নৈনগাঁও গণহত্যা (দোয়ারাবাজার, সুনামগঞ্জ)
নৈনগাঁও গণহত্যা (দোয়ারাবাজার, সুনামগঞ্জ) সংঘটিত হয় ১৯শে আগস্ট। এতে পাকহানাদারদের হাতে ১৯ জন সাধারণ মানুষ হত্যার শিকার হন। অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। অধিকাংশ লাশ জলে ভাসিয়ে দেয়া হয়। মানুষজনের ঘরবাড়িতেও তারা অগ্নিসংযোগ করে।
সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলা সদর থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার উত্তরে নৈনগাঁও গ্রাম। গ্রামটির দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সুরমা নদী। ১৯শে আগস্ট পাকবাহিনী এ গ্রামটিতে নৃশংস গণহত্যা চালায়। নৈনগাঁও-এর <আওয়ামী লীগ নেতা ইদ্রিস আলী মাস্টারের গাইডে মুক্তিযোদ্ধারা বেতুরা গ্রামে স্থাপিত পাকসেনাদের ক্যাম্প আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয় এবং নৈনগাঁও-এর গ্যাস পাইপ লাইনে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করে দিলে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক। এসব কারণে ইদ্রিস আলী মাস্টার ও নৈনগাঁও গ্রামের মানুষ কুখ্যাত দালাল মতছির আলী ফকির (বেতুরা, ছাতক; ফকির চেয়ারম্যান নামে পরিচিত; ছাতক থানা শান্তি কমিটির সদস্য)-এর রোষানলে পড়ে। ১৯শে আগস্ট দালাল মতছির আলী ফকিরের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাকবাহিনী নৈনগাঁও গ্রামে গণহত্যা চালায়। এদিন বেলা ১১ ঘটিকায় পাকসেনা ও রাজাকাররা দুটি লঞ্চযোগে সুরমা নদীপথে এসে নৈনগাঁও গ্রামে নামে। প্রথমে তারা হিন্দুপাড়ায় অগ্নিসংযোগ করে পুরো পাড়াটি ছারখার করে দেয় এবং গজেন্দ্র দাস, নরেন্দ্র দাস, আলকাছ আলীসহ কয়েকজন গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করতে-করতে পূর্বদিকে অগ্রসর হয়। এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে গ্রামের মানুষ ভয়ে মসজিদে গিয়ে আশ্রয় নেয়। পাকসেনারা মসজিদে প্রবেশ করে সেখান থেকে ২৫-৩০ জনকে ধরে ইয়াজ উল্লাহ বাড়ির উঠানে নিয়ে যায়। তারপর তাদের ৩ ভাগে ভাগ করে ইয়াজ উল্লাহর বাড়ি, আসিদ আলীর বাড়ি এবং উত্তর পাশের মাঠে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। সেদিন ১৯ জন সাধারণ মানুষ গণহত্যার শিকার হয়। তারা হলেন- ইদ্রিস আলী মাস্টার (পিতা দোস্ত মোহাম্মদ), গজেন্দ্র দাস (পিতা পরাণ দাস), মো. আসক আলী (পিতা মব উল্লা), রহমত আলী (পিতা জাফর আলী), আসকর আলী (পিতা মরম আলী), জায়ফর আলী (পিতা হোসেন বকস), চানফর আলী (পিতা পীর বকস), মনফর আলী (পিতা হোসেন বকস), আফরোজ আলী ওরফে ময়না (পিতা জোয়াদ উল্লা), ইদ্রিস আলী ওরফে ছলাই (পিতা ওয়াব উল্লা), নোয়াজ আলী (পিতা আজমত আলী), কাচা মিয়া (পিতা আকবর আলী), ছাইম উল্লা (পিতা সবদর মোড়ল), আবদুল মন্নাফ (পিতা মোহন আলী সরকার), আবদুর রব (পিতা আবদুল মন্নাফ), আব্দুর রজ্জাক (পিতা সদর আলী মুন্সী), ওয়াহিদ আলী (পিতা ইয়াজ উল্লা), আ. হেকিম (পিতা ইয়াকুব আলী) ও মফিজ আলী (পিতা উমর আলী)। এদিন গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে আছেন আলকাছ আলী, মফিজ আলী (পিতা মনকর আলী) ও যোয়াদ উল্লা (পিতা উছমান আলী)। মফিজ আলীর পেটের ডান দিক দিয়ে গুলি ঢুকে বাম দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। যোয়াদ উল্লার বুকের বাম দিক দিয়ে গুলি ঢুকে পিঠের দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। অপরজন আলকাছ আলী ডান বাহুতে গুলিবিদ্ধ হন। পাকবাহিনীর আঘাতে নরেন্দ্র দাসের দাঁত পড়ে যায় এবং মৃত ভেবে তাকে ফেলে রেখে যায়। গণহত্যায় শহীদদের মধ্যে শুধুমাত্র ইদ্রিস আলী মাস্টারের মরদেহ সমাহিত করা হয়। অন্যদের লাশ হাওড়ের জলে ভাসিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীকালে পাকবাহিনী আরো একবার নৈনগাঁও গ্রামে আসে এবং মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমানের ভাই আবাদ উল্লাকে হত্যা করে। জনাব আলী নামে একজনকে বেদম প্রহার করে ছেড়ে দিলেও ৭ দিন পর তিনি মারা যান। বধ্যভূমিটি চিহ্নিত করা অবস্থায় রয়েছে। তবে কোনো স্থাপনা নির্মিত হয়নি। [শফিউদ্দিন তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড