You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে নানিয়ারচর উপজেলা (রাঙ্গামাটি)

নানিয়ারচর উপজেলা (রাঙ্গামাটি) চেঙ্গী নদীর তীরে অবস্থিত। এখানে রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য পাহাড় ও ঝরনা। এর আয়তন ৩৯৩.৬৮ বর্গকিলোমিটার। মুক্তিযুদ্ধের সময় চাকমা, মার্মা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীসহ এর লোকসংখ্যা ছিল তিন থেকে চার হাজারের মতো। এ উপজেলা আনারসের জন্য বিখ্যাত এবং এখানে প্রচুর আনারসের চাষ হয়। নানিয়ারচরের বুড়িঘাট ছিল উপজেলার ব্যস্ততম একটি বাজার। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এখানে পণ্য বেচা- কেনার জন্য আসত। ১৯৭৯ সালে নানিয়ারচর ইউনিয়নকে রাঙ্গামাটি জেলার একটি থানা ঘোষণা এবং ১৯৮৩ সালে এটিকে উপজেলায় রূপান্তরিত করা হয়। নানিয়ারচর উপজেলার উত্তরে খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি, দক্ষিণে রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা, পূর্বে লংগদু ও বরকল উপজেলা এবং পশ্চিমে খাগড়াছড়ি জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা।
সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিলে সারাদেশে দ্রুত তার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্গমতার কারণে যে-কোনো খবর এ উপজেলায় পৌঁছতে বেশ সময় লাগত। এখানে বসবাসরত বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন অশিক্ষিত এবং খুবই সহজ-সরল।
এখানে তখন আওয়ামী লীগ-এর লোকজন ছিল না বললেই চলে। তাই এখানে তেমন আন্দোলন-সংগ্রামও হয়নি। তবে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় মুরুব্বিদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হতো। প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ছাত্র- যুবকরা এ উপজেলা দিয়ে যাতায়াত করত। প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও এ উপজেলা দিয়েই খাগড়াছড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তাঁরা চেঙ্গী নদী দিয়ে মহালছড়িতে যাতায়াত করতেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর শতশত শরণার্থী এ উপজেলা দিয়ে নৌপথে ভারতে যেত।
এ উপজেলায় যেহেতু কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না, সেহেতু এখানে স্থানীয় ছাত্র- যুবকদের নিয়ে কোনো কমিটিও গঠন করা হয়নি এবং প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়নি।
বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিলে রাঙ্গামাটির মহকুমা প্রশাসক এম আবদুল আলী সীমান্তে নিয়োজিত অবাঙালি ইপিআর-দের আস্তে-আস্তে ক্লোজ করতে থাকেন এবং তাদের নিরস্ত্র করেন। যেহেতু এখানে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতা ছিল না, সেহেতু এখানে কোনো প্রতিরোধ কমিটিও গঠন করা কিংবা স্থানীয় লোকজনদের সংগঠিত করে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়নি। এপ্রিল মাসে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের নানিয়ারচর হয়ে মহালছড়ি যাওয়ার পথে বেতছড়িতে চেয়ারম্যান তিলক চন্দ্র চাকমার বাড়িতে যান। তখন তাঁর সঙ্গে ১৫-২০ জন সৈন্য ছিল। তিনি চেয়ারম্যানের সঙ্গে যুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ- আলোচনা করেন। এ-সময় তাদের ঐ বাড়িতে আপ্যায়ন করানো হয়। এ কাজে সহায়তা করেন স্থানীয় কয়েকজন যুবক এবং চেয়ারম্যানের চার ছেলে প্রশান্ত চাকমা, সলিল কুমার চাকমা, সমীকরণ চাকমা ও নিখিল কুমার চাকমা।
২০শে এপ্রিল পাকসেনারা এ উপজেলায় প্রবেশ করে। তবে এখানে তারা কোনো ক্যাম্প স্থাপন করেনি। তারা খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং সেখান থেকে মাঝে- মাঝে বোটে করে নানিয়ারচর বাজারে এসে ঘুরে যেত।
বসুন্ধরা দেওয়ান (স্বামী চুনীলাল দেওয়ান) ছিল নানিয়ারচরের হেডম্যান। রাজা ত্রিদিব রায়ের নির্দেশে যখন জেলার সর্বত্র পাহাড়িরা রাজাকার ও শান্তি কমিটি গঠন করছিল, তখন বসুন্ধরা দেওয়ান শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর প্রধান হিসেবে কাজ করে। নানিয়ারচরের অন্যান্য হেডম্যান ও কারবারীরা শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিল। উপজেলার বিভিন্ন স্থানের চাকমা রাজাকাররা এসে সদরের হিন্দুদের গরু-ছাগল নিয়ে যেত। ২০শে এপ্রিল বুড়িঘাট যুদ্ধ-এর পর নানিয়ারচর অনেকটা বাঙালি শূন্য হয়ে পড়ে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই ছিল বাঙালি। তারা চলে যাওয়ার পর রাজাকাররা এসে দোকানের মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।
২২শে এপ্রিল তিনশতাধিক পাকিস্তানি সেনা নানিয়ারচরে আসে। তারা বসুন্ধরা দেওয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা রাজাকারদের সহায়তায় নানিয়ারচর বাজারে গিয়ে কয়েকজনকে ধরে ফেলে। তাদের মধ্যে কামাক্ষ্যা দত্ত নামে একজনকে হাত-পা বেঁধে গাছের সঙ্গে ঝুলায়। সাম্পানের এক মাঝি মো. জয়নালকে ধরে পানিতে চুবায়। এ খবর পেয়ে বসুন্ধরা দেওয়ান ছুটে এসে পাকসেনাদের বুঝিয়ে এদের রক্ষা করে। আরেকদিন মো. সৈয়দ ও মো. গুরা মিয়া নামে দুজনকে ধরে এনে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখে। তাদেরও বসুন্ধরা দেওয়ান পাকিস্তানিদের নির্যাতন থেকে রক্ষা করে। মে মাসের শেষদিকে মহালছড়ির মাইসছড়ি থেকে মো. জাকির খান নামে এক বিহারি নানিয়ারচরে আসে। সে ছিল জুয়াড়ি এবং তার কাঁধে সব সময় বন্দুক থাকত। ঐদিন রাতে সে বাজারের কয়েকটি হিন্দু ঘরে ঢুকে যুবতি মেয়েদের বের করে দেয়ার জন্য পরিবারের লোকজনদের হুমকি দিতে থাকে। বিষয়টি বসুন্ধরা দেওয়ানকে জানালে সে এসে জাকির খানকে এলাকা থেকে চলে যেতে বাধ্য করে। নানিয়ারচর উপজেলায় পাকসেনা ও অন্যত্র থেকে অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দুটি যুদ্ধ হয় বুড়িঘাট যুদ্ধ ও হাজাছড়ি যুদ্ধ। বুড়িঘাট যুদ্ধ হয় ২০শে এপ্রিল। এতে মুন্সী আব্দুর রউফ, বীরশ্রেষ্ঠ সহ ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অন্যদিকে পাকবাহিনীর ৩টি নৌযান ডুবে যায় এবং তাদের বেশকিছু সৈন্য নিহত হয়। হাজাছড়ি যুদ্ধ হয় ১৫ই ডিসেম্বর। এতে ১১ জন সাধারণ মানুষ প্রাণ হারায়। তবে পাকসেনারা পশ্চাদপসরণ করলে এদিনই নানিয়ারচর উপজেলা সম্পূর্ণ হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার বুড়িঘাটে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধি রয়েছে। সমাধির পাশে একটি আর্কাইভ করা হয়েছে, যেখানে বুড়িঘাট যুদ্ধ ও মুন্সী আব্দুর রউফ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। এছাড়া উপজেলার ইসলামপুর এলাকায় বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বুড়িঘাট ইউনিয়নে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। [ইয়াছিন রানা সোহেল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!