You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীনির্যাতন - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীনির্যাতন

নারীনির্যাতন শত বছরের বিভিন্ন যুদ্ধ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, যেখানেই জাতিগত বিদ্বেষ, ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতা যুদ্ধ ও ভায়োলেন্সের কারণ হিসেবে কাজ করেছে, সেখানেই নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ব্যাপকহারে সংঘটিত হয়েছে। প্রতিটি প্রতিশোধমূলক যুদ্ধ ও প্রতিহিংসাপূর্ণ আঘাতের সঙ্গে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশেষ করে জনযুদ্ধ ও স্বাধীনতার যুদ্ধগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। এসব যুদ্ধ ও সংঘাতে একজন নারী যুযুধান পুরুষের মতো শুধু যোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হন না, তিনি বিবেচিত হন কেবল মাত্র একজন নারী হিসেবে, পুরুষের ভোগের পণ্য হিসেবে, নানাবিধ দুর্বলতার আধার হিসেবে। এছাড়া, যুদ্ধ ও যুদ্ধক্ষেত্রগুলো যখন প্রচলিত নিয়ম ভেঙ্গে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং যখন তা কোনো সীমান্ত বা নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ থাকে না, তখনই নিরীহ জনগণ ও নারীরা এ-যুদ্ধের ফাঁদে আটকে যান। বাইরের আগ্রাসনের চেয়ে গৃহযুদ্ধগুলোতেই নারীরা বেশি আক্রান্ত হন। এতে নিরীহ, নিরপরাধ নারীরা শুধু ভয়ঙ্কর যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণেরই শিকারই হন না, যুদ্ধে স্বামী-সন্তান হারিয়ে স্বজনহারা ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন। স্বামী-সন্তান হারিয়ে একজন নারী যে মানসিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন, তা থেকে উঠে দাঁড়ানো তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। তার ওপর যখন আবার সংসারের চাকা ঘোরানোর দায়ভার এসে বর্তায়, তখন নারীর জীবন কতটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীর কাহিনি ও জবানবন্দিগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়।
শত্রুসেনারা শুধু নারীর স্বামী ও সন্তানকে হত্যাই করে না, কোনো-কোনো সময় তাদের ধরে নিয়ে গুম করে ফেলে। এরপর তারা জ্বালিয়ে দেয় গৃহ, ক্ষেত-খামার ও অন্যান্য সম্পদ। এ অবস্থায় নারী প্রথমে চেষ্টা করেন বেঁচে থাকা সন্তান ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বাঁচিয়ে রাখতে। অনন্যোপায় হয়ে তাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য কখনো ঘরদোর, হাঁস-মুরগি, ক্ষেত-খামার ও জীবনের সকল সঞ্চয় ফেলে চলে যান দূর-দূরান্তে, দেশান্তরে। ঘরবাড়ি ছেড়ে যাওয়া এসব নারীর জীবন হয়ে পড়ে নিরাপত্তাহীন, সংকটময় ও কণ্টকাকীর্ণ। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের নারীদের জীবনেও পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা উপর্যুক্ত ঘটনা ঘটে।
নারীনির্যাতনের ধরন: মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে নারীনির্যাতনের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে নির্যাতনের ধরন, প্রকৃতি, সংখ্যা, ব্যাপকতা, কাল প্রভৃতি সম্বন্ধে ধারনা পাওয়া যাবে। নারীদের ওপর নির্যাতন হয়েছে বিভিন্নভাবে, যার কয়েকটি হলো-
স্পট রেপ (Spot Rape): ২৫শে মার্চের গণহত্যার সঙ্গে- সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন শহর, সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি স্থানে এবং আওয়ামী লীগ এর নেতাকর্মী ও সমর্থক, স্বাধীনতার পক্ষের বুদ্ধিজীবী, সাধারণ জনগণ বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে ব্যাপক হানা দেয়। এতে সাধারণত পাকিস্তানি সৈন্যদের পেট্রল টিমগুলো কখনো রাজাকার ও বিহারিদের সহায়তায়, আবার কখনো নিজেরাই এককভাবে অংশগ্রহণ করে। তাদের এ ধরনের আক্রমণের মূলনীতি ছিল ‘Kill, burn and rape’। এর অংশ হিসেবে তারা ক্ষেত- খামার, গ্রাম-গঞ্জ ও বাড়িঘরে যেসব মহিলাকে অরক্ষিত পেয়েছে, তাদের আক্রমণ করেছে। কখনো অবাঙালি রাজাকার ও স্থানীয় দালালদের কুচক্রে পড়ে, সংসার, সম্পত্তি, চাকরি ইত্যাদি সংক্রান্ত নানা সমস্যায় নিরীহ নারীরা এই নারীলোভী দুর্বৃত্তদের আশ্রয়প্রার্থী হয়ে নিজগৃহে নির্যাতিত হয়েছেন। যাদের স্বামী-সন্তান ঘরে উপস্থিত ছিল না, তাদের অনেকেও এদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন। শহরের বিভিন্ন বাড়িতে কখনো গৃহকর্তাকে ধরতে গিয়ে, কখনো যুবক ছেলে বা নিকটজনের সন্ধানে উপস্থিত হয়ে নানা ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বাড়িতে উপস্থিত স্ত্রী-কন্যাদের পাকিস্তানি হানাদাররা নির্যাতন করেছে।
এ পর্যায়ে তারা কাউকে হত্যা এবং অনেককে ধরে নিয়ে যায়। কোনো-কোনো পরিবারের মা, মেয়ে ও বাড়িতে অবস্থানরত অন্যান্য নারীদের তাদের বাড়িতেই নির্যাতন করে। শুরুর দিকে যৌন নির্যাতনের চেয়ে হত্যা করার প্রবণতা ছিল বেশি। কয়েকদিনের মধ্যে শহর ও গ্রামের প্রতিরোধগুলো ভেঙ্গে হানাদাররা ছোট- ছোট শহর ও গ্রামগুলোতে অনুপ্রবেশ করে। এ-সময় তারা ব্যাপকভাবে ধ্বংস ও জ্বালাও-পোড়াও নীতি গ্রহণ করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে একজন নারীকে একাধিক সৈন্য গণধর্ষণ করেছে। এ ধরনের স্পট রেপ শুরু হয় এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের শেষদিক থেকে। এ ধর্ষণ প্রক্রিয়া মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। স্পট রেপের অধিকাংশ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে স্বামীর অবর্তমানে কিংবা স্বামীকে হত্যা করার পর।
জয়পুরহাটের বীরাঙ্গনা মনোয়ারা বেগম মলি স্পট রেপ-এর শিকার। গ্রাম বাংলার এক নিভৃত পল্লীর অধিবাসী মনোয়ারা বেগম মলি সত্তরের নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধ, নৌকার বিজয় প্রভৃতি ঘটনার কোনো কিছুই জানতেন না। তিনিও দগ্ধ হন যুদ্ধের উত্তাপে। তার মতো নারীরাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে হানাদার বাহিনীর ভয়ঙ্কর ধর্ষণের শিকার হন। যুদ্ধের ছয়-সাত মাস আগে বিয়ে হয়েছিল তার, থাকছিলেন স্বামীর বাড়িতেই।
তখন চৈত্র মাস, চৈত্রের খরা আর দাবদাহে হাঁসফাঁস মানুষের জীবন। এর মধ্যেই একদিন গ্রামে হানা দেয় পাকিস্তানি হায়েনারা। গ্রামের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ছুটে পালাতে থাকে সবাই এদিক-ওদিক। মনোয়ারা হানাদারদের ভয়ে ভাশুরের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। কিন্তু সেখানে গিয়েও তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্মম ধর্ষণ ও নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি।
মনোয়ারা বলেন, “ভাশুরের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েও আমি বাঁচতে পারলাম না। পাকিস্তানি সৈন্যরা সে বাড়িতে ঢুকে আমাকে ধরে ফেলল। তাদের কথায় রাজি না হলে আমার গালে প্রচণ্ড জোরে এক থাপ্পড় মারল, বুকের ওপর বন্দুকের নল ঠেকিয়ে গুলি করতে উদ্যত হল। তখন আমার করার আর কিছুই ছিল না। এরপর ঐ বাড়ির একটা ঘরে নিয়ে আমাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করল। তারা সংখ্যায় ছিল তিনজন। একজন ধর্ষণ করেছে আর অন্যরা পাশে দাঁড়িয়ে তা উপভোগ করেছে।
একাত্তরের শ্রাবণ মাসের একদিন। আপন মনে সংসারের কাজ করছিলেন টাঙ্গাইলের ভানু বেগম। হঠাৎ করে ৯ জন পাকিস্তানি সৈন্যের একটি দল তার বাড়িতে আক্রমণ করে। টেনে-হিঁচড়ে তাকে ঘরের ভেতর নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু ভানু বেগম তাদের লালসার কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাননি। তখন তার পাঁচ মাসের শিশুপুত্রকে পাকহানাদাররা জ্বলন্ত খড়ের গাদায় ছুঁড়ে ফেলতে উদ্যত হয়। এরপর আর কিছুই করার ছিল না ভানু বেগমের। ঘণ্টাখানেক টানা নির্যাতনের এক পর্যায়ে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তারা যাবার সময় ভানু বেগমের বাড়ির খড়ের গাদায় গান পাউডার ছিটিয়ে ভানু বেগম ও তার শিশুপুত্রকে ধাক্কা মেরে তাতে ফেলে দেয়। আগুনের সেই লেলিহান শিখায় ভানু বেগমের শরীরের পেছন অংশ ঝলসে যায় এবং চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার শিশুপুত্র রঞ্জুর কপালের এক পাশও আগুনে ঝলসে যায়।
একই দিন পাকিস্তানি সৈন্যদের আসতে দেখে ভয়ে দুটি শিশু ভানু বেগমের বাড়ির খড়ের গাদায় লুকিয়েছিল। ঐ শিশু দুটিও আগুনে পুড়ে যায়। এরপর ভানু বেগমের পাশের বাড়িতে ঢুকে ঐ পাকিস্তানি নরপিশাচরা একটি শিশুকে ফুটন্ত ভাতের হাঁড়িতে ছুড়ে ফেলে। এতে শিশুটির করুণ মৃত্যু ঘটে। এরূপ স্পট রেপ-এর ঘটনা বাংলার বিস্তীর্ণ জনপদে ঘটেছে হাজার-হাজার।
গণধর্ষণ (Gang Rape and Mass Rape): যেখানে হানাদার বাহিনী প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি আঁচ করেছে কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, সেসব স্থানের জনসাধারণ তাদের ভয়ঙ্কর রোষানলে পতিত হয়েছে। ঘটনার বাস্তবতা যাই হোক, সন্দেহের উদ্রেক হলেই তারা এক- একটা এলাকা ঘেরাও করেছে, শক্ত-সমর্থ পুরুষদের বন্দি করেছে এবং তাদের সম্মুখেই এক-একটা ভিটায় অথবা এক-একটা ঘরে অনেক নারীকে জড়ো করে গণধর্ষণ করেছে। পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দোসরদের ধর্ষণ ও নির্যাতনের একটি জঘন্য প্রক্রিয়া ছিল গণধর্ষণ। এ প্রক্রিয়ায় তারা কখনো কোনো এলাকায় একটি বাড়ি, রেল স্টেশন, ফাঁকা গুদামঘর, ট্রেন-বাসের মতো যানবাহন, এমনকি তাদের সামরিক কোর্ট, ক্যাম্প প্রভৃতি স্থানকে ব্যবহার করেছে। তারা কখনো উপস্থিত নারীদের একত্রিত করে, আবার কখনো কাউকে এককভাবে নানা চাপের মুখে নির্যাতন ও ধর্ষণ করেছে। এ ধরনের ধর্ষণযজ্ঞে প্রতিটি স্পটে ভিকটিমের সংখ্যা দিনপ্রতি কখনো দশের অধিক এবং কখনো তা কয়েকশতে পৌঁছেছে। এ প্রক্রিয়ায় ধর্ষণের পর পাকিস্তানি সৈন্যরা ধর্ষিত নারীদের মুক্ত করে দিয়েছে এবং নিজেরা স্পট ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেছে। আবার কখনো ধর্ষিতা নারীদের হত্যা করেছে।
লালমনিরহাট রেলওয়ে কলোনি, সৈয়দপুরের গোলাহাট, সিলেটের শমসেরনগর, আদিত্যপুর, শেখেরচক, বরিশালের রাজিহার, বগুড়ার মোকামবাজার, ঝিনাইদহ প্রভৃতি স্থানে পাকিস্তানি সৈন্যদের বীভৎস নারীনির্যাতন এই গণধর্ষণের এক-একটি উদাহরণ মাত্র।
স্পট ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও পথে-পথে ধর্ষণ (শরণার্থীদের ক্ষেত্রে)-এর শিকার হয়েছেন প্রায় ৩ লক্ষাধিক নারী, যা মোট নারীনির্যাতনের ৭০ ভাগ। এরা কেউ-কেউ এক বা একাধিকবার কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা নির্যাতিত হলেও দীর্ঘদিনব্যাপী এরা কেউ নির্যাতিত হননি বা পাকবাহিনীর নিকট কোনো নির্দিষ্ট স্থানে বন্দিও থাকেননি। কোনো-কোনো স্থানে পাকসেনারা একাধিকবার হামলা ও নির্যাতন চালিয়েছে। তারা বরিশালের রাজিহারের একটি খ্রিস্টান পরিবারে ৯ বার এবং সিলেট এলাকার চা বাগানগুলোতে বারবার হামলা চালায়। তাদের একাধিকবার হামলার স্পটের সংখ্যা দেশব্যাপী অসংখ্য। প্রতিটি অভিযানেই এদেশের অসহায় নারীরা আক্রান্ত হয়েছেন। কোনো-কোনো সময় এই হামলাকারীর সংখ্যা এক প্লাটুন থেকে এক কোম্পানি পর্যন্ত পৌঁছেছে। এ প্রক্রিয়ায় প্রতিটি স্পট ধর্ষণে সর্বনিম্ন একজন থেকে একশ এমনকি দুশ জন নারী পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতনের শিকার হন।
নাটোরের ছাতনী গ্রামে গণহত্যা চালানোর পর পাকবাহিনী এরকম একটি ভয়ঙ্কর গণধর্ষণ চালায়। কোনো এক রাতের শেষ প্রহরে হঠাৎ গুলির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় গ্রামবাসীর। গুলির শব্দে অনেকেই আশ্রয় নেন গ্রামের জসিম ডাক্তারের বাড়িতে। গ্রামের লোকজন সিদ্ধান্ত নিয়ে মেয়েদের একটি ঘরে ঢুকিয়ে শেকল তুলে দিয়ে পুরুষরা পালিয়ে যাচ্ছিল আশপাশের বন-বাদাড়ে। কিন্তু পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় হানাদার বাহিনীর হাতে। এভাবে ধরে নিয়ে পুরুষদের একে- একে জবাই করে হত্যা করে। গণহত্যা শেষ করে তারা সদ্যবিধবা ও সন্তানহারা অসহায় মহিলাদের ওপর চালায় ভয়ঙ্কর গণধর্ষণ।
ছাতনী গ্রামের বীরাঙ্গনা জোহরা বলেন, ‘পাকিস্তানি সৈন্যরা পুরুষদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল তা আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু কোথায় নিয়ে যাচ্ছিল তা বুঝতে পারছিলাম না। তবে শুনতে পেলাম তাদের সবাইকে জবাই করে হত্যা করেছে নরপশুরা। হত্যাযজ্ঞ শেষ করে গ্রামে ফিরে আসল তারা। হাজির হল আমাদের ঘরের সামনে। ঐ ঘরে তখন আমরা এক থেকে দেড়শ’ মহিলা। দশ বারোজন পাকিস্তানি সৈন্য ও বিহারি হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতরে। লুট করে নিতে লাগল মেয়েদের গায়ের স্বর্ণালঙ্কার। এরপর মেয়েদেরকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে দাঁড় করাল লাইনে। আমাদের বাচ্চারা তখন চিৎকার, কান্নাকাটি করছিল। পাকিস্তানি সৈন্যরা সেসময় আমাদেরকে কুপ্রস্তাব দিল। কিন্তু আমরা তাদের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তারা আমাদের বুকে বন্দুক তাক করে ধরল। ভয় দেখাল তাদের প্রস্তাবে রাজি না হলে বাচ্চাদের পা ধরে ছিঁড়ে ফেলবে। তখন বাধ্য হলাম আমরা তাদের কথামতো কাজ করতে। এরপর বাইরে দাঁড়ানো মেয়েদেরকে তারা এক এক করে ঘরের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছিল আবার বের করে নিয়ে আসছিল। তাদের মুখে তখন ছিল দাঁত বের করা ক্রূর হাসি, বিকৃত যৌন লালসা চরিতার্থ করবার পৈশাচিক উল্লাস। অনেক মেয়েকে বাড়ির বাইরেও নিয়ে যাচ্ছিল। আমার জা’কেও তারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আমি নিজেও পাকিস্তানি সৈন্যদের গণধর্ষণের শিকার হলাম।
পথে-পথে ধর্ষণ (Rape on Migratory Women): এপ্রিল ও মে মাসে যখন যুদ্ধের বাইরে ধ্বংস ও ধর্ষণের আঘাত সর্বোচ্চ, তখনই ব্যাপক হিন্দু সম্প্রদায় দেশ ছেড়ে সীমান্তের দিকে পাড়ি জমায়। এ-সময় প্রায় প্রতিটি পরিবারের নারী কোনো-না-কোনোভাবে পাকিস্তানি সৈন্যসহ রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের রোষাণলে পতিত হয়। পথিমধ্যে তারা শুধু তাদের নির্মম হত্যার শিকার, অগ্নিদগ্ধ হয়ে অঙ্গারই হয়নি, তাদের মধ্যে অনেকে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরদের দ্বারা ব্যাপকভাবে ধর্ষিত হয় সেনাঘাঁটিতে ধর্ষণ ও বন্দি নারীদের গণধর্ষণ (Rape in Custody and Gang Rape): যুদ্ধের পুরো ৯ মাস পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন বাড়িঘর, স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন যাত্রী ছাউনি, রেল স্টেশন, বাস স্টেশন, জাহাজ ঘাট, রেল, বাস প্রভৃতি যানবাহন থেকে নারীদের বন্দি ও অপহরণ করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। নিরীহ পথচারী এবং ভিটেমাটি ছেড়ে পলায়নরত নারীদের পরিবার ও দল থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। প্রত্যক্ষদর্শী দিনাজপুরের মুক্তিযোদ্ধা মোকসেদ আলী মামুন জানিয়েছেন, “দিনাজপুর সদরের আট নম্বর ইউনিয়নের ব্রিজের কাছে পাকিস্তানি সেনারা বাঙ্কার করেছিল। সেখানে পঁচিশে অক্টোবর ওদের সাথে আমাদের সরাসরি যুদ্ধ হয়। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনী টিকতে না পেরে পালিয়ে যায়। এরপর আমরা সেখানে গিয়ে বাঙ্কারের ওপরে কিছু রক্ত মাখা কাপড়-চোপড় পড়ে থাকতে দেখলাম। আমরা ভাবলাম ভেতরে হয়ত পাকিস্তানি সেনাদের লাশ আছে। কিন্তু ভেতরে তাকিয়ে দেখলাম দু’টি মেয়ে বাঙ্কারের ভেতরে একটি চৌকির ওপর উলঙ্গ অবস্থায় বসে আছে। তারা বাঙ্কার থেকে উঠে আসতে পারছিল না। এই অবস্থায় আমরা বাঙ্কারে না ঢুকে পাশের গ্রাম থেকে কিছু কাপড় চোপড়সহ কয়েকজন মহিলাকে নিয়ে আসি। তারপর একটি বাঁশের মইয়ের সাহায্যে গ্রামের মহিলাদেরকে বাঙ্কারের ভেতরে নামিয়ে দিয়ে কাপড় পরিয়ে ঐ দু’টি মেয়েকে উপরে উঠিয়ে আনি। মেয়ে দু’টির নাম ছিল আসমা খাতুন ও মরিয়ম বেগম। তাদের বাড়ি ছিল দিনাজপুরের চিরিরবন্দর থানায়। এদের একজন ছিল আইএ পাশ অন্যজন ছিল মেট্রিক পরীক্ষার্থী। মা বাবার সাথে ভারতে পালিয়ে যাবার সময় এরা ধরা পড়ে। যুদ্ধ শেষে তাদেরকে আমরা ঢাকার নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেই।’
এরকম অনেকগুলো ঘটনা ঘটে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া থানায়। সেখানকার একজন সংস্কৃতিমনা হিন্দু মেডিক্যাল অফিসার তার দুই ছেলেসহ নিহত হন পাকসেনা কর্মকর্তা নরপিশাচ মেজর ইফতেখারের হাতে। তাঁর তিন মেয়ের দুজন গ্রাজুয়েট ও একজন ম্যাট্রিকুলেট ছিলেন। তাদের ধরে নিয়ে যায় ইফতেখার। এরপর তাদের আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ইফতেখারের পাশবিক প্রবৃত্তির শিকার হয়েছেন অনেক স্বামীহারা, পিতৃহারা, মাতৃহারা হতভাগিনী। যৌনবিকারগ্রস্ত মেজর ইফতেখার এসব নারীদের ওপর ভয়ঙ্কর পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে তাদের হস্তান্তর করত মহকুমার বিভিন্ন নির্যাতনকেন্দ্রে, পশ্চিমা হানাদার আর কুখ্যাত রাজাকার, মুজাহিদ, আলবদর বাহিনীর কমান্ডার এবং স্বঘোষিত অফিসার ইনচার্জদের হাতে। এসব নির্যাতন ক্যাম্পে নারীরা কখনো একদিন, একাধিক দিন, কখনো বা মাসের পর মাস ধর্ষিতা হয়েছেন। নিজেদের বর্বরোচিত কর্মের নিদর্শন ধ্বংস ও অপরাধের ছাপ মুছে ফেলার জন্য যুদ্ধের শেষদিকে পরাজয়ের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী অনেক সন্তানসম্ভবা নারীসহ অধিকাংশকেই হত্যা করেছে।
যৌনদাসী (Comfort Girl and Sexual Slavery): মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পাকিস্তানি বাহিনী শহর ও গ্রামের যুবতী নারীদের কখনো বন্দি করে নিয়ে গেছে নিজেদের ক্যাম্প ও বাঙ্কারে। দিনের পর দিন সেখানে তাদের আটকে রেখে যৌন নির্যাতন করেছে। আবার তাদের ঘাঁটি ও ক্যাম্পের আশপাশের অনেককে বাধ্য করেছে দিনের পর দিন তাদের কাছে হাজিরা দিতে। কখনো স্বামীহারা মেয়েদের তারা নির্দেশ দিয়েছে নিজ ঘরে থাকবার জন্য, পাহারার ব্যবস্থা করেছে যাতে তারা অন্যত্র পালিয়ে যেতে না পারে। এরপর এসব মেয়েদের কাউকে-কাউকে তাদের গণসম্ভোগের জন্য ব্যবহার করেছে। এসব নারীদের সম্ভোগের জন্য ইচ্ছেমতো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে গেছে, ক্যাম্পে-ক্যাম্পে ঘুরিয়েছে।
মে মাসে হবিগঞ্জের লস্করপুর চা বাগান থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন সুপ্রিয়া নায়েককে ধরে নিয়ে যায়, তখন তার বয়স ১৬ পেরোয়নি। প্রথম দিন চা বাগানের এক ক্যাম্পে নিয়ে কয়েকজন পাকিস্তানি আর্মি তার ওপর বীভৎস যৌন নির্যাতন চালায়। সেই শুরু। তারপর পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে নিয়ে যায় এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে, এক বাগান থেকে অন্য বাগানে। দিনের পর দিন ঐসব ক্যাম্পের সেনা অফিসাররা তার ওপর নির্দয় নির্যাতন চালিয়েছে। দীর্ঘ আট মাসের প্রতি রাতে ৪ জন ৫ জন করে তাকে ধর্ষণ করেছে। একটি রাতের জন্যও নিষ্কৃতি দেয়নি তাকে। এর মধ্যে একবার ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এলেও পাক হানাদাররা আবার তাকে ধরে নিয়ে যায়।
ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে এবং বিজয়ের পর অসংখ্য যুবতীকে পাওয়া যায় পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে ও বাঙ্কারে। এসব নারীদের ঘৃণ্য পাকিস্তানি সৈন্যরা কমফোর্ট গার্ল হিসেবে ব্যবহার করেছে। সিলেটের সাবেক মহিলা এমপি সৈয়দা জেবুন্নেসা হক এরকম একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। সিলেট এয়ারপোর্টের বড়বড় বাঙ্কার ছিল পাকসেনাদের হত্যা ও নির্যাতনের অন্যতম কেন্দ্র। আশপাশের এলাকা থেকে মেয়েদের ধরে এনে এই বাঙ্কারগুলোতে আটকে রাখা হতো। দিনের পর দিন তাদের ওপর চালানো হতো পাশবিক অত্যাচার। জেবুন্নেসা হক যুদ্ধ শেষে সিলেট বিমান বন্দরে গিয়ে বাঙ্কার থেকে দুটি মেয়েকে জীবিত উদ্ধার করেন। দুজনই ভয়ঙ্কর যৌন নির্যাতনে বিধ্বস্ত ছিল। তাদের একজন আবার গর্ভবতী হয়ে পড়ে। মেয়ে দুটি তাকে জানায়, পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসেছে।
দেশের মোট নির্যাতিত নারীদের শতকরা ৩০ ভাগকে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের ক্যাম্প, বাঙ্কার, মিলিটারি হেডকোয়ার্টার্স এবং জেলখানা, স্কুল কলেজ, পরিত্যক্ত অফিস, কারখানা, গোডাউন প্রভৃতি স্থানে বন্দি রেখে দিনের পর দিন গণধর্ষণ করেছে। এছাড়া ধর্ষিতাদের মধ্যে অনেকেই নিজ গৃহ, অফিস-আদালত, হোটেল, বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্র প্রভৃতি স্থানে নানাবিধ চাপের মুখে আক্ষরিক অর্থে বন্দি না হয়েও যুদ্ধের পুরো ৯ মাস পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন। তাদের সংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ। পাকবাহিনী তাদের একদিন থেকে শুরু করে মাসের পর মাস, এমনকি যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত বন্দি করে রেখে গণধর্ষণ ও বারবার ধর্ষণ করেছে। তাদের মধ্যে ৪০ ভাগকে যুদ্ধের কোনো-না-কোনো সময় হত্যা করা হয়েছে অথবা নির্যাতিতারা নিজেরাই আত্মহত্যা করেছেন।
নির্যাতিত ও বন্দিপ্রায় নারীদের ৩টি ভাগে ভাগ করা যায়- ১. পাকিস্তানি সেনাদের বিভিন্ন ক্যাম্প, বাঙ্কার, মিলিটারি হেডকোয়ার্টার্স এবং অন্যত্র অনির্দিষ্ট কাল বন্দি এবং দিনের পর দিন গণধর্ষণের শিকার নারী; ২. পাকসেনাদের ক্যান্টনমেন্ট, বিভিন্ন বাড়িতে স্থাপিত মিনি পতিতালয় এবং ঐ এলাকার বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও অন্যান্য স্থানে আটককৃত নির্যাতিত নারী এবং ৩. গৃহস্থ বাড়ি, অফিস-আদালত, হোটেল প্রভৃতি স্থানে নানাবিধ চাপের মুখে ও ব্ল্যাক মেইলিং- এর শিকার হয়ে ধর্ষিত নারী, যারা নিয়মিত বন্দি না হয়েও যুদ্ধের পুরো ৯ মাস নির্যাতিত হয়েছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত নারীদের শতকরা ৮০ ভাগ উপর্যুপরি ধর্ষণের কারণে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন।
পরিবার ও সমাজ পরিত্যক্ত এসব ধর্ষিতা নারীদের অনেকে পতিতালয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। লোকলজ্জার ভয়ে অনেকে ধর্ষক পাকিস্তানি সৈন্যদের হাত ধরে পাকিস্তানে চলে গেছেন বা চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। এরকম নির্যাতিত নারীর সংখ্যা সাড়ে সাতশর অধিক। এসব হতভাগ্য নারীদের অধিকাংশই ছিলেন স্কুল-কলেজের ছাত্রী এবং কিছু সংখ্যক ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গের কন্যা ও স্ত্রী। এরা পাকিস্তানিদের ভোগের জন্য রক্ষিতা হিসেবে বিভিন্ন বাড়িতে ও পতিতালয়ে বন্দি হিসেবে থেকেছেন এবং অকল্পনীয় যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের কেউ- কেউ দেশে ফেরার জন্য চেষ্টাও করেছেন। এমনিভাবে পাকিস্তানে যাওয়া নারীদের মধ্যে ঝিনাইদহের হাসিনা নামের একটি মেয়ে, বগুড়ার এক পীরের মেয়ে, লালমনিরহাটের হাসান আলীর মেয়ে, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের মর্জিনা, রোকেয়াসহ আরো অনেকের তথ্য —ওয়ার ক্রাইমস্ ফ্যাক্টস্ ফাইন্ডিং কমিটি’ এবং ‘জেনোসাইড আর্কাইভ এন্ড হিউম্যান স্টাডিজ সেন্টার’-এ লিপিবদ্ধ রয়েছে। স্পট ধর্ষিতা, গণধর্ষিতা ও বন্দি ধর্ষিতাদের সংখ্যা চার লাখ আষট্টি হাজার।
নির্যাতিত অন্তঃসত্ত্বা নারী : ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে ধর্ষিতা নারীদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যখন কমপক্ষে ১৪ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা, তখন অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক ড. জিওফ্রে ডেভিস তাদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা এসে পৌঁছান। বাংলাদেশে অবস্থানকালে ড. ডেভিস ঢাকাতে মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য বিভাগের প্রায় এক হাজার ডাক্তারের উদ্দেশে গর্ভপাতের টেকনিক সম্পর্কে বক্তৃতা দেন। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের গর্ভপাতের উদ্দেশ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় অনেকগুলো ক্লিনিক স্থাপন করা হয়। ড. ডেভিস বলেন, অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের জন্য গৃহীত কর্মসূচি শুরু হবার আগেই দেড় লাখ থেকে এক লাখ সত্তর হাজার মহিলা গর্ভপাত করেছেন। এদের অধিকাংশ গর্ভপাত ঘটিয়েছেন স্থানীয় ধাত্রী বা হাতুড়ে ডাক্তারের সাহায্যে। এভাবে গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। কেউ-কেউ আত্মহত্যা করেছেন, কেউ-কেউ গর্ভপাত না ঘটিয়ে তাদের শিশুদের নিজেদের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে বসবাসকারী শহীদ আকবর হোসেনের পুত্র রাউফুল হোসেন সুজা সে-সময় পিতার লাশ খোঁজার জন্য বড় দু-ভাইয়ের সঙ্গে ফয়’স লেক বধ্যভূমিতে যান। সেখানে তারা প্রায় দশ হাজার বাঙালি নরনারীর লাশ দেখতে পান, যাঁদের অধিকাংশকেই জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল। বাবার লাশ খুঁজতে গিয়ে তারা সেখানে চুরাশিজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলার লাশও দেখতে পান, যাদের সবার পেট ফেঁড়ে দেয়া ছিল। এরকম ঘটনা বাংলাদেশে সর্বত্রই ঘটেছে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েকটি গর্ভপাত কেন্দ্র ও হাসপাতালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, অন্তঃসত্ত্বা নারীদের মধ্যে শতকরা দশভাগও আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি- বেসরকারি গর্ভপাত কেন্দ্রে আসেননি। স্থানীয়ভাবে যে যার মতো গর্ভপাত ঘটিয়েছেন এবং ঘটনাগুলো যাতে প্রকাশ না পায় অনেকে তার সবরকম ব্যবস্থা নিয়েছেন।
গর্ভপাত ও স্বাভাবিক প্রসব করানো কাজে দেশী-বিদেশী বেশ কয়েকটি এনজিও সহায়তা করেছে। এর মধ্যে যুদ্ধশিশুদের প্রতিপালন (গর্ভপাত নয়) ও পরিচর্যার জন্য মাদার তেরেসা ঢাকার ইসলামপুরের আমপট্টিতে ‘বেবি হোম’ পরিচালনা করেন। সুইডেনের ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড্ প্যারেন্টহুড ঢাকার নিউ ইস্কাটনে একটি গর্ভপাত কেন্দ্ৰ চালু করে। এ কেন্দ্রে যে-সমস্ত জীবিত শিশু জন্মায় তাদের ‘বেবি হোমে’ রাখা হয়। ধানমন্ডিসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এরকম আরো অনেকগুলো গর্ভপাত কেন্দ্র খোলা হয়। এসব কেন্দ্রের জীবিত শিশুদের অনেককে ধানমন্ডি ও ইন্দিরা রোডের দুটি শিশু-দত্তক সংস্থার নিকট রাখা হয়। পরবর্তীতে ঢাকার sos শিশু পল্লী সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসে।
এক হিসাবে একাত্তরের যুদ্ধশিশুর সংখ্যা ছিল সর্বনিম্ন তিন হাজার। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এসব যুদ্ধশিশুর অনেকেই বাংলাদেশের ভেতরে ছিল। তাদের একটা বড় অংশ কেয়ার, কারিতাস, CORR, ISS Agency New York এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলোর সহায়তায় ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে দত্তক হিসেবে চলে যায় এবং বাকিরা গোপনীয়তার অন্ধকারে দেশের মধ্যেই বেড়ে ওঠে। দেশের ভেতরে ও বাইরে এরকম বেশকিছু যুদ্ধশিশুর সন্ধান পাওয়া গেছে। কিছু যুদ্ধশিশুকে ঐ সময় বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে পাচারও করা হয়েছে।
কারাগারে নারীনির্যাতন : একাত্তরে বাংলাদেশে পাকবাহিনীর কারাগার ও বন্দি ক্যাম্পগুলোতে নিক্ষিপ্ত নারীর সংখ্যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে সর্বোচ্চ। নারীযোদ্ধা যখন বন্দি হয় পুরুষ সৈনিকদের হাতে, তখন প্রথমেই সে নির্যাতিত হয় শারীরিকভাবে। একাত্তরের এরকম এক নির্যাতিত নারী গৌরনদীর নূরজাহান ও তার সঙ্গীরা, মাগুরার হেলেন, সুনামগঞ্জের কাকন বিবি এবং অন্যান্য বহু নারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বন্দি নারীদের ওপর নানা ধরনের বীভৎস নির্যাতনের অনেক কাহিনি জানা গেছে বিভিন্ন বন্দিশিবিরে নারীনির্যাতন বিষয়ক রিপোর্টগুলো থেকে। একাত্তরে বরগুনা জেলখানায় হানাদার বাহিনীর নির্যাতনে পিষ্ট সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী মালতি রাণী রায়। সে জানায়, বর্বর পাকবাহিনী কারাগারের অভ্যন্তরে আটক সকল মহিলাকে পালাক্রমে বীভৎসভাবে ধর্ষণ করেছে। প্রতিরাতে আটক মহিলাদের মধ্য থেকে বেছে-বেছে কয়েকজনকে বের করে তাদের প্রমোদ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত পার্শ্ববর্তী ডাকবাংলোতে নিয়ে যেত। সারারাত ধর্ষণ শেষে পরদিন সকালে তাদের জেলখানায় ফিরিয়ে আনত। মালতি রাণী যেদিন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে, ঐদিনই মধ্যরাতে তারা তাকেসহ ৪ জন মহিলাকে পার্শ্ববর্তী ডাকবাংলোতে নিয়ে যায়। সেখানে ৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য তাদের ৪ জনের ওপর রাতভর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এই ৪ জনের একজন ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। নির্যাতনের তিন- চারদিন পরে তার গর্ভপাত হয়ে যায়।
৭১-এ মোট কত সংখ্যক নারী পাকিস্তানি হানাদারদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তা সঠিকভাবে নিরূপণ করা কখনোই সম্ভব নয়। তবে বিভিন্ন হিসাব মতে, এ সংখ্যা সাড়ে ৫ লক্ষের মতো হবে।
পাক হানাদাররা কখনো নারীর ওপর নির্যাতন করেছে নিজেদের বিকারগ্রস্ত বাসনা চরিতার্থ করার জন্য, কখনো তা করেছে বাঙালি জাতিকে হেয় প্রতিপন্ন করে জাতিগত সম্মান, মনোবল ও তাদের বিজয়ের স্বপ্নকে পদদলিত করার জন্য। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, সকল সম্প্রদায়ের নারীরাই তাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তবে তাদের মধ্যে মুসলমান নারীদের সংখ্যাই বেশি। জনসংখ্যা বিচারে সেটি হওয়াই স্বাভাবিক। অন্যভাবে, হিন্দু জনসংখ্যা ও নির্যাতিতা হিন্দু নারীদের সংখ্যা বিবেচনা করলে হিন্দু নারীদের পাল্লা ভারী হবে। আওয়ামী লীগ পরিবার ও স্বাধীনতার পক্ষের অন্যান্য দল ও ব্যক্তি, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ছিল হানাদারদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য। হিন্দু সম্প্রদায়ের পুরুষদের হত্যার পাশাপাশি নারীদের নির্যাতন করেছে, তাদের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করেছে, উদ্দেশ্য জাতিগত শুদ্ধি অভিযান (Ethnic Cleansing)। কখনো হিন্দু নারীর গর্ভে ‘ইসলামের বীজ’ প্রবেশ করিয়েও তারা এই শুদ্ধি অভিযান সাধনের চেষ্টা চালিয়েছে।
সুসান ব্রাউমিলার তাঁর Against Our Will : Men, Women and Rape (USA, Simon & Schuster 1975) গ্রন্থে ৭১-এ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা সংঘটিত যৌন নির্যাতনকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে চীনের নানজিং ও কোরিয়ায় জাপানি সৈন্যদের গণধর্ষণ এবং রাশিয়ার নারীদের ওপর নাৎসিদের ভয়ঙ্কর নির্যাতনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় তুসী নারীদের ওপর হুতুদের যৌন নির্যাতনের সঙ্গে ৭১-এ বাংলাদেশের নারীনির্যাতনের ঘটনা তুলনীয়। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে নারীদের ওপর যৌন নির্যাতনের ব্যাপকতা একক যুদ্ধ ও সময়ের হিসেবে পৃথিবীতে সংঘটিত সকল যৌন নির্যাতনের শীর্ষে। এসব নির্যাতিত নারীদের অধিকাংশ ছিলেন যুদ্ধ ও রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কবিহীন। [এম এ হাসান]
তথ্যসূত্র: ওয়ার ক্রাইমস্ ফ্যাক্টস্ ফাইন্ডিং কমিটি ও জেনোসাইড আর্কাইভ এন্ড হিউম্যান স্টাডিজ সেন্টার-এর গবেষণা তথ্য; ডা. এম এ হাসান, যুদ্ধ ও নারী, ঢাকা ২০০২; ডা. এম এ হাসান, যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ, ঢাকা ২০০১

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড