁতুলিয়া থেকে পঞ্চগড় হয়ে দক্ষিণগামী মহাসড়কটি দিনাজপুর পৌছানোর পথে ঠাকুরগাঁও, বীরগঞ্জ ও দশমাইল মোড় স্পর্শ করে। সৈয়দপুর-রংপুর সড়কটি এখানেই সংযুক্ত। দশমাইল মোড়টি এ অঞ্চলের প্রতিরোধযুদ্ধের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। তবে এ প্রধান রুট ছাড়াও অন্য বিকল্প রুটগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কেননা, সৈয়দপুর থেকে দশমাইলমুখী না হয়েও নীলফামারী-দেবীগঞ্জ হয়ে পঞ্চগড় পর্যন্ত চলাচল করা যায়। অন্যদিকে বীরগঞ্জ-খানসামা- দেবীগঞ্জ রুটটি ঠাকুরগাঁওকে বাইপাস করে চলাচলের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। ফলে এ রুটগুলোকে নিজেদের জন্য ব্যবহার উপযোগী রাখা এবং একই সঙ্গে শত্রুদের জন্য প্রতিকূল ও বিপদসংকুল করে রাখার বিষয়টিও মাথায় রেখে সে মোতাবেক ডিফেন্স সাজানো হয়।
৩০শে মার্চ রাতে পরবর্তী যুদ্ধের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা শুরু হয়ে যায়। এ গুরু দায়িত্ব বর্তায় সুবেদার মেজর কামিজ উদ্দিনের ওপর। সেনা ও জনতাও তাঁর ওপর ভরসা রাখে। কার্যত যুদ্ধপ্রস্তুতি ইতোমধ্যে একটি চলমান প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়। এর অংশ হিসেবে পঞ্চগড় ঠাকুরগাঁও হয়ে সৈয়দপুরগামী মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ ভাতগাঁও সেতুর সুরক্ষার জন্য দুই কোম্পানি সেনা ও এক কোম্পানি মুজাহিদ সমন্বয়ে সজ্জিত একটি বহর এদিন বিকেলেই পাঠানো হয়। এর নেতৃত্ব দেন সুবেদার আব্দুল খালেক। একইভাবে দেবীগঞ্জ রুটের সুরক্ষাকল্পে ‘সি’ কোম্পানিকে এক কোম্পানি মুজাহিদসহ প্রেরণ করা হয়। এর নেতৃত্ব দেন সুবেদার বদিউজ্জামান। ঠাকুরগাঁওয়ের পশ্চিমে শিবগঞ্জ বিমানবন্দরেও অনুরূপ ব্যবস্থা নেয়া হয়। সেনা ও জনতা এটিকে বিমান অবতরণের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত করে দেয়। এ-সময় উত্তরের বিস্তৃত সীমান্ত এলাকাকে পঞ্চগড় ও রুহিয়া এ দুটি সাব- সেক্টরে ভাগ করে সুবেদার আবুল কাশেম এবং নায়েক সুবেদার হাজী মুরাদ আলীকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সাব- সেক্টরগুলোর জন্য কিছু দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়, যথা- স্থানীয় মুজাহিদ ও আনসার সদস্যগণের সহযোগিতায় সীমান্ত রক্ষণাবেক্ষণ; সর্বসাধারণ ও সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ; মুজাহিদ ও আনসার বাহিনী পুনর্গঠনে এবং এলাকার স্বেচ্ছাসেবক ও ছাত্র-যুবকদের অস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান; প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা ও প্রয়োজনীয় বিষয়াদি সম্পর্কে সদর কার্যালয়কে অবগত করা; বন্ধুরাষ্ট্র থেকে প্রাপ্ত যে-কোনো সাহায্য-সামগ্রীর সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া যুদ্ধ ও রণাঙ্গন সম্পর্কিত কোনো তথ্য অন্যত্র প্রকাশ না করা।
২৫শে মার্চ এবং পরবর্তী দুই সপ্তাহ বৃহত্তর দিনাজপুরের জন্য ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল। ইপিআর ঠাকুরগাঁও ৯ম উইং এবং ইপিআর দিনাজপুর ৮ম উইং-এর বাঙালি সেনাদের দ্বারা সংঘটিত বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলাব্যাপী বাঙালি সেনা ও জনগণের এক অভূতপূর্ব জাগরণ ও সংহতি সৃষ্টি হয়। ২৮শে মার্চ ইপিআর উইং-এর বাঙালি সেনাদের বিদ্রোহে পশ্চিম পাকিস্তানি সকল সেনা নিহত হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২৯ ও ৩০শে মার্চের মধ্যে সীমান্ত ফাঁড়িসমূহে নিয়োজিত অন্যান্য পাকিস্তানি সেনাও জনতা ও বাঙালি সেনাদের হাতে প্রাণ হারায়। পাকিস্তানি সেনামুক্ত বৃহত্তর দিনাজপুরের উজ্জীবিত জনতার সার্বিক সহযোগিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি সেনারা সুসংগঠিত হয়ে এ অঞ্চলে পাকসেনাদের বড় ঘাঁটি সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট অভিমুখে অগ্রসর হতে শুরু করে। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন আধা – সামরিক মুজাহিদ ও আনসার বাহিনীর সদস্যবৃন্দ।। স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছাত্র-যুবক ও সাধারণ জনতাও পিছিয়ে থাকে না। সাধারণ অস্ত্র, নামমাত্র প্রশিক্ষণ, কিন্তু প্রতিটি মানুষের মনোবল যেন আকাশছোঁয়া।
কিন্তু বাঙালি সেনা ও উজ্জীবিত জনতার এ প্রতিরোধ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই সৈয়দপুর সেনাঘাঁটি থেকে ব্যাপক রণসজ্জা ও ধ্বংস পরিকল্পনা সহকারে পাকবাহিনী ভারী অস্ত্র-শস্ত্রসহ মুক্ত এলাকাসমূহ দখলে অগ্রসর হয়। বাঙালি সেনা ও জনতার প্রতিরোধও চলতে থাকে। কিন্তু ক্রমান্বয়ে একের পর এক এলাকা পাকবাহিনী দ্বারা অধিকৃত হয়। ১৫ই এপ্রিল ঠাকুরগাঁও শহরে পুনরায় পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরূপ সংকটময় সময়ে বাঙালি সেনারা পঞ্চগড় শহরের প্রান্তঘেঁষা করতোয়া ব্রিজকে কেন্দ্র করে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। একই সঙ্গে বিভিন্ন অবস্থান থেকে তাঁদের পরিবার- পরিজনদের সর্বোত্তরের থানা তেঁতুলিয়ায় সরিয়ে নেয়া হয়। সৈয়দপুর অভিমুখী বাঙালি সেনাদের অধিকাংশই ১৭ই এপ্রিল বিভিন্ন প্রতিরোধ স্থল ছেড়ে দিনাজপুর-পঞ্চগড় প্রধান সড়ক অথবা দেবীগঞ্জ হয়ে আসা বিকল্প সড়কপথে পঞ্চগড় পৌঁছান এবং প্রতিরোধযুদ্ধের নতুন পরিকল্পনা করেন। বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন বা আটকেপড়া যোদ্ধারাও ১৮ই এপ্রিল নাগাদ পঞ্চগড়ে এসে পড়েন। প্রধানত দেবীগঞ্জ-সাকোয়া সড়ককে প্রত্যাগমনের পথ হিসেবে বেছে নেয়া হয়। এবার পঞ্চগড়কে কেন্দ্র করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা শুরু হয়। অন্যদিকে প্রথমে ঠাকুরগাঁও তারপর পঞ্চগড় অভিযানের লক্ষ্যে পাকবাহিনী সামনে অগ্রসর হতে থাকে এবং ১৮ই এপ্রিল বোদা বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন সেতুর কাছে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ১৯শে এপ্রিল দুপুরে পঞ্চগড় শহরস্থ জেলা পরিষদ বাংলোয় সুবেদার মেজর কামিজ উদ্দিন তাঁর সঙ্গী কামান্ডারদের নিয়ে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আলোচনারত ছিলেন। ঠিক এ-সময় গোলার শব্দ শোনা যায় এবং আলোচনা স্থগিত হয়ে যায়। আশেপাশে প্রায় সর্বত্র শেল পড়তে থাকায় কমান্ডারগণ যার-যার মতো স্থান ত্যাগ করেন। গোলার আঘাতে একটি গাড়িতে আগুন লেগে যায়। এতে খানসামা যুদ্ধে আটককৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদ রক্ষিত ছিল। সুবেদার মেজর কামিজ উদ্দিন তাঁর গাড়িটি সরিয়ে নিতে সক্ষম হন। পঞ্চগড়-করতোয়া তীর ধরে গড়ে তোলা প্রতিরক্ষা স্থল থেকে হামলার জবাব দেয়া হয় এবং প্রায় পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী তা অব্যাহত থাকে। সুবেদার হাশেমসহ বেশ কয়েকজন এ-সময় আহত হন। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি ট্যাংকবহর আক্রমণে যোগ দিলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা শিথিল হয়ে পড়ে এবং বাঙালি যোদ্ধাদের আবারো পিছু হটে যেতে হয়। পঞ্চগড় শহর শত্রুবাহিনীর অধিকারে চলে যায়। পঞ্চগড় শহর থেকে আরো উত্তরে অগ্রসর হয়ে অমরখানায় পাকিস্তানি সেনারা শক্ত ঘাঁটি গড়ে। পঞ্চগড় ছেড়ে আসা প্রতিরোধযোদ্ধারা অবশিষ্ট মুক্ত এলাকাকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে না দিয়ে ভজনপুরস্থ করতোয়া সেতুর কাছে নতুন উদ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন। সুবেদার হাফিজ এবং নায়েক সুবেদার খালেকের নেতৃত্বে ২০শে এপ্রিল ভোর থেকে ঘাঁটি নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এ ঘাঁটি যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত টিকে ছিল।
পঞ্চগড় ও তেঁতুলিয়ার মধ্যবর্তী করতোয়া তীরবর্তী ভজনপুর বাজারের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত করতোয়া সেতুকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। ক্রমান্বয়ে তা দেশের সর্বোত্তরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়, কেননা পরবর্তী সময়ে মুক্তিবাহিনী ও -মিত্রবাহিনীর সেনারা এ প্রতিরক্ষা ঘাঁটি থেকেই পাকবাহিনী অধিকৃত এলাকাসমূহে ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ পরিচালনা করে।
এদিকে পঞ্চগড় শহরে প্রবেশ করার পরেই প্রতিহিংসায় উন্মত্ত পাকবাহিনীর তাণ্ডবলীলা শুরু হয়। বাজার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ শহরের এবং শহরতলীর অসংখ্য ঘরবাড়ি অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ভস্মীভূত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর প্রধান লক্ষ্যবস্তু হলেও, শহরের সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট কোনোকিছুই এ তাণ্ডবলীলা থেকে রক্ষা পায়নি। পঞ্চগড়ের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর পাকবাহিনী পঞ্চগড় থেকে তেঁতুলিয়া অভিমুখী সড়ক ধরে অমরখানা পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং এখানেই তাদের স্থায়ী ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে। তেঁতুলিয়াগামী প্রধান সড়কটি ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন হওয়ায় এলাকাটি পাকবাহিনীর চলাচল ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ধারণা করা হয়, কৌশলগত কারণেই পাকসেনারা তেঁতুলিয়া সদরের দিকে অগ্রসর হওয়ার ভাবনা পরিত্যাগ করে। ফলে পঞ্চগড়ের কিছু অংশসহ তেঁতুলিয়া থানার সমগ্র এলাকা মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই মুক্তাঞ্চল থেকে যায়। এ কারণেই তেঁতুলিয়া মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয়।
অধিকৃত পঞ্চগড় শহরের নিয়ন্ত্রণ সংহত করতে পাকবাহিনী ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এর অংশ হিসেবে অমরখানায় গড়ে তোলা হয় সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। পঞ্চগড় থেকে ১০ কিমি উত্তরের জগদল বাজারে গড়ে তোলা হয় দ্বিতীয় অগ্রবর্তী ঘাঁটি। অন্যদিকে পঞ্চগড় শহরকে ঘিরে স্থানে-স্থানে ক্যাম্প ও তল্লাশি চৌকি স্থাপন করা ছাড়াও নিয়মিত টহল জোরদার করা হয়। এসব স্থানের মধ্যে জেলা পরিষদ বাংলো, করতোয়া ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা, সার্কেল অফিসারের কার্যালয়, চিনিকল এলাকা, বি পি স্কুল, রুহিয়া মোড়, তালমা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
দেশের অন্যান্য স্থানের মতো পঞ্চগড়েও পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনসমূহের নেতা-কর্মীরা পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করে। তারা হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি অপরাধমূলক কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করে। পাকবাহিনী পঞ্চগড়ের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করলে এলাকার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল ও ব্যক্তিবর্গ এবং স্থানীয় অবাঙালি জনগোষ্ঠী নিজেদের কর্তৃত্ব প্রদর্শন, লুটপাট, বাড়িঘর দখল ইত্যাদি বিবেচনায় পাকবাহিনীর আস্থাভাজন হয়ে ওঠার জন্য তৎপর হয়। পাকবাহিনীও একদিকে আস্থাভাজন ব্যক্তিবর্গ সম্বয়ে শান্তি কমিটি গঠনের মাধ্যমে নিজেদের কর্মকাণ্ডকে স্থানীয় মানুষের কাছে পৌঁছাতে সচেষ্ট হয়, অন্যদিকে বিভিন্ন স্থাপনা, চেকপোস্ট ও চৌকির সুরক্ষাসহ প্রত্যন্ত এলাকায় চলাচলকারী পাকসেনাদের সহযোগী জনবল বৃদ্ধির প্রয়োজনে অনুগত যুবকদের সমন্বয়ে রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলে। শান্তি কমিটিতে পঞ্চগড় নতুনবস্তি নিবাসী হাজী ইসমাইল হক কমিটির সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করে। স্বাধীনতা উত্তরকালে সে দালাল আইনে অভিযুক্ত হয় [মামলার ক্রমিক নং ৯৩, ১৫৯ (রাজ) (৪) ফেব্রুয়ারি ১৯৭২]। শান্তি কমিটির সদস্যদের মধ্যে হাজী ইসমাইল হক, পীর মোহাম্মদ, চেরকু মুহুরি, আনোয়ার কসাই, সাকিম উদ্দীন মুন্সি, আজিজার রহমান, তবিবর রহমান, সাজেদার, নুর নবী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
পঞ্চগড় শহর এলাকার বাইরে বিভিন্ন ইউনিয়নেও পাকিস্তানপন্থী কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি পাকবাহিনীর সক্রিয় সহযোগীরূপে কাজ করে। তাদের মধ্যে ভিতরগড় এলাকার আব্দুস সামাদ, মীর খাঁন, অমরখানার বুধন মেম্বার, খালপাড়ার আফাজ মেম্বার, ভিতরগড় শালবাগানের জবান আলী, ঠাকুরপাড়া এলাকার মকবুল মেম্বার, সৈমত আলী, কালা, জগদলের আবুল হোসেন প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। পঞ্চগড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজনসহ হিন্দু সম্প্রদায় ও সন্দেহবশত আটক ব্যক্তিবর্গের ওপর পাকবাহিনীর নিত্যকার নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডে সক্রিয় সহযোগীরূপে যারা কাজ করে, তাদের মধ্যে চেরকু মুহুরি, আজিজার রহমান, সাজেদার রহমান, তবিবর রহমান, আনোয়ার কসাই প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
পঞ্চগড়ে পাকবাহিনীর বিভিন্ন পরিকল্পনা ও নানামুখী তৎপরতার প্রধান আস্তানা হয়ে ওঠে করতোয়া ব্রিজ সংলগ্ন জেলা পরিষদ বাংলো ও নিকটস্থ থানা ভবন। বিভিন্ন অভিযোগে আটককৃত শতশত নিরপরাধ মানুষের প্রহসনমূলক বিচারের কেন্দ্র ছিল এটি। তথাকথিত এ বিচার কাজে পাকবাহিনী একটি জুরি বোর্ডও গঠন করে। একজন সেনাকর্মকর্তাকে প্রধান করে গঠিত এ বোর্ডে স্থানীয়দের মধ্যে ছিল ইসমাইল হক, চেরকু মুহুরি, আব্দুস সামাদ, আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ।
পঞ্চগড়ে রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটির সদস্যরা হলো- চেরকু মুহুরি (পঞ্চগড়), আজিজার রহমান (সিংপাড়া), সায়িদার রহমান (সিংপাড়া), তবিবর রহমান (সিংপাড়া), আজিজার (টুনিরহাট), নাসির আলী (জালাসী), মো. গোলাম রসুল (পঞ্চগড়), নাসিরদ্দিন (জালাসী), শামসুল হক (পঞ্চগড়), আবুল কালাম (যতনপুকুরী), আলতাফ হোসেন (টুনিরহাট), আব্বাস আলী (টুনিরহাট), খোকা (বোয়ালমারী, কাজলদিঘি, টুনিরহাট), আইবুলহক (১৯) (লস্করপাড়া), শামসুদ্দিন (লস্করপাড়া), ত জ ম ল (লস্করপাড়া), মকবুল হােসেন (গলেহা), আহাদ আলী (তুলারডাঙ্গা, গলেহা), কালা আব্দুল (জগদল, গলেহা), বাংরু মো. (পঞ্চগড়), আ. সাত্তার (পঞ্চগড়), সফিয়ার রহমান (সিংপাড়া), আনছার আলী (গাড়াতিশাল), মছলিমউদ্দিন (খালপাড়া), শফিকুল ইসলাম (নতুনবস্তি ) মো. আ. করিম (ইসলামবাগ), আ. লতিফ (দ্বারিকামারী), মো. মজিবর রহমান (খালপাড়া), মো. আখতারুল হক (দর্জিপাড়া), মো. খাইরুল ইসলাম (খালপাড়া), পিয়ার মো. (খালপাড়া), আ. হামিদ (বলেয়াপাড়া), নজিবুল্লাহ হক (দলুয়াপাড়া), আব্বাস আলী (ঘটবর), মো. সলেমান (সিংপাড়া), নূরল ইসলাম (সিংপাড়া), উসমান আলী (ঘটবর), মো. আছিরদ্দিন (সিংপাড়া), আব্দুল আজিজ (বসুনিয়াপাড়া), কছিদ্দিন (খারিজা কাজলদিঘি), মকসুল সন (সরকারপাড়া), মো. জামুল হক (লস্করপাড়া), মো. ইসমাইল (সেওগ্রাপাড়া), আবু তালেব (ঘটবর), মো. শামসুদ্দিন (লস্করপাড়), মো. আব্দুল হাকিম প্রধান (ঘটবর), মখলেছুর রহমান (খালপাড়া), মো. খালেক (আমবাড়ি), আজিম উদ্দিন (বিশমনি), মো. হাফিজুল (চেছপাড়া), খলিলুর রহমান (তুলারডাঙ্গা), মো. জিল্লুর রহমান (মলানী বোদাপাড়া), মো. মকবুল হোসেন (ঝাকুয়াখালি), মো. শরিফউদ্দিন আহমদ (বলেয়াপাড়া), মো. নূরুল হক (ডাঙ্গাপাড়া), মো. শফিকুল ইসলাম (বলেয়াপাড়া), মো. আব্বাস আলী (বলেয়াপাড়া), মো. আ. বারেক (কায়েতপাড়া), মো. তরিকুল ইসলাম (নতুনবস্তী), আবু আলম (তুলারডাঙ্গা), মো. শাহু লাল, মো. নজরুল ইসলাম (সিংপাড়া), মো. আ. কাদের, মো. আনছার আলী (পঞ্চগড় বাজার), মো. আব্দুস সাত্তার (ইসলামবাগ), মো. আ. আজিজ (মলানীপাড়া), আইবুল হক (লস্করপাড়া), শফিজুর সুহম (বোয়ালমারী), মো. হাফিজুল হক, আইনুল হক, মো. তফিরদ্দিন, মো. রফিজদ্দিন, মকসেদ আলী (সিপাইপাড়া), মো. ইমান আলী, মো. ফজলুল হক, মো. রফিজুদ্দিন (টুনিরহাট), মো. আফজাল হোসেন (মিঠাপুকুর), মো. বেলালউদ্দিন (আরাজী শিকারপুর), মো. হাফিজুদ্দিন (মিঠাপুকুর), মো. তবিবর রহমান (মাগুড়া ধনিপাড়া), মো. আশরাফ আলী (ধাক্কামারা), এ কে এম সাইফুল ইসলাম (সিংপাড়া), মো. আবদুর রশিদ ((সিংপাড়া)), মো. এজাজুল হক (সাকোয়া প্রধানপাড়া), মো. আব্দুল হাদী (বোতলডাঙ্গা), মো. নজরুল হক (বলেয়াপাড়া), মো. নজিবুল্লাহ হক (দলুয়াপাড়া), মো. আব্দুল বাকী (খাসমহল), মো. আব্দুল আজিজ (বসুনিয়াপাড়া), মো. মজিবর রহমান (খালপাড়া), মো. কছিমদ্দিন (খারিজা কাজলদিঘি), মো. আখতারুল হক (দর্জিপাড়া), মো. আবুল হোসেন (বোয়ালমারী), মো. নজরুল হক (বলেয়াপাড়া), মো. আবুল কালাম (দলুয়াদারিকামারী), মো. তফিজদ্দিন (পানিহাগা), মো. সলিমউদ্দিন (তুলারডাঙ্গা), মো. জহিরুল আলম (ঘটবর) প্রমুখ।
পঞ্চগড় থানা সদরসহ অন্যান্য এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের রাজত্ব কায়েম করে এবং পরবর্তীতে এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। ১৯শে এপ্রিল পঞ্চগড় শহরে প্রবেশ করেই পাকবাহিনী পঞ্চগড় বাজারসহ নিকটবর্তী আবাসিক এলাকার বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। ফলে ছোট্ট শহরটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র চালু হয় জেলা পরিষদ বাংলো ও থানা ভবনে একে কেন্দ্র করে স্থানীয় সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে আটক, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটে, যা মুক্তিযুদ্ধকালীন পঞ্চগড়ের ইতিহাসের এক বেদনাদায়ক অধ্যায়রূপে স্বীকৃত।
পাকবাহিনী পঞ্চগড় অধিকার করার পর দ্রুত যে-সকল পদক্ষেপ নেয়, সেগুলো হলো- (ক) পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক কর্মীসহ স্থানীয় বিহারি ও অবাঙালি সম্প্রদায়েেক নিজেদের যাবতীয় কর্মতৎপরতায় সম্পৃক্ত করা; (খ) জনগণের মধ্যে এরূপ ধারণা তৈরি করা যে, পাকিস্তানের শত্রুরা বিতাড়িত হয়েছে এবং দেশে শান্তি বজায় আছে; বিভিন্ন দপ্তর ও প্রতিষ্ঠান চলতে কোনো সমস্যা নেই; (গ) স্থানীয় সহযোগী ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে শান্তি কমিটি গঠন ও পাক প্রশাসনকে কার্যকর রাখা এবং (ঘ) শহরের করতোয়া ব্রিজসহ বিভিন্ন স্থানে চেক পোস্ট স্থাপন ও সাধারণ পথচারীদের তল্লাশির আওতায় আনা।
অধিকৃত পঞ্চগড়ে পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী সন্দেহে এবং প্রতিহিংসামূলকভাবে বহু সাধারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে আটক করে নির্যাতন করে এবং তাদের অধিকাংশকেই হত্যা করে। পঞ্চগড় সদর উপজেলায় হত্যা বা গণহত্যার যেসব ঘটনা ঘটে, তার বেশির ভাগই করতোয়া ব্রিজ সংলগ্ন জেলা পরিষদ বাংলো ও থানা ভবনকে ঘিরে গড়ে তোলা নদীতীরবর্তী এলাকায় সংঘটিত হয়। শহরের বাইরে শহরতলীর মিঠাপুকুর এলাকা, জগদল, অমরখানা, তালমা, পানিমাছপুকুরী ইত্যাদি এবং পাকহানাদারদের ঘাঁটি ও ক্যাম্পসমূহের আশপাশের এলাকায়ও বেশকিছু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।
পঞ্চগড় শহরে প্রবেশের সময় পাকবাহিনীর শেলবর্ষণে তাৎক্ষণিকভাবে বেশকিছু মানুষ হতাহত হয়। পাকসেনাদের গুলিতেও অনেকে প্রাণ হারায়। পরবর্তীতে জেলা পরিষদ বাংলোস্থ পাকসেনা ক্যাম্পে বিভিন্ন অজুহাতে নিরীহ মানুষদের আটকে রেখে নির্যাতন করা, ক্যাম্প সংলগ্ন করতোয়া নদীর পাড়ে কখনো এককভাবে, কখনো গণহারে মানুষ হত্যা করা হয়। পাকসেনা ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের দ্বারা পঞ্চগড়ের পরিচিত মানুষজনের মধ্যে যারা অত্যাচারিত ও নিহত হন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন— মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাদেরের পিতা কুচিয়ামোড় এলাকার মওলানা ইদ্রিস আলী, আওয়ামী লীগ নেতা কমর উদ্দিন আহমেদের পুত্র কাওসার আলম, ন্যাপ কর্মী আব্দুস সোবহান, আবু আরেফ প্রমুখ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মচারী হারুন-অর-রশিদ, পঞ্চগড় রেল স্টেশন এলাকার অধিবাসী মনছুর আলী চৌধুরী এবং দর্জিপাড়ার অধিবাসী ইয়াসীন আলীকে জেলা পরিষদ বাংলোর পেছনে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পঞ্চগড় তহশিল অফিসের তহশিলদার আব্দুর রহমান প্রমাণিককে ধরে এনে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। পরবর্তীতে তাকে ঠাকুরগাঁও-এ পাঠানো হয় এবং সেখানে তাকে হত্যা করা হয়। মাগুড়া প্রধানপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হামিজউদ্দীন ওরফে চৌকা প্রেসিডেন্টকে পাকবাহিনী ধরে এনে ব্যাপক নির্যাতন শেষে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় করতোয়া নদীতে ফেলে দেয়। কয়েক কিলোমিটার দূরের গ্রামবাসী তাকে উদ্ধার করলে তিনি বেঁচে যান।
জেলা কাউন্সিল ভবন এবং তৎসংলগ্ন থানা ভবনস্থ পাকবাহিনীর প্রধান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ও ক্যাম্পে পঞ্চগড়ের বিভিন্ন এলাকা থেকে আটককৃত অসংখ্য নিরীহ মানুষকে দিনের পর দিন নির্যাতন করা হয়। তাদের একটি বড় অংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের। তাদের অধিকাংশকেই দলবদ্ধভাবে বেঁধে রাতের বেলা করতোয়া নদীর তীরে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে গুলি করে হত্যার পর মাটিচাপা দেয়া হয়। করতোয়া তীরবর্তী দুটি বধ্যভূমিতে শতশত মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের শিকারদের মাটিচাপা দেয়ার জন্য গর্ত খননের কাজও তাদের দিয়েই করা হয়।
পঞ্চগড় শহরে প্রবেশের পর পাকসেনারা তাদের সহযোগীদের মাধ্যমে খবর পায় যে, সার্কিট হাউজের সন্নিকটস্থ মিঠাপুকুর এলাকার বাসিন্দা মফিজ উদ্দীনের বাড়িতে আত্মরক্ষার্থে নির্মিত একটি বাংকারে কিছু মানুষ আত্মগোপন করে আছে। পাকসেনারা তৎক্ষণাৎ বাড়িটি আক্রমণ করে এবং বাংকারের মুখে মেশিনগানের গুলি চালায়। এতে আত্মগোপনকারী ৮ জনের মধ্যে ৫ জন নিহত হয়। মফিজ উদ্দীনসহ ৩ জন প্রাণে বেঁচে যান। রওশন আরা নামে একজন নারী এ ঘটনায় বেঁচে যাওয়াদের একজন, কিন্তু তার পিতা ভূঁইয়া মাস্টার এবং ভাই কবির ভূঁইয়া নিহত হয়। প্রাণে বেঁচে যাওয়া অপর একজনের নাম রফিজ উদ্দীন।
পঞ্চগড় শহর দখলে নেয়ার পর তৎক্ষণিকভাবে পাকসেনাদের দ্বারা যে-সকল নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, সেগুলোর একটি পানি উন্নয়ন বোর্ড সংলগ্ন প্রধান সড়কে সংঘটিত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড চত্বরে আত্মগোপনকারী আব্দুল রহমান নামে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর তথ্যমতে ভীত ও পলায়নরত একজন ব্যক্তিকে প্রধান সড়কে দেখামাত্র পাকসেনারা তাকে গুলি করে হত্যা করে। কিছু সময়ের ব্যবধানে সংযুক্ত গলিপথ হয়ে আরো ৫ জন মানুষ প্রধান সড়কে এলে তাদের সকলকেই গুলি করে হত্যা করা হয়।
পঞ্চগড় শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার পশ্চিমে সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী গ্রাম মীরগড়। জুলাই মাসের শেষদিকে সীমান্ত সংলগ্ন এ এলাকায় অবস্থানরত পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের শিকার হওয়ায় প্রতিশোধপরায়ণ পাকসেনারা স্থানীয় রাজাকার ও অবাঙালিদের সহযোগিতায় এ গ্রামের সকল বাড়িঘরে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভীত- সন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষ ভারতীয় সীমান্তের দিকে ছুটে যায়।
কিন্তু পাকসেনারা গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে এবং পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা কালে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আছির উদ্দিন আহাম্মদ, স্কুল শিক্ষক শামসুর হুদা এবং সেরু নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে। এদের মধ্যে আছির উদ্দিনকে আগুনে পুড়িয়ে এবং অপর দুজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই ঘটনায় মিন্টু নামে পঞ্চগড় এম আর কলেজের একজন ছাত্র প্রাণ হারায়।
পাকবাহিনীর সর্বউত্তরের ঘাঁটি অমরখানায় অবস্থানকারী সেনাদের দ্বারা আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়। বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে গরু- ছাগলসহ অন্যান্য মালামাল লুট করে আনা, নারীনির্যাতন, সন্দেহভাজনদের ক্যাম্পে এনে নির্যাতন ইত্যাদি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। লইপাড়া, জাবুরিদুয়ার, নূচরাপাড়া প্রভৃতি গ্রাম ভীত-সস্তস্ত্র মানুষের জনপদে পরিণত হয়। পাকসেনাদের শেলের আঘাতে লইপাড়ায় এক সঙ্গে ৫ জন মারা যায়। জুলাই মাসে এ ক্যাম্পে আটককৃত ১৮ জন নিরীহ মানুষকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের কি পরিণতি হয়, তা জানা যায়নি।
১৯৭১ সালে পাকবাহিনী কর্তৃক এদেশের নারী সমাজ যে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়, পঞ্চগড়েও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর যে-সকল ক্যাম্প ও বাংকার গড়ে উঠেছিল, তার প্রায় সবগুলোতেই বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য নারীকে ধরে এনে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। অমরখানা ঘাঁটির বাংকারগুলোতে বহু নারীকে দিনের পর দিন বিবস্ত্র অবস্থায় রেখে নির্যাতন করা হয়। এলাকাটি পাকহানাদারমুক্ত হলে এ ঘাঁটি থেকে বেশ কয়েকজন নারীকে উদ্ধার করা হয়। অমরখানা ছাড়াও পঞ্চগড় শহরের নিকটস্থ জালাসি, তালমা, গরুহাটি, কায়েতপাড়াসহ সদর উপজেলাধীন মধুপাড়া, বিষমনি, বদলুপাড়া, মীরগড়, খোলাপাড়া ও জাবুরিদুয়ার এলাকায় বহু নারী পাকবাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত হন। পাকবাহিনীর ছেড়ে যাওয়া বাংকারগুলোতে প্রাপ্ত বিভিন্ন নমুনা ও নির্যাতিত নারীদের ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিসপত্র থেকেও নারীনির্যাতনের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
বর্তমান জেলা পরিষদ বাংলো ও সংলগ্ন থানা ভবন পাকবাহিনীর প্রধান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ছিল। এটি নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী সন্দেহে বহু মানুষকে ধরে এনে এখানে চরম নির্যাতন করা হয় এবং অধিকাংশকেই করতোয়া পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যার পর মাটিচাপা দেয়া হয়। এ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে সংঘটিত ভয়াবহ ঘটনার একটি দৃষ্টান্ত ছিল সংলগ্ন নদী পাড়ের বধ্যভূমি। বিভিন্ন এলাকা থেকে শতশত মানুষকে ধরে এনে এখানে বন্দি করে রাখা হতো এবং রাতের বেলা নদীতীরবর্তী নির্জন এলাকায় নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে তাদের গুলি করে হত্যা করা হতো।
পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক অধিকৃত পঞ্চগড় থানার বিস্তৃত এলাকায় হত্যা, লুটপাট ও নির্যাতন এক নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। বিভিন্ন স্থানে চলে হত্যা ও গণহত্যা। বহু স্থান পরিণত হয় বধ্যভূমিতে। সেসব স্থানের সবগুলো চিহ্নিত হয়নি। যে-সকল স্থান ও স্থাপনা ৭১-এর দুঃসহ স্মৃতি জাগিয়ে তোলে, সেগুলোর কয়েকটি হলো— পঞ্চগড় শহর সংলগ্ন করতোয়া ব্রিজের পশ্চিম দিকে নদীর পাড়ের নিকটস্থ জেলা পরিষদ ও থানা ভবনে স্থাপিত সেনা ক্যাম্প। এখানে শতশত নিরীহ মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন শেষে হত্যা করা হয়। এখান থেকে আরো পশ্চিমে নির্জন প্রান্তর হয়ে উঠেছিল আর একটি বধ্যভূমি। প্রায়শ রাতের বেলা এখানে সারিবদ্ধ করে শতশত মানুষকে গুলি করে মাটিচাপা দেয়া হয়।
পঞ্চগড় দখলদার বাহিনীমুক্ত হবার প্রাককালে চিনিকল এলাকায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনকালে পাকসেনাদের গুলিতে নিহত হন সাহসী যুবক হারুন-অর- রশিদ। তাঁকে সমাহিত করা হয় ভারতের কোটগছে। পঞ্চগড় সড়ক ও জনপদ বিভাগে ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন প্রকৌশলী ফারুক আহমদ। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে স্থানীয় পর্যায়ে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটক হলে বীরগঞ্জে তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁকে সমাহিত করা হয় বীরগঞ্জের হাবলুর হাটে। জগদল দখলের প্রাক্কালে এক সম্মুখ যুদ্ধে নিহত হন বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার সাকিম উদ্দিন, বীর বিক্রম। জগদলে তাঁর সমাধি রয়েছে। অমরখানায় দুজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি রয়েছে। তাঁরা হলেন শহীদ মকবুল হোসেন এবং শহীদ বদিউজ্জামান।
পাকবাহিনীর অমরখানা ঘাঁটি পঞ্চগড় তথা উত্তরাঞ্চলের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল বিধায় একে কেন্দ্র করে একাধিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পঞ্চগড়ের উত্তর সীমান্তবর্তী চাউলহাটি গেরিলা ইউনিটের যোদ্ধাদের তৎপরতা জুলাই মাস থেকে ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। জনবল ও রণকৌশলেও নতুন মাত্রা যোগ হয়। এ-সময় সীমান্ত সংলগ্ন টোকাপাড়ার পরিত্যক্ত ইপিআর ক্যাম্পে গেরিলারা ক্যাম্প স্থাপন করেন। কিন্তু ১২ই জুলাই পাকবাহিনী ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ক্যাম্পটি আক্রমণ করলে গেরিলা দলটি এক অসম যুদ্ধের সম্মুখীন হয়। প্রাণপণে প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। ব্যাপক মর্টার শেলের আঘাতে ক্যাম্পটি বিধ্বস্ত হয় এবং পাকসেনারা এটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। গেরিলা দলের সদস্যরা নিরাপদ স্থানে সরে গেলেও এ-যুদ্ধে গোলাম গউস নামে একজন গেরিলা যোদ্ধা শহীদ হন। গোলাম গউস ছিলেন এখানকার গেরিলা ইউনিটের শাহাদত বরণকারী প্রথম যোদ্ধা। তাঁকে সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকায় সমাহিত করা হয়।
পঞ্চগড় সদর উপজেলার উত্তর-পূর্ব অংশে বিভিন্ন হাইড আউট থেকে গেরিলারা বিভিন্ন স্থাপনা, ক্যাম্প ও সেতুকে লক্ষ করে বেশকিছু অপারেশন পরিচালনা করেন। সেসব অপারেশনে পাকবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
পঞ্চগড়ের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে গেরিলা বাহিনীর সদস্যদের ধারাবাহিক অপারেশনের ফলে পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ক্রমে শিথিল হতে থাকে। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে পাকনিয়ন্ত্রণ কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে। সঙ্গত কারণেই পাকবাহিনীর সুরক্ষিত ঘাঁটিগুলোকে লক্ষ করে মুক্তিবাহিনীর রণপরিকল্পনা ঢেলে সাজানো হয়। ভারতীয় সেনা অফিসারদের কমান্ডে থাকা চাউলহাটিসহ অন্যান্য গেরিলা ইউনিটটিকে সংযুক্ত করা হয় সাব- সেক্টর ৬/এ-র অধীনে। চাউলহাটি ইউনিটটিকে একটি কোম্পানিতে পরিণত করে এর নামকরণ করা হয় ৩-এ মধুপাড়া কোম্পানি। অমরখানা, জগদলসহ বিস্তৃত এলাকায় এ কোম্পানি গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি সম্মুখ যুদ্ধেও অংশ নেয়।
নভেম্বরের শুরু থেকে পঞ্চগড়কে হানাদারমুক্ত করার লক্ষ্যে মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণ তীব্রতর হয়ে ওঠে। ভারতীয় মিত্রবাহিনীও প্রয়োজনীয় আর্টিলারি সাপোর্ট অব্যাহত রাখে। মধ্যনভেম্বর থেকে পরবর্তী দুই সপ্তাহ জুড়ে পঞ্চগড়ের পাকঘাঁটিসমূহের পতন হতে থাকে। এ-সময় পঞ্চগড় শহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে অমরখানা, চৈতন্যপাড়া, জগদল, মলানি, তালমা এসব স্থানে উভয় পক্ষে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। একইভাবে শহরের পশ্চিম দিকে মীরগড় থেকে তৎকালীন জুট কর্পোরেশন এলাকা হয়ে পঞ্চগড় সুগার মিল মুক্ত করতে ব্যাপক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অবশেষে ২৯শে নভেম্বর পঞ্চগড় শহরে দামাল মুক্তিযোদ্ধাদের পদচারণা শুরু হয় এবং ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এদিনই পঞ্চগড় সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- মো. ওসমান গনি, বীর প্রতীক- (পিতা মো. আজিজুল হক, মিঠাপুর)। পঞ্চগড় সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. নুর ইসলাম (পিতা মো. রমিজ উদ্দিন মুন্সি, পুরিপাড়, মাগুড়া), আনাজ আলী (পিতা আব্দুল জব্বার, ডাংগাপাড়া, কামাতকাজলদিঘি), হাবিবর রহমান (পিতা বাচ্চা মিয়া, নিউমার্কেট, পঞ্চগড়), মো. সাইফুল ইসলাম (পিতা মুনির উদ্দিন আহমেদ, মুরাবাড়ি, গড়িনাবাড়ী), আব্দুল বাকী (পিতা আলিফ উদ্দিন মুন্সি, মসজিদপাড়া, পঞ্চগড়), হাবিবুর রহমান (পিতা তছির উদ্দিন, কমলাপুর, ধাক্কামারা), গোল হোসেন (পিতা আহাম্মদ হোসেন কবিরাজ, ফকিরপাড়া, কমলাপুর, ধাক্কামারা), মো. রহিম উদ্দিন (পিতা” কছির উদ্দিন, লাঠুয়াপাড়া, ধাক্কামারা), আফজাল হোসেন (পিতা মো. নিজাম উদ্দিন, গোয়ালপাড়া, অমরখানা), তছির উদ্দিন (পিতা জমির উদ্দিন, নহলিয়াপাড়া, হাড়িভাসা), হারুন-অর- রশিদ (পিতা ফজলুল করিম প্রধান, উত্তরপ্রধানপাড়া, হাড়িভাসা), শের আলী (পিতা মো. আব্দুল গনি আকন্দ, বড়দহ, কামাতকাজলদিঘি), সাহেব আলী (পিতা সামেদ আলী, কামাতপাড়া, পঞ্চগড়), খন্দকার আব্দুল মান্নান (পিতা খন্দকার রেফাজ উদ্দিন, ডুবানুচি, সাতমেরা, পঞ্চগড়), হাফিজ উদ্দিন (পিতা টুনকু মোহাম্মদ, বোদাপাড়া, সাতমেরা), আব্দুল বারিক (পিতা আবুল হোসেন, সর্দারপাড়া, হাফিজাবাদ), মকবুল হোসেন (পিতা অলি সরকার, তালবাস্তি, অমরখানা) ও মোহাম্মদ সম (পিতা মোহাম্মদ শেরু, আমতলা, ধাক্কামারা)। এছাড়া পঞ্চগড় সদর উপজেলার বাইরের ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা এ এলাকায় যুদ্ধ করে শহীদ হন। তাঁরা হলেন – সাকিম উদ্দিন, বীর বিক্রম (তেঁতুলিয়া), গোলাম গাউস (রংপুর) ও বদিউজ্জামান (কুমিল্লা; ইপিআর)।
পঞ্চগড় সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মারকগুলো হলো- জেলা পরিষদ বাংলো বধ্যভূমি স্মারক, অমরখানা ব্রিজ সংলগ্ন মুক্তাঞ্চল তোরণ, জগদল যুদ্ধে শহীদ সাকিম উদ্দিন, বীর বিক্রম-এর সমাধিস্থল, পঞ্চগড় হানাদারমুক্ত হওয়ার প্রাক্কালে চিনিকল এলাকায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনকালে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হারুন- অর-রশিদ-এর নামে সড়ক, অমরখানায় শহীদ বদিউজ্জামান ও মকবুল হোসেন-এর সমাধি, সড়ক ও জনপথ কার্যালয়ের সামনে নির্মিত শহীদ প্রকৌশলী ফারুক আহমদ স্মৃতিস্তম্ভ এবং ভিতরগড় এলাকায় শহীদ গোলাম গউস-এর সমাধি। [শফিকুল ইসলাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড