মুক্তিযুদ্ধে পটিয়া উপজেলা (চট্টগ্রাম)
পটিয়া উপজেলা (চট্টগ্রাম) ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদে আওয়ামী লীগ- নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পটিয়া আসন থেকে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী এমএনএ এবং সুলতান আহমদ কুসুমপুরী এমপিএ নির্বাচিত হন। কিন্তু পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে চক্রান্ত শুরু করলে পটিয়ার জনমনে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ১ তারিখ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নির্দেশে পটিয়ায় ২রা থেকে ৬ই মার্চ হরতাল পালিত হয়। এদিকে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর পটিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট মুস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীকে আহ্বায়ক ও সাধারণ সম্পাদক হামিদুর রহমানকে সদস্য সচিব করে পটিয়া সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর সদস্য ছিলেন পূর্ণেন্দু কানুনগো, মিঞা আবু মোহাম্মদ ফারুকী, ছালেহ আহমদ কন্ট্রাক্টর, গোলাল সওদাগর, মজহারুল হক চৌধুরী, আহমদ নূর সওদাগর, আবদুল বারিক, খালেদ (পরে মেজর), অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ প্রমুখ। ইউনিয়ন ও গ্রামভিত্তিক সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদও গঠিত হয়। মনসার টেক সংগ্রাম পরিষদে চৌধুরী হারুনর রশিদ, এ এন এম নূর-উন-নবী, আবুল হাশেম মাস্টার, ডা. নুরুন্নবী, ডা. জাফর, কামাল উদ্দিন খান, পেটান শীল, ডা. নুরুল ইসলাম, খোরশেদ, আবু সৈয়দ মাস্টার, আবদুল মালেক; কালারপোল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে নুর হোসেন, ফেরদৌস চৌধুরী; পশ্চিম পটিয়া ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে ফরিদ বাঙালি, নুরুল ইসলাম, আলী নূর, রফিক আহমদ খান, কামাল, ছিদ্দিক বিকম, আবুল হাশেম, ফজল আহমদ, মোহাম্মদ আসলাম, হামিদুল হক, এম এন ইসলাম, এয়াকুব, নুরুল আফসার, আবু তাহের বাঙালি, ফেরদৌস চৌধুরী, মুক্তিমান বড়ুয়া, ইউনুস, নুরুল আমিন, রশিদ আহমদ, রফিকুল আলম চৌধুরী, হারুন অর রশিদ (পিতা সাহেব মিয়া); খরনা-কচুয়াই সংগ্রাম পরিষদে মিঞা আবু মোহাম্মদ ফারুকী, আবুল কাশেম, আবু তাহের, আবদুল গফুর, আমির আলী, বদিউল আলম চৌধুরী, শাহ্ আলম; জিরি ফকিরা মসজিদ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে আবুল বশর চৌধুরী, ফজল আহমদ, ফরিদ উদ্দিন খান, নুরুল আলম, আবু তাহের বাঙালি, এনামুল হক সিকদার, ইউসুফ এস্কারী, আবুল বশর, ফরিদুল আলম, আবু তৈয়ব, রুহুল আমিন, একরামুল হক, ফরিদ, ফজলুল হক, জুলফিকার, এমদাদ, ইসহাক, আবদুল হাকিম প্রমুখ যুক্ত ছিলেন। ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে পটিয়া থানা ভবনের সামনে ছাত্রনেতা সামশুদ্দিন আহমদ স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ইতোমধ্যে পটিয়া থানা ছাত্রলীগ এর সাধারণ সম্পাদক সামশুদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক ও মনোজ সিংহ হাজারীকে যুগ্ম-আহ্বায়ক করে পটিয়া সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ পরিষদের সদস্য ছিলেন চৌধুরী সিরাজুল ইসলাম খালেদ, আবু তাহের, আবুল বশর, আবদুল গফুর চৌধুরী, আবু তাহের খান খসরু, আবদুল মতিন চৌধুরী প্রমুখ।
পাকিস্তানিদের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠলে -আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি সদ্বীপের মানিক চৌধুরী (ভূপতি ভূষণ চৌধুরী) এবং বরিশালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য চিত্তরঞ্জন সূতার বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মার্চের শুরুতেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক কর্মকাণ্ড শুরু করেন। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে পটিয়া কলেজ, আবদুস সোবহান রাহাত আলী হাইস্কুল, আদর্শ হাইস্কুল, হুলাইন ছালেহ নূর কলেজ প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠে স্থানীয় আনসার ও ইপিআর সদস্যদের সহায়তায় ছাত্র-জনতা কাঠের তৈরী ডামি রাইফেল দিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকবাহিনীর বর্বর গণহত্যার পর সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ইউনিয়ন ও গ্রামভিত্তিক পরিষদ, ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি এবং ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতৃবৃন্দ অস্ত্র সংগ্রহ শুরু করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ আরো জোরদার করা হয়। পালিয়ে আসা ইবিআর (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট), ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা প্রশিক্ষণ দানে সহযোগিতা করেন। ২৭শে মার্চ বিকেলে এম এ হান্নান, এম এ মান্নান, ডা. এম এ মান্নান, আতাউর রহমান খান কায়সার, ডা. জাফর, এ কে এম আবদুল মন্নানসহ কয়েকজন নেতা পটিয়া কলেজে স্থাপিত ইপিআর-ইবিআর ক্যাম্পে মেজর জিয়ার খোঁজে আসেন। উল্লেখ্য যে, এদিন সকালে মেজর জিয়া এখানে এসেছিলেন। এম এ মান্নান তখন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সম্বলিত ৪-৫ হাজার প্রচারপত্র সামশুদ্দিন আহমদকে প্রদান করেন। তিনি সামশুদ্দিনকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যেতে আগ্রহীদের একটি তালিকাও প্রস্তুত করতে বলেন। নেতৃবৃন্দ চলে যাওয়ার পর মাইকিং-এর মাধ্যমে প্রচারপত্রসমূহ জনতার মধ্যে বিলি করা হয়। এর কিছুদিন পর সামশুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে ৭০ জনের একটি দল উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যায়।
পটিয়া উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃস্থানীয় সংগঠকরা হলেন- অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী এমএনএ (মুক্তিযুদ্ধে পূর্বাঞ্চলীয় ১ নং জোনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং ১ নং সেক্টরে পূর্বাঞ্চল যুব শিবিরের পরিচালক), সুলতান আহমদ কুসুমপুরী এমপিএ, চৌধুরী হারুনর রশিদ (ভারতে ন্যাপ- কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলা ১৯ হাজার প্রশিক্ষিত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ড কাউন্সিলের অন্যতম প্রধান), মানিক চৌধুরী (ভূপতি ভূষণ চৌধুরী), এস এম ইউসুফ, খালেদ (মেজর), এডভোকেট জালাল উদ্দিন, হারুন আল জাফর চৌধুরী, এডভোকেট আবুল কালাম আজাদ (দক্ষিণ হাশিমপুর), ছালেহ আহমদ কন্ট্রাকটার, সিদ্দিক আহমদ, চৌধুরী, ডা. মুসলিম চৌধুরী, অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ (পরে অধ্যক্ষ), ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিম (জিরি), এ কে এম শামসুল আলম, এ কে এম আবদুল মতিন চৌধুরী, অধ্যাপক জাফর, আবু তাহের বাঙালি (জিরি), নুরুল আফসার চৌধুরী, সৈয়দ আহমদ, লুৎফুন্নেসা বেগম (হাইদগাঁও), আছিয়া বেগম (কচুয়াই), ফেরদৌস বেগম চৌধুরী, নাসরিন বেগম, এডভোকেট বদিউল আলম, এ কে এম আবদুল মান্নান, এডভোকেট মুস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, হাফেজ মৌলভী আহমদুল হক, রাখাল চন্দ্র সরকার, ডা. শামসুল আলম, মৃণাল কান্তি বড়ুয়া, চৌধুরী সিরাজুল ইসলাম খালেদ, সামশুদ্দিন আহমদ, সাংবাদিক জালাল উদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক আবদুল আলিম, প্রমথেশ দত্ত, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, পূর্ণেন্দু কানুনগো, ধীরেন দাশ, এ এন এম নূর-উন-নবী, ফণীভূষণ দাশ, মাস্টার দিলীপ ভট্টাচার্য, কমরেড মোহাম্মদ মুসা, কমরেড শাহ্ আলম, হামিদুর রহমান, আহমদ হোসেন পোস্ট মাস্টার, অনিল লালা, মিঞা আবু মোহাম্মদ ফারুকী, আহমদ শরীফ মনির, চাচা আবদুল খালেক, আবদুল হক (বড়), আবুল কালাম, কবির আহমদ কালা, বদিউর রহমান, শাহজাহান, মাহবুবুল আলম তসলিম, আহমদ নূর, মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, নুর মোহাম্মদ, হাবিবুর রহমান হাবিব, আবদুস সালাম মাস্টার, আবুল মাসুদ চৌধুরী, বদিউল আলম চৌধুরী, আনোয়ার উদ্দিন আহমদ, হরিসাধন দেব ব্রাহ্মণ, মুক্তিমান বড়ুয়া, শক্তিমান বড়ুয়া, আবদুল মালেক, জাফর আহমদ, বাবু রাজেশ্বর রক্ষিত প্রমুখ। এঁরা আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও এসব দলের অঙ্গ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁরা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন তাঁরা হলেন— এফএফ ১৫১ গ্রুপের কমান্ডার অধ্যাপক গৌরাঙ্গ প্রসাদ মিত্র, অধ্যাপক শামসুল ইসলাম গ্রুপের কমান্ডার অধ্যাপক শামসুল ইসলাম; শাহ আলম গ্রুপের কমান্ডার কমরেড শাহ আলম, ডেপুটি কমান্ডার উদয়ন নাগ; এফএফ ৩৩ গ্রুপের কমান্ডার মুহাম্মদ মহসীন খান; আবু সৈয়দ গ্রুপের কমান্ডার আবু সৈয়দ, ডেপুটি কমান্ডার সুধাংশু বিমল চৌধুরী; এফএফ ৩৪ গ্রুপের কমান্ডার মনজুরুল হক;বিএলএফ-এর নুরুল আনোয়ার গ্রুপের কমান্ডার নুরুল আনোয়ার, ডেপুটি কমান্ডার ইদ্রিছ আনোয়ারী; বিএলএফ- এর নুরুল ইসলাম গ্রুপের কমান্ডার নুরুল ইসলাম, ডেপুটি কমান্ডার দিলীপ কান্তি দাশ এবং ফণীভূষণ দাশ গ্রুপের কমান্ডার ফণীভূষণ দাশ। সামশুদ্দিন আহমদ গ্রুপের কমান্ডার সামশুদ্দিন আহমদ, আহমদ নবী গ্রুপের কমান্ডার আহমদ নবী, লাঠি আলম গ্রুপের কমান্ডার লাঠি আলম এবং হাবিলদার সুলতান আহমদ গ্রুপের কমান্ডার হাবিলদার সুলতান আহমদ। বিএলএফ-এর চট্টগ্রাম জেলা কমান্ডার ছিলেন এস এম ইউসুফ। এছাড়া অপারেশন কমান্ডাররা হলেন কমরেড শাহ্ আলম, মুহাম্মদ মহসীন খান, আহমদ নবী, হাবিলদার নুরুল আলম, সুবেদার সোলায়মান, হাবিলদার নুরন্নবী, সামশুদ্দিন আহমদ, সুবেদার মেজর টি এম আলী, হাবিলদার সুলতান আহমদ, মৃণাল কান্তি বড়ুয়া এবং নায়েক আজিজুল হক। বাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সুবেদার মেজর টি এম আলী, ফাইট সার্জেন্ট মহিউল আলম, ক্যাপ্টেন করিম (প্রকৃত নাম সিরাজুল করিম। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কর্পোরাল হলেও তিনি ক্যাপ্টেন করিম নামে পরিচিত ছিলেন) ও সুলতান আহমদ কুসুমপুরী এমপিএ।
২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট-এর পর পটিয়ার রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ জনগণ আরাকান সড়কে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ২৬শে মার্চ ভোরে পটিয়ার হাজার-হাজার মানুষ ‘যার যাকিছু আছে তাই নিয়ে’ পাকবাহিনীর প্রতিরোধকল্পে আরাকান সড়কে অবস্থান নেয়। সকাল ৬টার দিকে একটি জীপ নিয়ে মেজর জিয়া পটিয়ার ওপর দিয়ে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছিলেন। এসময় থানার মোড়ে জীপ থামিয়ে লোকজনদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন’। এর আগেই পটিয়া ক্লাব ও শশাঙ্ক বালা (পরে আবদুর রহমান) গার্লস হাইস্কুলে ইবিআর ও ইপিআর সদস্যদের ক্যাম্প স্থাপিত হয়। পটিয়া জমিরিয়া মাদ্রাসায়ও রুমা থেকে আসা ইপিআর সদস্যদের ক্যাম্প স্থাপিত হয়। পটিয়া কলেজ ক্যাম্প গঠিত হওয়ার পর অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী এমএনএ একটি যুদ্ধ পরিচালনা কমিটি গঠন করেন। উপর্যুক্ত ক্যাম্পসমূহ থেকে সৈনিকরা প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। পটিয়ার জনগণ পটিয়া সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে এসব ক্যাম্পে, এমনকি কালুরঘাটে খাদ্য ও রসদপত্র প্রেরণ করত। ১১ই এপ্রিল পাকবাহিনীর হাতে কালুরঘাটের পতন হলে পটিয়া অক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। ১৬ই এপ্রিল সকালে ও দুপুরে দুবার পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান বোমা হামলা করলে পটিয়া থানার মোড় ও সংলগ্ন এলাকায় ২০ জন লোক শহীদ হয়। ফলে আরাকান সড়কে প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী এমএনএ, সুলতান আহমদ কুসুমপুরী এমপিএ, পটিয়া থানা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ, পটিয়া সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ইউনিয়ন ও গ্রামভিত্তিক সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ন্যাপ- কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন, ইবিআর-ইপিআর-পুলিশ- আনসার বাহিনীর প্রচুর সদস্য এবং পটিয়ার স্বাধীনতাকামী জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে ওঠা সত্ত্বেও ১৬ই এপ্রিল পটিয়ার পতন ঘটে।
১৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী পটিয়ায় প্রবেশ করে এবং কয়েকদিন পরে পটিয়া কলেজে ক্যাম্প স্থাপন করে। আরো পরে পটিয়া পিটিআইতে একটি শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপিত হয়।
পটিয়া উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে এডভোকেট রমিজ আহমদ (খরনা), আবু সিদ্দিক চৌধুরী (হাবিলা, সদ্বীপ), এজাহার মিয়া (দক্ষিণ ভূর্ষি), মৌলানা আকতার (বরলিয়া), আবুল হোসেন (দক্ষিণ গোবিন্দারখীল), আবুল কালাম (মনসা), মৌলানা ইউনুছ, আবুবকর চৌধুরী (আশিয়া), জলিল সওদাগর (শিকলবাহা), মৌলানা মো. শরীফ, ছৈয়দ রফিকুল আলম (জিরি), আবু মুসা সওদাগর বালি (পাইকপাড়া), মৌলভী নুর মোহাম্মদ (মনসা), মফিজুর রহমান (কচুয়াই), সালেহ আহমদ (ছনহারা), বাদশা মিয়া (হাইদগাঁও), জমির উদ্দিন (আজিমপুর), এডভোকেট আহমেদ হোসেন (আজিমপুর), মীর আহমেদ (ভাটিখাইন), শাহ্ আলম চৌধুরী (আলমদার পাড়া), অলি আহমেদ পণ্ডিত (রশিদাবাদ), সাব্বির আহমেদ (এলাহাবাদ), মনির আহমদ চৌধুরী (ছনহারা), আমিন শরীফ (পারীগ্রাম), ডা. উমর ফারুক (শিকলবাহা), মাস্টার নাছির আহমেদ (শিকলবাহা), সোনামিয়া চৌধুরী (কোলাগাঁও), ছৈয়দ আহমদ ওরফে মরিচ ছৈয়দ (কুসুমপুরা), মনির আহমদ চৌধুরী (পূর্ব বাথুয়া), নুরুল ইসলাম (জঙ্গলখাইন), মফিজুর রহমান (খরনা), বশির আহমেদ ওরফে বুইজ্জা মিয়া (পূর্ব কোলাগাঁও), আবদুস সাত্তার (দক্ষিণ ভূর্ষি), আনু মিয়া (ভাটিখাইন), ফজল করিম (হাইদগাঁও), আসলাম (খরনা), ইসহাক চৌধুরী (রশিদাবাদ) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
পটিয়ায় মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় সক্রিয় ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় এসব দলের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও মুজাহিদ বাহিনী গঠিত হয়। পূর্ব চন্দনাইশ চৌধুরী পাড়ার খায়ের আহমদ চৌধুরী (পিতা রহমত আলী)-কে আহ্বায়ক করে গঠিত পটিয়া থানা শান্তি কমিটির সদস্যরা ছিল- পাইকপাড়ার আবু মুসা সওদাগর বালি ও সোনা মিয়া, সুচক্রদণ্ডির আহমদ ছফা চৌধুরী, ধলঘাটের মৌলানা ইমাম শরীফ, কেলিশহরের আমিনুল হক, হাইদগাঁওয়ের নুরুচ্ছাফা, খরনার এডভোকেট রমিজ আহমদ, কচুয়াইয়ের এডভোকেট আহমদ হোসেন, শোভনদণ্ডির ইসহাক চৌধুরী, ছনহারার মনির আহমদ চৌধুরী, শাহ্ আলম চৌধুরী, সালেহ আহমদ, জঙ্গলখাইনের নুরুল ইসলাম, আশিয়ার পূর্ব বাথুয়ার মনির আহমদ চৌধুরী, হাবিলা, সদ্বীপের আবু ছিদ্দিক চৌধুরী, কুসুমপুরার মৌলভী নূর মোহাম্মদ, ছৈয়দ আহমদ ওরফে মরিচ ছৈয়দ, জিরির ছৈয়দ রফিকুল আলম, কোলাগাঁওয়ের বশির আহমদ ওরফে বুইজ্যা মিয়া, সোনা মিয়া চৌধুরী, শিকলবাহার জলিল সওদাগর, চরলক্ষ্যার তমিজ গোলাল, বড় উঠানের আহমদ চেয়ারম্যান প্রমুখ। বৈলতলীর নুরুল হক-কে কমান্ডার করে সহস্রাধিক সদস্যের এক বিশাল রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। প্রত্যেক ইউনিয়নে এর শাখা কমিটি ছিল। রাজাকার বাহিনী সাব-মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর (চিটাগাং সেক্টর)-এর অধীনে কাজ করত। নুরুল হক রাজাকার কমান্ডার হলেও সবচেয়ে বেশি অপরাধকর্মে লিপ্ত ছিল তার দুই ভাই আহমদ সৈয়দ ও বাদশা। ফজর রহমান (হাইদগাঁও), আবদুস সোবহান (হাইদগাঁও), মো. ইসমাইল (হাইদগাঁও), আবুল হোসেন (দক্ষিণ গোবিন্দারখীল), নুরুল হক (বাতইনা), আবদুস সাত্তার (দ্বীপকালা মোড়ল), আবদুল মুনছেফ (হাইদগাঁও), মাহমুদুল হক চৌধুরী (বাতইনা), মীর আবদুর রহমান (পটিয়া), আবদুল মোতালেব (কৈয়গ্রাম), বদিউজ্জামান (বাতইনা), মীর মো. ইছহাক (খরনা), লোকমান হোসেন (কৈয়গ্রাম), আবদুল জব্বার (কৈয়গ্রাম), আবদুল নবী (হাইদগাঁও), আবদুন নুর (সাফকাইন), এজাহার মিয়া (হাইদগাঁও), আজাহার মিয়া (হাইদগাঁও), আবদুল মালেক (হাইদগাঁও), আনো মিয়া (কচুয়াই), মোহাম্মদ ইয়াকুব (পটিয়া), রশিদ আহাম্মেদ চৌধুরী (বাতইনা), আমির হোসেন (খরনা), শওকত আলী (দ্বীপকালা মোড়ল), মাহবুবুর রহমান (খরনা), মুনছেফ আলী (বাতইনা), মো. ইসমাঈল (আজিমপুর), সুলতান আহাম্মেদ (দক্ষিণ ভূর্ষি), আবদুল হক (ছনহারা), আলী আহাম্মেদ (হাইদগাঁও), সুলতান আহাম্মেদ (ছনহারা), শামসুল আলম (ছনহারা), সকের আহাম্মেদ (ছনহারা), আবদুল খালেক (হাইদগাঁও), সিরাজুল ইসলাম (ছনহারা), নুরুন্নবী (গোবিন্দারখীল), আবুল কাসেম (ছনহারা), লিয়াকত আলী (হাইদগাঁও), মোহাম্মদ নাসিম (ছনহারা), সুলতান আহাম্মেদ (কেলিশহর), সোনা মিয়া (গোবিন্দারখীল), গোরা মিয়া (হাইদগাঁও), জমির উদ্দিন (আজিমপুর), দুলা মিয়া (হাইদগাঁও), শরাফত আলী (কচুয়াই)। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র সংঘ-এর সাহায্যে পটিয়া থানা আলবদর, আলশামস ও মুজাহিদ বাহিনী গঠন করা হয়। এ তিন বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত হয় যথাক্রমে মনসার আবুল কালাম, সাতবাড়িয়ার মোজাফ্ফর আহমদ এবং চৌধুরীপাড়ার নুর মোহাম্মদ (পূর্ব চন্দনাইশ)। এসব বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিবাহিনীর খবরাখবর সংগ্রহ করে পাকবাহিনীকে দিত এবং হত্যা, গণহত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণে অংশ নিত। পটিয়া উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা বেশ কয়েকটি গণহত্যা সংঘটিত হয়। সেগুলোর মধ্যে পটিয়া গণহত্যা, গৌরাঙ্গপাড়া গণহত্যা, মুজাফ্ফরাবাদ গণহত্যা, দক্ষিণ ভূর্ষি গণহত্যা, কেলিশহর গণহত্যা, ছনহারা গণহত্যা, ভাটিখাইন গণহত্যা, গৈড়লা গণহত্যা, শাহ্মীরপুর ফিরিঙ্গি বাড়ি গণহত্যা, মনসার টেক গণহত্যা, বাইন্যাপাড়া গণহত্যা, কচুয়াই গণহত্যা এবং ইন্দ্রপোল গণহত্যা উল্লেখযোগ্য। পটিয়া গণহত্যা সংঘটিত হয় ১৬ই এপ্রিল। এদিন সকালে ও দুপুরে পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান থেকে পটিয়া সদরে বোমা হামলা চালানো হলে পটিয়া সদর থানার মোড় ও সংলগ্ন এলাকায় ২০ জন বেসামরিক লোক শহীদ হয়। গৌরাঙ্গপাড়া গণহত্যা সংঘটিত হয় ২৩শে এপ্রিল। এদিন পাকবাহিনী তাদের দোসরদের সহায়তায় এখানে অনেক নিরীহ লোককে হত্যা করে। মুজাফ্ফরাবাদ গণহত্যা সংঘটিত হয় ৩রা মে। এদিন পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসররা মুজাফ্ফরাবাদ গ্রামের তিন শতাধিক লোককে হত্যা, ৪০-৫০ জন নারীকে ধর্ষণ ও অনেক ঘরবাড়ি লুট করে এবং পরে ঐসব ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। দক্ষিণ ভূর্ষি গণহত্যা সংঘটিত হয় ৪ঠা মে। এদিন পাকবাহিনী দক্ষিণ ভূর্ষি গ্রামে ৮ জনকে হত্যা ও অনেক নারীকে ধর্ষণ করে এবং অনেক বাড়িঘর লুট করার পর জ্বালিয়ে দেয়। কেলিশহর গণহত্যা সংঘটিত হয় ১৬ই মে। এদিন পাকবাহিনী কেলিশহরে ৩৩ জন নিরীহ লোককে হত্যা ও অনেক নারীকে ধর্ষণ করে এবং তাদের দোসররা অনেক বাড়িঘর লুট করার পর জ্বালিয়ে দেয়। ছনহারা গণহত্যা সংঘটিত হয় ১৭ই মে। এতে ৯ জন গ্রামবাসী প্রাণ হারান। ভাটিখাইন গণহত্যা সংঘটিত হয় মে মাসে। এ-সময় পাকবাহিনী ভাটিখাইনে দুদিনে ১১ জনকে হত্যা করে এবং অনেক বাড়িঘরে আগুন দেয়। গৈড়লা গণহত্যা সংঘটিত হয় ২৭শে মে। এতে ৬ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। শাহমীরপুর ফিরিঙ্গি বাড়ি গণহত্যা সংঘটিত হয় ৪ঠা জুন। এদিন পাকবাহিনী পশ্চিম পটিয়া শাীরপুর মরিয়ম আশ্রম প্রাঙ্গণে ১১ জন নিরীহ লোককে হত্যা করে। মনসার টেক গণহত্যা সংঘটিত হয় ২১শে আগস্ট। এদিন সকালে মনসার টেকের পূর্বপাশে পাকবাহিনী ৭-৮ জন নিরীহ লোককে হত্যা করে। বাইন্যাপাড়া গণহত্যা সংঘটিত হয় ২৬শে অক্টোবর। এতে ৭ জন নিহত ও দুজন আহত হয়। অনেক বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও অনেক নারীকে ধর্ষণ করা হয়। কচুয়াই গণহত্যা সংঘটিত হয় ১০ই ডিসেম্বর এদিন পাকবাহিনী কচুয়াই ইউনিয়নে ১০ জনকে হত্যা করে। ১১ই ডিসেম্বর ইন্দ্রপোল গণহত্যায় ২৭ জন মানুষ শহীদ হন।
পটিয়া উপজেলায় পটিয়া পিটিআই, পটিয়া কলেজ, আব্দুস সোবহান রাহাত আলী হাইস্কুল, পটিয়া জমিরিয়া মাদ্রাসা এবং জিরি মাদ্রাসায় পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বাধীনতার পক্ষের এমনকি নিরীহ লোকজনদেরও ধরে এনে এখানে নির্যাতন করা হতো।
পটিয়ায় দুটি বধ্যভূমি ও গণকবর আছে – পটিয়া কলেজ বধ্যভূমি এবং পটিয়া পিটিআই বধ্যভূমি ও গণকবর। প্রথমটিতে বিভিন্ন সময়ে বহু লোককে হত্যা, নির্যাতন ও বহু নারীকে ধর্ষণ করা হয়। দ্বিতীয়টিতে এপ্রিলের শেষার্ধ থেকে শুরু করে আত্মসমর্পণের পূর্ব পর্যন্ত পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা অগণিত নিরীহ ও স্বাধীনতাকামী মানুষকে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পটিয়া উপজেলায় একাধিক স্থানীয় মুক্তিবাহিনী গড়ে ওঠে। এর মধ্যে ১১টি বাহিনী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাহিনীসমূহ হলো- মহিউল আলম বাহিনী, করিম বাহিনী, ইসলাম কোম্পানি, ২১৫১নং গৌরাঙ্গ প্রসাদ মিত্র গ্রুপ, সামশুদ্দিন আহমদ গ্রুপ, অধ্যাপক শামসুল ইসলাম গ্রুপ, নুরুল ইসলাম গ্রুপ, আবু সৈয়দ গ্রুপ, মহসিন খান গ্রুপ, ২টি এম আলী বাহিনী ও শাহ্ আলম গ্রুপ। বরিশালের অধিবাসী ফ্লাইট সার্জেন্ট মহিউল আলম মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বরমা ইউনিয়নের শাহজাহান ইসলামাবাদীর দেউরি ঘরে ঘাঁটি স্থাপন করেন এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য, পালিয়ে আসা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর সদস্যদের নিয়ে একটি মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলেন। এ বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে স্থানীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। রাউজানের নোয়াপাড়া গ্রামের মল্লপাড়ার অধিবাসী সিরাজুল করিম ছিলেন করিম বাহিনীর প্রধান। তিনি ছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর কর্পোরাল। ক্যাপ্টেন করিম নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি হুলাইন গ্রামে এডভোকেট জালাল উদ্দিনের বাড়িতে বসে এ বাহিনী গঠনের কাজ শুরু করেন। ইসলাম কোম্পানির প্রধান ছিলেন হাবিলদার আবু মোহাম্মদ ইসলাম। অক্টোবর মাসে তিনি ধোপাছড়িতে গিয়ে সুলতান আহমদ কুসুমপুরী এমপিএ প্রমুখের সহায়তায় শতাধিক সদস্য নিয়ে এ বাহিনী গঠন করেন। ১৫১নং গৌরাঙ্গ প্রসাদ মিত্র গ্রুপের প্রধান ছিলেন ঢাকার নটরডেম কলেজের অধ্যাপক গৌরাঙ্গ প্রসাদ মিত্র গ্রুপ এবং অধ্যাপক শামসুল ইসলাম গ্রুপের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক শামসুল ইসলাম। নুরুল ইসলাম গ্রুপের প্রধান ছিলেন বিএলএফ নেতা নুরুল ইসলাম (মনসা, পটিয়া)। এ গ্রুপ ফটিকছড়ি ও রাউজান এলাকায় পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসদের বিরুদ্ধে একাধিক যুদ্ধ করে। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আবু সৈয়দ (হাইদগাঁও, পটিয়া)-এর নামে পরিচিত ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলটি। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে এ গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। পটিয়ার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মহসিন খান (নাইক্ষাইন, পটিয়া) মহসিন খান গ্রুপের প্রধান ছিলেন। পটিয়া এলাকায় তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অস্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নন-কমিশন অফিসার টি এম আলীর নেতৃত্বে পটিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বাহিনী গড়ে ওঠে, যা টি এম আলী বাহিনী নামে সুপরিচিত। মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম এলাকায় এ বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশিষ্ট বামপন্থী সংগঠক শাহ্ আলম (কচুয়াই, পটিয়া)-এর নামে মুক্তিযোদ্ধাদের এ বাহিনী গড়ে ওঠে। পটিয়া ও বোয়ালখালী এলাকায় বিভিন্ন যুদ্ধে এ বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পটিয়া উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বহু সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েকটি সফল অপারেশনও পরিচালনা করেন। সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো- জিরি কাজির হাট যুদ্ধ, গিরি চৌধুরী বাজার অপারেশন, পটিয়া অপারেশন, পটিয়া থানা অপারেশন, পটিয়া এলএসবি গোডাউন অপারেশন, কালারপোল পুলিশ ফাঁড়ি অপারেশন চাপারা রাডার স্টেশন অপারেশন, মিলিটারি পুল অপারেশন, রায়খালী ব্রিজ অপারেশন, গোমদণ্ডি অপারেশন, জিরি মাদ্রাসা মুজাহিদ ক্যাম্প অপারেশন, খরনা স্টেশন রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, মালিয়ারা অপারেশন মিলিটারি পুল যুদ্ধ, খানমোহনা রেলস্টেশন রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন কেলিশহর রাজাকার অপারেশন, ধলঘাট রেল স্টেশন অপারেশন, পটিয়া ইন্দ্রপুল অপারেশন, উত্তর ভূর্ষি রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন ধলঘাট রেললাইন অপারেশন গৈড়লার টেক অপারেশন, ভাটিখাইন রাজাকার অপারেশন, কেয়ারাছড়ি অপারেশন, রাজস্থলী প্রাথমিক বিদ্যালয় যুদ্ধ, ধলঘাট হাসপাতাল যুদ্ধ এবং কৈয়গ্রাম বাজার ব্রিজ অপারেশন। এছাড়া আরো যেসব যুদ্ধ এবং অপারেশন পরিচালিত হয়েছে সেগুলো হলো- মনসার টেক অপারেশন, মুন্সীর হাট তহশিল অফিস অপারেশন, চাপারা তহশিল অফিস অপারেশন, পশ্চিম পটিয়া রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, পটিয়া তহশিল অফিস অপারেশন, কেলিশহর তহশিল অফিস অপারেশন, রাউজান রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, পটিয়া থানা শান্তি কমিটি হেডকোয়ার্টার্স অপারেশন- পটিয়া সদরে রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, আশিয়া যুদ্ধ, দেওয়ানহাট যুদ্ধ, পটিয়া জমিরিয়া মাদ্রাসা মুজাহিদ ক্যাম্প অপারেশন, হাতিয়ারঘোনা অপারেশন, কালীগঞ্জ ব্রিজ অপারেশন, ধলঘাট পুলিশ ফাঁড়ি অপারেশন এবং পূর্ব শাকপুরা যুদ্ধ। ১৩ই ডিসেম্বর পটিয়া উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আহমেদ হোসেন, বীর প্রতীক- (পিতা আসাদ আলী, কুসুমপাড়া) ও দুদু মিয়া, বীর প্রতীক- (পিতা বদিউর রহমান, গোবিন্দারখিল)।
পটিয়া উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— ফ্লাইট সার্জেন্ট মহিউল আলম, ক্যাপ্টেন করিম, ইসলাম মিয়া (পিতা মফিজ উল্লাহ, বিনিনিহারা), পূর্ণেন্দু দস্তিদার (পিতা চন্দ্রকুমার দস্তিদার, ধলঘাট), হাবিলদার আবদুল লতিফ (চরকানাই), বদিউল আলম (পিতা ওমতাজ মিয়া, ছনহারা), আবদুচ ছালাম (পিতা সৈয়দ অলি আহমদ, জিরি), মোহাম্মদ লোকমান (পিতা মোহাম্মদ আমিন, জিরি), শাহ্ আলম (পিতা হাজি আমজু মিয়া, দক্ষিণ শ্রীমাই), গাজী আবদুচ ছবুর (পিতা আলী চাঁদ, পটিয়া), জমির উদ্দিন (পিতা আবদুল খালেক, পূর্ব হাইদগাঁও), রফিক আহমদ (পিতা ছমদ আলী, পটিয়া), আলী আহমদ (পিতা হামিদ আলী, হাইদগাঁও), মোহাম্মদ ইব্রাহিম (পিতা আবদুল খালেক, গৈড়লা), নুরুল আনোয়ার (পিতা নুরুল ইসলাম, রশিদাবাদ), হারুন-অর-রশিদ (পিতা সাহের মিয়া, এয়াকুবদণ্ডি), মোহাম্মদ রফিক (পিতা বজলুর রহমান, বোয়ালখালী; পটিয়া কালারপোল যুদ্ধে শহীদ), নুরুল হক (বোয়ালখালী; টি এম আলী গ্রুপের সদস্য, নোয়াপতং যুদ্ধে শহীদ), আমির হামজা (বোয়ালখালী; ইপিআর সদস্য, ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে শহীদ), রাসবিহারী নাথ (শিকলবাহা), সৈয়দ আবুল বশর চৌধুরী (গৈড়লা) এবং সুবেদার হাফেজ (চরকানাই)।
পটিয়া উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে যেসব স্মৃতিসৌধ, স্মৃতিফলক ও ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে সেগুলো হলো— পটিয়া সদরে জাতীয় স্মৃতিসৌধের অনুরূপ স্মৃতিসৌধ ও শহীদ মিনার, মুজাফ্ফরাবাদ বধ্যভূমিতে স্মৃতিফলক, গৈড়লার টেক মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ ‘বিজয় মিনার’ এবং ‘ঘৃণাস্তম্ভ’ (পাকদোসরদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের জন্য)। যেসব প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে সেগুলো হলো- শহীদস্মৃতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (খরনা), শহীদ মুক্তিযোদ্ধা গাজী আবদুচ ছবুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (কেলিশহর), শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলম পাঠাগার (উত্তর ছনহারা)। যেসব সড়কের নামকরণ করা হয়েছে সেগুলো হলো— শহীদ মুক্তিযোদ্ধা গাজী আবদুচ ছবুর রোড (থানামোড়, পটিয়া), শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শাহ্ আলম সড়ক (খরনা-কচুয়াই), বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলতান আহমদ কুসুমপুরী এমপিএ সড়ক (কুসুমপুরা ইউনিয়ন), বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী এমএনএ সড়ক (পটিয়া পৌরসভা) এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রফিক আহমদ সড়ক (পটিয়া ডাকঘর সংলগ্ন)। এছাড়া কুসুমপুরা ইউনিয়নে একটি চত্বরের নামকরণ করা হয়েছে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা চৌধুরী হারুন-অর- রশিদ চত্বর’। [শামসুল আরেফীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড