You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে নিয়ামতপুর উপজেলা (নওগাঁ) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে নিয়ামতপুর উপজেলা (নওগাঁ)

নিয়ামতপুর উপজেলা (নওগাঁ) নওগাঁ মহকুমার প্রাচীন থানাগুলোর একটি। ১৯১৮ সালে এ থানা গঠিত হয়। ১৯৮৩ সালে এটি উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। নওগাঁ শহর থেকে নিয়ামতপুর থানা সদরের দূরত্ব ৩৩ মাইল। এ উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন হলো- চন্দননগর, নিয়ামতপুর, পারইল, বাহাদুরপুর, ভাবিচা, রসুলপুর, শ্রীমন্তপুর এবং হাজীনগর। নিয়ামতপুরের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত না থাকলেও সীমান্তবর্তী নওগাঁ জেলার একটি উপজেলা হিসেবে এখানে মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য ছিল। নিয়ামতপুর ছিল ৭ নম্বর সেক্টরের অধীনস্থ এলাকা। এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন প্রথমে মেজর খন্দকার নাজমুল হক এবং পরে মেজর কাজী নূর-উজ-জামান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে পরিচালিত -অসহযোগ আন্দোলন-এর প্রভাব নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর থানায়ও পড়ে। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর বঙ্গবন্ধু ২৬শে মার্চ পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণার পর নিয়ামতপুরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য আজিজুর রহমান রেদওয়ানের নেতৃত্বে থানা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদ ছাত্র-যুবকদের সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের রায়গঞ্জ ও সিলিগুড়ি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভারতীয় সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন রাজবীর সিং এবং নিয়ামতপুর ইপিআর ক্যাম্পের বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে নিয়ামতপুরের ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়া নিয়ামতপুরের অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভারতের অন্যান্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এ বি এম জমসেদ আলী নিয়ামতপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। আফাজ উদ্দীন মোল্লা ও এডভোকেট শাহ জামান আলী কমান্ডার ছিলেন।
নিয়ামতপুর থানা এলাকায় কোনো প্রতিরোধ মোকাবেলা না করেই পাকসেনারা অনুপ্রবেশ করে। ২৭শে মার্চ পাকবাহিনী মান্দা উপজেলা থেকে ভাবিচা হয়ে নিয়ামতপুরে প্রবেশ করে। ৫ই এপ্রিল নিয়ামতপুরের থানা মাঠে তারা সভা করে। এতে নেতৃত্ব দেয় মুসলিম লীগ-এর সভাপতি আব্দুস সালাম চৌধুরী। নিয়ামতপুর উপজেলায় পাকবাহিনীর কোনো স্থায়ী ক্যাম্প ছিল না। তবে অন্যান্য জায়গা থেকে এসে তারা নিয়ামতপুর থানায় অবস্থান করত।
এ উপজেলায় শান্তি কমিটির প্রধান ছিল আব্দুস সালাম চৌধুরী (নিয়ামতপুর)। সদস্যদের মধ্যে ছমির হাজি (সাবিলপুর) ও ইয়াকুব আলী (চৌপুকুরিয়া)-র নাম উল্লেখযোগ্য। রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল আজিমদ্দিন (রশিদপাড়া) ও কালু (ঘুলকুড়ি শালবাড়ি)।
নিয়ামতপুরের বিভিন্ন জায়গায় পাকবাহিনী নির্যাতন ও গণহত্যা চালায়। ২রা মে তারা উপজেলার ভাবিচা গ্রামে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ৫ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। ভাবিচা গণহত্যার পর হানাদাররা গ্রামে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়া নিয়ামতপুরের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধে অংশ নিয়ে প্রাণ হারান। নিয়ামতপুর থানায় পুলিশ ও পাকসেনারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ধরে এনে আটক করে রাখত এবং তাদের ওপর নির্যাতন চালাত।
নিয়ামতপুর মুক্ত করার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধারা ২৭শে নভেম্বর নিয়ামতপুর থানা ভবন আক্রমণ করেন। এদিন ভোর ৩টার দিকে পরিচালিত এ আক্রমণে থানায় অবস্থানরত পাকসেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা পাল্টা-আক্রমণ করলে কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। শেষ পর্যন্ত শত্রুপক্ষ পরাজিত হয়। পাকসেনাদের কয়েকজন নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা থানা ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। নিয়ামতপুর নওগাঁ জেলার প্রথম দখলমুক্ত থানা হওয়ার গৌরব অর্জন করে। ২৭শে নভেম্বর নিয়ামতপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
নিয়ামতপুরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আবদুল্লা আল মামুন (পিতা ডা. নজরুল ইসলাম, রামকুড়া; তিনি মান্দা থানায় দায়িত্বরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন), আবু বক্কর (পিতা পিয়ার আলী, রামনগর), ছলেমান হোসেন (পিতা দোস্তনা মোল্লা, গোরাই নেহেন্দা; ভারতের তপনে তাঁর কবর রয়েছে) এবং মকবুল হোসেন (পিতা গিয়াসউদ্দিন মোল্লা, গোরাই নেহেন্দা; ভারতের তপনে তাঁর কবর রয়েছে)।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নিয়ামতপুরে দুটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। একটি উপজেলা সদরে নির্মিত শহীদ মিনার। অন্যটি উপজেলার সাহেব নগরে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ। এছাড়া শহীদদের স্মরণে তিনটি স্থানের নামকরণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো- শহীদ আবু বক্কর রামনগর মোড়, শহীদ ছলেমান হোসেন ছাতড়াবাজার মোড় এবং শহীদ মকবুল হোসেন গাবতলী মোড়। [মো. শাহজাহান শাজু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড