বীর প্রতীক নূরউদ্দীন আহম্মেদ
নূরউদ্দীন আহম্মেদ, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৫২) স্কুলের ছাত্রাবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫২ সালের ৬ই জুন হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের সাতাইহাল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো. তমিজউদ্দীন আহমেদ, মাতার নাম তাহমিনা বেগম।
১৯৭১ সালে নূরউদ্দীন আহমেদ দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি রাজনীতি-সচেতন
ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বাঙালিদের ওপর গণহত্যা এবং ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের সঙ্গে তিনি প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এলাকার ছাত্র-যুবকদের সঙ্গে মিছিল সহকারে তিনি শেরপুর প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে তিনি নিজ এলাকা ছেড়ে হবিগঞ্জ হয়ে মৌলভীবাজারে চলে যান এবং মৌলভীবাজার সার্কিট হাউসে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট সেন্টারে অন্তর্ভুক্ত হন। এখান থেকে চা-বাগানের ভেতর বাঁশবাড়ি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ৭ দিনের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। অতঃপর কর্তৃপক্ষের নির্দেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য তিনি ভারতে চলে যান। প্রথম পর্যায়ে ভারতের আসলামবাড়িতে ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সেখান থেকে ভারতের ওমরানগরে প্রায় দেড় মাসের সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ৪ নম্বর সেক্টরের কুকিতল ও জালালপুর সাব-সেক্টরের অধীনে অন্তর্ভুক্ত হয়ে লাঠিটিলা, ছোটলেখা, কানাইঘাটসহ আরো কয়েকটি স্থানের যুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এর মধ্যে দিলকুশা চা-বাগান যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার অন্তর্গত দিলকুশা চা-বাগানে পাকিস্তানি ঘাঁটিতে আক্রমণ করেন। এ ঘাঁটির মাধ্যমে পাকিস্তানি সৈন্যরা সীমান্ত এলাকায় নজরদারি করত। স্থানটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ৪ মাইল দূরে অবস্থিত। সীমান্তের ওপারে কুকিতলে ছিল ৪ নম্বর সেক্টরের একটি সাব-সেক্টর। এ সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা প্রায়ই সীমান্ত অতিক্রম করে ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতিতে পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দলের সমন্বয়ে দিলকুশা চা-বাগান যুদ্ধ পরিচালিত হয়। তাঁরা ৩টি অ্যাসল্ট পার্টি ও ২টি কাট অফ পার্টি হিসেবে বিভক্ত ছিলেন। নূরউদ্দীন আহমেদ অ্যাসল্ট পার্টি বা আক্রমণকারী দলে ছিলেন। পরিকল্পনা মোতাবেক তাঁরা কুকিল থেকে রওনা হয়ে রাত ২টায় লাঠিটিলায় পৌছান। সেখান থেকে ভোর ৫টার দিকে দিলকুশা চা-বাগানে যান। পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্যাম্প থেকে ৫০-৬০ গজ দূরে অবস্থান নিয়ে অ্যাসল্ট পার্টির মুক্তিযোদ্ধারা তিনদিক থেকে তাদের ওপর আক্রমণ চালান। আকস্মিক আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। এ-যুদ্ধে নূরউদ্দীন আহমেদ যথেষ্ট বীরত্ব প্রদর্শন করেন। পাকিস্তানি সৈন্যদের পাল্টা আক্রমণে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নূরউদ্দীন আহমেদকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন। এরপর তিনি জাসদের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। পরবর্তী সময়ে পারিবারিক ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। বর্তমানে নিজ এলাকায় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তাঁর স্ত্রীর নাম সুলতানা তাইবুন নাহার। এ দম্পতি ২ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তানের জনক-জননী। [রেহানা পারভীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড