You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ

নূর মোহাম্মদ শেখ, বীরশ্রেষ্ঠ (১৯৩৬-১৯৭১) ইপিআর-এর শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। শত্রুর শেলের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়েও কাভারিং ফায়ার দিয়ে সহযোদ্ধাদের নিরাপদ বেইসে ফিরে যেতে ভূমিকা পালন এবং এরপর তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ। ১৯৩৬ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি যশোর জেলার নড়াইল মহকুমার (বর্তমান জেলা) সদর থানার মহিষখোলা গ্রামে এক কৃষক পরিবারে নূর মোহাম্মদ শেখের জন্ম। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ আমানত শেখ এবং মাতার নাম জেন্নাতুন নেসা। বড়ভাই ছোটবেলায় মারা যাওয়ায় তিনি ছিলেন পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। দশ বছর বয়সে ১৯৪৬ সালে তিনি মাতৃহারা হন। এর তিন বছর পর তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। এরপর তাঁর এক চাচা তাঁকে লালন-পালন করেন। কিন্তু তিনিও এক বছরের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। চাচার মৃত্যুর পর কিশোর নূর মোহাম্মদ চাচির হেফাজতে আসেন। কিন্তু অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস, তিন বছরের মধ্যে চাচিরও মৃত্যু
ঘটে এবং এর সঙ্গে তিনি অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন।
১৯৫২ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে গ্রামের এক কৃষকের কন্যার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর একটি কন্যা ও একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। শৈশব থেকেই চরম প্রতিকূল অবস্থার কারণে নূর মোহাম্মদের পড়াশোনা বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। স্থানীয় হাইস্কুল থেকে তিনি ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পাস করেন। সংসারের অভাব- অনটনের কারণে তাঁকে কাজের সন্ধানে ছুটতে হয়। প্রথমে তিনি আনসার বাহিনীতে যোগ দেন। এর দ্বারা সংসারের ব্যয় নির্বাহ না হওয়ায় ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকার পিলখানা ইপিআর বাহিনীতে যোগ দেন। রাজশাহীতে প্রশিক্ষণ শেষে তাঁকে দিনাজপুর ইপিআর উইং-এ নিযুক্ত করা হয়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় দিনাজপুর সীমান্তবর্তী বিওপি-তে পাহারারত অবস্থায় প্রতিপক্ষের গুলিতে তিনি আহত হন। ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে নূর মোহাম্মদ বদলি হয়ে যশোর হেডকোয়ার্টার্সের অধীন ৪নং ইপিআর উইং-এ যোগ দেন। তখন এর কমান্ডার ছিলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। ৭১-এর মার্চ মাসে তিনি যখন ছুটিতে বাড়িতে ছিলেন, তখনই ঢাকার পুলিশ লাইন, রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত হয় অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া ও মা-বোনদের ওপর পাশবিক নির্যাতন। এরূপ অবস্থায় তিনি নীরব থাকতে পারনেনি। ছুটি শেষ না হতেই তিনি দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে নিজ কর্মস্থল যশোর সেক্টরের ইপিআর ৪নং উইং-এ ছুটে যান এবং মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধকে সুসংগঠিত ও অধিকতর কার্যকর করার লক্ষ্যে এক পর্যায়ে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। ৮নং সেক্টরের দায়িত্ব মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর ওপর ন্যস্ত করা হয়। যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে ৮নং সেক্টরকে পুনরায় ৭টি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। এর একটি বয়রা সাব-সেক্টর। এর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদা। এ সাব-সেক্টরে সিপাহি নূর মোহাম্মদ পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিক এম্বুশ, ঝটিকা আক্রমণ ও সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের পাকহানাদার বাহিনীর বরনী বিওপি ক্যাম্প আক্রমণ ছিল একটি বড় ঘটনা। এখানকার যুদ্ধে প্রথমদিকে পাকবাহিনীর অনেক সৈন্য নিহত হয় এবং বাকিরা বিওপি ছেড়ে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু হঠাৎ করে পেছন থেকে পাকবাহিনীর একটি দল ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করলে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ-যুদ্ধে সিপাহি নূর মোহাম্মদ বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন এবং তাঁর ও অপর এক সৈনিকের কারণে কমান্ডার ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার প্রাণ রক্ষা পায়।
আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে আবু ওসমান চৌধুরীর পরিবর্তে মেজর এম এ মঞ্জুর সেক্টর কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট-ছোট গ্রুপে বিভক্ত করে পেট্রলিং, এম্বুশ, গেরিলা আক্রমণ, বিদ্যুৎ লাইন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্নকরণ ইত্যাদি কৌশলের ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করেন। ৫ই সেপ্টেম্বর সিপাহী নূর মোহাম্মদকে অধিনায়ক করে ৪ জন সহযোদ্ধার একটি পেট্রল গ্রুপকে যশোর ক্যান্টনমেন্টের অদূরে সুতিপুর প্রতিরক্ষা এলাকাধীন গোয়ালহাটি গ্রামের কাছে শত্রুপক্ষের গতিবিধির ওপর নজরদারি, তাদের সম্ভাব্য আক্রমণ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ইত্যাদি দায়িত্ব দিয়ে পাঠান হয়। এক পর্যায়ে তাঁরা পাকহানাদার বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হন। হানাদারদের ছোড়া গুলিতে সিপাহি নান্নু মিয়া মারাত্মকভাবে আহত হন। অধিনায়ক নূর মোহাম্মদ দ্রুত তাঁর দিকে এগিয়ে যান এবং তাঁকে কাঁধে তুলে এক হাতে শত্রুবাহিনীর ওপর গুলি ছুড়তে থাকেন। এমতাবস্থায় হানাদার বাহিনীর ছোড়া একটি গুলি তাঁর ডান কাঁধে বিদ্ধ হয় এবং মর্টার শেলের আঘাতে ডান হাঁটু ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। এতদ্সত্ত্বেও অধিনায়ক নূর মোহাম্মদ অপর সহযোদ্ধাদের আহত নান্নু মিয়াকে নিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে এবং তিনি কাভারিং ফায়ার চালিয়ে যাবেন এ কথা বলেন। সহযোদ্ধারা চাচ্ছিলেন অধিনায়ক নূর মোহাম্মদকেও তাঁদের সঙ্গে নিয়ে যেতে। নূর মোহাম্মদ কিছুতেই তাঁদের কথায় সম্মত হননি। তাঁর বক্তব্য ছিল, তাতে সকলকেই শত্রুর হাতে প্রাণ হারাতে হবে। সহযোদ্ধারা বারবার তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলে এবার অধিনায়কের কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে তিনি তাঁদের দ্রুত প্রস্থানের নির্দেশ দেন। অগত্যা গ্রুপের অন্য সদস্যরা আহত নান্নু মিয়াকে নিয়ে তাঁদের ক্যাম্পে ফিরে যেতে সক্ষম হন। শত্রুর গোলার আঘাতে মারাত্মক আহত অবস্থায় অসহনীয় যন্ত্রণা ও বিরামহীন রক্তক্ষরণের মধ্যেও নূর মোহাম্মদ সহযোদ্ধাদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছানো পর্যন্ত পুরোটা সময় কাভারিং ফায়ার চালিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রায় ১ ঘণ্টা পর অতিরিক্ত সৈনিক ও অস্ত্রশস্ত্রসহ সহযোদ্ধারা ঘটনা স্থলে এসে দেখেন অধিনায়ক নূর মোহাম্মদের নিথর দেহটি ঝোঁপের আড়ালে পড়ে আছে।
তাঁর দুটি চোখ হানাদার বাহিনী কর্তৃক উপড়ানো এবং সমগ্র শরীর বেয়নেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত।
এভাবে সিপাহি নূর মোহাম্মদের জীবনের বিনিময়ে সহযোদ্ধাদের জীবন রক্ষা পায়। তিনি মুক্তিযুদ্ধে দুঃসাহসিকতা ও গভীর দেশপ্রেমের স্বাক্ষর রাখেন। তাঁকে সীমান্তবর্তী কাশিপুরে সমাহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর আত্মত্যাগ ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ রাষ্ট্রীয় উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এছাড়া তাঁকে সিপাহি থেকে ল্যান্স নায়ক পদে মরণোত্তর পদোন্নতি দেয়া হয়। নড়াইল, মহিষখোলা নিজগ্রাম এবং ঢাকার পিলখানাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁর স্মরণে একাধিক সড়ক, স্থাপনা, প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে মহিষখোলা গ্রামে তাঁর নামে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর, যশোরের শার্শা উপজেলার কাশিপুরে তাঁর ও আরো কয়েক শহীদের সমাধি এবং ঢাকায় বিজিবি হেডকোয়ার্টার্সে তাঁর নামে একটি কলেজ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বাঙালি জাতির এ শ্রেষ্ঠ সন্তানের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। [হারুন-অর-রশিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!