You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে নেত্রকোনা সদর উপজেলা - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে নেত্রকোনা সদর উপজেলা

নেত্রকোনা সদর উপজেলা রাজনীতি-সচেতন একটি এলাকা। ১৯৩৯ সালে নেত্রকোনা সদরে নেতাজি সুভাষচন্দ্ৰ বসু এক জনসভায় ভাষণ প্রদান করেন। ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় সর্বভারতীয় কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান আমলে বাঙালির সকল গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে নেত্রকোনার মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর প্রার্থীরা এখান থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাতই মার্চের ভাষণ শোনার পর থেকে নেত্রকোনা সদরের সাধারণ মানুষ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এর পূর্বে ৩রা মার্চ ছাত্রলীগ- নেত্রকোনা শহরে মিছিল বের করে। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে প্রতিদিন গ্রাম থেকে হাজার-হাজার মানুষ মিছিল করে নেত্রকোনা শহরে আসত। ২৫শে মার্চ ঢাকার গণহত্যার খবর নেত্রকোনার গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছলে সাধারণ মানুষ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ২৭শে মার্চ নেত্রকোনা সদরের আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে আব্বাস আলী খান এমপিএ ও নূরুল ইসলাম খানের (এন আই খান) নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। তখন ছাত্র সংগ্রাম কমিটিও গঠিত হয়। পরে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত সংগ্রাম কমিটিগুলো বিস্তৃতি লাভ করে। উভয় সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে নেত্রকোনা সদরে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম চলতে থাকে।
এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক ছিলেন এডভোকেট আবদুল মমিন এমএনএ, আব্বাস আলী খান এমপিএ, ফজলুর রহমান খান, পৌরসভার চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম খান (এন আই খান), খালেকদাদ চৌধুরী প্রমুখ। ছাত্রলীগের সাবেক মহকুমা সভাপতি মো. শামসুজ্জোহা (পিতা নুরুজ্জামান, নাগড়া; নেত্রকোনা জেলার সাবেক ভিপি), আশরাফ আলী খান খসরু, ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম এরশাদুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক হায়দার জাহান চৌধুরী, বাদল মজুমদার, আনিছুর রহমান, গুলজার আহমেদ প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধ শুরু হলে কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দেন মো. শামসুজ্জোহা, সাফায়াত্ আহামেদ খান, আবু সিদ্দিক আহমেদ (পিতা সৈয়দ আহমেদ তালুকদার, নাড়িয়াপাড়া), আলতাব আহমেদ ও শামছুদ্দীন আহমেদ।
নেত্রকোনা মোক্তারপাড়া মাঠে স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির ব্যবস্থাপনায় যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণের জন্য নেত্রকোনা কলেজের ডামি রাইফেলগুলো সংগ্রহ করা হয়। মোক্তারপাড়া মাঠের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন স্থানীয় আনসার কমান্ডার আলী ওসমান তালুকদার। মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে নেত্রকোনা সদরের অনেক আনসার ও সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য নিজ-নিজ এলাকায় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেন। নেত্রকোনা সদরের মদনপুর গ্রামেও একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে ওঠে। এ ক্যাম্পের প্রশিক্ষক ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত এক ইপিআর সদস্য। দেশের এসব স্থানে প্রশিক্ষণ ছাড়াও নেত্রকোনা সদরের অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভারতের তুরা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ২৩শে এপ্রিল দুটি পাকিস্তানি যুদ্ধ বিমান নেত্রকোনার ওপর দিয়ে চলে যায়। পাকিস্তানি সেনারা যাতে নেত্রকোনা সদরে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য নেত্রকোনার প্রবেশপথ কেন্দুয়ার রামপুর ও সদরের চল্লিশা বাজারে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে রাস্তার ওপর গাছ ও ড্রাম ফেলে প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয়৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সড়কপথে ২৯শে এপ্রিল সকালে নেত্রকোনা সদরে অনুপ্রবেশ করে। শহরে প্রবেশ করেই তারা মহুকুমা প্রশাসকের অফিসে যায়। পরে স্থানীয় প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও ভকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে তাদের প্রধান ক্যাম্প স্থাপন করে। আখড়ার মোড়ে অবস্থিত সাহা স্টুডিওকেও তাদের একটি ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে। স্থানীয় সার্কিট হাউসটি ব্যবহৃত হতো পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার বাংলো হিসেবে। এ বাংলোর কয়েকটি কক্ষ থেকে সামরিক সদর দপ্তরের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। ঠাকুরাকোনা বাজারে পাকবাহিনীর একটি অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল। নেত্রকোনা সদরে পাকিস্তানিরা প্রবেশের কয়েক দিনের মধ্যে তারা শ্যামগঞ্জ- মোহনগঞ্জ রেলপথের চল্লিশা রেলসেতু, ঠাকুরাকোনা রেলসেতুসহ মধ্যবর্তী প্রত্যেক সেতুতে পাহারার ব্যবস্থা করার জন্য রাজাকারদের দিয়ে ক্যাম্প বসায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় নেত্রকোনা সদরে জামায়াতে ইসলামী ও <নেজামে ইসলামী-র বেশ তৎপরতা ছিল। জামায়াত ও নেজামে ইসলামীর সঙ্গে মুসলিম লীগ-এর স্থানীয় নেতা- কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নেত্রকোনা সদর থেকে প্রাদেশিক পরিষদে জামায়াতে ইসলামীর ফজলুল করিম খান এবং জাতীয় পরিষদে নেজামে ইসলামীর মওলানা মঞ্জুরুল হক প্রার্থী ছিল। নেত্রকোনায় শান্তি কমিটির সভাপতি ছিল মুসলিম লীগ নেতা এ কে ফজলুল হক। কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিল ডা. আবদুর রাজ্জাক, আবদুল হেকিম তালুকদার (মওলা মিয়া), খোরশেদ উদ্দিন চৌধুরী, ফারুক আহমেদ, আমীর আলী খান পাঠান (এ আর খান পাঠান), মৌলবী আবদুল খালেক, অছিম উদ্দিন আহমেদ, প্রিন্সিপাল তসদ্দক আহমেদ, অধ্যাপক আবদুল জলিল, এডভোকেট জলিল আজাদ, এডভোকেট এ টি এম আজিজ, এডভোকেট আবদুল আজিজ তালুকদার, আবদুল আজিজ খান, রফিক উদ্দিন, মুজিবুর রহমান (শিক্ষক), ডা. আজাদ, আবুল উদ্দিন মোক্তার, নাবালক মিয়া, অধ্যাপক এম ইউসুফ প্রমুখ।
নেত্রকোনা সদরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ছিল প্রথমে ক্যাপ্টেন জাহিদী। দুমাসের মধ্যে মেজর বাবরকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়। আগস্ট মাসের শেষদিকে মেজর বাবরের পরিবর্তে কর্নেল রাজ্জাক মির্জা যোগ দেয়। নেত্রকোনায় আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিল ওবায়দুল হক তাহের, হেদায়েত উল্লাহ ওরফে আঞ্জু, এজাহারুল হক, দুলাল মিয়া, হুমায়ুন, জাহাঙ্গীর, নান্নু মিয়া, আব্দুর রশিদ প্রমুখ। রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ছিল চাঁন মিয়া। রাজাকার বাহিনীর অন্য সদস্যদের মধ্যে সোনা মিয়া, কালু মিয়া, ভোলা মিয়া, মাজু মিয়া, বিল্লাল হোসেন, শহীদুল্লাহ, জহুর উদ্দিন, আনোয়ার হোসেন মিস্টার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। নেত্রকোনা শহর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষজনের ওপর এরা নানাভাবে নির্যাতন চালায়।
২৯শে এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নেত্রকোনায় অনুপ্রবেশ করেই জজ কোর্টের সামনের রাস্তা থেকে ডা. মিহির সেন, সিদ্ধার্থ সেন, শংকর সেন ও করুণা দে-কে ধরে নিয়ে যায়। বিকেলে নেত্রকোনা-পূর্বধলা সীমান্তবর্তী ত্রিমোহনী ব্রিজের ওপর দাঁড় করিয়ে তাঁদের গুলি করে। গুলিতে ঘটনাস্থলে ডা. মিহির সেন, সিদ্ধার্থ সেন ও করুণা দে নিহত হন। শংকর সেনের শরীরে ৫টি বুলেট বিদ্ধ হলে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন এবং পরবর্তীতে তিনি মারা যান।
একই দিন দালালদের সহায়তায় নেত্রকোনা শহর থেকে অনেককে ধরে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা ত্রিমোহনী ব্রিজে লাইন করে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এখানে নিহতদের মধ্যে যাদের পরিচয় জানা গেছে, তারা হলেন- সুরেন্দ্র চন্দ্র সাহা, সতীশ চন্দ্র সরকার, দুর্গানাথ চক্রবর্তী, ব্রজেন্দ্র চন্দ্র সরকার, মতিলাল সাহা, পীযূষ কান্তি সাহা, দীপক কুমার পাল, সন্তোষ চন্দ্র পাল, দিলীপ কুমার পাল, রমেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী, অজিত কুমার সাহা, সতীশ চন্দ্র সাহা, স্বদেশ দত্ত, যোগেন্দ্র চন্দ্র সরকার, বিনন্দ্র চন্দ্র দে, মণীন্দ্র চন্দ্র সাহা, বিনয় ভূষণ সরকার ও দীনেশ চন্দ্র সরকার। গুলিতে প্রফুল্ল চন্দ্র সরকার নামে একজন আহত হন। এ ব্রিজে পরে কামিনী চক্রবর্তী ও অনিল পণ্ডিতকেও হত্যা করা হয়।
৬ই আগস্ট রাতে পাকবাহিনী উকিল অখিল সেন ও হেম সেনকে নেত্রকোনা মোক্তারপাড়া ব্রিজে গুলি করে হত্যা করে। রাজারকাররা অভয় দিয়ে তাদের নেত্রকোনা শহরে এনেছিল। ১৩ই নভেম্বর আলবদরদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী বিরামপুর বাজার থেকে আবদুল মালেক শান্তু, আবু সিদ্দিক ও ইসমাইল হোসেনকে ধরে এনে মোক্তারপাড়া ব্রিজে হত্যা করে।
পাকবাহিনী ও রাজাকাররা নেত্রকোনা সদর উপজেলার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে সবচেয়ে বেশি লুটপাট ও নির্যাতন চালায়। বিশেষ করে শহরের বড় বাজার, অজহর রোড, উকিলপাড়া এবং আমতলা, সিংহের বাংলা, নূরপুর প্রভৃতি গ্রামে ব্যাপক লুটপাট করে। জুন মাসে কালিয়ারা গাবরাগাতীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সিদ্দিকের বাড়িসহ ৪২টি বাড়িতে হানাদাররা অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনার কয়েক দিন পর রাজাকার সিদ্দিক মুন্সির সহায়তায় ঠাকুরাকোনার বিপ্লবী সুধীর মজুমদারের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়।
নেত্রকোনা শহরের ডাকবাংলো, প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ভকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, বড় বাজারের সর্বমোহন বণিকের দোতলা বাসা ও সাহা স্টুডিও ছিল পাকসেনাদের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। সর্বমোহন বণিকের বাসার দ্বিতীয় তলায় নির্যাতনকেন্দ্র ছিল। সাহা স্টুডিওতে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হতো।
নেত্রকোনা সদরের উল্লেখযোগ্য বধ্যভূমিগুলো হলো- সদর থানার পার্শ্ববর্তী মগড়া নদীতীর বধ্যভূমি, বধ্যভূমি, জাহানারা বালিকা বিদ্যালয়ের পাশে অবস্থিত মগড়া নদীর পাড় বধ্যভূমি ও ত্রিমোহনী বধ্যভূম। নেত্রকোনায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আবু সিদ্দিক আহমেদ (পিতা সৈয়দ আহমেদ তালুকদার, নাড়িয়াপাড়া, নেত্রকোনা সদর) বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ভারতের তুরা ক্যাম্পের প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রথমে প্লাটুন কমান্ডার এবং পরে কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।
নেত্রকোনা, দুর্গাপুর, কমলাকান্দা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধে অপর এক কোম্পানি কমান্ডার মো. শামসুজ্জোহা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা মহাবিদ্যালয় ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। তিনি মহকুমা ছালীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি মেঘালয়ের বাঘমারা ইয়ুথ ক্যাম্পে যোগ দেন। এরপর তুরা ক্যাম্পে এক মাসের প্রশিক্ষণ শেষে ১৩২ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত একটি কোম্পানির কমান্ডার নিযুক্ত হয়ে দেশে ফেরেন। এটি জোহা কোম্পানি নামে পরিচিত ছিল।
৭ই জুলাই নেত্রকোনার কংস নদীর তীরে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। কংস নদীর যুদ্ধ-এ হানাদাররা পরাজিত ও বিপর্যস্ত হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন আবু সিদ্দিক আহমেদ। মুক্তিযোদ্ধারা জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে নেত্রকোনার সঙ্গে বারহাট্টা ও মোহনগঞ্জের পাকিস্তানি হানাদারদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আবু সিদ্দিক আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ১৩ই জুলাই ঠাকুরাকোনা রেলব্রিজ ধ্বংস করে। হাবিব, আবু আক্কাছ, আবু খাঁ-সহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মধ্যরাতে ডিনামাইটের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এ রেলব্রিজটি ধ্বংস করেন। এ অপারেশন সফল হওয়ায় নেত্রকোনার সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদারদের বারহাট্টা ও মোহনগঞ্জের যোগাযোগ সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
৮ই ডিসেম্বর শেষরাত থেকে ধর্মপাশা, মোহনগঞ্জ, বারহাট্টা অঞ্চলের পাকিস্তানি সৈন্যরা নেত্রকোনার দিকে দলে- দলে পালিয়ে আসতে থাকে। মোহনগঞ্জ-নেত্রকোনা সড়ক দিয়ে আসার পথে দরুন সহতা গ্রামের কাছে তিন শতাধিক পাকিস্তানি সেনার একটি দলের মুখোমুখি হন আবদুল গনি ও ইসব আলী নামের দুজন মুক্তিযোদ্ধা। এঁরা আত্মরক্ষার্থে পাকসেনাদের প্রতি গুলি ছোড়েন। পাকসেনারা তাদের প্রতি পাল্টা গুলি ছোড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে তারা পার্শ্ববর্তী কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
৮ই ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি হানাদারদের একটি দল আমতলা-নেত্রকোনা রাস্তা ধরে নেত্রকোনা শহরে প্রবেশ করে। ইতোমধ্যে নেত্রকোনার পূর্বধলা ও দুর্গাপুর ব্যতীত বাকি থানাগুলো ছেড়ে এসে হানাদাররা নেত্রকোনা শহরে অবস্থান নেয়। এদিন নেত্রকোনা শহরকে হানাদারমুক্ত করতে <মিত্রবাহিনীর ক্যাপ্টেন চৌহানের পরামর্শে আবু সিদ্দিক আহমেদের নেতৃত্বে আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী নেত্রকোনা শহরের উত্তর দিক থেকে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণ শুরু হয়। রাত থেকে শহরের দক্ষিণে খামারবাড়িতে প্রায় ৩০০ মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেন। গভীর রাতে শহরের উত্তর দিক থেকেও আক্রমণ শুরু হয়। পাকিস্তানিরা প্রতিরোধ করলে দুপক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধ ৪-৫ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আবু খাঁ, আবদুস সাত্তার ও আবদুর রশিদ শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধাদের দলনেতা আবু সিদ্দিক আহমেদ আহত হন। অপরপক্ষে বহু পাকসেনা হতাহত হয়। এ-যুদ্ধ নেত্রকোনা শহর যুদ্ধ— নামে পরিচিত। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে নেত্রকোনা থেকে পাকবাহিনী ময়মনসিংহের রাস্তা ধরে ঢাকার দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ৯ই ডিসেম্বর সকালে নেত্রকোনা সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- খলিলুর রহমান খান, বীর প্রতীক- (পিতা আবদুস সোবহান খান, উত্তর সাতপাই), মো. হেলালুজ্জামান, বীর প্রতীক- (পিতা আবদুল গফুর, দেবশ্রী) ও মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ, বীর প্রতীক- (পিতা ছমির উদ্দিন মাস্টার)।
নেত্রকোনা সদরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- লুৎফর রহমান তালুকদার (পিতা আবদুস সুবান তালুকদার, নন্দীপুর), ডা. আবদুল আজিজ (পিতা ডা. মকবুল হোসেন, দিগলা), ফজলুল হক (পিতা ফরহাদ আলী, নাগড়া), আবদুর রশিদ (পিতা সদর আলী মণ্ডল, কাঠপোড়া), আব্দুল জব্বার (পিতা হাসান খাঁ, গাবরাগাতী), আব্দুস সাত্তার (পিতা ডামন শেখ, গাবরাগাতী), গোলাম মোস্তফা (পিতা জালাল আহমেদ, শিবগঞ্জ রোড, মালনী; ইপিআর), আব্দুল বারী (পিতা জাবেদ আলী, কোনাপাড়া; সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য), আব্দুল খালেক (পিতা শেখ কলিম উদ্দিন, মালনী রোড), এলাহী নেওয়াজ ওসমানী (পিতা সমর আলী, কাটলী) এবং রইচ উদ্দিন (পিতা হোসেন আলী মণ্ডল, পুলিশ সদস্য, পাঁচাশী)।
নেত্রকোনায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে কিছু স্মৃতিস্মারক নির্মাণ করা হয়েছে। নেত্রেকোনা ডিসি অফিসের সামনে রয়েছে ‘প্রজন্ম চত্বর’। সদর থানার পাশে মগড়া নদীর তীরে ১৯৭২ সালে নির্মিত হয় “শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ’। পরে এ স্তম্ভটি ভেঙ্গে নতুন মডেলে পুনর্নির্মাণ করা হয়। মোক্তারপাড়া ব্রিজের পাশে মিতালী সংঘ নামে একটি সংগঠন নির্মাণ করেছে স্মৃতি একাত্তর স্মারকস্তম্ভ। নেত্রকোনা সরকারি কলেজের ছাত্র সংসদ প্রাঙ্গণে নির্মাণ করা হয়েছে ‘স্বাধীনতা ভাস্কর্য’। নেত্রকোনা সদর থানার কালিয়ারা গাবরাগাতী ইউনিয়নে মুক্তির বাজার নামে একটি বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। [আলী আহাম্মদ খান আইয়োব]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড