You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে নান্দাইল উপজেলা (ময়মনসিংহ)

নান্দাইল উপজেলা (ময়মনসিংহ) ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন-এর মধ্য দিয়ে নান্দাইলবাসী রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে ওঠে। এ আন্দোলনে নান্দাইলের ছাত্রনেতা ও পূর্ব ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম -ছাত্রলীগ-এর সাধারণ সম্পাদক (১৯৪৯-১৯৫৩) খালেক নওয়াজ খান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মুখ্যমন্ত্রী (১৯৪৮-১৯৫৪) নূরুল আমিনের বাড়িও ছিলো নান্দাইলে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে সচেতন নান্দাইলবাসী তাকে প্রত্যাখান করে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ঘোষিত বাঙালির মুক্তি সনদ ৬-দফা এবং ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতনের পর নতুন সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ- বিপুল বিজয় অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের নেতা বঙ্গবন্ধুর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্র শুরু করলে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন। নান্দাইলবাসী এ আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকেই নান্দাইলে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় চণ্ডীপাশা হাইস্কুল মাঠ ও মুশুল্লীতে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ চলে। সেখানে ছাত্র-যুবকরা বাঁশের লাঠি ও ডামি রাইফেল দিয়ে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।
নান্দাইলে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে শাহনেওয়াজ ভূঁইয়া (সভাপতি, নান্দাইল থানা আওয়ামী লীগ), ফজলুল হক ভূঁইয়া (সাধারণ সম্পাদক, ঐ), মজিবর রহমান ফকির, আব্দুর রহিম ভূঁইয়া, সাধু ভূঁইয়া, সিরাজুল ইসলাম বাচ্চু, শশীকান্ত রায়, রইস উদ্দিন ভূঁইয়া প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। নান্দাইলে যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন দুজন। তাঁরা হলেন- গাজী আব্দুস সালাম ভূঁইয়া, বীর প্রতীক (পিতা শহীদ শাহনেওয়াজ ভূঁইয়া, চারআনীপাড়া) ও মুকতুল হোসেন (পিতা কেনু মোড়ল, নান্দাইল)।
ময়মনসিংহ-ভৈরব রেলপথে নান্দাইল থানার মুশুল্লী রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিণে শুভখিলা রেলওয়ে ব্রিজ। নান্দাইলে পাকবাহিনীর অগ্রাভিযানকে প্রতিরোধ করার জন্য এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মেজর খালেদ মোশারফ ও এ টি এম হায়দারের নেতৃত্বে বাঙালি সেনাবাহিনীর একটি ট্রুপস ডিনামাইট দিয়ে এ ব্রিজটি উড়িয়ে দেন। পাকবাহিনী তাদের কনভয় নিয়ে যাতে নান্দাইলে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য মুক্তিকামী জনতা ১৮ই এপ্রিল নান্দাইল-কিশোরগঞ্জ রাস্তায় নান্দাইল বাজারের প্রবেশমুখে নরসুন্দা নদীর পশ্চিম পাশে রাস্তা কেটে দেয়। কাটাস্থানে কাঠের তক্তা বসিয়ে তার ওপর সাদা কাপড়ে মাটির প্রলেপ দিয়ে ফাঁদ তৈরি করে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধের ব্যবস্থা করে। এ সংবাদ স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে পাকবাহিনী জেনে যায়। এ ঘটনার জন্য শাহনেওয়াজ ভূঁইয়া, মজিবর রহমান ফকির, আব্দুর রহিম ভূঁইয়া, সিরাজুল ইসলাম বাচ্চু, শশীকান্ত রায়, রইস উদ্দিন ভূঁইয়া, আব্দুস সালাম ভূঁইয়া এই সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা ও ওয়ারেন্ট জারি হয় এবং তাঁদেরকে সাতদিনের মধ্যে কিশোরগঞ্জ সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
১৯৭১ সালের ২১শে এপ্রিল পাকবাহিনী নান্দাইলে অনুপ্রবেশ করে এবং নান্দাইল থানা ও বারুইগ্রাম মাদ্রাসায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকেই নান্দাইলে মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানপন্থী অন্যান্য দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে পাকবাহিনীর সহযোগী শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এ দুই বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে নান্দাইলের কাজী তসাদ্দক আলী (শান্তি কমিটির সভাপতি), এ এফ এম ইসহাক (শান্তি কমিটির সহ-সভাপতি), আব্দুল গণি ভূঁইয়া, (শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক), আব্দুল গফুর (ভাটিমাজার পাঁচআনী, রাজাকার কমান্ডার), কাকচরের আব্দুল মতিন ভূঁইয়া, জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া, খোরশেদ খান (চণ্ডীপাশা), নুরুল ইসলাম (বারুইগ্রাম, আলবদর প্রধান) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
১৯৭১ সালের ২১শে এপ্রিল পাকবাহিনী নান্দাইলের রনাজগাতী, শুভখিলা ও কালিগঞ্জ গ্রামের ১৮ জন নিরপরাধ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে এবং সেদিন কয়েকশত ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এপ্রিল মাসের শেষ দিকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মুশুল্লী ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা সাধু ভূঁইয়াকে বাড়ি থেকে নান্দাইল হানাদার ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্যাতন শেষে গুলি করে হত্যা করে। নান্দাইল থানা সদর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার পূর্বে বারুইগ্রাম মাদ্রাসায় স্থাপিত হানাদার ক্যাম্পের পাশেই ছিল ডাংরীবন্দ ইটখোলা। পাকবাহিনী সেখানে ২৫-৩০ জন মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
১৪ই নভেম্বর রাজাকার আব্দুল মতিন ভূঁইয়ার নির্দেশে স্থানীয় রাজাকাররা চারআনীপাড়া গ্রামের মায়া রাণী চৌধুরীকে তাঁর বাড়ি থেকে জোরপূর্বক ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্যাতন শেষে ভারতে যেতে বাধ্য করে। ১৭ই নভেম্বর নান্দাইল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শাহনেওয়াজ ভূঁইয়াকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
নান্দাইল উপজেলায় দুটি বধ্যভূমি ও একটি গণকবর রয়েছে— ডাংরীবন্দ ইটখোলা বধ্যভূমি, শুভখিলা রেলব্রিজ বধ্যভূমি এবং বারুইগ্রাম গণকবর।
১৭ই নভেম্বর মফিজ মাস্টার, আলেক মিয়া, মাহবুব ও সিরাজের নেতৃত্বে চারটি গ্রুপে প্রায় দুশ মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে নান্দাইল থানা অপারেশন- পরিচালিত হয়। এ-সময় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ৪ ঘণ্টাব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে ২৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ২৮শে নভেম্বর তোফাজ্জল হোসেন চুন্নুর কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ নান্দাইলে মিলিশিয়া ও রাজাকারদের পেট্রোল দলের ওপর অতর্কিতে হামলা করে। এতে কয়েকজন মিলিশিয়া ও রাজাকার আহত হয়। ১১ই ডিসেম্বর নান্দাইল উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আনিসুল হক আকন্দ, বীর প্রতীক (পিতা আবদুল আজিজ আকন্দ, লংপুর), আব্দুল জব্বার, বীর প্রতীক (পিতা ইসহাক আলী, কপালহর, কালেংগা বাজার) ও গাজী আব্দুস সালাম ভূঁইয়া, বীর প্রতীক (পিতা শহীদ শাহনেওয়াজ ভূঁইয়া, নান্দাইল)। নান্দাইলের বাসিন্দা এমন তিনজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন- শামছুল হক (পিতা আব্দুর রহিম, রসুলপুর), ইলিয়াছ উদ্দিন ভূঞা (পিতা হাজী মোহাম্মদ হোসেন, মেরাকোনা) ও জিল্লুর বাকী (পিতা রোস্তম আলী, মোরাগালা)।
নান্দাইল উপজেলা পরিষদ ভবনের সম্মুখে ‘বঙ্গবন্ধু চত্বর’ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ সড়কের নান্দাইল উপজেলার প্রবেশদ্বারে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে প্রায় সাতফুট উঁচু ত্রিকোণাকার নান্দাইল মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। এর পাশে রয়েছে শহীদ মিনার। এছাড়া নান্দাইলে শহীদদের স্মরণে শহীদ স্মৃতি আদর্শ কলেজ এবং ১৯৯০ সালে শহীদ শাহনেওয়াজ ভূঁইয়া স্মৃতি পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। [খায়রুল আলম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!