You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা পাকিস্তানি শাসকদের দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রাজনৈতিক নেতা- কর্মী ও সংগঠকবৃন্দ সমগ্র বাঙালি জাতিকে মুক্তির প্রত্যাশায় উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। জাতির এ প্রত্যাশা চূড়ান্ত রূপ নেয় বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন ও সাতই মার্চের ভাষণ-এর মধ্য দিয়ে। নারায়ণগঞ্জবাসী সহজেই বুঝতে পারে স্বাধীনতা যুদ্ধ অনিবার্য। এখানকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা-কর্মীসহ সর্বস্তরের জনগণ সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
২রা মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে নারায়ণগঞ্জবাসী এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রায় প্রতিদিনই নারায়ণগঞ্জ মহকুমার সর্বত্র সভা-সমাবেশ চলতে থাকে। মহকুমা শহর, ফতুল্লা, সিদ্দিরগঞ্জ, পঞ্চবটি, ফতুল্লা বাজার ও পাগলা এলাকাসহ কাশিপুর, বক্তাবলী এবং এনায়েতনগর ইউনিয়নের গ্রামগুলোতেও অসহযোগ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ৩রা মার্চ থেকে উপজেলার শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিকরা কারখানায় যোগ না দিয়ে রাজপথে নেমে আসে। তখনকার ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কের পাগলা থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ছাত্র-শ্রমিক-জনতা প্রতিদিনই মিছিল করতে থাকে। ৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকে সারা দেশের প্রশাসন যন্ত্র বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে থাকে।
১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণে ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পর এর প্রতিবাদে সিদ্ধিরগঞ্জ আদমজী ফুটবল মাঠে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এদিন পুলিশের গুলিতে আদমজী মিলের শ্রমিক আব্দুর রশিদ নিহত হন। আব্দুর রশিদ হত্যার প্রতিবাদে ৪ঠা মার্চ চিত্তরঞ্জন কটন মিলসের মাঠে এক জনসমাবেশের আয়োজন করা হয়। সিদ্ধিরগঞ্জের শ্রমিক- জনতা বিপুল সংখ্যায় রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের জনসভায় যোগ দেয়। ৯ই মার্চ সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের শ্রমিকরা এক সভায় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের নির্দেশাবলি বাস্তবায়নে অঙ্গীকার করে। এর কয়েক দিন পর গোদনাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে একটি প্রতিবাদী ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ১৩ই মার্চ আদমজী জুট মিলসের শ্রমিক সমাবেশ থেকেও বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। ১৬ই মার্চ আদমজী মিলের শ্রমিকরা অসহযোগ আন্দোলন বেগবান করতে তাদের একদিনের মজুরি (মোট ১ লাখ ২ হাজার ১ শত ১২ টাকা ৪৯ পয়সা) বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেয়। ২০শে মার্চ চিত্তরঞ্জন কটন মিলস মাঠে স্বাধীনতার পক্ষে শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন এবং শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বে সভা-সমাবেশ, মিছিল ও অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়। এতে নেতৃত্ব দেন বক্তাবলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আবদুল লতিফ চৌধুরী, আবদুল মান্নান ও ইব্রাহীম প্রধান, ন্যাপের আবদুর রশিদ ও নূরুল হক খান, কাশিপুরের আক্কাস আলী এবং এনায়েতনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আবদুল লতিফ ও ন্যাপের শামসুল হক। স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি পালন করতে থাকে।
২৩শে মার্চ উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ছাত্র-শ্রমিক-জনতা সিদ্ধিরগঞ্জের মুনলাইট সিনেমা হলে সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করে। সংগ্রাম পরিষদের দায়িত্বে ছিলেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মালেক, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রমিজউদ্দিন ভূঁইয়া এবং ছাত্রনেতাদের মধ্যে নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া, মো. গিয়াসউদ্দীন, মো. মোহর আলী, খোরশেদ আলম, আব্দুল মতিন-১, মো. কামাল হোসেন, আব্দুল মতিন-২, মহি প্রমুখ। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আনসারদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
২৩শে মার্চ সিদ্ধিরগঞ্জের শ্রমিক-ছাত্র-শিল্পী-জনতা প্রতিরোধ দিবস পালন করে। এদিন সকাল ৯টায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গোদনাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাদে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হয়। ২৩শে মার্চ সিদ্ধিরগঞ্জের নানা শ্রেণি- পেশার মানুষ ট্রাকযোগে মিছিল নিয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বর বাড়িতে।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা সিরাজুল ইসলাম, শরিফুল আশরাফ, রাশেদুল ইসলাম রাশু প্রমুখ ২৬শে মার্চ সকাল ৭টায় নারায়ণগঞ্জ কোর্টের মালখানা থেকে ১২১টি রাইফেল এবং ৪ প্যাকেট বুলেট নিয়ে এসে আলী আহমদ চুনকা নেতৃত্বে দেওভোগ সমাজ কল্যাণ ক্লাবে রাখেন। শফিউদ্দিন সারোয়ার (বাবু সারোয়ার)-এর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা দুপুরে নারায়ণগঞ্জ কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মালখানা এবং বিকেলে চাষাড়া পুলিশ ক্যাম্পের সকল অস্ত্র হস্তগত করেন। ঐদিনই আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ আকমল হোসেন, আহমদ চুনকা, সুলতান মোহাম্মদ মল্লিক, গোলাম মোরশেদ ফারুকী, খোকা মহিউদ্দিন এবং ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন কর্মী শহরের রহমতউল্লাহ ইন্সটিটিউটে সভা করে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করেন। তারা ফতুল্লা, আদমজী ও পাগলা এলাকায় দলীয় নেতা- কর্মীদের জনসাধারণকে সংগঠিত করার নির্দেশ দেন। ন্যাপ নেতা শামসুল হক, আওয়ামী লীগ নেতা ইব্রাহিম প্রধান, মোহাম্মদ আলী, কে এম ফজলুল হক, আমিনুল ইসলাম ও আবদুল লতিফ চৌধুরীর নির্দেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১৫ জনের একটি দল ফতুল্লা থানার অস্ত্র হস্তগত করেন। এ- সময় দুজন অবাঙালি পুলিশ বাধা দিতে এলে তাদের বেঁধে রেখে অস্ত্রগুলো নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়।
আওয়ামী লীগের মো. শামসুজ্জোহা এমএনএ, আফজাল হোসেন এমপিএ, বজলুর রহমান, খাজা মহিউদ্দিন, ডা. শাহাদাত হোসেন, আলী আহমদ চুনকা, শেখ মিজানুর রহমান, সুলতান মোহাম্মদ মল্লিক ও জানে আলম ২৫শে মার্চ খান সাহেব ওসমান আলীর বাসভবনে বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকে মো. শামসুজ্জোহা এনএনএ-র নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। বৈঠক শেষে বিকেল সাড়ে চারটায় তাঁরা উপস্থিত কয়েকশ নেতা-কর্মীকে ঢাকা- নারায়ণগঞ্জ সড়ক অবরোধ করার নির্দেশ দেন। যার যে অস্ত্র আছে তা নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ২৭শে এপ্রিল লক্ষ্মীনগরের আজিজ কয়ালের বাড়িতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন নারায়ণগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগ নেতা সুলতান মোহাম্মদ মল্লিক। অন্যান্যের মধ্যে মহকুমা আওয়ামী লীগ নেতা আলী আহমেদ চুনকা এবং আক্কাস আলী এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভায় আবদুল লতিফ চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে ৩৩ সদস্যবিশিষ্ট সর্বদলীয় কমিটি গঠিত হয়।
নারায়ণগঞ্জ সদরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ছাত্র-যুবক, পুলিশ, আনসারসহ অনেকে সংগঠিত হয়ে প্রশিক্ষণের জন্য ভারেত যান। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডাররা নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তোলেন। এ শিবিরগুলোতে স্থানীয় যুবকদের ক্রলিং, পিটি, প্যারেড, রাইফেল শুটিং, স্টেনগান, গ্রেনেড, এসএলআর ইত্যাদি সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হতো। নারায়ণগঞ্জ সদর থানা কমান্ডার মুজিব বাহিনী-র অধিনায়ক ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মো. সিরাজুল ইসলাম (পিতা সৈয়দ আলী মাস্টার, ২৮নং মহিম গাঙ্গুলী রোড) ফতুল্লা থানার বক্তাবলী ইউনিয়নের মুক্তারকান্দিতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষণার্থী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আলহাজ ফয়েজ আহমেদ (পিতা আব্দুল জালাল উদ্দিন মুন্সি, উত্তর মাসদাইর) এবং আজাহার হোসেন (পিতা সৈয়দ আলী মাস্টার, ২৮নং মহিম গাঙ্গুলী রোড)-এর নাম উল্লেখযোগ্য।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম ও ইপিআর অফিসার মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে বক্তাবলী ইউনিয়নের পাঁচটি ক্যাম্পে দেড়শ ছাত্র, যুবক, শিক্ষক, কৃষক ও শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়। ১২ই জুন রাতে মুক্তারকান্দি গ্রামের ক্যাম্পে কিছু সংখ্যক ছাত্র- যুবক ও সাধারণ লোক নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করেন কমান্ডার মোস্তাফিজুর রহমান। ১৭ই জুন তিনি মধ্যনগরে আলী আকবর মাতবরের বাড়িতে গ্রামের ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন। ১৮ই জুন কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম মধ্যনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কার্য শুরু করেন। পরে রাজাপুর এবং আলীরটেক গ্রামেও প্রশিক্ষণ 5 শুরু হয়। প্রশিক্ষণের শুরুতে শারীরিক কসরত, অপারেশনের কৌশল, গুলি ছোড়া, গ্রেনেড নিক্ষেপ, গ্রেনেড স্থাপন, পাকবাহিনীর ক্যাম্পের সংবাদ সংগ্রহ, পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ ও নদীপাড়ে পাহারা দেয়ার কৌশল শেখানো হয়। পরবর্তীতে রাইফেল, এসএলআর ব্যবহার ও বেয়নেট চার্জের প্ৰশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ প্রদান করেন কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম, কমান্ডার মোস্তাফিজুর রহমান, ফয়েজ আহমেদ, আজাহার হোসেন, মনির হোসেন ও কমান্ডার সাইফুল ইসলাম বাচ্চু।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার জালকুঁড়ি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প ছিল। এখানে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আব্দুল খালেক মোল্লার নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে ওঠে। এ প্রশিক্ষণ শিবিরে স্থানীয় যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন ভারত থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা থানা কমান্ডার মো. ইসমাইল ও গ্রুপ কমান্ডার খোরশেদ আলম। এখানে ১৮-২০ জন যুবক সশস্ত্র যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
এ অঞ্চলের বিএলএফ কমান্ডের গ্রুপনেতা ছিলেন সিরাজুল ইসলাম (ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক), নূরুমিয়া চৌধুরী বাচ্চু, মোবারক হোসেন এবং শাহ আলম চৌধুরী। নারায়ণগঞ্জ জেলার এফএফ কমান্ডের গ্রুপনেতা ছিলেন মো. গিয়াসউদ্দিন (থানা কমান্ডার), মহিউদ্দিন আহমেদ দুলাল, গোপীনাথ দাস ও মাহফুজুর রহমান। নারায়ণগঞ্জ শহর কমান্ডের প্রধান ছিলেন মোবারক হোসেন। গণবাহিনীর গ্রুপ কমান্ডের মো. গিয়াসউদ্দীনের অধীনে আলীরটেক নামক স্থানে এ এলাকার যুবকরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। নারী মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া শাহাবুদ্দীন তাঁর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেন।
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলাধীন ফতুল্লা থানার যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন- সিরাজুল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান (ইপিআর অফিসার), সাইফুল ইসলাম বাচ্চু, আলী হোসেন, মাহফুজুর রহমান, মো. ফজল হক ও এ কে এম ফজলুল হক (থানা কমান্ডার)। উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন এফএফ গ্রুপের কমান্ডাররা হলেন- মো. ইসমাইল, রেহানউদ্দীন রেহান, আলী হোসেন ও মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন। মো. ইসমাইল ছিলেন থানা কমান্ডার এবং অন্যরা গ্রুপ কমান্ডার।
পাকবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করলে সিদ্ধিরগঞ্জ সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঢাকা-আদমজী রুটে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সিরাজুল ইসলাম ও মোসলেহউদ্দীনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সিরাজুল ইসলামের নির্দেশে স্থানীয় ছাত্র-যুবকরা বার্মা ইস্টার্নের সামনের রাস্তা কেটে ফেলে। অন্যদিকে খোরশেদ আলম, মহি, মতি ও হামিদ দলবল নিয়ে ঢাকা-ডেমরা সড়ক ও ২নং বাসস্ট্যান্ডের সড়ক কেটে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন।
২৫শে মার্চ রাত ৯টার দিকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ন্যাপ এবং ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে জামতলা ঈদগাহ ময়দানের সামনে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কের দুপাশে বড়বড় কড়ই গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতা আলী আহমেদ চুনকা, বাবু সারোয়ার ও সুলতান মোহাম্মদ মল্লিক সেখানে উপস্থিত থেকে এ কাজের তত্ত্বাবধান করেন। রাত ১০টার দিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কের কবরস্থান থেকে পঞ্চবটির দিকে কয়েকগজ দূরে বড় আকারের ৪০টির মতো গাছ কেটে রাস্তায় প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। আশপাশের সাধারণ মানুষও এতে যোগ দেয়। রাত ১১টার দিকে ছাত্রলীগ নেতা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের তিন ভাগে বিভক্ত করে সাধারণ ছাত্র-জনতাকে নিয়ে মাসদাইর কবরস্থান ও শ্মশানের তিনদিকে অবস্থান নিয়ে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার পরিকল্পনা করেন। তাঁর নেতৃত্বে একটি দল মাসদাইর গ্রামের আবুল খায়েরের বাড়ির পাশে, অপর দলটি শ্মশানের পশ্চিম পার্শ্বে এবং তৃতীয় দলটি জামতলার পূর্ব- উত্তরে রেললাইনের কাছাকাছি অবস্থান গ্রহণ করে। শতাধিক মানুষ রাত সাড়ে এগারটার দিকে বাবু সারোয়ার, কচি ও ফয়েজ আহমেদের নেতৃত্বে চাঁনমারির কাছে ঢাকা- নারয়ায়ণগঞ্জ রেললাইন উপড়ে ফেলে সেখানে অবস্থান নেয়। স্থানীয় নেতা-কর্মীরা পঞ্চবটি, ফতুল্লা বাজার, পোস্ট অফিস ও আলীগঞ্জের আরো পাঁচটি স্থানে গাছ কেটে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
২৬শে মার্চ সকালে শ্রমিক নেতা সাইদুল হক সাদু, রেহানউদ্দিন রেহান ও সুন্দর আলী অন্য শ্রমিকদের নিয়ে চিটাগাং রোডে এসে সড়ক কাটতে শুরু করেন। তখন কাঁচপুর ব্রিজের নির্মাণ কাজে পাহারারত পাকসেনারা গুলি চালায়। গুলিতে একজন ছাত্র শহীদ হন। পাকসেনা ও শ্রমিকদের মাঝে অনেকক্ষণ ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া চলে। এক পর্যায়ে পাকসেনারা আন্দোলনরত কয়েকজন নারী শ্রমিককে স্পিডবোটে তুলে নিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী দিয়ে পালিয়ে যায়। পরে শ্রমিকদের একটা অংশ ফতুল্লার দিকে যায় এবং সেখানে অন্যদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্রিজের পাশের সড়কটি কেটে ফেলে।
২৬শে মার্চ সকালে গোদনাইল উচ্চবিদ্যালয় মাঠে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ (মোজাফফর) প্রভৃতি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এক সভা থেকে ২৫শে মার্চের গণহত্যার প্রতিবাদ করেন। এ সভা শেষে পরবর্তী নির্দেশনা কামনা করে ছাত্র-শ্রমিক-যুবকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে চিত্তরঞ্জন কটন মিলস মাঠে বিশাল শ্রমিক সমাবেশ করেন। ২৭শে মার্চ সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ছাত্র নেতৃবৃন্দ চিত্তরঞ্জন মিলসের শাহজাহান ও গোদনাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র নৌবাহিনীর সৈনিক আব্দুর রহিমকে সঙ্গে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ রহমতউল্লাহ্ ইনস্টিটিউটে সংগ্রাম পরিষদের প্রধান কার্যালয়ে যান। সেখানে সভা শেষ করে তাঁরা শ্রমিক নেতা সিরাজুল ইসলামসহ অন্যদের নিয়ে ১ ও ২নং ঢাকেশ্বরী মিলস, আদর্শ মিলস, চিত্তরঞ্জন কটন মিলস এবং লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস থেকে বন্দুক ও কার্তুজ সংগ্রহ করেন। সিরাজুল ইসলাম ছাত্রনেতা মোহর আলীর হাতে ৩টি বন্দুক ও কিছু কার্তুজ দিয়ে নারায়ণগঞ্জ ফিরে যান। ২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় পাকবাহিনী পোস্তগোলা দিয়ে নারায়ণগঞ্জের দিকে প্রবেশ করার সময় প্রতিরোধযোদ্ধারা মাসদাইর কবরস্থানের বিভিন্ন অবস্থান, আলীগঞ্জ মসজিদ ও পোস্ট অফিস এলাকা থেকে গুলিবর্ষণ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। পাকসেনারা রাস্তায় গাছের ব্যারিকেডে বাধাপ্রাপ্ত হলে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে আলীগঞ্জে আসে। সঙ্গে-সঙ্গে তারা প্রতিরোধকারীদের গুলিবর্ষণের সম্মুখীন হয়। তারাও পাল্টা গুলি চালায়। উভয় পক্ষের মধ্যে এক ঘণ্টা গুলি বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে গুলি শেষ হয়ে গেলে প্রতিরোধযোদ্ধারা রেলস্টেশনের দিকে চলে যায়। রাত দেড়টার দিকে ফতুল্লা বাজার এলাকা থেকে প্রতিরোধযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ শুরু করেন। তার কিছুক্ষণ পরই মাসদাইর কবরস্থান থেকেও তাঁরা গুলিবর্ষণ করেন। সকাল ১১টার দিকে পাকবাহিনী পঞ্চবটি মোড় দিয়ে গাড়িবহর থেকে একযোগে গুলি ছুড়তে-ছুড়তে মাসদাইর কবরস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। ব্যারিকেড সরিয়ে পাকসেনারা মাসদাইর কবরস্থানে পৌছামাত্র তিনদিক থেকে প্রতিরোধকারীরা আক্রমণ চালান। কয়েকজন পাকসেনা গাড়িবহর থেকে লাফিয়ে পড়লে তাদের লক্ষ করে অবরোধকারীরা গুলিবর্ষণ করেন। মাসদাইর কবরস্থান যুদ্ধ-এ ৫ জন পাকসেনা নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়।
পাকসেনারা ২৬শে মার্চ গুলিবর্ষণ করতে-করতে শ্যামপুর ও পাগলা হয়ে ফতুল্লায় প্রবেশ করে। ঐদিন তারা ফতুল্লায় অবস্থান না করে চলে যায়। পরদিন ২৭শে মার্চ পুনরায় তারা ফতুল্লায় প্রবেশ করে এবং পাকিস্তান ন্যাশনাল অয়েল মিলস (বর্তমান যমুনা অয়েল মিলস)-এ ঘাঁটি স্থাপন করে। ১৫টির অধিক গাড়ি, কয়েকটি ট্যাংক ও মেশিনগানসহ ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত যুদ্ধবহর নিয়ে তারা তেলের ডিপো পুরোটা নিয়ন্ত্রণে নেয়। বিকেল ৩টার দিকে বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে চারটি যুদ্ধ জাহাজ এসে সেখানে নোঙ্গর করে। ৩০শে মার্চ পাকবাহিনী বিহারিদের মালিকানাধীন ডালডা মিলে এবং ফতুল্লা বাজারের উত্তরে আলীগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়া তারা ফাজেলপুর তেলের ডিপো, মাসদাইর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, আইইটি স্কুল, শাসনগাঁও টেক্সটাইল মিলস, কাশিপুর পুলের পাশ, বাটা কোম্পানি এবং কুমুদিনী ট্রাস্ট ভবনেও ক্যাম্প স্থাপন করে। ফাজেলপুর তেলের ডিপো ক্যাম্পে অবস্থানরত পাকসেনারা নৌপথে ঢাকার প্রবেশপথ বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদী নিয়ন্ত্রণে রেখে অবস্থান নেয়। এসব ক্যাম্প থেকে পাকসেনারা বিভিন্ন স্থানে অভিযান এবং হত্যাকাণ্ড চালায়।
২৮শে মার্চ দুপুর ১২টার দিকে পাকসেনারা নারায়ণগঞ্জ শহরে অনুপ্রবেশ করে প্রথমে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় ক্যাম্প স্থাপন করে। তখন থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা নারায়ণগঞ্জ সদরে অবস্থান করে। এ সময়কালে হানাদার বাহিনী এখানকার বিভিন্ন স্থানে ঘাঁটি স্থাপন করে। সেসব ঘাঁটির মধ্যে ছিল- নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা অফিস, নারায়ণগঞ্জ টেলিফোন অফিস, কাশীপুর ইউনিয়নের বাটা, নারায়ণগঞ্জ কোর্ট, নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুল, কুমুদিনী প্রেমিস, খানপুর, ১নং বাবুরাইল, দেওভোগ, পাইকপাড়া, তামাকপট্টি (গুদারাঘাট), ডব্লিউটি-র ঘাট (নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশন ঘাট), বাংলাবাজার ও আলমাস আলীর বাড়ি।
২৮শে মার্চ পাকবাহিনী সিদ্ধিরগঞ্জে অনুপ্রবেশ করে থানা দখল করে নেয়। আদমজী জুট মিলসে পাকবাহিনী একটি শক্তিশালী ঘাঁটি এবং হেডকোয়ার্টার্স গড়ে তোলে। এ সেনা ছাউনিতে প্রায় সাড়ে চার হাজার পাকসেনার অবস্থান ছিল। এছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন, বার্মা ইস্টার্ন অয়েল কোম্পানি লি. (বর্তমানে পদ্মা অয়েল)-এর সুপারের বাংলো, এস ও অয়েল কোম্পানি লি. (বর্তমানে মেঘনা অয়েল)-এর অফিস কক্ষেও পাকবাহিনীর ক্যাম্প ছিল।
পাকহানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে এখানে রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। রাজাকারদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সদরের কাশীপুর ইউনিয়নের মহসিন, ১নং বাবুরাইলের মহিউদ্দিন আহম্মেদ মাহির গ্রুপ, মনির হোসেন মইন্না, আলমাস, বারেক, শাহজাহান ও টুলু নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপর নির্যাতন চালায়। খানপুরের আবু মোহাম্মদ নইম আনসারী, চেয়ারম্যান আব্দুল বাসেত, মুজাহিদ মো. আলী, মো. আজগর, মো. জুলহাস মিয়া, আবু মোহাম্মদ নইম আনসারী ও আব্দুল বাসেত ছিল এলাকার ত্রাস। এছাড়া রাজাকার আব্দুল হালিম, লালমিয়া ও ‘জামাই’ নামে পরিচিত একজন আলবদর সদস্য খুবই সক্রিয় ছিল। রাজাকার কমান্ডার জিমখানা এলাকার রেলওয়ে কোম্পানির গুলজার এবং খোদা বখস, দেলোয়ার (দুলু) কাশীপুরের নিরীহ মানুষের ওপর নির্যাতন চালায়। দেওভোগের সিনেমা হলের টিকিট ব্লাকার শাহ আলম ও জায়েদ, নারায়ণগঞ্জ কো-অপারেটিভ ব্যাংকের চেয়ারম্যান বিবি রোডের ইসলাম, আমলাপাড়ার আরজু মিয়া, আলম খান লেনের মিলন খান, নামারবাগের জয়নাল, মিশনপাড়ার বুড্ডু, রেলিরবাগানের মোহাম্মদ হোসেন, গলাচিপার শাহজামাল প্রমুখ এলাকার মুক্তিযোদ্ধা, নিরীহ মানুষ এবং মেয়েদের ধরে নিয়ে পাকসেনাদের হাতে তুলে দিত। নারায়ণগঞ্জ সদরের বিভিন্ন এলাকায় শান্তি কমিটির সদস্যদের তৎপরতা ছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল দেওভোগের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আলমাস আলী, বাবুরাইলের শান্তি কমিটির সেক্রেটারি আমীর আলী, সিদ্দিকুর রহমান ভূঁইয়া, নাজিরউদ্দিন আহমেদ, নুরুউদ্দিন মিয়া, আবদুল জলিল, ডা. হাবিব, আজিজ সরদার, হোসেন জামাল প্রমুখ।
এপ্রিলের প্রথম দিকে পাকসেনারা বক্তাবলী, কাশীপুর ও এনায়েতনগর ইউনিয়নে মুসলিম লীগ, নেজামে
ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর নেতা-কর্মীদের নিয়ে প্রথমে শান্তি কমিটি গঠন করে। এ কমিটির নেতা- কর্মীরাই পরবর্তীতে রাজাকার বাহিনী গঠন করে। ৩৩ সদস্যবিশিষ্ট শান্তি কমিটি মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- ওয়ারেস সরদার, রমিজউদ্দিন আহমেদ, আবদুর রহিম, সোনামিয়া সরদার, খলিল মাতাব্বর, শাহেদ আলী মীর, কালু মুন্সী, সোলেমান খান, কাসেম আলী খলিফা, জাহেদ আলী মাতাব্বর, আলী হোসেন শিকদার, আবেদ আলী, জাকির হোসেন, সফিউদ্দিন প্রমুখ। হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে চেয়ারম্যান, হাসিবুল বারী ও আবদুল্লাহ মুন্সীকে ভাইস- চেয়ারম্যান, এ কে সিদ্দিকুর রহমানকে সেক্রেটারি, নূর ইসলাম খান ও নূরুল হক মোল্লাকে সহকারী সেক্রেটারি করে বক্তাবলী ইউনিয়ন কাউন্সিল শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির সদস্যরা পরে রাজাকার বাহিনী গঠন করে অত্র এলাকায় নির্যাতন, হত্যা ও লুটপাট চালায়।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার রাজাকারদের মধ্যে কাশেম (গোদনাইল), সফর আলী ভূঁইয়া, (গোদনাইল), জামাল মেম্বার (শিমুলপাড়া, মুসলিম লীগের সদস্য), মজিব মেম্বার (শিমুলপাড়া, সোনামিয়া বাজার, মুসলিম লীগের সদস্য), মোজাফফর মেম্বার (শিমুলপাড়া, সোনামিয়া বাজার, মুসলিম লীগের সদস্য), কুদ্দুস ডাক্তার (শিমুলপাড়া, সোনামিয়া বাজার, ডিসপেনসারির মালিক), রফিক, মো. মোস্তফা (সিদ্ধিরগঞ্জ), হাশেম ওরফে হাসু (গোদনাইল), আলী হোসেন (অবাঙালি, আদমজীনগর, সিদ্ধিরগঞ্জ), তজমুদ্দিন (অবাঙালি, আদমজীনগর), নিজামুদ্দিন (অবাঙালি, আদমজীনগর, সিদ্ধিরগঞ্জ), রহিমুদ্দিন (অবাঙালি, আদমজীনগর, সিদ্ধিরগঞ্জ), হাজের মিঞা (আদমজীনগর, সিদ্ধিরগঞ্জ), এ জব্বার সিদ্দিকী (অবাঙালি, আদমজীনগর, সিদ্ধিরগঞ্জ), মোহাম্মদ ইসমাইল (অবাঙালি, আদমজী জুট মিলস, শিমুলপাড়া) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। উপজেলা শান্তি কমিটির সদস্যদের মধ্যে মোহাম্মদ আলী (সিদ্ধিরগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের ঠিকাদার), আব্দুর রশীদ (গোদনাইল, ব্যবসায়ী, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), বাদশা মিয়া (আইলপাড়া, শিমুলপাড়া বিহারি কলোনি, আদমজী জুট মিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ মুসলিম লীগের সদস্য), সিকদার ডাক্তার (আদমজীনগর, সিদ্ধিরগঞ্জ), জিন্নাত আলী মাতবর (আদমজীনগর, সিদ্ধিরগঞ্জ, শান্তি কমিটির সদস্য), চানমিয়া সর্দার (থানা শান্তি কমিটির সদস্য), সাইদুর মাতবর (সিদ্ধিরগঞ্জ), সবদার খান (অবাঙালি, পিয়ন, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস, ১নং স্টাফ কোয়ার্টার্স), ইয়াকুব আলী খান (অবাঙালি, পিতা সবদার খান, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস, ১নং স্টাফ কোয়ার্টার্স) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বিহারি সালাম দেওয়ানের সহযোগিতায় পাকসেনারা পঞ্চবটি, শাসনগাঁও ও কাশিপুর এলাকায় রাজাকার বাহিনী গঠন করে। সালাম দেওয়ানের সহযোগী ছিল আবদুল খালেক ও আবদুল মালেক। রাজাকাররা অক্টোবর মাস পর্যন্ত ফতুল্লা থানার শিল্প এলাকায় পাকসেনাদের গণহত্যায় সহযোগিতা করে। গোগনগর গ্রামের শান্তি কমিটির কমান্ডার আফি সরদার ও তার গ্রুপের সদস্যরা শীতলক্ষ্যা, কাশিপুর, হাটখোলা, পাইকপাড়া ও ভুইগড় এলাকায় এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত অর্ধশত বাঙালিকে হত্যা করে এবং সর্বত্র লুটপাট ও নারীনির্যাতন চালায়।
২৬শে মার্চ রাত ১২টার দিকে পাকবাহিনী পাগলায় এসেই বাজারটি জ্বালিয়ে দেয়। তারা ৭০টির মতো দোকানে আগুন দেয়। ট্রাকে আগুন দিয়ে একজন ট্রাক শ্রমিককে পুড়িয়ে মারে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩ জন লোককে হত্যা করে। দুপাশে কয়েকটি বাড়িতে আগুন দেয়। হিন্দুদের উপসনালয়ে আক্রমণ করে আরো ৩ জনকে গুলি করে হত্যা করে। রাস্তার পাশে কয়েকটি দোকান লুট করে। লুটপাট করে চলে যাওয়ার সময় একজন দোকানদার দা দিয়ে দুজন পাকসেনাকে কোপায়। এ-সময় তারা তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। পাকবাহিনী আলীগঞ্জে প্রবেশ করে শতাধিক বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ২টি লবণ মিল ও ৩টি করাতকলে আগুন দেয়৷
পঞ্চবটি সড়ক দিয়ে ভেতরে ঢুকে পাকসেনারা আশপাশের অসংখ্য বাড়িতে আগুন দেয়, যাকে পায় তাকেই গুলি করে এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। দোকানপাটে ঢুকে লুটপাট চালায়। এক পর্যায়ে ডালডা মিলস থেকে বেশকিছু সংখ্যক বিহারি পাকসেনাদের সঙ্গে যোগ দেয়। বিহারিরা হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর দেখিয়ে দিলে পাকসেনারা সেগুলোতে আগুন দেয়। পঞ্চবটিতে তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের দুশতাধিক বাড়িতে আগুন দেয় এবং তাদের কয়েকজনকে হত্যা করে। পাকসেনারা মাসদাইর গ্রামে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে এবং রাস্তার দক্ষিণ পাশে ব্যাংকার শরীয়তউল্লাহর বাড়ি ও দারোগা বাড়িসহ বহু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এখানে তারা শরীয়তউল্লাহ, মো. জিন্নাহ, ফটিক মিয়া, ফকির চাঁন ও মো. সাচ্চুসহ ৩৮ জন মানুষকে হত্যা করে, যা মাসদাইর গণহত্যা হিসেবে পরিচিত ২৮শে মার্চ হানাদার বাহিনী নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা অফিসে ক্যাম্প স্থাপন করে। এদিন তারা আমেনা মঞ্জিলের মালিক আমেনা বেগম, টানবাজার এলাকায় আশা সিনেমা হলের মালিক মোশারফ হোসেন মাশা ও ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক চিত্তকে গুলি করে হত্যা করে। রাতে পাকসেনারা রহমতুল্লাহ ক্লাব, দেওভোগ সমাজ উন্নয়ন সংসদ ও দেওভোগস্থ মফিজ সাহেবের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এরপর বাড়ি-বাড়ি তল্লাশি চালায়। ২৮শে মার্চ মধ্যরাতে নিতাইগঞ্জের ১১নং আর কে দাস রোডের এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করে প্রতিষ্ঠানের মালিক সন্তোষ রায় চৌধুরী, তার ছোট ভাই লোটন রায় চৌধুরী এবং কর্মকর্তা কুমিল্লার কাইতলা গ্রামের গোবিন্দ চন্দ্র পোদ্দারকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। পাকসেনাদের এ হত্যাকাণ্ডে সহায়তা করে রাজাকার গুলজার ও মনির। ঐদিন তারা পাইকপাড়া পুলের ওপর থেকে আগুন লাগানো শুরু করে। বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করতে-করতে তারা জল্লারপাড়া এবং ১নং ও ২নং বাবুরাইলের অসংখ্য বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়; হত্যা করে নিরীহ গ্রামবাসীদের। নিতাইগঞ্জ পুলের ওপর তারা গণহত্যা চালায়। এটি নিতাইগঞ্জ গণহত্যা নামে পরিচিত।
পাকসেনারা নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে আড়তে হামলা চালায়। এপ্রিল ও মে মাস জুড়ে তারা রাজাকারদের সহায়তায় নারায়ণগঞ্জ শহরে গণহত্যা চালায়। তারা জয়গোবিন্দ রায় চৌধুরী ভবন, ডালপট্টি কানাই সাহার বাড়ি ও বর্তমান বঙ্গবন্ধু সড়কের আনন্দ পোদ্দারের ভবন জ্বালিয়ে দেয়। আনন্দ পোদ্দার ভবনে ঢুকে পাকসেনারা পঞ্চু পোদ্দারসহ ১৬ জন ব্যক্তিকে হত্যা করে। এটি আনন্দ পোদ্দার ভবন গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। তারা ৯ই এপ্রিল তোলারাম কলেজের ছাত্র অমিত সেনসহ ১১ ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে গোদনাইল বার্মা ইস্টার্ন কোম্পানিতে (বর্তমান পদ্মা অয়েল কোম্পানি লি.) হত্যা করে, যা গোদনাইল গণহত্যা নামে পরিচিত। দেওভোগের তরুণ রাজনৈতিক কর্মী জাহির ও তার বড়ভাই সলিমুল্লাহ মিয়াকে পাকসেনারা হত্যা করে। তারা ইংরেজ আমলের বিপ্লবী নেতা সীতানাথ দাসকে তাঁর উকিল পাড়ার বাসায় ঢুকে গুলি করে হত্যা করে। গলাচিপার রামকানাই আখড়াতে হামলা চালিয়ে ঘোষ বাবু ও অন্নদা বাবুকে হত্যা করে। হানাদাররা ‘ভাষা ও কথা’ নামক বইয়ের দোকানের মালিক শিশুকে গুলি করে হত্যা করে। চায়ের দোকানদার মন্টু বাবু ও তার বড়ভাইকেও একই সঙ্গে হত্যা করে বর্বর বাহিনী। ১লা মে তারা মোহাম্মদ সফিউদ্দিনকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে।
৩০শে মার্চ পাকসেনারা হরিহরপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি ভবন ও বাড়িতে আগুন দেয়। বাড়ি থেকে পালানোর সময় নিতাই দাশ, তার স্ত্রী অনিমা দাশ, শ্যালক অমলেশ নন্দী, দোকানদার সোহরাব হোসেনসহ মোট ৮ জনকে তারা হত্যা করে। এটি হরিহরপাড়া গণহত্যা নামে পরিচিত। পাকসেনারা নারীদের হাত ও গলা থেকে স্বর্ণের অলঙ্কার খুলে নেয়। ২রা এপ্রিল সন্ধ্যায় তারা ফতুল্লা বাজার সেতুর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের পাড়ে হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে আক্রমণ চালায়। তারা অর্ধশত হিন্দু বাড়িতে আগুন দেয়। কুমিল্লার দাউদকান্দির শম্ভু রায় (নরসুন্দর), তার স্ত্রী সূচিত্রা রায় ও এক মেয়ে এ আগুনে পুড়ে মারা যায়। পাকসেনাদের গুলিতে দোকানদার শ্যাম মারা যায়। পোস্ট অফিস রোডের সামনে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কের ওপর কাঠ ব্যবসায়ী নির্মলকে তারা গুলি করে হত্যা করে।
৭ই এপ্রিল পাকসেনারা ফতুল্লা থানার দেওভোগের আখড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনালয়ে আগুন দেয়। তারা পুরোহিত অরবিন্দ চক্রবর্তী ও তার দুই ভাইকে হত্যা করে এবং এলাকার শতাধিক বাড়িতে আগুন দেয়। দেওভোগ আখড়া রোডের হিন্দু সম্প্রদায়ের তিনটি ভবনে তারা আগুন দেয় এবং ৮ জনকে ধরে নারায়ণগঞ্জ শহরের দিকে নিয়ে যায়। শহরের মণ্ডলপাড়া পুলের কাছে নিয়ে সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এটি মণ্ডলপাড়া গণহত্যা বলে পরিচিত। ২রা সেপ্টেম্বর ভোররাতে কয়েকশ পাকসেনা ধর্মগঞ্জ গ্রামে হামলা চালায়। বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী ধর্মগঞ্জ, মুসলিমনগর ও শাসনগাঁও-এর অর্ধশত বাড়িতে তারা আগুন দেয়। জেলেপাড়া পুড়িয়ে দেয়ার সময় ৩ জন জেলেকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। অপর এক জেলে অমল রায়কে তারা ঘরের ভেতরে গুলি করে হত্যা করে।
২৯শে নভেম্বর বক্তাবলী যুদ্ধের পর পাকবাহিনী এখানকার ৫টি গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে। এতে কয়েকশ বাড়ি এবং শতশত মন ধান, পাট, আলু ও চিনাবাদাম পুড়ে যায়। এদিন তারা ১৪০ জন মানুষকে হত্যা করে, যা বক্তাবলী গণহত্যা নামে পরিচিত। এছাড়া পাকসেনাদের গুলিতে আহত হয় ২০০ জনের মতো মানুষ। ২রা ডিসেম্বর রাতে পাকসেনারা ফাজেলপুর গ্রামে প্রবেশ করে অর্ধশত বাড়িতে আগুন দেয় এবং আমানউল্লাহ ও আবদুস সালাম নামে দুজন ছাত্রসহ ৯ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এটি ফাজেলপুর গণহত্যা বলে পরিচিত।
কাশীপুর ইউনিয়নে এসে রাজাকার গুলজার, বাবুরাইলের মহিউদ্দিন আহম্মেদ মাহির গ্রুপের ৭-৮ জন ও মনির হোসেন মইন্না নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপর নির্যাতন চালায়। তারা যুবতী নারী ও স্কুলের ছাত্রীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এখানে হানাদার বাহিনীকে তারা পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। হানাদাররা আগুন ধরিয়ে বিপুল সংখ্যক বাড়িঘর ও সম্পত্তির ক্ষতি সাধন করে। এছাড়াও নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও লুটতরাজের মধ্য দিয়ে গ্রামবাসীদের আতঙ্কিত করে তোলে। কাশীপুর ইউনিয়নের একজন যুবতির ওপর পাশবিক অত্যাচার করে হানাদাররা। রাজাকাররা মর্গান উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী মাহফুজাকে ধরে নেয়ার চেষ্টা করলে মেয়েটি দৌড়ে একটি বাড়িতে আত্মগোপন করে হানাদারদের হাত থেকে রক্ষা পায়।
পাকসেনারা তিনটি ক্যাম্পকে বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। সেগুলো হচ্ছে- ফাজেলপুর তেলের ডিপো, মাসদাইর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় ও আইইটি স্কুল। বিভিন্ন এলাকা ও গ্রাম থেকে বাঙালিদের ধরে এনে এসব ক্যাম্পে নির্যাতন করা হতো। তেলের ডিপো ক্যাম্পের পাশে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে নিয়ে বন্দিদের মধ্য থেকে সাড়ে আট মাসে শতাধিক বাঙালিকে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এ ক্যাম্পে কেরানীগঞ্জের পানগাঁও জেলে পল্লীর ১১ জন জেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়, যা ফাজেলপুর তেলের ডিপো ক্যাম্প গণহত্যা বলে পরিচিত। মাসদাইর সরকারি বিদ্যালয় ক্যাম্প ছিল পাকসেনাদের ভয়াবহ নির্যাতনকেন্দ্র। বাড়িঘর থেকে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে এখানে ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। বন্দিদের স্বজনদের কাছে বড় অংকের টাকা দাবি করা হতো এবং যারা টাকা দিত তাদের স্বজনদের ছেড়ে দেয়া হতো। যুবকদের ধরে এনে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হতো। লাশ নিয়ে ফেলা হতো বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যায়। কাশিপুর, কুমুদিনী, পাইকপাড়া, বাবুরাইল, মাসদাইর ও দেওভোগে পাকসেনাদের অনেকগুলো বাঙ্কার ছিল। এই বাঙ্কারগুলো তারা নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করত।
এ উপজেলায় বেশ কয়েকটি বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ফাজেলপুর তেলের ডিপো বধ্যভূমি, বুড়িগঙ্গা নদীর তীর বধ্যভূমি- রাজাপুর বধ্যভূমি, আদমজী মিল পাট গুদাম সংলগ্ন বধ্যভূমি- ও আদমজী জুট মিলস্ পুকুরপাড় বধ্যভূমি- এবং লক্ষ্মীনগর গণকবর -, মুক্তারকান্দি গণকবর, মুসলিমনগর গণকবর – ঢাকা বাজু টেডিগেট বধ্যভূমি- ও মাসদাইর গণকবর। এছাড়া আদমজী শিমুলপাড়া বিহারি কলোনি যমঘর, আদমজী শিমুলপাড়া বিহারি কলোনির যমঘর সংলগ্ন পুকুর, আদমজী শিমুলপাড়া বিহারি কলোনির যমঘর সংলগ্ন পাম্প, ক্যান্টিনের দক্ষিণ পাশের পুকুর, আদমজীতে ঢাকা বাজু আনসার ক্যাম্প, আদমজী নিউ কলোনি টেডিগেট সংলগ্ন খাল, গোদনাইল ভাঙারপুল, বার্মা ইস্টার্ন অয়েল (বর্তমান পদ্মা অয়েল) ডিপোর জেটি, এস ও অয়েল (বর্তমান মেঘনা অয়েল) ডিপোর ৫নং টেঙ্কি সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন নদীর পাড় এবং নারায়ণগঞ্জ টারমিনাল বধ্যভূমি ও গণকবর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এপ্রিলের মধ্যভাগে থানা কমান্ডার মো. ইসমাইলের নেতৃত্বে মোহম্মদ মোহর আলী, মোমতাজ উদ্দীন ভূঁইয়া, নুরুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম প্রমুখের সমন্বয়ে গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল হেক্সোব্লেড দিয়ে একটি বৈদ্যুতিক টাওয়ার কেটে ফেলে। এ-সময় আরো তিনটি টাওয়ার কেটে ফেললে ঢাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
মুক্তিযোদ্ধারা জুন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ১৬ই জুলাই পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে তাঁদের কর্মতৎপরতা জোরদার করেন। তাঁরা প্রথমে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল পোস্ট অফিসে হাতবোমা নিক্ষেপ করে অপারেশন শুরু করেন। এরপর একটি সাব- স্টেশনের ট্রান্সফর্মার ধ্বংস করেন। নারায়ণগঞ্জ শহরে তাঁরা একদল টহলদার পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন। এতে ১০ জন পাকসেনা নিহত হয়। আগস্ট মাসে মুক্তিযোদ্ধারা লাঙ্গলবন্দ ব্রিজ ধ্বংস করতে ব্যর্থ হওয়ার পর মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনের গ্রুপসহ কয়েকটি গ্রুপ মিলে আবার তা ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেয়।
১২ই জুলাই রাত পৌনে ১২টার দিকে গ্রুপ কমান্ডার খোরশেদ আলমের নেতৃত্বে আলী হোসেন, আব্দুল মতিন, এহসান কবির রঞ্জন, রোশন আলী, রিয়াজুল হক, আলী আক্কাসসহ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল গোদনাইলের চৌধুরী বাড়ি বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মারে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ২৬শে জুলাই রাত এগারোটার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের একই দল আজিম মার্কেট এলাকার জেলে পাড়ার কাছে একটি কালভার্ট ধ্বংস করে। ৩রা আগস্ট রাত ২টার দিকে তাঁরা সিদ্ধিরগঞ্জ গোদনাইলের পাটের গুদামে আগুন ধরিয়ে দেন। গোদনাইলের বার্মা ইস্টার্ন অয়েল ডিপোতে পাকহানাদারদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। আগস্ট মাসের প্রথম দিকের এক রাতে তাঁরা এখানকার ট্রান্সফর্মারে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেটি উড়িয়ে দেন।
১৪ই আগস্ট থানা কমান্ডার মো. ইসমাইলের নেতৃত্বে সুন্দর আলী, নুরুল ইসলাম, মো. জয়নাল আবেদীন, মোমতাজ উদ্দীন ভূঁইয়া, মোহর আলী, বড় রশিদ, বদু, শফি, তপু ও গ্রুপ কমান্ডার রেহানউদ্দীন রেহানসহ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বার্মা ইস্টার্নের তেলের ট্যাঙ্কিতে বিস্ফোরণ ঘটায়, কিন্তু তা ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়। অভিযান শেষে ফেরার পথে জালকুঁড়ি রেললাইনের পশ্চিম পাশে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি বিনিময় হয়। তবে মুক্তিযোদ্ধা দল নিরাপদে তাদের আস্তানায় ফিরে আসতে সক্ষম হয়। মুক্তিবাহিনীর লক্ষ্য ছিল বার্মা ইস্টার্ন থেকে পাকবাহিনীর তেল সরবরাহ বন্ধ করা। ১৪ই আগস্টের ব্যর্থ অভিযানের দুদিন পর ১৬ই আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা অভিযান পরিচালনা করে তেলের ট্যাঙ্কিতে বিস্ফোরণ ঘটান এবং এবার তাঁরা সফল হন।
সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তিযোদ্ধা তাইজুল ইসলাম খেদু, মজিবর রহমান ও মজিদ সিদ্ধিরগঞ্জের দুর্ধর্ষ কাশেম রাজাকারের বিরুদ্ধে আদমজী জুট মিলস গেইটের বাজারে এক অপারেশন পরিচালনা করেন। এ অপারেশনে কাশেম নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন থেকে ঢাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা। তাই গ্রুপ কমান্ডার রেহানউদ্দীন রেহান এবং গ্রুপ কমান্ডার মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথ আক্রমণে শাহাজীবাজার লাইনের কয়েকটি বৈদ্যুতিক টাওয়ার ধ্বংস করা হয়। ২২শে সেপ্টেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল আজিম মার্কেটে পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণাধীন কয়েকটি পাটের গুদামে আগুন দেয়। এ অপারেশনের সময় একজন পাক গুপ্তচর নিহত হয়।
২৫শে সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে এগারোটার দিকে মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল গোদনাইল বাজারে কোরবান আলী নামক এক দুর্ধর্ষ রাজাকারের বিরুদ্ধে অপারেশন করে। এতে সে নিহত হয়। জালকুঁড়ি গ্রামের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে অবস্থিত বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করতে থানা কমান্ডার ইসমাইলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল অভিযান পরিচালনা করে। পাকবাহিনীর ডাক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে ৪ঠা অক্টোবর খোরশেদ আলমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের অপর একটি দল লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলসের এঞ্জেলা ডাকঘর আক্রমণ করে। ১৯শে অক্টোবর দুপুরে গ্রুপ কমান্ডার খোরশেদ আলমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল জেএমসি-র নিকটস্থ জনতা ব্যাংকে অভিযান পরিচালনা করে।
নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে থানা কমান্ডার ইসমাইলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বার্মা ইস্টার্ন সড়কের টেলিফোন বক্স ধ্বংস করে দেয়। ১৪ই ডিসেম্বর কমান্ডার রেহানউদ্দিন রেহানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য একটি দল যৌথ বাহিনীর সহায়তায় আদমজীতে অবস্থিত পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে।
আগস্টের শেষের দিকে পাকবাহিনী চরবয়রাগাদি গ্রামে আক্রমণ করলে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আবদুর রবের নেতৃত্বে গেরিলা বাহিনী তিনদিক থেকে পাল্টা আক্রমণ করে। উভয় পক্ষের মধ্যে আধঘণ্টা ব্যাপী গোলাগুলির পর পাকবাহিনী পিছু হটে। এ-যুদ্ধে ৩ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং তাদের দুটি রাইফেল ও একটি এসএলআর মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। এটি চরবয়রাগাদি যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১২ই সেপ্টেম্বর গেরিলা বাহিনী ফতুল্লা রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চিম পাশে নলখালি রেলসেতুর পাশে পাকবাহিনীর গমভর্তি ৯টি বগিসহ একটি ট্রেন শক্তিশালী এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। কমান্ডার আলী হোসেনের নেতৃত্বে ২০-২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা এ অপারেশনে অংশ নেন। নলখালি রেলসেতু অপারেশন-এ ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১৯শে সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা ফতুল্লা থানা অপারেশন পরিচালনা করেন। ফাজিলপুরের সহকারী কমান্ডার আমিনুলের নেতৃতে মধ্যরাতে থানার তিনদিক থেকে এ অপারেশনে অংশ নেন গেরিলা শাজাহান, অনিল কুমার দে, পরেশ, ফজল, নাসির, আউয়াল, মমিন, বি এম হালিম, জসিম ও ফজলুল হক। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকসেনারা অস্ত্রশস্ত্র রেখেই পালিয়ে যায়।
২৫শে সেপ্টেম্বর সকালে কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম ও কমান্ডার মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে ৩০ জন গেরিলা আফি সরদারের বাড়িতে অপারেশন চালান। এ-সময় আফি সরদার ও তার বড় ছেলে গুলি করতে-করতে ঘর থেকে বের হয়ে পালানোর সময় মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা গুলিবর্ষণে নিহত হয়। পরে তার স্ত্রী মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়ে মারলে সেও মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে নিহত হয়। রাজকারদের একটি বড় গ্রুপকে সহায়তা করত সুলতানা রানী নামে এক মহিলা ও তার দুই চাচাতো ভাই রহিম খান ও দুলাল খান। ২রা নভেম্বর রাতে কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম তাঁর দল নিয়ে চন্দনতোলা গ্রাম থেকে তাদের ধরে নিয়ে বুড়িগঙ্গার তীরে – আলীরটেক গ্রামে আসে। রানীকে আটকে রেখে দুই ভাইকে ঐ রাতেই গুলি করে হত্যা করা হয়। ৮দিন পর রানীর বাবা মুচলেকা দিয়ে মেয়েকে নিয়ে যায়।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে ধর্মগঞ্জে মাওলা টেক্সটাইল মিলসের সামনের রাস্তায় দুপুর ১টার দিকে রাজাকার সালাম দেওয়ানকে মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম, শুকুর আহমেদ ও বরুণ দাশ আক্রমণ করেন। তাঁরা সালাম রাজাকারকে তিনদিক থেকে গুলি করার পরও সে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, কিন্তু তার সহযোগী রাজাকার মানিক গুলিতে মারা যায়। এ-সময় বাজারের ভেতর থেকে আরেক রাজাকার রিকশাচালক সোহরাবকে ধরে এনে সাধারণ জনতা পিটিয় হত্যা করে। ৩রা নভেম্বর সন্ধ্যায় বাবুরাইল সেতুতে বসে কয়েকজন সশস্ত্র রাজাকার আড্ডা দিচ্ছিল। এ সংবাদ পেয়ে কমান্ডার মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে অপারেশন চালান। মুক্তিযোদ্ধারা ব্রাশফায়ার করলে কয়েকজন রাজাকার অস্ত্রসহ পানিতে লাফিয়ে পড়ে। বারেক ও দেলোয়ার নামে ২ জন রাজাকার ঘটনাস্থলে মারা যায়। ৩ জনকে পানি থেকে ধরে এনে পিটিয়ে আধমরা করে ফেলে রাখা হয়। এ অপারেশনে মাহফুজুর রহামনের সঙ্গে ছিলেন জানে আলম, ইসমাইল হোসেন, বাচ্চু, রমজান, শাহাবুদ্দিন শাহা, আবু বকর ও শহীদুল্লাহ।
অক্টোবর মাসে মুক্তিযোদ্ধারা দুটি অপারেশন পরিচালনা করেন- একটি কালিরবাজার অপারেশন- এবং অপরটি বাবুরাইল সেতু অপারেশন-। কালিরবাজার অপারেশনে ৪ জন পাকসেনা ও ৭ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। অপরদিকে বাবুরাইল সেতু অপারেশনে ২ জন রাজাকার নিহত ও এক জন আহত হয়।
সৈয়দপুর ক্যাম্প থেকে গেরিলাদের একটি দল ১৩ই নভেম্বর মুন্সিগঞ্জের কমলাঘাট বন্দরে বিহারি অধ্যুষিত পাড়ায় রাজাকারদের ওপর আক্রমণ করে। বাচ্চু, সিরাজ, রমজানসহ ৮ জনের একটি গেরিলা দল এতে অংশ নেয়। একই সময়ে বক্তাবলী থেকে কমান্ডার সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে আরো একটি গেরিলা দল সেখানে এসে যোগ দেয়। উভয় গ্রুপ একযোগে হামলা করে ৭ জন রাজাকারকে হত্যা করে। এরপর থেকে কমলাঘাট বন্দর শত্রুমুক্ত হয়।
২৯শে নভেম্বর রাত ৪টার দিকে পাকবাহিনী বক্তাবলীতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোতে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ চালান। ৪ ঘণ্টাব্যাপী এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি শেষ হয়ে গেলে তাঁরা নিরাপদ স্থানে চলে যান। বক্তাবলী যুদ্ধ-এ বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। ২রা ডিসেম্বর দুপুরে কাশিপুর পুলের কাছে শান্তি কমিটির দলনেতা আমির হামজা ও তার এক সহযোগী বিহারি রমজান মিয়া শর্টগান নিয়ে দাঁড়িয়ে বুদ্ধি-পরামর্শ করছিল। এ-সময় গেরিলা শাহাবুদ্দিন, রমজান, আজাহার, ফয়েজ, হারুন ও ছোট সিরাজ অতর্কিতে চারদিক থেকে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করলে রমজান ও আমির হামজা নিহত হয়। ৩রা ডিসেম্বর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জামতলার কাছে চাষাঢ়া রেলস্টেশনের অদূরে রেলসেতু আক্রমণ করে সেতুর একটি অংশ উড়িয়ে দেন। এ অপারেশনে অংশ নেন মাসদাইরের শহীদুল্লাহ ও কচি এবং জামতলার আহসান উল্লাহ ও নাসিরউদ্দিন। পাকসেনারা এরপর থেকে ট্রেনে চড়ে নারায়ণগঞ্জে আসা বন্ধ করে দেয়। পরের দিন পুনরায় কমান্ডার ফজলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ফতুল্লা রেলস্টেশনে পাকবাহিনীর একটি বগিতে অপারেশন চালান। আধঘণ্টা তুমুল লড়াইয়ের পর পাকবাহিনী ফতুল্লা স্টেশন ত্যাগ করে ঢাকায় ফিরে যায়।
৩রা ডিসেম্বর মাহফুজুর রহমান মাফুজের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কাশীপুর মসজিদের পাশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ করেন। এতে একজন পাকসেনা নিহত এবং দুজন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নাগালে না পেয়ে পাকসেনারা কাশীপুরের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ করে।
৬ই ডিসেম্বর ভোররাতে কমান্ডার মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে একদল গেরিলা বক্তাবলীর কানাইনগর থেকে নৌকাযোগে কাশিপুর বাটা কোম্পানিতে পাকসেনাদের ক্যাম্পে অপারেশন চালান। এ দলের মধ্যে ছিলেন জানে আলম, পরিমল চক্রবর্তী, জাহাঙ্গীর আলম, শফিউদ্দিন, মাইজুদ্দিন, বাচ্চু, মো. আবদুল হালিম, তমিজউদ্দিন রিজভী, মনির হোসেন ও আজাহার। পঞ্চবটি ডালডা মিলসের ভেতর ছিল পাকসেনা ও বিহারিদের শক্তিশালী ক্যাম্প। ৯ই ডিসেম্বর নদী ও স্থল উভয় দিক থেকে এ ক্যাম্পের ভেতর অপারেশন চালান মুক্তিযোদ্ধারা। স্থলভাগে ছিলেন আবদুল মান্নান, কনক দাশ, অরুণ দাশ, শফি, মোহাম্মদ আলী, ছানা রায়, বরুণ দাশ, আবদুল হালিম সরদার ও নাসিরউদ্দিন। প্রায় দুঘণ্টার অপারেশনে গেরিলারা পাকসেনাদের ক্যাম্প বিধ্বস্ত করে দেন। বুড়িগঙ্গা নদীতে পাকসেনাদের দুটি ছোট জাহাজেও তাঁরা আক্রমণ চালান। জাহাজ ফেলে পাকসেনারা ডিপোর ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নেয়। হরিহরপাড়ার শীষমহলে প্রায়ই হিন্দুদের বাড়িঘরে আক্রমণ করত বিহারিরা। তাদের সঙ্গে শফি রাজাকার ও তার দলের সদস্যরা লুটপাটে অংশ নিত। ১১ই ডিসেম্বর কমান্ডার ফজলের দল শফির বাড়ি ঘেরাও করে তাকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে।
১৩ই ডিসেম্বর কান্দাপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এদিন কমান্ডার মাহফুজের নেতৃত্বে মধ্যনগর ও রাজাপুর ক্যাম্প থেকে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা এ অপারেশনে যোগ দেন। বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরানীগঞ্জ থেকে কমান্ডার মোস্তফা মহসীন মন্টুর গ্রুপের বেশ কয়েকজন সদস্যও এতে যোগ দেন। অপারেশনে পাকসেনারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং ঐ রাতেই তারা ফতুল্লা তেলডিপো ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ১৬ই ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- গিয়াস উদ্দিন, বীর প্রতীক (পিতা সামসুদ্দীন আহমেদ, তল্লা)।
নারায়ণগঞ্জ সদরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মোহাম্মদ জুলহাস মিয়া (পিতা সৈয়দ আলী, ১৪৫নং পশ্চিম দেওভোগ, ছাত্র), এ কে এম ইমদাদুল্লা (পিতা সাইজুদ্দিন বেপারী, তোলারাম কলেজের স্নাতক পরিক্ষার্থী), আব্দুল আলীম (পিতা মো. ইমামউদ্দিন মুন্সি, ১০/বি নওয়াব সুলিমুল্লাহ সড়ক), খোকন বিশ্বাস, আব্দুল আউয়াল মিলন (পিতা হাজী আব্দুল লতিফ, শীতলক্ষ্যা), আলী আকবর (পিতা ইউনুছ সরদার, সৈয়দপুর গোসনগর) ও আব্দুর রউফ বাচ্চু মিয়া (পিতা হাবিবুর রহমান, মজিদ খানপুর)।
ফতুল্লার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- জুলহাস মিয়া (ছাত্র, পশ্চিম দেওভোগ), আলী আকবর (সৈয়দপুর), মো. ওয়াহিদুর রহমান (পিতা মো. মতিউর রহমান, মুক্তারকান্দি), আব্দুল কুদ্দুস মাহমুদ বিশ্বাস (পিতা আব্দুল লতিফ বিশ্বাস, বাংলাবাজার), আব্দুস সালাম (আনসার সদস্য; পিতা আবেদ আলী সরকার, মাইসদাইর), জয়নাল আবেদিন (দাউদকান্দি), জুলহাস (মধ্যনগর), মোহাম্মদ হোসেন (ডিক্রিরচর), সাইদুর রহমান (আওয়ামী লীগ নেতা, আলীগঞ্জ) ও তাঁর পুত্র মিজানুর রহমান।
সিদ্ধিরগঞ্জের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. সলিমুল্লাহ সাউদ (পিতা জাবেদ আলী সরদার; ছাত্র, গোদনাইল উচ্চ বিদ্যালয়, ধনকুণ্ডা, গোদনাইল), মো. ফজলুল হক (পিতা মো. আলিম সরদার, জালকুঁড়ি, গোদনাইল), আমিনুল হক (পিতা মুরলী, জালকুঁড়ি, গোদনাইল), আব্দুল কাদির মিয়া (পিতা মফিজউদ্দিন, গোদনাইল ভূঁইয়াপাড়া), মো. সামসুদ্দিন প্রধান (পিতা আকালি প্রধান, সুমিলপাড়া), আব্দুল আলী (পিতা লালচান দালাল, সুমিলপাড়া), হযরত আলী (পিতা মো. পিয়ার আলী, গোদনাইল), আব্দুল আজিজ (সিদ্ধিরগঞ্জ), আফসারউদ্দীন (সিদ্ধিরগঞ্জ), আ. কাদির (পিতা মফিজ উদ্দিন, গোদনাইল), আব্দুল লতিফ (পিতা জয়নাল আবেদীন, এনায়েতনগর), কালু (সিদ্ধিরগঞ্জ), আব্দুল বারেক (পিতা সুলতান হাজী, গোদনাইল), লস্কার আলী (পিতা নবু মিয়া, গোদনাইল), কুতুব আলী (পিতা ইয়াকুব আলী, গোদনাইল), আব্দুল হামিদ (পিতা সমির উদ্দিন বেপারী, কদমতলী), মো. মজিবুর রহমান (পিতা মো. নবী বক্স; গোদনাইল উচ্চ বিদ্যায়ের ছাত্র, গোদনাইল বি ই রোড), কালা চান্দ কালু মিয়া (২নং মিলের মেডিকেলে কর্মরত, আদমজী জুট মিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ), রজব আলী মাতবর (কৃষিজীবী, জালকুঁড়ি উত্তরপাড়া, গোদনাইল), বিশ্বনাথ পাল (ম্যানেজার, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ), রমাকান্ত দাস (কেরানি, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ), অরুণ চন্দ্র আইচ (কম্পাউন্ডার, ১নং স্টাফ কোয়ার্টার্স, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ), দীনেশ দাস (টাইপিস্ট, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ), দিলীপ দাস (শ্রমিক, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ), গীরিন বসাক (কেরানি, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ), যোগেশ দাস (পিয়ন, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ), চিন্তাহরণ দে (পারচেজ এসিস্ট্যান্ট, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ), বঙ্কিম বিহারী রায়চৌধুরী (অফিস সহকারী, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ), গোপাল দে (কেরানি, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ), কালিপদ সিং (শ্রমিক, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ), সতীশ দে (শ্রমিক, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ), আশা রঞ্জন শীল (শ্রমিক, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ), পুণ্য চন্দ্র দত্ত (শ্রমিক, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ), প্রাণেশ দত্ত (ছাত্র, ১নং স্টাফ কোয়ার্টার্স, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ), খোকন মিঞা (ব্যবসায়ী, ১নং স্টাফ কোয়ার্টার্স, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ), আব্দুল আজিজ (ব্যবসায়ী, ১নং স্টাফ কোয়ার্টার্স, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ) এবং মো. মমতাজ উদ্দিন (১নং স্টাফ কোয়ার্টার্স, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ)।
নারায়ণগঞ্জ স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে জেনারেল ওসমানী স্টেডিয়াম। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নির্মাণ করা হয়েছে ‘মুক্তিস্মরণী ভাস্কর্য’, শহীদদের স্মরণে চাষাড়া গোল চত্বরে নির্মিত হয়েছে বিজয়স্তম্ভ। নারায়ণগঞ্জ শহরের হাজীগঞ্জে ‘শ্রেষ্ঠ সন্তান’ ভাস্কর্য, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মুখে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক, তামাকপট্টিতে ‘স্বাধীনতা চত্বর’ ও ‘৭১ দেয়াল’ স্মৃতি ভাস্কর্য, ২নং রেলগেইটে ‘ফিরে দেখা ৭১’ ভাস্কর্য, খানপুরে ‘বিজয় উল্লাস’ ভাস্কর্য রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ফতুল্লা থানা এলাকায় স্মৃতিসৌধ এবং মাসদাইর কবরস্থান ও কানাইনগর সোবহানিয়া হাইস্কুল মাঠের পাশে স্থাপিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ। দেওভোগে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য এবং ফাজেলপুর তেলের ডিপো, পাগলা বাজার ও মুক্তারকান্দি কবরস্থানে স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। [রীতা ভৌমিক, হালিম আজাদ ও শরিফ রেজা মাহমুদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!