You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে নিকলী উপজেলা (কিশোরগঞ্জ)

নিকলী উপজেলা (কিশোরগঞ্জ) কিশোরগঞ্জ জেলার ভাটি অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী উপজেলা। এখানকার মানুষ প্রতিবাদী ও রাজনীতি-সচেতন। নিকলীতে স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দল ও সংগঠন আওয়ামী লীগ, ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি এবং কৃষক সমিতির শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি ছিল। এখানে স্বাধীনতাবিরোধী দল মুসলিম লীগ-এরও কার্যক্রম ছিল। নিকলীর প্রভাবশালী কারার পরিবার মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। ষাটের দশকে স্বাধিকার আন্দোলন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জনপ্রিয়তার প্রভাবে এ এলাকার মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষে ব্যাপক জনমত তৈরি হয়। নিকলীতে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন- ইত্যাদি সংগঠন গড়ে ওঠে। এসব সংগঠন ছাত্র ও যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিতে অনুপ্রাণিত করে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর নিকলীতে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। থানা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মো. আবদুল জব্বার মাস্টারকে সভাপতি এবং মো. ইদ্রিস আলীকে সম্পাদক করে এ কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন— গুরুই গ্রামের মোহাম্মদ আলী, সিংপুরের ইউপি চেয়ারম্যান মো. ইসরাইল মিয়া, মো. মির্জালী, নরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ, দীপক প্রফেসর, ডা. আমীর হোসেন (গুরুই), শৈলেশ ডাক্তার, ডা. মিহির রঞ্জন পাল (গুরুই) প্রমুখ। ২৫শে মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার খবর শুনে নিকলীতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তখন স্থানীয়ভাবে খবর আসে যে, কিশোরগঞ্জের আজিমউদ্দিন হাইস্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য, পুলিশ, আনসার ও ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে ওঠে। তাদের খাবারের প্রয়োজন মেটাতে নিকলী থেকে চিড়া, মুড়ি, ডিম, ডাব সংগ্রহ করে কিশোরগঞ্জে পাঠানো হয়।
সংগ্রাম পরিষদের পরামর্শ ও সহযোগিতায় শহরমূল গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য নাছিরউদ্দিন শেলীর নেতৃত্বে স্থানীয় আনসার ও ছাত্রদের নিয়ে দামপাড়া চিটাগাং পাট মোকামে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। পূর্ববাংলা ছাত্র ইউনিয়নের ময়মনসিংহ জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক মতিয়র রহমান ময়মনসিংহ থেকে নিকলীতে এসে ছাত্র- যুবকদের প্রশিক্ষণ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। তারা স্থানীয়ভাবে কিছু অস্ত্রও সংগ্রহ করেন। এ অবস্থায় খবর আসে যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কিশোরগঞ্জের প্রতিরোধব্যূহ ভেঙে শহরে অবস্থান নিয়েছে। এরপর নিকলীর মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প বন্ধ হয়ে যায়। তবে সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এলাকায় মিছিল- সমাবেশ চলতে থাকে। এক পর্যায়ে ছাত্ররা নিকলী থানায় উড্ডীন পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে।
১৯৭১ সালে গুরুই একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে ওঠে। গুরুই ইউনিয়নের লোকজন রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত ছিল। তারা স্বাধীনতার পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। নিকলীতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনে গুরুই ইউনিয়নের মোহাম্মদ আলী, মিহির রঞ্জন পাল ও ডা. আমির হোসেন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। নিকলীতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের পর গুরুই গ্রামের বেশ কয়েকটি বাড়িতেও পতাকা উত্তোলিত হয়। এ সময় দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীরা ভারতে যেতে শুরু করেন। আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি (পরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজের শিক্ষক নরেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ ভারতে যাবার পথে ধারীশ্বর গ্রাম হয়ে নিকলীতে আসেন। সেখান থেকে তাঁরা ভারতে যান। সামরিক বাহিনীর প্রাক্তন সদস্য সাহেব আলী (হিলচিয়ার মঠখোলা) গুরুই গ্রামে এসে খেলার মাঠে যুবকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এরপর কিশোগঞ্জের পিটি প্রশিক্ষক সুশীল বাবু, আওয়ামী লীগ কর্মী কাটাবাড়িয়ার আবদুল বারী খান- সহ আরো অনেকে গুরুই আসেন। এখানে ও ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে পরে হিলচিয়ায় একটি শক্তিশালী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপিত হয়। গুরুই ইউনিয়নের ছাতিরচর গ্রামে শামসুল হক (হিলচিয়ার পুড্ডা) একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করেন। ছাতিরচরের প্রাক্তন সেনাসদস্য অহেদ মিয়া প্রশিক্ষণদানে সহায়তা করেন। মজলিশপুর ও সিংপুরেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল।
নিকলী থানা থেকে সে-সময় যে-সকল যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেশত্যাগ করে, তাদের মধ্যে ছিল- মো. ইদ্রিস আলী, মোহাম্মদ আলী, শহাদৎ হোসেন, মতিয়র রহমান (পরে বীর বিক্রম), রিয়াজুল ইসলাম খান বাচ্চু, মোজাম্মেল হক আবীর, সুখেন্দু বিকাশ রায়, মোহাম্মদ সোলায়মান (গুরুই), সৈয়দ আমিনুল হক ওরফে সৈয়দ ইকবাল, ফজর আলী (মজলিশপুর), আব্দুল হাশিম (দামপাড়া ইউপি-র সাবেক চেয়ারম্যান), গিয়াসউদ্দিন (পুড্ডা), দিয়ারিশ মিয়া (গুরুই), মির্জালী (নগর), হারেছ মিয়া (ভাটি নানশ্রী), মতিউর রহমান (টেঙ্গুরিয়া), লাল মাহমুদ (সিংপুর), আরব আলী (দামপাড়া), শাহাবুদ্দিন (সিংপুর), আব্দুল হাই (টেঙ্গুরিয়া), সিরাজউদ্দিন (টেঙ্গুরিয়া), শামসুল ইসলাম মাস্টার (টেঙ্গুরিয়া), সাহেদ আলী (টেঙ্গুরিয়া), আব্দুল কাদির (টেঙ্গুরিয়া), ছানাউল্লাহ (টেঙ্গুরিয়া), নূর আলী (টেঙ্গুরিয়া), ইজ্জত আলী (দামপাড়া), আব্দুল হামিদ (ভাটি বরাটিয়া), হরিশ দাশ (ডুবি) প্রমুখ। বহু যুবক দেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ২৬শে মে সকালবেলা পাকবাহিনী নিকলীতে অনুপ্রবেশ করে। পাকসেনাদের অনুপ্রবেশের পর অনেক সাধারণ মানুষ বাড়িঘর ও সহায়-সম্পদ ফেলে পালাতে শুরু করে। পাকবাহিনী চুক্তিখালী থেকে সরাসরি নিকলী থানায় আসে এবং কয়েক ঘণ্টা পর নিকলী ত্যাগ করে। ২১শে আগস্ট পাকবাহিনী পুনরায় নিকলীতে আসে এবং জি সি পাইলট হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে। নিকলী থানায় আনসার ও পুলিশ বাহিনীর ক্যাম্প ছিল।
পাকবাহিনী নিকলীর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল হামিদ, নিকলীর চেয়ারম্যান আমির উদ্দিন আহমদ, করার গিয়াসউদ্দিন, পূর্বগ্রামের সিরাজুল ইসলাম প্রমুখকে নিয়ে শান্তি কমিটি গঠন করে। তারা অন্যান্য ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের নিয়েও শান্তি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। স্থানীয় মুসলিম লীগের নেতারা এসব কমিটি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
নিকলীর মুক্তিযুদ্ধে মতিয়র রহমান (পিতা মো. কিনু মিয়া, বানিয়াহাটি; ১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শেষবর্ষের ছাত্র) ও তাঁর সহযোগীরা অসামান্য অবদান রাখেন। মতিয়র রহমানের সহযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন মোজাম্মেল হক আবির, দেবদাস সাহা, আবদুল হামিদ, ব্রজেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ, আব্দুর রশিদ প্রমুখ। মতিয়র রহমান প্রথমে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুবকদের সংগঠিত করেন। ৫ই জুন মেজর মীর শওকত আলীর অধীনে ৫ নম্বর সেক্টরের বড়ছড়া সাব-সেক্টরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর মুসলেহ্ উদ্দিন। আর টুআইসি ছিলেন ফ্লাইট লে. নাজমুল হাসান ভূঞা। মতিয়র রহমান ছিলেন কোম্পানি কমান্ডার। তিনি সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সাহসিকতার কথা কিংবদন্তি হয়ে আছে। নিকলী মুক্ত করার যুদ্ধে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত হন।
মুক্তিযুদ্ধে গুরুই গ্রামের অনন্য অবদান রয়েছে। এ গ্রামের আবুল হাসিম, ডা. মিহির রঞ্জন পাল, ডা. আমির হোসেন, মোহাম্মদ আলী, মোহাম্মদ সোলায়মান, মহিউদ্দিন, আলিমুদ্দিন-সহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা দেশমাতৃকার জন্য লড়াই করেন। যুদ্ধের সময় এসব মুক্তিযোদ্ধার অবস্থান ছিল গুরই, হিলচিয়া ও বাজিতপুর কেন্দ্রিক। এঁদের মধ্যে মহিউদ্দিন আহমদ গেরিলা কমান্ডার হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে ৩০শে আগস্ট বাংলাদেশে প্রবেশ করে গুরুই-হিলচিয়ায় অবস্থান নেন। এ অঞ্চলের বহু সম্মুখ যুদ্ধে তাঁর দল অংশগ্রহণ করে। জেলার এক দুর্ধর্ষ ডাকাতের নাম আব্দুল মোতালিব বসু ওরফে বস্যা। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে সে একাধিক ডাকাতি ও হত্যা মামলায় কিশোরগঞ্জ কারাগারে অন্তরীণ ছিল। কিশোরগঞ্জ সদর থানাধীন শহরতলীর কাটাবাড়িয়া (ডাউকিয়া) গ্রামের আব্দুল বারী খান গুরুই এসে বসুকে কারাগার থেকে বের করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে উৎসাহিত করেন। বসু মুক্তি পেয়ে নিজের গ্রাম গুরুই ফিরে আসে। সেখানে তার অনুগত অন্য যুবকদের সংগঠিত করে একটি নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলে। এক পর্যায়ে তার বাহিনীর কর্মকাণ্ড নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে চরম বিরোধ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে এর সুরহা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় হিলচিয়া ও গুরুই এলাকায় বসু বাহিনী বেশ প্রাধান্য বিস্তার করেছিল।
এপ্রিলের প্রথমদিকে পাকিস্তানি বাহিনী দেশজুড়ে সামরিক অভিযান শুরু করে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সামরিক বিমান থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়। নিকলীর বানিয়াহাটির মন্টু মিয়ার বাড়ি, ধোপাহাটির কারার মোহন মিয়ার বাড়ি ও দামপাড়ার নদীতে গুলি বর্ষিত হয়। এতে কেউ হতাহত না হলেও জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন বাড়ির উঠানে বাংকার তৈরি করা হয়।
১৯৬৪ সালে নিকলী উপজেলায় স্থাপিত শহীদ মিনারটি সকল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। ১৯৭১ সালের মে মাসে থানা প্রশাসনের কাছে এটি ভেঙে ফেলার নির্দেশ আসে। সে অনুযায়ী ২৫শে মে রাতের আঁধারে শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলা হয়।
পাকিস্তান সামরিক বাহিনী জুলাই মাসের শেষ দিকে নিকলীর দামপাড়া ও মজলিশপুরে অপারেশন চালায়। তারা মজলিশপুরের পালবাড়িতে লুটপাট করে। দামপাড়ায় তারা ছাত্রলীগ নেতা ইদ্রিছ আলীর বাড়িতে লুটপাট করে এবং তাদের সব ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এরপর তারা দামপাড়ায় নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়। গ্রামের নিরীহ ও নিম্নবিত্ত হিন্দু পরিবারের ৩৪ জন লোককে রিলিফ কার্ড দেয়ার কথা বলে শ্মশানখোলায় নিয়ে হত্যা করে। দামপাড়া গণহত্যায় স্থানীয় দালালরা সহযোগিতা করে। এখানে নিহতদের মধ্যে কয়েকজন পার্শ্ববর্তী বাজিতপুর উপজেলার বসন্তপুর গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। হানাদার বাহিনীর নির্মমতা থেকে বাঁচার জন্য তারা নিজ গ্রাম ছেড়ে দামপাড়ায় এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
২১শে আগস্ট পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন দুররানির নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনী নিকলী এসে হত্যাকাণ্ড শুরু করে। তারা ধোপাহাটির নিবু সর্দার এবং বয়োবৃদ্ধ মহেন্দ্র সাহাকে গুলি করে হত্যা করে। অন্যদিকে ষাইটধারের রাজেন্দ্র সূত্রধরকে হত্যা এবং চন্দ্রনাথ গোসাই আখড়ার মোহন্তকে গুলি করে। ৬ই সেপ্টেম্বর গুরুই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকবাহিনী প্রতিশোধ নেয়ার জন্য গ্রামের নিরীহ মানুষদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। গুরুই গণহত্যায় বহু লোক নিহত হয়, যাদের মধ্যে ২৫ জনের পরিচয় জানা যায়।
কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে নিকলীর যোগাযোগ সুদীর্ঘ কাল থেকেই প্রায় বিচ্ছিন্ন। নৌপথ ছাড়া সুবিধাজনক যোগাযোগের কোনো পথ নেই। এ সুযোগে মুক্তিযোদ্ধারা এখানে একটি শক্ত অবস্থান গড়ে তোলেন। এখানকার প্রতিটি গ্রাম দুর্গম এলাকা। এর ফলে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা কিছুতেই পেরে উঠছিল না। মুক্তিযোদ্ধারা ছোটো- ছোটো অভিযানে তাদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন।
৬ই সেপ্টেম্বর গুরুই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর একটি যুদ্ধ হয়। এটি ছিল এ অঞ্চলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ। দুপক্ষের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ গুলি বিনিময় হয়। গুরুই যুদ্ধ-এ ২ জন পাকসেনা ও ১০ জন রাজাকার নিহত হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করেন।
হিলচিয়া ও গুরুই ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা ১৯শে অক্টোবর সকালে নিকলীকে শত্রুমুক্ত করার জন্য থানায় আক্রমণ করেন। পুলিশ, আনসার ও রাজাকাররাও প্রতি-আক্রমণ করে। দুপক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ হয়। সারাদিন ধরে যুদ্ধ চলে। এক পর্যায়ে পুলিশ, আনসার ও রাজাকাররা ৪৫টি ৩০৩ রাইফেল ও গোলাবারুদ ফেলে পালিয়ে যায়। নিকলী থানা যুদ্ধ-এ ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
দুই দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা ১৯শে অক্টোবর রাতে নিকলী ছেড়ে পালিয়ে যায়। এদিনই মুক্তিযোদ্ধারা নিকলীতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- মতিউর রহমান, বীর বিক্রম- (পিতা মো. কিনু মিয়া, বানিয়াহাটি)। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিকলী থানার অনেক মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন জায়গায় শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে যাঁদের নাম জানা যায়, তাঁরা হলেন- মো. শাহাবুদ্দিন (পিতা মো. রইছ উদ্দিন, ষাইটধার; অষ্টগ্রাম যুদ্ধে শহীদ), মো. আনোয়ারুল হক (পিতা মনিরউদ্দিন খান, কার পাশা; বালিয়াবাড়ি যুদ্ধে শহীদ), মো. নুরুল ইসলাম (কারপাশা; বালিয়াবাড়ি যুদ্ধে শহীদ), সুখেন্দু বিকাশ রায় (পিতা নবদ্বীপ চন্দ্র রায়, নগর; ধৃত হয়ে শত্রুদের হাতে শহীদ), সৈয়দ আমিনুল হক ইকবাল (পিতা সৈয়দ জহুরুল হক, কুর্শা; ধৃত হয়ে শত্রুদের হাতে শহীদ), আব্দুল করিম (পিতা হাজী আশ্রব আলী, দৌলতপুর; গাড়ি দুর্ঘটনায় শহীদ), আব্দুল মালেক মালু (পিতা আব্দুল গণি, পূর্বগ্রাম; নিকলী যুদ্ধে শহীদ), মতিউর রহমান (পিতা আব্বাছ আলী সরকার, গুরুই; নিকলী যুদ্ধে শহীদ), আব্দুল হেকিম (পিতা হাজী শমসের আলী, ষাইটধার; সিলেটের সাচনা যুদ্ধে শহীদ), মেঘু মিয়া (পিতা নূর মামুদ, ষাইটধার; নিকলী যুদ্ধে শহীদ), নান্টু মিয়া (পিতা শামসুদ্দিন সাচুনি, পূর্বগ্রাম; নিকলী যুদ্ধে শহীদ), আব্দুল বারিক (পিতা হাফিজউদ্দিন, দোয়ারহাটি; সিলেটের চিনাকান্দি যুদ্ধে শহীদ), ইউনুছ আলী (পিতা খোরশিদ আলী, পুকুরপাড়; সিলেটের চিনাকান্দি যুদ্ধে শহীদ), আছির উদ্দিন (ষাইটধার; টেকেরঘাট যুদ্ধে শহীদ), আহেদ আলী ওরফে মগা মিয়া (পিতা আ. মজিদ, মহরকোণা; টেকেরঘাট যুদ্ধে শহীদ), সিরাজুল হক খান ওরফে আঞ্জু মিয়া (পিতা আ. রউফ খান, নানশ্রী; টেকেরঘাট যুদ্ধে শহীদ), নিভু শেখ (পিতা ছাবু শেখ, ধোপাহাটি; টেকেরঘাট যুদ্ধে শহীদ), মহেশ চন্দ্র সাহা (পিতা গৌরচান সাহা, বড় মালোহাটি; টেকেরঘাট যুদ্ধে শহীদ) ও জয়চন্দ্র সূত্রধর ষাইটধার; টেকেরঘাট যুদ্ধে শহীদ)।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে ১৯৭২ সালে নিকলীতে শহীদ স্মরণিকা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। মুক্তিযোদ্ধা মতিয়র রহমান, বীর বিক্রম-এর নামে বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন নির্মিত হয়েছে। দামপাড়ায় গণহত্যার শিকার শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। এ ফলকে নিহতদের নাম উৎকীর্ণ রয়েছে। [মহিবুর রহিম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!