বীর প্রতীক নূরুল হক
নূরুল হক, বীর প্রতীক (১৯৪৫-১৯৭২) বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ১৯৭২ সালে আদমজীতে অবাঙালিদের গুলিতে শহীদ। তিনি ১৯৪৫ সালের ২৮শে এপ্রিল ফেনী জেলার দাগনভূঁইয়া উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের নয়নপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল লতিফ এবং মাতার নাম সুফিয়া বেগম। নূরুল হক বৈরাগী হাট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন শেষে চাকরি জীবনে প্রবেশ করেন। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তিনি গাড়িচালক হিসেবে যোগদান করেন। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে কর্মরত থাকাকালে নূরুল হক আদমজী জুট মিলস এলাকায় অবাঙালি কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের সীমাহীন দৌরাত্ম্য এবংবাঙালিদের প্রতি তাদের অসম্মানজনক আচরণ প্রত্যক্ষ করেন। এসব দেখে অবাঙালিদের বিরুদ্ধে তিনি ক্রমান্বয়ে বিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদমুখর হন। এ ক্ষোভ ও প্রতিবাদ তাঁকে পাকিস্তানিদের অন্যায় আচরণ থেকে বাঙালিদের মুক্তির সংগ্রামে যুক্ত করে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন- শুরু হলে তিনি তাতে যোগ দেন। নারায়ণগঞ্জ এলাকার সকল মিছিল ও সমাবেশে তিনি অংশ নেন। ১৯৭১ সালের মার্চে নূরুল হক ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। ২৫শে মার্চ পাকহানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ও তাঁর ভাই শামসুল হক, বীর প্রতীক সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে গিয়ে ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। উল্লেখ্য, তাঁর ভাই সামসুল হকও সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাজ করতেন। তিনি ফিটার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় নূরুল হক ও সামসুল হককে ভারতের মেঘালয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বিস্ফোরক বিষয়ক বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন নারায়ণগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে অপারেশন পরিচালনার জন্য তাঁদের প্রস্তুত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানিরা বাঙালি সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে অনুপস্থিতদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের আহ্বান জানায়। এ সুযোগ কাজে লাগানোর পরিকল্পনা অনুযায়ী নূরুল হক ও সামসুল হক সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যোগ দেন। এখানে কাজ করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অক্টোবর মাসে তাঁরা প্রথম কেন্দ্রের মেশিন রুমে বিস্ফোরক স্থাপন করেন। কিন্তু সেদিন তা বিস্ফোরিত হয়নি। ৪ঠা নভেম্বর তাঁরা আবার বিস্ফোরক স্থাপন করেন। গভীর রাতে প্রচণ্ড শব্দে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে সমগ্র নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার বৃহৎ অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এ অপারেশন সফল হওয়ার পর নূরুল হক পালিয়ে ভারতে চলে যান। নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে তিনি ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে আরো কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার নূরুল হককে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। স্বাধীনতার পর নূরুল হক তাঁর পূর্ববর্তী কর্মক্ষেত্র সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যোগ দেন। ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদাররা আত্মসমর্পণ করলেও আদমজী এলাকার অবাঙালিরা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে অস্বীকৃতি জানায়। মুক্তিযোদ্ধাদের বেষ্টনীর মধ্যে থেকেও তারা সশস্ত্র কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। ১৯৭২ সালের ১৪ই জানুয়ারি তারা বাঙালিদের ওপর গুলিবর্ষণ করলে নূরুল হকসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মকভাবে আহত হন। নূরুল হক এদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে নিজ গ্রামের পারিবারিক কবর স্থানে দাফন করা হয়। পারিবারিক উদ্যোগে শহীদ নূরুল হক ও তাঁর বড়ভাই শামসুল হক স্মরণে নয়নপুরে একটি শহীদবেদি স্থাপন করা হয়েছে। তিনি ১ পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম হাজেরা বেগম। [জালাল আহমেদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড