মুক্তিযুদ্ধে নালিতাবাড়ী উপজেলা (শেরপুর)
নালিতাবাড়ী উপজেলা (শেরপুর) গারো পাহাড়ের কাছে এবং ভারতের মেঘালয় সীমান্তবর্তী। এখানকার মানুষ যেমন সহজ-সরল, তেমনি প্রতিবাদী এবং অধিকার আদায়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সংঘটিত সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ, বক্সার বিদ্রোহ, টিপু পাগলার বিদ্রোহ, টংক-তেভাগা আন্দোলন-সহ প্রায় সকল আন্দোলন-সংগ্রামের ঢেউ এ এলাকায় লেগেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নালিতাবাড়ীর মানুষের সাহসী ও আত্মত্যাগের গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে এখান থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আব্দুল হাকিম সরকার এমএনএ এবং ডা. নাদিরুজ্জামান খান এমপিএ নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে সারাদেশের মতো সীমান্তবর্তী এ জনপদের মানুষও বিক্ষুব্ধ হয়। ৩রা থেকে ৬ই মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ডাকে এখানে হরতাল পালিত হয়। সবার কণ্ঠে ‘ইয়াহিয়ার ঘোষণা- মানি না, মানি না’, ‘পাকিস্তান মানি না’, “বীর-বাঙালি অস্ত্র ধর – বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার আমার ঠিকানা – পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ইত্যাদি স্লোগান উচ্চারিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ- নালিতাবাড়ীবাসী পরদিন বেতারের মাধ্যমে শুনতে পায়। এ ভাষণ থেকে নির্দেশনা পাওয়ার পর প্রতিবাদী মানুষের সভা-সমাবেশ ও মিছিলে পুরো এলাকা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আব্দুল হাকিম সরকার এমএনএ-কে প্রধান করে নালিতাবাড়ীতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। নালিতাবাড়ীর জনগণ বিশেষ করে ছাত্র ও যুব সম্প্রদায় আব্দুল হাকিম সরকার এমএনএ ও ডা. নাদিরুজ্জামান খান এমপিএ-এর নেতৃত্বে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার শপথ গ্রহণ করে। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের এক সভা থেকে বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের ভয়াবহতা ব্যাখ্যা করে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। নালিতাবাড়ীর নেতাদের উদ্যোগে তারাগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ২৩শে মার্চ স্থানীয় সিএন্ডবি-র ডাকবাংলো চত্বরে (বর্তমান শহীদ আব্দুর রশীদ কলেজ) সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উত্তোলন করেন এলাকায় কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেট সিরাজুল ইসলাম। নালিতাবাড়ীর অনেক ছাত্র ও যুবক ভারতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে ছাত্র ও যুবকদের প্রাথমিক পর্যায়ে ইয়ুথ ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়া হতো। এখান থেকে তাদের সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ধারণা দিয়ে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিতে পোড়াখাশিয়া, রংনাবাক-সহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠানো হতো। এসব এলাকায় নালিতাবাড়ী উপজেলার তিন শতাধিক ছাত্র ও যুবক প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধে অংশ নেয়।
নালিতাবাড়ীতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা হলেন- আব্দুল হাকিম সরকার এমএনএ (নিজপাড়া), ডা. নাদিরুজ্জামান খান এমপিএ, নূর হোসেন সরকার (প্রাক্তন চেয়ারম্যান, রূপনারায়ণকুড়া ইউপি), নগেন্দ্র চন্দ্র পাল (শিক্ষক, খালভাঙ্গা), আব্দুর রেজ্জাক (রাজনীতিক, গোবিন্দনগর), মেহের আলী সরকার (প্রাক্তন চেয়ারম্যান, নালিতাবাড়ী- কাকরকান্দি ইউপি), অধ্যাপক মো. এনায়েত আলী (শিক্ষক, নালিতাবাড়ী বাজার), হুসিমদ্দিন মিয়া মহাজন (ব্যবসায়ী, তারাগঞ্জ বাজার), সেকান্দর আলী তালুকদার (শিক্ষক, বরুয়াজনি), নিরেন দত্ত (ব্যবসায়ী, তারাগঞ্জ বাজার), আবু মো. নুরুল হক (ব্যবসায়ী, আমবাগান), আবদুল মতিন মাস্টার (শিক্ষক, রানীগাঁও), আব্দুর রশীদ (চাকরিজীবী, গোবিন্দনগর), আব্দুর রহমান সরকার (কৃষিজীবী, গড়কান্দা), শরাফত আলী (কৃষিজীবী, কালিনগর), ইউসুফ আলী (কৃষিজীবী, গড়কান্দা), আরফান আলী মাস্টার (শিক্ষক, তন্তর), ডা. আব্দুল হামিদ (আমবাগান), মুশতাক হাবীব (শিক্ষক, তারাগঞ্জ দক্ষিণ বাজার), অধ্যাপক আবু তাহের (শিক্ষক, তারাগঞ্জ দক্ষিণ বাজার), আফতাব উদ্দিন সরকার (ব্যবসায়ী, গোবিন্দনগর), শহীদ নাজমুল আহসান (বরুয়াজানি), আব্দুল হালিম উকিল (নলিতাবাড়ী বাজার) প্রমুখ।
পাক হানাদারবাহিনী ২৬শে এপ্রিল শেরপুরে অনুপ্রবেশ করে। ২৭শে এপ্রিল কোনো প্রতিরোধ মোকাবেলা না করেই তারা নালিতাবাড়ীতে আসে। তারা নন্নী উচ্চ বিদ্যালয়, বারোমারী (তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্প), রামচন্দ্রকুড়া ও তিনানী ফরেস্ট অফিসে ক্যাম্প স্থাপন করে।
নালিতাবাড়ীতে পাকবাহিনী তাদের সহযোগী শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করে এসব বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারীদের বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের হত্যা, অমানুষিক নির্যাতন, তাদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন এবং নারীদের নির্যাতন করত। এরা মুক্তিযোদ্ধাদের খবর পাকবাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয়াসহ বিভিন্নভাবে তাদের সহযোগিতা করে। নালিতাবাড়ীতে ৯ সদস্যবিশিষ্ট শান্তি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিল— আব্দুর রহমান হাজী (গোবিন্দনগর), মাওলানা সাইদুর রহমান (রানীগাঁও), আক্কাছ আলী চেয়ারম্যান (যোগানিয়া), আব্দুল আজিজ (কাপাশিয়া), আকবর আলী (জারুয়ার পাড়), মাওলানা আবুল মোবারক (গড়কান্দা), আবুল হোসেন মাস্টার (আমবাগান), আব্দুল খালেক মাস্টার (বাগিচাপুর) ও হাছেন আলী (গেরাপঁচা)। নালিতাবাড়ীতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অন্যদের মধ্যে আকরামুজ্জামান (গোবিন্দপুর), রফিজ উদ্দিন দেওয়ান (নালিতাবাড়ী বাজার), আজগর আলী খান (নালিতাবাড়ী বাজার), নূর মোহাম্মদ (ছিটপাড়া), জামান উদ্দিন (ছিটপাড়া), আব্দুল মালেক (গোবিন্দপুর), আব্দুল বারিক (গোবিন্দপুর), হাবিবুল্লাহ (গোবিন্দপুর), আব্দুল্লাহ (গোবিন্দপুর) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
পাকহানাদার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারী ব্যক্তিদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে নির্যাতন ও অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করে। এভাবে প্রায় ২ শত মানুষ নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে যাদের নাম জানা গেছে, তারা হলেন— আব্দুর রাজ্জাক চেয়ারম্যান (নয়াবিল), জয়নাল আবেদীন (তারাগঞ্জ বাজার), শরাফত আলী (ছিটপাড়া), কাশেম আলী (গোবিন্দনগর), আব্দুল মান্নান (যোগানিয়া), আব্দুল খালেক মাস্টার (কাপাশিয়া), কালু (যোগানিয়া), আব্দুল খালেক (গেড়ামারা), খলিলুর রহমান (তারাগঞ্জ বাজার), আব্দুল (দাওধারা), ডা. আবদুস সামাদ (দাওধারা), জহুর ফকির (ফুলপুর), নূর ইসলাম (কিল্লাপাড়া), নেভি ক্যাপ্টেন বদিউজ্জামান (রানীগাঁও), কিশোর (পাঁচগাঁও), গহর (দাওধারা), সাদেক (হাতিপাগার), জামাল (তন্তর), হাফেজ উদ্দিন (ছিটপাড়া), কছির উদ্দিন (চাটকিয়া), মফিজ উদ্দিন (রসাইতলা), মেরাজ আলী (রসাইতলা), হাতেম আলী (সোহাগপুর), মতিউর রহমান (কাউয়াকুড়ি), ছফর উদ্দিন (সোহাগপুর), হাফিজুর রহমান (নন্নী), আব্দুর রউফ (পোড়াগাঁও), আব্দুল জলিল (লক্ষীকুড়া), মজিবুর রহমান তারা (লক্ষীকুড়া), ইসহাক আলী (পোড়াগাঁও), শামছুল হক (নন্নী), রমজান আলী (সমশ্চূড়া), সিদ্দিক (নলজোড়া), আ. সামাদ (নন্নী), শ্যাম মারাক (রসাইতলা), হাসান আলী (পোড়াগাঁও), কাশেম (পোড়াগাঁও), আ. খালেক (বেকিকুড়া) এবং হাবিবুর রহমান (কৃষনপট্টি)।
পাহাড়ি নদী ভোগাইয়ের তীর ঘেঁষে বাংলাদেশের নাকুগাঁও আর ভারতের ডালু। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ-পথ দিয়ে হাজার- হাজার নারী-পুরুষ আশ্রয়ের জন্য ভারতে যেত। তখনো ভারতে শরণার্থী ক্যাম্প গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ ভারতে যাওয়ার সময় বারাংগাপাড়া, ডালু বাজার, চান্দুভূঁই, মাছাংপানি, ছৈপানি ডিমাপাড়া-সহ বিভিন্ন জায়গার মন্দির, রাস্তা ও গাছতলায় আশ্রয় নিত। ২৫শে মে পাকহানাদারদের একটি বিরাট দল নদী পার হয়ে ডালু বিএসএফ ক্যাম্প এবং পাশের প্রায় ২ কিলোমিটার ভারতীয় সীমানা এলাকা ঘিরে ফেলে। বিএসএফ সদস্যরা তাৎক্ষণিকভাবে পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত শত্রুর কাছে সে প্রতিরোধ বেশি সময় টিকে থাকতে পারেনি। এক-এক করে ৯ জন বিএসএফ সদস্যের মৃত্যুর পর তাদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। হানাদাররা নির্বিচারে গুলি করে নিরীহ মানুষের ওপর। তাদের গুলিতে কয়েক শত মানুষ প্রাণ হারায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ ঘটনা নাকুগাঁও-ডালু গণহত্যা নামে পরিচিত।
নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের একটি গ্রাম সোহাগপুর। ২৫শে জুলাই পাকহানাদার বাহিনীর ১৫০ জনের একটি দল সোহাগপুরের প্রফুল্লের দিঘি থেকে সাধুর আশ্রম পর্যন্ত পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। এরপর এক নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালায়। ৬ ঘণ্টা ধরে এ নির্মম হত্যাযজ্ঞে গ্রামের ১৮৭ জন নিরীহ পুরুষ নিহত হন। গ্রামের প্রায় সকল পুরুষকে হত্যা করায় এ গ্রামের নাম এখন <বিধবাপল্লী। <সোহাগপুর গণহত্যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বহুল আলোচিত ও মর্মস্পর্শী এক ঘটনা। গণহত্যার পর নিহতদের স্ত্রীদের নির্যাতন ও ধর্ষণ করা হয়।
২৭শে এপ্রিল পাক হানাদাররা তারাগঞ্জ বাজারের কালি মন্দির ও গৌর কুণ্ডের দোকানে আগুন লাগিয়ে দেয়। এছাড়া হিন্দুদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করে। পাকবাহিনীর ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন গ্রাম থেকে নারীদের ধরে এনে পাশবিক নির্যাতন করা হতো।
জুন মাসে মুজিব বাহিনী – (বিএলএফ) নালিতাবাড়ীর গেড়ামারাতে ঘাঁটি স্থাপন করে। ধনাকুশা, পূর্বপাড়া, ধনারপাড়, কুড়ের কান্দা, তালুকপাড়া, কান্দাপাড়া, বাইটকামারী, বাথুয়ারকান্দা, কুত্তামারা, নয়াপাড়া, ঘোড়ামারা, বিবির পাড়, বরিতার, বাঁশকান্দা-সহ বিভিন্ন এলাকায় এ বাহিনী তৎপর ছিল। মুজিব বাহিনীর সদস্যদের আশ্রয় দেয়ায় এসব এলাকাবাসীকে রাজাকার বাহিনীর নির্মম অত্যাচার সহ্য করতে হয়। মুজিব বাহিনীর ঘাঁটি স্থাপনের পর রাজাকাররা এসব এলাকার গ্রামগুলোতে আক্রমণ করে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে আশ্রয়দাতাদের একেবারে নিঃস্ব করে দেয়। রাজাকাররা এজন্য তারাগঞ্জ বাজারের অনেক দোকান ভাংচুর ও লুণ্ঠন করে।
নালিতাবাড়ীর তিনানী ফরেস্ট অফিস, নন্নী উচ্চ বিদ্যালয় এবং রামচন্দ্রকুড়া ফরেস্ট অফিসে পাকবাহিনীর বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্র ছিল।
নালিতাবাড়ীর উপজেলা পরিষদের যে স্থানটিতে এখন মসজিদ, সেটি তখন বধ্যভূমি ছিল। ভারতের ডালু সীমান্ত সংলগ্ন নাকুগাঁও-এ ২৫শে মে গণহত্যায় নিহতদের ও পরে আরো অনেককে নাকুগাঁও গণকবরে সমাহিত করা হয়। নন্নী-বারোমারী সড়কের তাজুরাবাদ এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে পাক হানাদার ক্যাম্পের কমান্ডার মেজর জাভেদ-সহ ৪ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়। রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের তন্তর গ্রামে একটি যুদ্ধ হয়। তন্তর যুদ্ধ-এ ৮ জন গ্রামবাসী নিহত হয়। একাত্তরের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা নালিতাবাড়ী থানা আক্রমণ করেন। থানায় অবস্থানরত রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের খবর পেয়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা থানা থেকে দুটি রাইফেল, প্রচুর গোলাবারুদ ও কয়েকটি গ্রেনেড দখল করেন। তারপর কেরোসিন ঢেলে থানা পুড়িয়ে দেয়া হয়।
৫ই জুলাই মুক্তিযোদ্ধারা কাটাখালি ব্রিজ ধ্বংস করেন। রামচন্দ্রকুড়া ফরেস্ট ক্যাম্পে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয়। রামচন্দ্রকুড়া ফরেস্ট ক্যাম্প ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। টানা তিনদিন গেরিলা আক্রমণের পর মুক্তিযোদ্ধারা এ ক্যাম্প দখলে নেন। নালিতাবাড়ীতে পাকবাহিনীর মূল ক্যাম্প ছিল বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবন-সহ পুরাতন ভবনে। এ ক্যাম্প দখলে নিয়ে নালিতাবাড়ী অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত করতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম আক্রমণ চালান ১লা ডিসেম্বর। ৪ঠা ডিসেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে নালিতাবাড়ী আক্রমণ করে। শিমুলতলায় প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধারা দুভাগে বিভিক্ত হয়ে থানা-সহ ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। টানা দুদিন উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। ৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে তাঁরা গোলাবারুদ সংগ্রহের জন্য কিছুক্ষণ আক্রমণ শিথিল করেন। এ ফাঁকে ক্যাম্পের রাজাকার ও আলবদররা গুলি ছুড়তে-ছুড়তে বিভিন্ন পথে পালিয়ে যায়। ৭ই ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আবু তাহেরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী নালিতাবাড়ীতে প্রবেশ করে এবং নালিতাবাড়ী হানাদারমুক্ত হয়।
নালিতাবাড়ীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নাজমূল আহসান (পিতা সেকান্দর আলী তালুকদার, বরুয়াজানী), আলী হোসেন (পিতা আব্দুল মোতালেব, কাকরকান্দি), মোফাজ্জল হোসেন (পিতা আহসান উল্লাহ, বরুয়াজানী), আলাল উদ্দিন (পিতা ওসমান গণি, বাঘবেড়), আব্দুর রশিদ (পিতা জোনাব আলী, বাঘবেড়), নূর মোহাম্মদ (পিতা আফছর আলী, নয়াবিল), হাসেন আলী মুন্সী (পিতা তাহের আলী, বনকুড়া), ইদ্রিস আলী (পিতা আক্কাছ আলী, কালাকুমা), আলতাফ হোসেন (পিতা রিয়াজ উদ্দিন, তাজুরাবাদ), মফিজ উদ্দিন (পিতা আনছার আলী, তাজুরাবাদ), জসিম উদ্দিন (পিতা আবু শেখ, বেকীকুড়া), আব্দুল লতিফ (পিতা গোল মামুদ, খুঁজিউড়া), আনোয়ার আলী (পিতা জয়দর আলী, ফুলপুর), চাঁন মিয়া (পিতা আব্দুল কাদির, বেকীকুড়া), ইউসুফ আলী (পিতা ইন্তাজ আলী, বাতকুচি), আফছর আলী (পিতা শমশের মোল্লা, পলাশিকুড়া), ছোরহাব আলী (পিতা হরমুজ আলী, কালাকুমা), আব্দুল খালেক (পিতা হাকিম উদ্দিন, বোনারপাড়া) এবং আনসার আলী (পিতা জয়দর আলী, বেকীকুড়া)।
নালিতাবাড়ীতে বেশকিছু স্মৃতিফলক ও স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। নালিতাবাড়ী শহরের নালিতাবাড়ী-হালুয়াঘাট সড়কে ‘স্বাধীনতা স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মিত হয়েছে। কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। তাতে শহীদদের মধ্যে ৬৯ জনের নাম খোদিত রয়েছে। শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজমূল আহসানের নামে নালিতাবাড়ীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নাজমূল স্মৃতি কলেজ। এছাড়া তাঁর স্মরণে তাঁর নিজ গ্রাম বরুয়াজানিতে (কাকরকান্দি ইউনিয়ন) নাজমুল আহসান স্মৃতি সংঘ এবং ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নামকরণ করা হয়েছে (শহীদ নাজমূল আহসান হল)। কাকরকান্দি ইউনিয়নের বরুয়াজানি গ্রামে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কলেজ নির্মাণ করা হয়েছে। নয়াবিল ইউনিয়নের নাকুগাঁও গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা উচ্চ বিদ্যালয় নির্মিত হয়েছে। নালিতাবাড়ীর তারাগঞ্জ উত্তর বাজারে (শহীদ মিনার চত্বর) ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ’ নির্মাণ ও নামফলক স্থাপন করা হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সংবলিত স্মৃতিফলক রয়েছে। যোগানিয়া ইউনিয়নের কাপাশিয়া গ্রামে কাপাশিয়া শহীদ স্মৃতি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। কাকরকান্দি ইউনিয়নের বরুয়াজানি গ্রামে শহীদ মোফাজ্জল হোসেনের নামে শহীদ মোফাজ্জল স্মৃতি সংঘ ও মোফাজ্জল স্মৃতি পাঠাগার রয়েছে। কাকরকান্দি ইউনিয়নের কাকরকান্দি গ্রামে শহীদ আলী হোসেনের নামে শহীদ আলী হোসেন স্মৃতি সংঘ স্থাপিত হয়েছে। [কোহিনূর রুমা]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড