বীর প্রতীক নানু মিয়া
নানু মিয়া, বীর প্রতীক (১৯৪২-১৯৮৭) যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪২ সালে সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার দাড়িপত্তন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল হক এবং মাতার নাম জয়গুন বিবি। ৫ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ।
নান্নু মিয়া ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এ চাকরি নেন। ১৯৭১ সালে তিনি যশোর ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করলে তিনি এ নিষ্ঠুরতা প্রত্যক্ষ করেন এবং বাঙালি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে বিদ্রোহ করে প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁদের এ দলটি বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের পর অস্ত্র ও গোলা-বারুদের সংকটে ক্রমান্বয়ে পশ্চাদপসরণ করে ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান নেয়। সেখান থেকে এম্বুশ, রেইড এবং গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে হানাদার বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে।
পরবর্তীতে নান্নু মিয়া ৮ নম্বর সেক্টরের অধীন বয়রা সাব-সেক্টর এলাকায় যুদ্ধ করেন। তিনি গোয়ালহাটি, বর্নি, গঙ্গাধরপুর, কাশিপুর, বেলতাসহ আরো কয়েকটি যুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দেন।
আগস্ট মাসে যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার সুতিপুরে একদল মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেন। পাকিস্তানি সৈন্যদের সম্ভাব্য আগমন ও গতিবিধি লক্ষ করার জন্য কয়েকজনের একটি দলকে গোয়ালহাটি গ্রামে স্ট্যান্ডিং পেট্রল পার্টি হিসেবে নিয়োজিত করা হয়। নূর মোহাম্মদ শেখ, বীরশ্রেষ্ঠ-এর নেতৃত্বে ৭-৮ জনের এ দলের একজন সদস্য ছিলেন নান্নু মিয়া। কয়েকদিন ধরে সেখানে তাঁরা দায়িত্ব পালন করেন। স্থানীয় বাঙালি দালালদের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনী এ খবর জানতে পারে। ৫ই সেপ্টেম্বর একদল পাকিস্তানি সৈন্য তাঁদের তিনদিক থেকে আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে। তখন তাঁরাও পাল্টা আক্রমণ করে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকেন। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যদের আধুনিক ও ভারী অস্ত্রের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত নেন। পাল্টা গুলি করতে-করতে পশ্চাদপসরণের সময় হঠাৎ নান্নু মিয়ার পিঠে শেলের কয়েকটি টুকরো এবং হাতে দু-তিনটি গুলি লাগে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সহযোদ্ধারা তাঁকে উদ্ধার করে নিজেদের ঘাঁটিতে আনতে সক্ষম হলেও অধিনায়ক নূর মোহাম্মদ শেখ এ-যুদ্ধে শহীদ হন। আহত নান্নু মিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের উড়িষ্যার একটি হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। প্রায় তিন মাস পর সুস্থ হয়ে তিনি স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নান্নু মিয়াকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতার পর তিনি পূর্বের কর্মস্থলে যোগদান করেন। দেহে থাকা শেলের টুকরো ও গুলির আঘাতের কারণে তাঁর শারীরিক জটিলতা থেকে যায়। কয়েক বছর পর তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ১৯৮৪ সালে শারীরিক অক্ষমতা দেখিয়ে তাঁকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়। তাঁর স্ত্রীর নাম রীনা বেগম ১৯৮৭ সালে তিনি স্ত্রী ও ২ কন্যা সন্তানকে অত্যন্ত অসহায় অবস্থায় রেখে মৃত্যুবরণ করেন। [রেহানা পারভীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড