বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই ভিক্টোরোভিচ পদগর্নি
নিকোলাই ভিক্টোরোভিচ পদগর্নি (১৯০৩-১৯৮৩) সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম সোভিয়েতের চেয়ারম্যান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিবাদকারী, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে চূড়ান্ত সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারীদের মধ্যে অন্যতম এবং মুক্তিযুদ্ধে সামগ্রিক অবদানের জন্য Bangladesh Liberation War সম্মাননা (মরণোত্তর) প্রাপ্ত।
নিকোলাই ভিক্টোরোভিচ পদগনি ১৯০৩ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ইউক্রেনের কারলভকা শহরের একটি শ্রমিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তিনি কিয়েভ টেকনোলজি ক্যল ইনস্টিটিউটে অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে ইউক্রেন কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় সেক্রেটারি এবং ১৯৫৭ সালে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম সেক্রেটারি হন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত সুপ্রিম সোভিয়েতের চেয়ারম্যান এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ৭১-এর মার্চে বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করলে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পদগর্নি এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ২রা এপ্রিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে একটি চিঠি দেন। ঐ চিঠিতে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – ও বাংলাদেশের অন্য নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি পাকিস্তানকে এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের উপায় বের করার এবং অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। পদগর্নি তাঁর চিঠিতে বলেন,
‘…[পূর্ব পাকিস্তানে] অগণিত মানুষের প্রাণহানি, নিপীড়ন ও দুঃখকষ্টের খবরে সোভিয়েতের জনগণ বিচলিত না হয়ে পারে না। মুজিবুর রহমান এবং অন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বন্দি করায় এবং নির্যাতন করায়ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উদ্বেগ বোধ করছে। এইসব নেতা হালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সন্দেহাতীত সমর্থন লাভ করেছিলেন।…আমরা বিশ্বাস করি যে, পাকিস্তানে বর্তমানে যে জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, বলপ্রয়োগ না করে রাজনৈতিকভাবে তার সমাধান করা যায় এবং করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানে দমননীতি এবং রক্তপাত যদি চলতে থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে সমস্যার সমাধান আরো কঠিন হয়ে উঠবে এবং তাতে পাকিস্তানের সমস্ত মৌল স্বার্থেরই ক্ষতি হবে। …পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য, সেখানকার মানুষের নিপীড়নের অবসান ঘটানোর জন্য এবং সমস্যা সমাধানের একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক উপায় উদ্ভাবনের জন্য অত্যন্ত জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি।…আপনাকে এই অনুরোধ জানাতে আমরা কোন নীতি দ্বারা পরিচালিত হয়েছি, আশা করি আপনি তা সঠিকভাবে বুঝতে পারবেন। আমাদের একান্ত কামনা যে অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক (বঙ্গানুবাদ)।’
ইয়াহিয়া খানকে দেয়া সোভিয়েত প্রেসিডেন্টের এ চিঠি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। বাংলাদেশ প্রশ্নে সোভিয়েত নীতির সারসংক্ষেপ এতে প্রতিফলিত হয়েছে। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন এমনকি বাংলাদেশবিরোধী চীনের সরকারি ভাষ্যেও এ চিঠির প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে। চীন এ চিঠির জন্য পদগর্নি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সমালোচনা করে। ১১ই এপ্রিল চীনের পিপলস ডেইলি পত্রিকায় প্রকাশিত ‘What are৷ndian Expansionists Trying to Do?’ শীর্ষক এক মন্তব্য কলামে বলা হয়, “In his message to President Yahya Khan, President of the Presidium of the Supreme Soviet of the U. S. S. R. Podogomy made no mention of the৷ndian reactionary’s threat to Pakistan, but on the contrary৷mprudently criticised the Pakistan Government. They posed themselves as ‘freinds’ and hypocritically expressed concern for the৷nterests of the people of Pakistan.” ১২ই আগস্ট সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকোর ভারত সফর শেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত যে যুক্ত বিবৃতি দেয়, তাতে পদগর্নির ২রা এপ্রিল দেয়া চিঠির উল্লেখ করা হয়। ভারতের পক্ষ থেকে এ চিঠির জন্য পদগর্নির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো হয়। সেপ্টেম্বরে ইন্দিরা গান্ধী-র সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের সময়ও এ চিঠির প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়। সোভিয়েত-ভারত যৌথ বিবৃতিতে পদগর্নির চিঠির উল্লেখ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয় যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের পাশে থাকবে। ৪ঠা ডিসেম্বর সোভিয়েত প্রতিনিধি জ্যাকব মালিকের জাতিসংঘে দেয়া বিবৃতিতেও এ চিঠির প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়। জ্যাকব উল্লেখ করেন যে, প্রেসিডেন্ট পদগর্নি ২রা এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার সমাধানের জন্য শান্তিপূর্ণ পথ উদ্ভাবনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু ‘দুর্ভাগ্যবশত পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়৷’
প্রেসিডেন্ট পদগর্নি কেবল এ চিঠি নয়, আরো বিভিন্ন উপায়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাংলাদেশ-নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অবদান রাখেন। তিনি আগস্টে স্বাক্ষরিত ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির নেপথ্যের অন্যতম কারিগর ছিলেন। সেপ্টেম্বরে ইন্দিরা গান্ধী সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে গেলে পদগর্নির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশ পরিস্থিতি, সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তি ও চলমান বিশ্ব রাজনীতির নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন। ভারত সফরে এসে পদগর্নি ১লা অক্টোবর নয়াদিল্লিতে দেয়া এক ভাষণে ভারত উপমহাদেশে বিরাজমান সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তিতে একটি উপসংহারে পৌঁছার ব্যাপারে সম্ভাব্য সকল সহায়তার আশ্বাস দেন। ডিসেম্বরে পাকিস্তান, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির যে অপচেষ্টা করে, তা বানচাল করতে সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘ভেটো’ প্রয়োগের কৌশল নির্ধারণে পদগর্নি ভূমিকা পালন করেন। পদগর্নির এ কৌশলের সফল প্রয়োগ হওয়ায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত সাফল্য নিশ্চিত হয়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের ২৭শে মার্চ নিকোলাই ভিক্টোরোভিচ পদগর্নিকে Bangladesh Liberation War সম্মাননা (মরণোত্তর) প্রদান করে। বাংলাদেশের এ বন্ধু ১৯৮৩ সালের ১২ই জানুয়ারি ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে মৃত্যুবরণ করেন। [জালাল আহমেদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড