You dont have javascript enabled! Please enable it!

নাজিরগঞ্জ যুদ্ধ (সুজানগর, পাবনা)

নাজিরগঞ্জ যুদ্ধ (সুজানগর, পাবনা) সংঘটিত হয় ২৪শে অক্টোবর। এতে বেশ কয়েকজন রাজাকার ও মিলিশিয়া নিহত হয় এবং প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও রসদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। ঘটনার দিন মুক্তিযোদ্ধা মো. জহুরুল ইসলাম বিশু – মুজিব বাহিনীর একটি দল নিয়ে নাজিরগঞ্জে অবস্থান করছিলেন। পদ্মা নদীর পাড়ে নাজিরগঞ্জের তহসিল অফিসের পাকা ভবন। মো. জহুরুল ইসলাম বিশু, দুলাল, শামছুল, রাজ্জাক, সামাদ, হাবিব, পিন্টু, ইসমত, হুমায়ূন, হান্নান, তোফা, হাই, মোস্তফা, হেলাল, মাহাতাব, জমির, ছাদেকসহ প্রায় ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা ঐ অফিসের কাছে এক বাড়িতে এবং বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধা একটু দূরে বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নেন।
এদিন সকালে মো. জহুরুল ইসলাম বিশু মুক্তিযোদ্ধা দুলালের সঙ্গে তাঁদের স্থানীয় ঘাঁটিতে বসে সুজানগর থানা এলাকার একটি ম্যাপ নিয়ে থানা আক্রমণের পরিকল্পনা করছিলেন। এমন সময় তাঁরা বাইরে লোকজনের ছোটাছুটির শব্দ শুনতে পান। তাঁদের সেন্ট্রি এসে খবর দেয় যে, একটু দূরে ফেরি দেখা যাচ্ছে এবং ফেরির শব্দ শুনে লোকজন মিলিটারির ভয়ে পালাচ্ছে। এ খবর পেয়েই মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত প্রস্তুত হয়ে পজিশন নেন।
মুক্তিযোদ্ধারা ফেরি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের কাছে একটি আরসিএল গান (Recoilless Gun), ছয়টি ব্রিটিশ এলএমজি এবং সবার কাছে এসএলআর ও রাইফেল ছিল নদীর পারে বিভিন্ন স্থানে পজিশন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অপেক্ষা করতে থাকেন। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠানো হয় গ্রামের অন্যান্য জায়গায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দিতে, যাতে তাঁরা দ্রুত প্রস্তুত হয়ে চলে আসতে পারেন।
দুপুর ১২টার দিকে ফেরিটি মুক্তিযোদ্ধাদের পজিশনের কাছাকাছি এসে পৌঁছায়। ফেরির দোতলার খোলা জায়গায় পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনীর বেশ কয়েকজন রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফেরিটি ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসছে। রেঞ্জের মধ্যে আসামাত্রই মো. জহুরুল ইসলাম বিশু ফেরির নিচের দিকে আরসিএল গান থেকে ফায়ার করেন। তাঁর ফায়ারের সঙ্গে-সঙ্গে অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও ঝড়ের মতো গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনীও মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। দুপক্ষের মধ্যে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। হঠাৎ ফেরিটি খুব জোরে এসে নদীর পাড়ে ধাক্কা খায় এবং ফেরির ইঞ্জিনের গতি বেড়ে যায়। ফেরি চলে যাচ্ছে মনে করে মো. জহুরুল ইসলাম বিশু আবার আরসিএল গান দিয়ে ফায়ার করেন। অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের এলএমজি ও এসএলআর এক সঙ্গে গর্জে ওঠে। হঠাৎ ফেরির ইঞ্জিনের শব্দ থেমে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করা বন্ধ করে নিজেদের পজিশনে অপেক্ষা করতে থাকেন। ইতোমধ্যে ফেরির দোতলা থেকে কিছু লোক রাইফেলের মাথায় জামা বেঁধে উঁচু করে ধরে ‘জুই বাংলা, জুই বাংলা’ বলে চিৎকার করতে থাকে। মো. জহুরুল ইসলাম বিশু তাঁর পজিশনে থেকেই চিৎকার করে তাদের মধ্য থেকে ৩ জনকে হাত তুলে নেমে আসতে বলেন। তখন ফেরি থেকে একজন রাজাকার ও দুজন মিলিশিয়া নেমে আসে। তারা মো. জহুরুল ইসলাম বিশুর কথামতো ফেরির শেকল নদীপাড়ের একটি খেজুর গাছের সঙ্গে বাঁধে এবং বাকি সবাই হাত ওপরে তুলে নেমে আসে। তারা সকলে তহশিল অফিস ভবনের ভেতর ঢুকলে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের পজিশন ছেড়ে উঠে আসেন এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ভবনের দরজা বন্ধ করে পাহারা দিতে থাকেন। মো. জহুরুল ইসলাম বিশু কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে ফেরির ওপরে উঠে দেখেন তিন তলার সারেং রুমে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৬ জন নিহত হয়েছে। তাদের ৪ জন ফেরির চালক আর বাকি দুজন মিলিশিয়া। তিন তালা ও দোতলায় আরো ৫ জন মিলিশিয়া ও দুজন রাজাকারের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। নিচতলায় ৪ জন রাজাকার ও ১১ জন মিলিশিয়ার লাশ পড়ে আছে।
নিহত রাজাকার ও মিলিশিয়াদের লাশগুলো ফেরি থেকে নদীতে ফেলে দেয়া হয়। তাদের সবার কাছেই আইডেনটিটি কার্ড ছিল। মিলিশিয়া বাহিনীর সেনাদের প্রায় সবার বাড়ি ছিল পাকিস্তানের ফ্রন্টিয়ার এবং ওয়াজিরিস্তানে। রাজাকারদের ঠিকানা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়, তবে পাবনা জেলার কোনো রাজাকার এদের সঙ্গে ছিল না। বন্দি মিলিশিয়া ও রাজাকারদের হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়। এদিন প্রায় ৫০ জন মিলিশিয়া ও রাজাকার নিহত হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ফেরিটি ডুবিয়ে দেন। যুদ্ধের পাঁচ দিন পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র- থেকে এ খবর প্রচার করা হয় ৷
মিলিশিয়া বাহিনী ও রাজাকাররা ফেরিটিতে করে পাকিস্তানি আর্মির জন্য রেশনসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছিল। ফেরিটিতে ৪৭টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, প্রচুর প্ররিমাণ গুলি, ২৫ ড্রাম কেরোসিন তেল, ১০০ বস্তা চাল, ২৫ বস্তা ডাল, চিড়া, চিনি, বিস্কুট, সরিষার তেল, চাদর, সোয়েটার, কম্বল, লেপ-তোষকসহ প্রচুর মালপত্র ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ফেরি থেকে নেমে আসেন। ইতোমধ্যে এ-যুদ্ধের খবর পেয়ে চারদিক থেকে আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধা এসে হাজির হন। আশপাশের লোকজন ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে ছুটে আসে। পাবনা জেলার মধ্যে যে কয়েকটি ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছে, তার মধ্যে নাজিরগঞ্জ যুদ্ধ ছিল অন্যতম। এ-যুদ্ধের পর শত্রুশিবিরে ব্যাপক হতাশা নেমে আসে। সুজানগর এলাকা থেকে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যসহ স্বাধীনতাবিরোধীরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে শহরে অথবা থানায় আশ্রয় নিতে শুরু করে। [মো. জহুরুল ইসলাম বিশু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!