নাজিমগঞ্জ রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন (কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরা)
নাজিমগঞ্জ রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন (কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরা) পরিচালিত হয় সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। এতে ২১ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।
দেশের সব স্থানের মতো কালীগঞ্জেও রাজাকারদের নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে পাকবাহিনী যখন কোণঠাসা হয়ে পড়ে, তখন তারা রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এদের দ্বারাই তখন থেকে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাঙালি নিধন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। কালীগঞ্জ থানায় রাজাকারদের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি ছিল নাজিমগঞ্জের বিশিষ্ট ধনী ব্যবসায়ী করিম গাইনের বাড়ির ক্যাম্প। ২৫-৩০ জনের এ ক্যাম্পের নেতৃত্বে ছিল পাঞ্জাবি পান্ডা উপাধিপ্রাপ্ত জেসিও (জুনিয়র কমান্ডিং অফিসার) ইয়াছিন। বাড়িরটির ছাদের ওপর বালির বস্তা দিয়ে এবং নিচে চারদিকে ট্রেঞ্চ আর বাঙ্কার দিয়ে সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। তাছাড়া কালীগঞ্জ পাকক্যাম্পের কাছাকাছি হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে এ ঘাঁটিতে আক্রমণ করা ছিল দুরূহ কাজ।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা এ ক্যাম্প আক্রমণ করেন। লে. মাহফুজ আলম বেগ ও শেখ ওয়াহেদুজ্জামানের নেতৃত্বে আকবর হোসেন, লিয়াকত আলী, মনির হোসেন, আব্দুল হাকিম, আবদুস সামাদ, তোয়াক্কেল, মোকাররম হোসনসহ ৪০-৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধা রাত ৯টার দিকে উকসা সীমান্ত দিয়ে ইছামতী পার হয়ে ঘোরতর অন্ধকারের মধ্যে ধানক্ষেত, কর্দমাক্ত পথ আর বন-জঙ্গল পার হয়ে এলএমজি, এসএলআর, ২ ইঞ্চি মর্টার ও গ্রেনেডসহ প্রচুর অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কালীগঞ্জ পৌঁছান। রাত ১২টার দিকে তাঁরা ক্যাম্পের পাশে অবস্থান নেন। কমান্ডারের নির্দেশ পাওয়া মাত্র রাজাকাররা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণ করতে থাকেন। রাজাকারদের পক্ষ থেকেও পাল্টা জবাব আসে। উভয় পক্ষে কিছুক্ষণ অবিরাম গুলি বিনিময়ের পর মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক লে. মাহফুজ আলম বেগ শত্রুদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। কিন্তু তারা আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানিয়ে গুলি চালাতে থাকে। তখন লে. মাহফুজ আলম বেগ মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বিগুণ শক্তিতে যুদ্ধ শুরুর নির্দেশ দেন। শুরু হয় প্রচণ্ড গোলাগুলি। কয়েক মিনিট পর লে. মাহফুজ আলম বেগ কয়েকজন সঙ্গীসহ গুলি করতে-করতে ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকে পড়েন। উপায়ান্তর না দেখে রাজাকার কমান্ডার ইয়াছিন তার ২০ জন সঙ্গীসহ আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু ‘জল্লাদ’ খ্যাত রাজাকার কাসিম ও জোবাহার-সহ বাকিরা পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা আত্মসমর্পণকারীদের বন্দি করে নিজেদের গন্তব্যে চলে যান। পতন হয় নাজিমগঞ্জ রাজাকার ক্যাম্পের। সেই থেকে ২০শে নভেম্বর কালীগঞ্জ শত্রুমুক্ত হওয়া পর্যন্ত এ এলাকার মানুষ রাজাকার বাহিনীর নির্যাতন থেকে মুক্তি পায়। আজো এলাকার মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের আশীর্বাদ করে, স্মরণ করে তাঁদের জীবন বাজি রেখে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামকে। [এম এম নজমুল হক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড