You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে নীলফামারী সদর উপজেলা

নীলফামারী সদর উপজেলা ১৯৭১ সালের মার্চের শুরুতেই নীলফামারীর রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ঢাকায় ঘোষিত কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এখানেও বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হতে থাকে। ৫ই মার্চ রঙ্গীন সাংস্কৃতিক সংস্থার উদ্যোগে তিস্তা ক্লিনিকের সামনে থেকে একটি গণমিছিল বের হয়ে মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয় (বর্তমান ডিসি অফিস সংলগ্ন লাল বিল্ডিং) ঘেরাও করা এবং পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর আব্দুর রউফ এমএনএ তাঁর গাড়িতে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা নিয়ে সৈয়দপুর গেলে বিহারিরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং তাঁর সঙ্গে বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে। এতে বাঙালি ও বিহারিদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং তা নীলফামারী সদর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ৯ই মার্চ বর্তমান চৌরঙ্গী মোড়ে স্মৃতি-অম্লান চত্বরে মিউনিসিপ্যালিটির একটি লাইট পোস্টে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এদিনই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জাতীয় পরিষদ সদস্য আফসার আলী আহমেদের বাসায় এক বৈঠকে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পরিষদের সদস্যরা ছিলেন- আফসার আলী আহমেদ এমএনএ, আব্দুর রউফ এমএনএ, খয়রাত হোসেন (সাবেক খাদ্যমন্ত্রী), কাজী আমিনুল হক (নীলফামারী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক), এডভোকেট দবির উদ্দিন আহমেদ (আওয়ামী লীগের নীলফামারী শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি), আব্দুর রহমান চৌধুরী (ঠাকুরগঞ্জ, ডিমলা), আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট জোনাব আলী, একরামুল হক, ইব্রাহীম মিয়া, আবু নাজেম মোহাম্মদ আলী, তরিকুল ইমলাম, নূরুল আমীন, ছাত্রলীগ নেতা এস এম সোলায়মান, ইয়াকুব আলী, আবু হাসান মো. ইলিয়াস, আমিনুল হক, তবিবুল ইসলাম, আবুল ফজল ফজু, মো. মতিয়ার রহমান, এনামুল কবির লুলু, মজিবর রহমান, সমীর কুমার কুণ্ডু, হায়দার আলী চৌধুরী মেনু, আনছারুল আলম ছানু, নূর ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলের ছাত্র সংসদের জিএস কাজী জাহেদুল ইসলাম প্রমুখ। এর পাশাপাশি একটি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদও গঠিত হয়। তার নেতৃত্বে ছিলেন দেলওয়ার হোসেন বুলবুল ও রুহুল আমিন। অন্যারা হলেন শওকত আলী টুলটুল, মতিউর রহমান, হযরত আলী, শাহজাহান আলী বুলবুল, আবদুল কুদ্দুস, আসাদুজ্জামান নূর (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রী) প্রমুখ। সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে সাধারণ জনগণ নিজ-নিজ বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। ২৩শে মার্চ পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসে মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনেও বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এতে নেতৃত্ব দেন ছাত্রনেতা সমীর কুমার কুণ্ডু, শওকত আলী টুলটুল, মো. মতিয়ার রহমান প্রমুখ।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর থেকেই মূলত মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। এজন্য এডভোকেট জোনাব আলীকে প্রধান করে একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়৷ এ কমিটির তত্ত্বাবধানে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর কর্মীসহ স্থানীয় যুবকরা ডামি রাইফেল ও বাঁশের লাঠি নিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। নীলফামারী টাউন ক্লাব মাঠে (বর্তমান নীলফামারী সরকারি হাইস্কুল মাঠ) প্রশিক্ষণ চলে। প্রশিক্ষণে নেতৃত্ব দেন অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য একরামুল হক, আনসার কমান্ডার আলী হোসেন, জানকীনাথ প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক আলী হোসেন মুন্সী, লোকমান হোসেন লোকো, ফজলুর রহমান এবং ইয়াকুব আলী। ইব্রাহীম মিয়ার নেতৃত্বে নীলফামারী বালিকা বিদ্যালয়ে কিছু সংখ্যক যুবতী নারীকেও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। দেশের মধ্যে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তাঁরা ভারতে যান এবং হলদীবাড়ি, দেওয়ানগঞ্জ, আটিয়াবাড়ি, ঘুঘুডাঙ্গা প্রভৃতি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
নীলফামারী সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন আফসার আলী আহমেদ এমএনএ, আব্দুর রউফ এমএনএ, আব্দুর রহমান চৌধুরী, জোনাব আলী, খয়রাত হোসেন, কাজী আমিনুল হক, আহসান আহমেদ. ডা. জাহিদ হোসেন, সামসুদ্দোহা, রাহাত খান, কানু ঘোষ, গোলাম সারওয়ার আবু, আবুল কালাম আজাদ, আসাদুজ্জামান নূর প্রমুখ। আর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন ইপিআর সুবেদার মেজর কাজিমুদ্দিন এবং আনসার কমান্ডার ফজলার রহমান। সহকারী কমান্ডার ছিলেন লোকমান হেসেন। ২৫শে মার্চ পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট- এবং ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আফসার আলী আহমেদ এমএনএ, এডভোকেট জোনাব আলী, প্রাক্তন সেনাসদস্য একরামুল হক প্রমুখের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় জনতা প্রস্তুতি নেয়। পাকবাহিনী যাতে সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে নীলফামারী সদরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সীমান্ত এলাকার ধোদ্দধোরা পুল ভেঙ্গে সেখান থেকে নীলফামারী শহর পর্যন্ত রাস্তায় গাছ ফেলে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। এরপর প্রতিরোধ কমিটির সদস্য এস এম সোলায়মান সহ ইয়াকুব আলী, ছাত্রলীগ সভাপতি আবু হাসান মো. ইলিয়াস, মো. মজিবর রহমান প্রমুখ মহকুমা প্রশাসক মুয়ীদ চৌধুরীর কার্যালয়ে যান এবং এস এম সোলায়মান ট্রেজারি থেকে কিছু রাইফেল দাবি করেন। মহকুমা প্রশাসক প্রথমে অস্বীকৃতি জানালেও পরে ২২টি রাইফেল দেন। এর পরে আনসারদের ২২টি পোশাক, ২২ জোড়া জুতা এবং ৪ বাক্স গুলিও সংগ্রহ করা হয়।
কিন্তু ৭ই এপ্রিল প্রতিরোধ ভেঙ্গে পাকসেনারা ট্যাংক নিয়ে শহরে প্রবেশ করে। প্রবেশের পথে দারোয়ানি মেলার পিলারের নিকট নীলফামারী জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি হযরত আলী এবং তাঁর পিতাকে ট্যাংকে তুলে নিয়ে এসে শিয়ালডাঙ্গা নামক স্থানে গুলি করে হত্যা করে। এরপর নীলফামারী শহরে প্রবেশ করে তারা প্রথমে ডাকবাংলো এবং পরে বর্তমান সরকারি কলেজে ক্যাম্প স্থাপন করে।
এপ্রিল মাসের শেষদিকে পাকবাহিনীর সহায়তায় এখানে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এর আহ্বায়ক ছিল মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী এবং সদস্য ছিল এডভোকেট আব্দুল লতিফ, নিছার আলী শাহ্ ফকির, আবদুস সাত্তার শাহ্ ফকির, শাহজাহান আলী, আশরাফউদ্দিন মোল্লা, মো. নজরুল ইসলাম, বয়েজ উদ্দিন, আজিজার রহমান, জবান উল্লাহ শাহ্ ফকির প্রমুখ। এছাড়াও পাকবাহিনীর সহযোগী ব্যক্তিদের মধ্যে এডভোকেট আজিজুল হাসান, এডভোকেট মহসীন আলী টুলু, তৈয়ব খান, মনসুর আলী (ডাইলপট্টী) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ- সক্রিয় ছিল। রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিল গফফার, ঝড়ু, মোস্তাকিম, বুলবুল, হালিম, আরব আলী, আলাউদ্দিন (মাছুয়া পাড়া), বুলুয়া (মেলার ডাঙ্গা), তছলিম (বাড়াই পাড়া) প্রমুখ। এরা সকলেই ছিল অশিক্ষিত ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষ। কিন্তু শিক্ষিত ও বিত্তবানরা ছিল আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্য। এই দুই বাহিনীর সদস্য ছিল ডাইলপট্টী বাজার এলাকার মনসুর আলী, মঞ্জুর, মাহামুদ, আব্দুল্লাহ, বাবুপাড়ার ওয়াহেদ, আলমগীর সরকার, মোহাম্মদ আলী বুলু, টুপামারী ইউনিয়নের নুরুজ্জামান, রায়হানুল প্রমুখ। তৈয়ব খান, মনসুর আলী প্রমুখ ছিল শান্তি কমিটির সদস্য। রাজাকাররা শহরের ডাকবাংলো, টেঙ্গনমারী, কচুকাটা, পলাশবাড়ি, পুরাতন রেলওয়ে স্টেশন, নীলফামারী কলেজ মোড়, হরিবল্লভ স্কুল মাঠ, খাচুয়া কবিরাজের পুল ইত্যাদি স্থানে অবস্থান করত। নীলফামারী কলেজ, ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও ডাকবাংলো ছিল তাদের প্রধান নির্যাতনকেন্দ্র।
পাকবাহিনী নীলফামারীতে প্রবেশ করার পর ব্রজনাথ ঘোষ (বোথা ঘোষ) ও তাঁর দুই ছেলেকে ধরে নিয়ে বর্তমান দারোয়ানি টেক্সটাইল মিলসের নিকট এক গর্তে ফেলে গুলি করে ওখানেই মাটিচাপা দেয়। পরবর্তীতে নীলফামারী সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের নিকটস্থ বিষু ও শম্ভু নামে দুই ভাইকে গুলি করে হত্যা করে। নীলফামারী বাজারের হেমন্ত ডাক্তার, ব্যবসায়ী সত্য কুণ্ডু, নীলফামারী কালীবাড়ির ঠাকুর অহিকে হত্যা করে। নীলফামারী সদরের কুন্দুপুকুর ইউনিয়নের বিশিষ্ট সমাজসেবক ঘীনা সাহাকে ডাকবাংলোর নির্যাতনকেন্দ্রে নিয়ে নির্মম অত্যাচারের পর হত্যা করে এবং নিকটস্থ কবরস্থানের পূর্বপাশে মাটিচাপা দেয়। নীলফামারী মহকুমা ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মাহাফুজার রহমান (দুলু)-কে বেশ কয়েক দিন যাবৎ নির্যাতনের পর নির্মমভাবে হত্যা করে। এর আগে উকিল পাড়ার টুনু, সারদা মোহন দাস (দাউদ), স্বর্গ নারায়ণ বর্মণ (পলাশবাড়ী), আশরাফ আলী আসাদ (জুম্মাপাড়া), আছিমুদ্দিন (সুটিপাড়া), আনছার আলী, ইঞ্জিনিয়ার মারুফ আহম্মেদ (কাঞ্চন পাড়া)-কে হত্যা করে। বর্তমান নিউ ওয়াপদা মোড়ের বাসিন্দা পচা মামুদকে নির্মম নির্যাতনের পর বন্দিশিবিরে কয়েক দিন ধরে ফেলে রাখে। নির্যাতনের ফলে তার সারা শরীরে ঘা হয়ে যায়। এরূপ দুঃসহ যন্ত্রণা দিয়ে পরে তাকে হত্যা করা হয়। বুড়ীর ডাঙ্গা কলোনি থেকে আনসার হাতেম আলীকে ধরে নিয়ে পাকহানাদাররা হত্যা করে। নীলফামারী শহরের বাসা থেকে আলতাফ হোসেনকে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর নেতা আব্দুল্লাহ ও তার দোসররা ধরে নিয়ে বন্দিশিবিরে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। স্বাধীনতার পক্ষের এক ছাত্রনেতা ও তার পরিবারকে আশ্রয় দেয়ার অভিযোগে মাইজার রহমান নামের এক ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করা হয়। বোথা ঘোষের দুই মেয়েকে আব্দুল্লাহ মঞ্জুর, মাহামুদ ও হালিম রাজাকার ধরে নিয়ে নির্যাতন করে। সালাউদ্দিন নামে তাদের এক প্রতিবেশী বাধা দেয়ায় ২৫শে এপ্রিল তাঁকে ধরে নিয়ে সিও অফিসের (বর্তমান উপজেলা অফিস) নিকট গুলি করে হত্যা করে। এক ডাক্তারের মেয়েকেও তারা ধর্ষণ করে। নীলফামারী কেন্দ্রীয় কবরস্থানের কাছে মোবারক হোসেন নামক জনৈক ব্যক্তির কন্যাকে একই উদ্দেশ্যে ধরার চেষ্টা করলে তিনি পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন, কিন্তু রাজাকাররা মোবারক হোসেনের বৃদ্ধ পিতা তফিজ উদ্দিনকে বাড়ি থেকে কিছু দূরে নিয়ে জবাই করে হত্যা করে। এ নৃশংস কাজে নেতৃত্ব দেয় তছলিম নাপিত। এছাড়া সদর উপজেলার বাইরের জলঢাকা উপজেলা থেকে বহু হিন্দু পরিবারের নারী-পুরুষদের নীলফামারী কলেজ বন্দিশিবিরে নিয়ে এসে নির্মম নির্যাতন করা হয়। গভীর রাতে তাদের আর্তনাদে ঐ এলাকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে নারীদের ধর্ষণের পর পুরুষদের সহ হত্যা করা হয় এবং তাদের লাশ পার্শ্ববর্তী একটি কূপে ফেলে দেয়া হয়। কোনো-কোনো লাশ কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের পেছনে বাঁশঝাড়ের পাশে মাটিচাপা দেয়া হয়।
পাকবাহিনী নীলফামারীতে প্রবেশ করে ডাকবাংলোয় অবস্থান নেয়ার খবর পেয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কেউ-কেউ ভারতে চলে যায়। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগসহ স্বাধীনতার পক্ষের লোকদেরও কেউ-কেউ শহর ছেড়ে চলে যায়। পাকসেনাদের অনুপ্রবেশের পরদিন থেকেই তাদের সহযোগিতায় স্থানীয় দোসররা এসব পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি লুট করে। ডাকবাংলোর কাছে নতুন বাজার এলাকায় নিতাই কুণ্ডুর পাটের গুদাম, নীলফামারী-সৈয়দপুর সড়কে তাঁর বাড়ি, হরু ঘোষের বাড়ি, টেংনা মুহুরীর বাড়ি, ভোন্দা ঘোষের বাড়ি, নীহার সান্যালের বাড়ি, নন্দলাল আগরওয়ালার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি লুট করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ভারতে যাওয়ার পথে তাদের সঙ্গে থাকা টাকা-পয়সা, স্বর্ণালঙ্কার ইত্যাদি ছিনিয়ে নেয়। তাদের রেখে যাওয়া গরু-ছাগল জবাই করে খেয়ে ফেলে। নীলফামারী ডাকবাংলো, নীলফামারী কলেজ এবং পিটিআই স্কুল ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির।
নীলফামারী সদর উপজেলায় তিনটি বধ্যভূমি ও দুটি গণকবর রয়েছে, সেগুলো হলো নীলফামারী কলেজ বধ্যভূমি ও গণকবর – নীলফামারী ডাকবাংলো বধ্যভূমি – এবং <দারোয়ানি টেক্সটাইল মিলস বধ্যভূমি ও গণকবর। নীলফামারী কলেজ ক্যাম্পাসে একটি পানীয় জলের কূপ ছিল। অনেক লোককে নির্যাতনের পর হত্যা করে সেই কূপে ফেলে দেয়া হয়। অনেক নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে তাদের লাশও সেখানে ফেলা হয়। বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ধরে এনে ডাকবাংলোতে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে ঘীনা সাহা ছিলেন একজন বিশিষ্ট সমাজসেবক। ১২ই এপ্রিল বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক ব্রজনাথ ঘোষসহ ১০-১২ জনকে ধরে এনে দারোয়ানি টেক্সটাইল মিলস প্রাঙ্গণে হত্যা করে কবর দেয়া হয়। এছাড়া আরো অনেককে এখানে হত্যা করে কবর দেয়া হয়।
নীলফামারী সদর উপজেলা ও দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলার সীমান্তে আঙ্গারপাড়ায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর একটি যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় পাকবাহিনীর তিনটি ট্যাংক ধ্বংস এবং বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। ১৪ই ডিসেম্বর নীলফামারী সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
নীলফামারী সদর উপজেলায় ৩ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন— ক্যাপ্টেন আবুল বাশার (পিতা আছিরউদ্দিন; ২৯শে এপ্রিল চট্টগ্রাম সেনানিবাসে বন্দি অবস্থায় শহীদ), আহমেদুল হক (পিতা হাজী আশেকুর রহমান) এবং আলী হোসেন (নোয়াখালী)।
নীলফামারী সদরে রয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু চত্বর’। এছাড়া নীলফামারী সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে চৌরঙ্গী মোড়ে ‘স্মৃতি অম্লান’ নামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। এছাড়া ২০০৪ সালে শহীদ ক্যাপ্টেন আবুল বাশারের নামে শহরের প্রবেশপথে মশিউর রহমান ডিগ্রি কলেজের সামনে একটি তোরণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। এটি উদ্বোধন করেন ক্যাপ্টেন বাশারের মা রিজিয়া আহমেদ। একই বছর একই স্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ভও নির্মিত হয়েছে, যেখানে ২৪ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ ফারুক ইকবালের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফারুক ইকবাল উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৭৪ সালে নীলফামারী পৌরসভার সম্মুখস্থ সড়কটির নাম রাখা হয়েছে শহীদ ক্যাপ্টেন বাশার সড়ক। শহীদ আলী হোসেনের নামে জনকীনাথ স্কুল থেকে সদর উপজেলা অফিস পর্যন্ত রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে শহীদ আলী হোসেন সড়ক এবং জেলা মুক্তিযোদ্ধা অফিসের সামনের রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে শহীদ আহমেদুল হক সড়ক। [দীপঙ্কর ঘোষ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!