নান্দিয়াপাড়া যুদ্ধ (সোনাইমুড়ি, নোয়াখালী)
নান্দিয়াপাড়া যুদ্ধ (সোনাইমুড়ি, নোয়াখালী) সংঘটিত হয় ২৩শে সেপ্টেম্বর। কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার লুৎফর রহমান- ও সুবেদার শামছুল হকের নেতৃত্বে অর্ধশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এতে শত্রুপক্ষের ৪-৫ জন সৈন্য নিহত ও বহু আহত হয়।
১৯৭১ সালে নান্দিয়াপাড়া ছিল বেগমগঞ্জ থানাধীন। বর্তমানে এটি সোনাইমুড়ি উপজেলার অন্তর্ভুক্ত। তখন নান্দিয়াপাড়া এলাকাটি ছিল মুক্তাঞ্চল এবং মুক্তিবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। এখানেই মুক্তিযোদ্ধারা বন্দিদের বিচার করতেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নান্দিয়াপাড়ার নাম রেখেছিল কসাইখানা। এই saved নাম শুনলে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনীর আত্মা ভয়ে কেঁপে উঠত। হানাদার বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে সুযোগ খুঁজছিল কীভাবে নান্দিয়াপাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি ধ্বংস করা যায়। নোয়াখালীতে হানাদার বাহিনীর বড় ক্যাম্প ছিল বেগমগঞ্জ চৌরাস্তার টেকনিক্যাল হাইস্কুলে। সোনাইমুড়ি ও বজরাতে ছিল রাজাকার ক্যাম্প। মুক্তিবাহিনী নান্দিয়াপাড়ার রক্ষাকবজ হিসেবে সোনাইমুড়ি-নান্দিয়াপাড়া রোডে এক প্লাটুন মুক্তিফৌজকে সব সময় পাহারায় নিয়োজিত রাখত। ২৩শে সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকারআলবদর বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে অতর্কিতে নান্দিয়াপাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে। হানাদার বাহিনী বেগমগঞ্জের ক্যাম্প থেকে বের হয়ে পথিমধ্যে বজরা বাজার ও সোনাইমুড়ির সিমুলিয়া গ্রামে প্রবেশ করে। এ-সময় তারা তাদের দলে সোনাইমুড়ি রাজাকার ক্যাম্পের রাজাকারদের অর্ন্তভুক্ত করে নেয়। তারা সিমুলিয়া গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে আগুন লাগায় এবং ভারী আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ফায়ার করতে-করতে নান্দিয়াপাড়ার দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করে। তারা পাহারারত মুক্তিবাহিনীর মুখোমুখি হয়। উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল গুলি বিনিময় হয়। কিন্তু শত্রুবাহিনীর তুলনায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কম এবং তাদের হাতে অপ্রতুল অস্ত্র থাকায় লড়াই না চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করেন। ঠিক সেই মূহূর্তে কমান্ডার সুবেদার লুৎফর রহমান তাঁর দলবল নিয়ে রামগঞ্জ থেকে ফিরছিলেন। সোনাইমুড়ির দিক থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ শুনে তাঁরা অসীম সাহস নিয়ে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি নান্দিয়াপাড়ার দিকে দ্রুত অগ্রসর হন। প্রায় ৭ মাইল পথ অতিক্রম করে সুবেদার লুৎফর রহমান ও তাঁর দল শত্রুবাহিনীর দুইশত গজের মধ্যে এসে পৌঁছান। শত্রুবাহিনী অনবরত শেলিং করছিল। কিন্তু সুবেদার লুৎফর রহমান বাহিনীর অগ্রগতি তখনো থামেনি। শেলিংএর মুখে নিজেদের রক্ষা করে তাঁরা অগ্রসর হতে থাকেন। পশ্চাদপসরণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘবদ্ধ করতে সুবেদার লুৎফর রহমান উদ্যোগী হন। শত্রুবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘবদ্ধ হওয়ার বিষয়টি টের পায়। ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার শামছুল হকের বাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সুবেদার লুৎফর রহমানের দলের সঙ্গে যোগ দেয়। এতে মুক্তিবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি পায়। সুবেদার লুৎফর রহমান ও সুবেদার শামছুল হক বাহিনীর ভারী অস্ত্র ও এলএমজির ব্রাশ ফায়ার শত্রুবাহিনীর ওপর বর্ষিত হয়। চতুর্দিকে গুলি আর গুলি। কয়েক মিনিটের মধ্যে শত্রুপক্ষের ৪-৫ জন সৈন্য নিহত ও বহু আহত হয়। বাকিরা পশ্চাদপসরণ করে সোনাইমুড়ির দিকে পালিয়ে যায়। নন্দিয়াপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সফল অভিযানের ফলে পাকিস্তানি বাহিনী আর কখনো নান্দিয়াপাড়া আক্রমণ করার সাহস পায়নি। [মো. ফখরুল ইসলাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড