You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে নাজিরপুর উপজেলা (পিরোজপুর)

নাজিরপুর উপজেলা (পিরোজপুর) পিরোজপুর জেলা সদর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। এর উত্তর দিকে টঙ্গিপাড়া ও উজিরপুর, পূর্বে বানারীপাড়া ও নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠী), পশ্চিমে মোল্লারহাট ও চিতলমারী এবং দক্ষিণে পিরোজপুর সদর ও কচুয়া উপজেলা। ৫২-র ভাষা- আন্দোলন, ৬৬-র ৬-দফা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এ নাজিরপুরের মানুষ অংশগ্রহণ করে। ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- নাজিরপুরের মাটিভাঙ্গায় এক নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দেন। নাজিরপুর থানা আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি নিখিল রঞ্জন হালদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ঐ জনসভাটি ছিল পিরোজপুর জেলায় প্রথম নির্বাচনী জনসভা। ৭০-এর নির্বাচনে নাজিরপুরের জনগণ আওয়ামী লীগ প্রার্থী এনায়েত হোসেন খানকে এমএনএ এবং ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডলকে এমপিএ নির্বাচিত করে। এ নির্বাচনে সারা দেশে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্র শুরু করলে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন। নাজিরপুরের সংগ্রামী জনতা এতে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানায় এবং মুক্তির চূড়ান্ত সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণ এর পর এনায়েত হোসেন খান এমএনএ ও ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল এমপিএ-র নেতৃত্বে নাজিরপুরে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সংগ্রাম কমিটির সদস্যদের মধ্যে নিখিল রঞ্জন হালদার (নাজিরপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি), নূর মোহাম্মদ ফরাজী (নাজিরপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক), আব্দুস সাত্তার মিয়া (ন্যাপ-, দীঘিরজান), আওয়ামী লীগের নিরোদ কুমার মজুমদার (কাইলানী), রমেশ মণ্ডল (সাথিয়া), নাসির হালদার (মাটিভাঙ্গা), মুকুন্দ হালদার (দীর্ঘা), মনিন্দ্রনাথ বড়াল (শ্রীরামকাঠি), আবুল হাসনাত খান পেয়ারা (নাজিরপুর), আব্দুল সালেক মোল্লা (বানিয়ারী), এ্যভোকেট আব্দুর রহমান (নাজিরপুর), এ বি এম রেজাউল করিম (বানারীপাড়া কমিউনিস্ট পার্টি, দীঘিরজান) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ নাজিরপুরের ছাত্র-যুবক, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে অভূতপূর্ব জাগরণ সৃষ্টি করে। তারা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বাঁশের লাঠি, লোহার বল্লম, ঢাল-সড়কি ইত্যাদি নিয়ে মাথায় লাল কাপড় বেঁধে হাট-বাজারে মিছিল, সমাবেশ ও পথসভার মাধ্যমে জনগণকে স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাড়ায়-পাড়ায় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। বাঁশের ডামি রাইফেল দিয়ে নাজিরপুর, শ্রীরামকাঠি হাইস্কুল মাঠে, বাদুতলার গোবর্ধন হাইস্কুল মাঠে, দীর্ঘা হাইস্কুল মাঠে এবং মাটিভাঙ্গা ও সাথিয়া কুমুদ মণ্ডলের বাড়ির আঙিনায় ছাত্র-যুবকরা মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। এর কয়েকদিন পর নাজিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোকাদ্দেস মিয়ার নিকট থেকে কয়েকটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল সংগ্রহ করে সাবরেজিস্ট্রার অফিসের সামনে অস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। শ্রীরামকাঠি হাইস্কুল মাঠে মতি কমান্ডার, গোবর্ধন হাইস্কুল মাঠে ননী হালদার ও আব্দুল হাকিম মৌলভী, দীঘিরজান হাইস্কুল মাঠে এ বি এম রেজাউল করিম এবং বানিয়ারী মাঠে সরোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করলে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ নাজিরপুরে ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন শতশত মানুষ আবেগ আর উত্তেজনায় মিছিল নিয়ে ১৬ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে নাজিরপুর থেকে পিরোজপুর জেলা সদরে ছুটে যায়। এদিন এনায়েত হোসেন খান এমএনএ-র পিরোজপুরের বাসায় নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে উচ্চ পর্যায়ের এক সভায় যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সদস্যরা ছিলেন এনায়েত হোসেন খান এমএনএ, ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল এমপিএ, ডা. আব্দুল হাই এমপিএ, এডভোকেট আলী হায়দার খান, এডভোকেট এম এ মান্নান প্রমুখ। এ কমিটির নির্দেশে সংগ্রামী জনতা পিরোজপুর ট্রেজারির তালা ভেঙ্গে অস্ত্র বের করে নিয়ে আসে।
নাজিরপুরের যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন দুজন। তাঁরা হলেন তাজুল ইসলাম (পিতা নওয়াব আলী, কলারদোয়ানিয়া) ও সরোয়ার হোসেন (পিতা দলিল উদ্দিন শেখ, পূর্ববানিয়ারী) নাজিরপুর থানার মাটিভাঙ্গা ইউনিয়নে লুটপাট প্রতিরোধ করার জন্য আলাউদ্দিন মাস্টারকে সভাপতি ও এ বি এম রেজাউল করিমকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৩ সদস্যের একটি স্কোয়াড গঠন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে এ প্রতিরোধ কমিটিই দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মাটিভাঙ্গায় স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা চালায়। পরবর্তীতে এ বি এম রেজাউল করিম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং যুদ্ধকালীন কমান্ডার হিসেবে নাজিরপুরের বাহিরে দায়িত্ব পালন করেন।
১৫ই মে পাকবাহিনী নাজিরপুরে অনুপ্রবেশ করে প্রথমে নাজিরপুর থানায় ও পরবর্তীতে ডাকবাংলোয় তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। তাছাড়া শ্রীরামকাঠি হাইস্কুল, রঘুনাথপুর মঈনুদ্দিন চেয়ারম্যানের বাড়ি ও নাজিরপুরের আমতলার জয়নাল মোল্লার বাড়িতে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপিত হয়।
মে মাসের প্রথমদিকে আব্দুল লতিফ বাহাদুর (কলারদোয়ানিয়া)-কে চেয়ারম্যান ও ছব্দুল খান (দীঘিরজান)-কে সেক্রেটারি করে নাজিরপুরে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এ দুই বাহিনীর সদস্যরা এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ শুরু করলে আব্দুল লতিফ বাহাদুর শান্তি কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সক্রিয় সদস্যদের মধ্যে আবুবকর খাঁ ওরফে আপন খাঁ (রাজাকার বাহিনীর জল্লাদ হিসেবে পরিচিত, যুগিয়া), সিরাজুল হক মোল্লা (কুমারখালী), ওহাব মোল্লা (কাইলানী), আইউব খান (কাইলানী), উমেদ গাজী (যুগিয়া), গফুর ডিলার (মনোহরপুর), মালেক মিঞা (ডুমুরিয়া), আব্দুল গণি (পাকুরিয়া), গঞ্জে আলী (পাটিতাবাড়ি), শাহাবুদ্দিন শেখ (রঘুনাথপুর), শাহাবুদ্দিন (গিলাতলা), সেকেন্দার আলী (হোগলাবুনিয়া), জব্বার হাওলাদার (শ্রীরামকাঠি), রাঙ্গা মিয়া (ডুমুরিয়া) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকবাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় নাজিরপুরের পাজরাপাড়া, গাবতলা, শ্রীরামকাঠি, মধ্য জয়পুর, বাবলা, দীর্ঘা, ঘোষকাঠি, শাখারীকাঠিসহ হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় ব্যাপক হত্যা, গণহত্যা, নারীনির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। কালীগঙ্গা নদীর তীরে প্রাচীন বন্দর নগরী শ্রীরামকাঠি। ১৫ই মে পাকবাহিনীর গানবোট এ বন্দরে এসে ভেড়ে। রাইফেল আর মেশিনগানের গুলিতে ঝাঝড়া হয়ে যায় গোটা বন্দর। দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন, পুড়তে থাকে দোকানপাট ও ঘরবাড়ি। জীবন বাঁচাতে তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ, নারী যে যেভাবে পেরেছে ছুটছে। মা-বোনদের আর্তনাদে সৃষ্টি হয় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা শ্রীরামকাঠির পাজরাপাড়া গ্রামে গণহত্যা চালিয়ে ১৮ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে, যা পাজরাপাড়া গণহত্যা নামে পরিচিত এদিন তারা পার্শবর্তী নৈলতলা গ্রামের গৌরকান্তি রায় (পিতা জ্ঞানেন্দ্র রায়), অশ্বিনী বেপারী (পিতা ভগবান বেপারী), নকুল চন্দ্র মণ্ডল (পিতা দ্বারিক মণ্ডল), হরিচরণ ওঝা (পিতা কালিচরণ ওঝা), চরখোলা গ্রামের নিরোদ হালদার (পিতা ষষ্ঠিচরণ হালাদার), অরুণা বালা বাড়ৈ (স্বামী বিনোদ বাড়ৈ) এবং খৈজুরতলা গ্রামের সদানন্দ নামে এক পাগলকে গুলি করে হত্যা করে। অতঃপর লুটপাট শেষে গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেয়। একই দিন রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী নাজিরপুরের গাবতলা গ্রামে প্রবেশ করে গণহত্যা চালায়। গাবতলা গণহত্যায় ৭ জন নিরপরাধ মানুষ শহীদ হন। এদিন ভুবনখালী গ্রামের রাজকুমার মিস্ত্রী (পিতা মনোরঞ্জন মিস্ত্রী) ও সুরবালা হালদার (পিতা মুধসূদন হালদার)-কে পাকবাহিনী গুলি করে হত্যা করে।
১৫ই মে পাকবাহিনী গানবোটযোগে দীর্ঘা বাজারে এসে বাজারটিতে অগ্নিসংযোগ করে এবং নৃশংস গণহত্যা চালায়। পাকবাহিনী সেদিন ৪১ জন মানুষকে কাউকে গুলি করে, কাউকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যা করে, যা দীর্ঘা গণহত্যা নামে পরিচিত। এদিন স্নাতক শ্রেণির মেধাবী ছাত্র ভূপেন মণ্ডল (পিতা যদু মণ্ডল)-কে গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০শে মে চাঁদাকাঠি বাজার, ২১শে মে নাওটানা ও পার্শবর্তী এলাকা এবং ২২শে মে লেবুজিলবুনিয়া গ্রামে পাকবাহিনী লুটপাট চালায়।
২৪শে মে পাকবাহিনী শ্রীরামকাঠি বাজারে গণহত্যা চালায়। শ্রীরামকাঠি বাজার গণহত্যায় ১০ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এদিন জীবন গ্রামের সুধন্য শিকদার (পিতা কৈলাস শিকদার) ও মহানন্দ মণ্ডল (পিতা যাদব মণ্ডল) পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। একই দিন চট্টগ্রাম থেকে বাড়ি আসার পথে কাউখালী লঞ্চ টার্মিনালে পাকবাহিনীর গুলিতে নিহত হন চালিতাবাড়ির নিকুঞ্জ মণ্ডল (পিতা তারাচাঁদ মণ্ডল), অজিত মণ্ডল (পিতা তারাচাঁদ মণ্ডল) এবং ভীমকাঠির দিলীপ বেপারী (পিতা উপেন্দ্রনাথ বেপারী)।
পাকবাহিনী অত্যাচার করবে না রাজাকারদের এমন আশ্বাসে ঘোষকাঠি মনোরঞ্জন বিদ্যানিকেতনে বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ শতাধিক মানুষ এসে আশ্রয় নেয়। কিন্তু ২৪শে মে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা সেখানে আক্রমণ চালিয়ে স্বর্ণালঙ্কারসহ টাকাকড়ি লুট করে নেয় এবং ৫ জনকে ধরে নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। নিহতরা হলেন নারায়ণ চন্দ্র হালদার (পিতা অগ্নিকুমার হালদার), শশীভূষণ হালদার (পিতা মহিরঞ্জন হালদার), জগদীশ চন্দ্র হালদার (পিতা অশ্বিনী কুমার হালদার), অনন্ত কুমার হালদার ও বসন্ত কুমার মণ্ডল। মে মাসের শেষদিকে নাজিরপুর সদরের পণ্ডিত অনিল ভট্টাচার্যের পুত্র নির্মল ভট্টাচার্য মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য স্বরূপকাঠির কুড়িয়ানা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের উদ্দেশে রওনা হন। পথে শ্রীরামকাঠি বন্দরে তিনি রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। রাজাকাররা তাকে হুলারহাট বন্দরে স্থাপিত হানাদার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিলে পাকবাহিনী তাকে হুলারহাট টার্মিনালে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। একই সঙ্গে জয়পুর থেকে আসা জনার্ধন হালদার (পিতা বসন্ত হালদার)- কে হুলারহাট পাকসেনা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায় এবং পাকবাহিনী তাকেও টার্মিনালে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তার অশীতিপর বৃদ্ধ পিতা বসন্ত হালদারকে পাকসেনারা বুটের তলায় পিষে হত্যা করে।
১লা জুন পাকবাহিনী মধ্য জয়পুর গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে গৌরাঙ্গ পাল (পিতা দেবেন্দ্র পাল), অনন্ত কুমার পাল (পিতা রাজকুমার পাল), বিমল ধর (পিতা কালিপদ ধর), সত্যরঞ্জন মিস্ত্রী (পিতা বসন্ত কুমার মিস্ত্রী) ও হরেকৃষ্ণ মাঝিকে গুলি করে হত্যা করে।
আগস্ট মাসের প্রথম দিকে আমতলা গ্রামের আশ্রাব আলী খান (ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ও জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য) মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে নাজিরপুর আসার পথে হুলারহাটে রাজাকার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। সেখানে রাজাকাররা ৭-৮ দিন তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। অতঃপর রাজাকার সিরাজুল হক মোল্লা তাকে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। ১৫ই আগস্ট পাকবাহিনী তাকে গুলি করে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেয়। দুদিন পর এক দড়িতে বাঁধা কয়েকজনের লাশের সঙ্গে তার লাশ পিরোজপুরের চানমারি নদীতে পাওয়া যায়। ২২শে সেপ্টেম্বর শ্রীরামকাঠি বাজারে পাকসেনাদের গুলিতে তিনজন হাটুরে নিহত হয়। ৬ই অক্টোবর রাজাকারদের একটি গ্রুপ শ্রীরামকাঠি গ্রামে আক্রমণ চালায় এবং রতন হালদার ওরফে কানু (পিতা কৃষ্ণ কান্ত হালদার), ধীরেন্দ্রনাথ হালদার (পিতা ষষ্ঠিচরণ হালদার), মাখন লাল হালদার (পিতা প্রসন্ন কুমার হালদার) ও কদমবালা শীল (স্বামী যোগেন্দ্রনাথ শীল)-কে গুলি করে হত্যা করে। একই দিন রাজাকারদের গুলিতে শহীদ হন বলিবাবলা গ্রামের নিশিকান্ত মাঝি (পিতা ষষ্ঠিচরণ মাঝি), কালিচরণ হালদার (পিতা দ্বারকানাথ হালদার) ও নিশিকান্ত মিস্ত্রী (পিতা বেচারাম মিস্ত্রী) নামে তিনজন।
৬ই ডিসেম্বর রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী নাজিরপুর উপজেলার শাখারীকাঠি ইউনিয়নের শাখারীকাঠি, বাইনকাঠি, কাঁঠালিয়া ও সাতকাছিমা গ্রামে এক নৃশংস গণহত্যা চালায়। সেদিন তারা এসব গ্রামের ১২ জন সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে, যা শাখারীকাঠি গণহত্যা নামে পরিচিত। গণহত্যা শেষে গ্রামগুলোতে ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এদিন রাজাকারদের ইশারায় পাকবাহিনী শাখারীকাঠি খালপাড়ের জঙ্গলে পালিয়ে থাকা নারী ও শিশুসহ ৮-৯ জনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যা করে। সেদিন শ্রীরামকাঠির ১৭ বছর বয়সী লক্ষীরাণী মণ্ডল-কে মা-বাবার অনুনয় বিনয় উপেক্ষা করে পাকবাহিনী অস্ত্রের মুখে শ্রীরামকাঠি ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যায়। রাতভর তার উপর পাশবিক নির্যাতন শেষে অচেতন অবস্থায় পরদিন তাকে সেই জঙ্গলে ফেলে রেখে যায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নাজিরপুরে শতাধিক নারী এরকম পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন।
নাজিরপুর থানা সেনা ক্যাম্প, শ্রীরামকাঠি হাইস্কুল, রঘুনাথপুর ও আমতলার রাজাকার ক্যাম্পে বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনদের ধরে এনে বন্দি করে নির্যাতন চালানো হতো।
নাজিরপুর থানার পাশে (ডাকবাংলোর সামনে) পুরনো খেয়াঘাটটি ছিল বধ্যভূমি। এখানে পাকবাহিনী নোঙ্গর করে রাখা লঞ্চে অনেক মানুষকে ধরে এনে লঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে গুলি করে ও বেয়নেট চার্জের মাধ্যমে হত্যা করে তাদের লাশ কালীগঙ্গা নদীতে ফেলে দিত।
জুন মাসের দিকে নাজিরপুরে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা শুরু হয়। এ সময় বেশ কিছু লুটেরা ও শান্তি কমিটির সদস্য বিভিন্ন স্থানে তাঁদের হাতে নিহত হয়। অক্টোবর মাস থেকে ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এসে যুক্ত হলে তাঁদের শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং তখন থেকে তাঁরা প্রকাশ্যে তৎপরতা চালাতে থাকেন। ফলে স্বাধীনতাবিরোধী ও পাকবাহিনীর দালালদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হয়।
৬ই অক্টোবর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী শ্রীরামকাঠি খাদ্য গুদাম লুট করতে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের গুলি বিনিময় হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে তারা টিকতে না পেরে অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। এদিন দুপুরে আবার রাজাকার, মিলিশিয়া ও পাকবাহিনী শ্রীরামকাঠি বাজারে আসে এবং দোকানপাট লুণ্ঠন শেষে বাজারটি পুড়িয়ে দেয়। এসময় তারা কয়েকজন মানুষকে গুলি করে হত্যা করে এবং বেশ কয়েকজন যুবককে আটক করে নাজিরপুর থানা ক্যাম্পে নিয়ে যায়।
১লা নাভেম্বর সাতকাছিমায় রাজাকারদের সঙ্গে বানিয়ারী ক্যাম্প কমান্ডার সরোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের এক ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ-যুদ্ধে কমান্ডার সরোয়ার হোসেন শহীদ হন। তিনজন সাধারণ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ চালিয়ে যান এবং এক পর্যায়ে রাজাকাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
শ্রীরামকাঠি থেকে পূর্বদিকে বেলুয়া নদী। এ নদীর তীরে মাদারবাড়ি ও পাটিতাবাড়ি গ্রাম অবস্থিত। পাকবাহিনী গানবোটযোগে এ নদীতে টহল দিত। গানবোট থেকেই তারা গ্রামের দিকে গুলি ছুঁড়ত। ১০ই নভেম্বর গানবোট থেকে ছোড়া গুলিতে পাটিতাবাড়ি খেয়াঘাটে শহীদ হন নিরঞ্জন মণ্ডল (বানিয়াকাঠি)। মাদারবাড়ির নিকট এলে কলারদোয়ানিয়া হাটের পাশে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা টহলরত পাকবাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে একজন পাকসেনা নিহত হয়৷ এমতাবস্থায় পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর বেপরোয়াভাবে গুলি চালাতে থাকলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন।
৭ই ডিসেম্বর পাকবাহিনী নাজিরপুর থেকে লঞ্চযোগে পিরোজপুর যাওয়ার পথে শাখারীকাঠি খ্যাপী আশ্রম এলাকায় ওঁৎ পেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইসলাম, সালেক মোল্লা ও মোক্তার হোসেন গ্রুপের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। প্রায় ১৫ মিনিট গুলি বিনিময়ের পর পাকবাহিনী দ্রুত পালিয়ে যায়। ১২ই ডিসেম্বর নাজিরপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। নাজিরপুর উপজেলায় ছয়জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন— সরোয়ার হোসেন (পিতা দলিল উদ্দিন শেখ, পূর্ব বানিয়ারী), আ. হালিম খন্দকার (পিতা মো. আ. রাজ্জাক খন্দকার, মাটিভাঙ্গা), গোলাম মোস্তফা (পিতা হাজী সোনামুদ্দিন, পেনাখালী), মোবারক আলী শিকদার (পিতা ইউসুফ আলী শিকদার, রঘুনাথপুর), হোসেন আলী শেখ (পিতা হাজী জোনাব আলী শেখ, রঘুনাথপুর) এবং আশ্রাব আলী খান (পিতা হাজী আমীর হোসেন খান, আমতলা)।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নাজিরপুর উপজেলার শ্রীরামকাঠি হাইস্কুল প্রাঙ্গণে ‘অরুণোদয়’ নামে মুক্তিযুদ্ধের একটি নান্দনিক স্মৃতিসৌধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নামফলক নির্মাণ করা হয়েছে। ১৫ই মে-র দীর্ঘা গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে দীর্ঘা হাইস্কুল প্রাঙ্গনে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। ১৫ই মে স্নাতক শ্রেণির ছাত্র ভূপেন মণ্ডল (পিতা যদু মণ্ডল, দীর্ঘা)-কে পাকবাহিনী যেখানে গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে, সেখানে তার পরিবারের পক্ষ থেকে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। যুদ্ধকালীন কমান্ডার শহীদ সরোয়ার হোসেনের সমাধি (পূর্ববানিয়ারী)-তে এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোবারক আলী শিকদারের স্মরণে শেখ মাটিয়ায় একটি করে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। [সঞ্জীব কুমার রায়]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!