You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে নাসিরনগর উপজেলা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)

নাসিরনগর উপজেলা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) ১৯৬৬ সালের ৬- দফা আন্দোলনের পরপরই নাসিরনগর এলাকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের পতনের পর ইয়াহিয়া খান পুনরায় সামরিক শাসন জারি করলে এ অঞ্চলের রাজনীতি-সচেতন মানুষের মধ্যে পাকিস্তানবিরোধী মানসিকতা তীব্রতর হয়। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩-রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে সারা বাংলার মানুষের মতো নাসিরনগরের মানুষও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। এরপর ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে এখানকার মানুষ উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। নাসিরনগরের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ-এর নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ- শুনতে ঢাকা যান। তাদের কাছ থেকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার পর আওয়ামী লীগ নেতা এডভেকেট মোহাম্মদ ছায়েদুল হক, মোজাম্মেল হক (কাপ্তান মিয়া) এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এর সৈয়দ মোর্শেদ কামাল সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলেন। ২৫শে মার্চ পাকসেনারা গণহত্যা শুরু করলে নাসিরনগরের ছাত্র-যুবকরা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। মোহাম্মদ ছায়েদুল হকের নেতৃত্বে ৩৯ সদস্যের একটি দল আগরতলার লেবুছড়া ক্যাম্পে পৌঁছায়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সুনীল দত্ত, আলাউদ্দিন, সাহাবুদ্দিন, মেজবাউদ্দিন, নিধুরাম দত্ত, নিতাই দাস, মাহমুদ আমিন বকুল মিয়া, মুহিত লাল, অরুণকান্তি সরকার প্রমুখ। এঁরা মেজর সফিউল্লাহর তত্ত্বাবধানে ৩নং সেক্টরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে নাসিরনগরসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্যান্য উপজেলায় প্রেরণ করা হয়।
এ উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন- এডভোকেট ছায়েদুল হক (আওয়ামী লীগ নেতা, প্রয়াত মৎস ও পানিসম্পদ মন্ত্রী), মোজাম্মেল হক কাপ্তান মিয়া (আওয়ামী লীগ নেতা) এবং সৈয়দ মোর্শেদ কামাল (ন্যাপ নেতা)। এখানকার যুদ্ধকালীন থানা কমান্ডার ছিলেন মো. আলাউদ্দিন।
যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী বেশ কয়েকবার নাসিরনগরে প্রবেশ করে এবং স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিদের নিয়ে সভা- সমাবেশ করে। এখানে পাকবাহিনী কোনো স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেনি।
পাকবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় দোসর সৈয়দ সওয়াব মিয়া চৌধুরীর (নাসিরনগর) সহযোগিতায় নাসিরনগরে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। কাজী ফারুক আহাম্মেদ (নাসিরনগর), আব্দুল কায়ূম ভূঁঞা (কুলিকুন্ডা), মো. আশ্রাফ আলী (ধরমণ্ডল), বাবরু মিয়া (ফান্দাউক), মশ্রব আলী শাহ (ফান্দাউক) ও আব্দুস ছুবাহান (গোকর্ণ) ছিল শান্তি কমিটির উপদেষ্টা। কমিটির কনভেনর ছিল সামছুদ্দিন চৌধুরী ছুটু মিয়া (টেকানগর), সহ-কনভেনর ছিল মুঞ্জুর আলী (গুনিয়াউক) ও ছামু হাজী (আশুরাইল) এবং সদস্য-সচিব আব্দুল হান্নান চৌধুরী (নাসিরনগর)। কমিটির অন্য সদস্যরা হলো- আব্দুস ছালাম (কুলিকুন্ডা), মন্নর আলী (প্রাক্তন চেয়ারম্যান), জাহির হোসেন চৌধুরী (নাসিরনগর), ছৈয়দ আবু আলী (নূরপুর, গোকর্ণ), আলফু মোল্লা (চটিপাড়া, গোকর্ণ), রোকন উদ্দিন মাস্টার (গোকর্ণ) ও মোশারফ হোসেন চকদার (নাসিরনগর)। পাকবাহিনীর অন্যতম দোসর সৈয়দ সওয়াব মিয়া চৌধুরী নাসিরনগর এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। গ্রামের নিরীহ লোকজনকে সে রাজাকার বাহিনীর সদস্য হতে বাধ্য করে। কেউ অস্বীকৃতি জানালে তাকে হত্যা করার ভয় দেখাত তুল্লাপাড়া গ্রামের রাজকুমার দাস নামে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তিকে সে জোর করে রাজাকার বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে। সওয়াব মিয়া এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত করে পাকবাহিনীর কাছে জমা দেয়াসহ মুক্তিযোদ্ধাদের নানারকম খবর সরবরাহ করত। নাসিরনগর থানার কিছু সংখ্যক বাঙালি পুলিশও পাকবাহিনীর পক্ষে কাজ করে। পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা নাসিরনগর সদরের আশপাশের গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ চালায়। তাদের মধ্যে মধু রাজাকার ছিল ভয়ানক দুর্ধর্ষ। পুরো এলাকায় সে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বিভিন্ন এলাকায় ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে দেয়, হিন্দুদের বাড়িঘর লুট করে, মানুষ ধরে নিয়ে পাখির মতো গুলি করে মারে। সে ছিল রাজাকার কমান্ডার। তার দলের অত্যাচারের বীভৎসতা সারা এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল। এলাকার সাধারণ লোকজন তার ভয়ে সব সময় আতঙ্কিত থাকত।
২২শে জুন আশুগঞ্জ থেকে মাধবপুর যাওয়ার পথে পাকবাহিনীর একটি লঞ্চ কুণ্ডা ফেরিঘাটের চরে আটকে যায়। পাকসেনারা লঞ্চটি নামাতে না পেরে মাঠে কর্মরত কয়েকজনকে ধরে নিয়ে আসে। তাদের সহযোগিতায় লঞ্চটিকে চর থেকে নদীতে নামানোর পর পাকসেনারা সবাইকে কালিমা পড়তে বলে। যারা কালিমা পড়তে পারেনি তাদের হাত ও চোখ বেঁধে লঞ্চে তুলে মাধবপুর নিয়ে যায়। পথে কুণ্ডাগ্রাম থেকে চারজনকে ধরে এনে মাধবপুর থানাধীন একটি পুকুর পাড়ে নিয়ে গুলি করে৷ মোহন সরকার, হৃদকমল সাহাজী ও জয়দাস সাহাজী নামে ৩ জন ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। লাল মোহন নামে একজন ঝাঁপ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে তার হাতে এবং পায়ে গুলি লাগে। আহত অবস্থায় কিছু সময় সে পানিতে পড়ে থাকে। পাকসেনারা চলে যাওয়ার পর সে গ্রামে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। হত্যার এ ঘটনা মাধবপুর গণহত্যা নামে পরিচিত। ১১ই নভেম্বর সংঘটিত হয় কুলিকুণ্ডা গণহত্যা। এতে ৪ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। ১৩ই নভেম্বর সংঘটিত হয় বুরুঙ্গা গণহত্যা। এতে ৯ জন সাধারণ মানুষ শহীদ ও ১ জন আহত হন।
মুক্তিবাহিনীর খোঁজে পাকসেনারা একদিন ফুলপুর গ্রামে আক্রমণ চালায় এবং নূরুর রহমান চৌধুরী নামে একজনকে গুলি করে হত্যা করে। ফুলপুর মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে তাকে কবর দেয়া হয়। নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকার ও শান্তি কমিটির সহায়তায় গুনিয়াউক ইউনিয়নের দাউরা গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি বাড়িতে আক্রমণ চালায়। গ্রামের চারদিক থেকে আক্রমণ করে তারা বিভিন্ন বয়সের ২৬ জন সাধারণ লোককে ধরে এনে একটি পুকুরপাড়ে দাঁড় করিয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে জানতে চায়। তারা কোনো তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানালে পাকসেনা ও রাজাকাররা তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে ১৫ জন গুলিবিদ্ধ হয় এবং তাদের ১৩ জন ঘটনাস্থলে নিহত হয়। এটি দাউরা গণহত্যা নামে পরিচিত। রাজাকাররা নিহতদের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল মধু রাজাকার (সাতগাঁ), আতাব আলী (গুনিয়াউক), মিহির উদ্দিন, আক্কাছ আলী, আবদুর রহমান (চৌকিদার), একিন আলী ও মাহফুজ মিয়া। নাসিরনগর থানাকে পাঁচটি অঞ্চলে ভাগ করে অঞ্চলভিত্তিক শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। সেগুলো হলো— হরিপুর, গুনিয়াউক ও চাপড়তলা ইউনিয়ন, ফান্দাউক ও ধরমন্ডল ইউনিয়ন, নাসিরনগর, বুড়শ্বর ও কুন্ড ইউনিয়ন, চাতলপাড়া, ভলাকুট ও গোয়ালনগর ইউনিয়ন এবং গোকর্ণ ও পূর্বভাগ ইউনিয়ন।
দাউরা গ্রামের হত্যাকাণ্ড ও লুটপাট শেষে মধু রাজাকারের সহায়তায় পাকবাহিনী পার্শ্ববর্তী নিশ্চিন্তপুর গ্রামে আক্রমণ চালায়। তাদের ভয়ে গ্রামবাসীরা দ্রুত অন্যত্র পালিয়ে যায়। এ-সময় রাজাকারদের হাতে মণীন্দ্র ও প্রেমেন্দ্র নামে দুজন ধরা পড়ে। এ দুজনকে হাত বেঁধে তারা পাশের গুতমা গ্রামে নিয়ে যায় এবং যাবার সময় নিশ্চিন্তপুর গ্রামের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। গুতমা গ্রামে কায়সার বাহিনীর (স্থানীয়ভাবে গঠিত পাকিস্তানিদের সহযোগী বাহিনী) ভয়ে গ্রামবাসী আতঙ্কিত ছিল। তারা লোকজন ধরে নিয়ে গুতমা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তর পাশে রাস্তার ওপর একটি তুলাগাছের নিচে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। নিশ্চিন্তপুরের মণীন্দ্র এবং প্রেমেন্দ্রকেও এ সারিতে দাঁড় করিয়ে তারা মোট ১২ জনকে গুলি করে হত্যা করে। নিহত সবাই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। এটি গুতমা-নিশ্চিন্তপুর গণহত্যা নামে পরিচিত। রাজাকার ও কায়সার বাহিনীর লোকেরা গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে এবং সেসব বাড়িঘরে তারা আগুন লাগিয়ে দেয়। দীর্ঘ সময় ধরে লুটপাটের পর পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা গ্রাম ছেড়ে নাসিরনগর এবং মাধবপুরের দিকে চলে যায়। এছাড়া তারা গুনিয়াউক ইউনিয়নের বুরুংগা, চিতনা, কুলিকুন্ডা চাতলপাড়সহ বিভিন্ন গ্রামে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারীনির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটায়। এছাড়া নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে সংঘটিত হয় চিতনা গণহত্যা। এতে ১৫ জন সাধারাণ মানুষ শহীদ হন।
নাসিরনগর উপজেলার হরিপুরের জমিদার বাড়ির (বড়বাড়ি) রাজাকার ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র। পরিত্যক্ত এ বাড়িটি রাজাকাররা দখল করে নিয়েছিল। প্রতিদিন এলাকার সাধারণ লোকজনকে ধরে এনে এখানে নির্যাতন করা হতো। হরিপুর রাজাকার ক্যাম্প থেকে নির্যাতন ও গণহত্যার নীলনক্সা তৈরি হতো।
গুনিয়াউক ইউনিয়নের দাউরা গ্রামে একটি গণকবর রয়েছে। এখানে গর্ত খুঁড়ে ১৩ জনকে মাটিচাপা দেয়া হয়। এটি দাউরা গণকবর হিসেবে পরিচিত।
নাসিরনগরে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি যুদ্ধ হয়নি। এখানকার বিভিন্ন গ্রামে মুক্তিবাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান ছিল। এখান থেকে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে তাঁরা পাকবাহিনী ও রাজাকারদের ওপর অতর্কিতে গেরিলা আক্রমণ চালাতেন। সরাইল থানার ধরন্তি ঘাট থেকে পুলিশ বাহিনী ও রাজাকারসহ শান্তি কমিটির কয়েকজন সদস্য নৌকাযোগে নাসিরনগরের দিকে যাওয়ার পথে তুল্লাপাড়া অতিক্রম করার সময় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ করেন। অতর্কিত আক্রমণে রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা পানিতে ঝাঁপ দেয়। তুলাপাড়া অপারেশন-এ সৈয়দ সওয়াব মিয়া চৌধুরীসহ কয়েজন পুলিশ, রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্য নিহত হয় এবং অন্যরা পালিয়ে যায়। ৭ই নভেম্বর নসিরনগর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। এখানকার একমাত্র শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেন সিদ্দিকুর রহমান (পিতা সিরাজ আলী, চাঁন্দের পাড়া)।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নাসিরনগর উপজেলা সদরে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। [জামিল ফোরকান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!