নাজিরপুর যুদ্ধ (কলমাকান্দা, নেত্রকোনা)
নাজিরপুর যুদ্ধ (কলমাকান্দা, নেত্রকোনা) সংঘটিত হয় ২৬শে জুলাই। পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সংঘটিত এ-যুদ্ধে ৩ জন পাকসেনা নিহত ও অনেকে আহত হয়। অপরপক্ষে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা ও একজন পথচারী শহীদ হন।
২৬শে জুলাই সকালে দুর্গাপুর থানার বিরিশিরি ক্যাম্প থেকে পাকসেনাদের একটি দল গোলাবারুদ নিয়ে কলমাকান্দার দিকে যাচ্ছে খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। রংড়া বিএসএফ ক্যাম্পের ভারতীয় ক্যাপ্টেন চৌহানের পরামর্শ ও সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা রণকৌশল প্রণয়ন করেন। নাজমুল হক তারা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের কোম্পানি কমান্ডার। নদীপথে দুর্গাপুর-কলমাকান্দার নাজিরপুর বাজারের কাছে পাকহানাদারদের ওপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী নাজমুল হক তারার নেতৃত্বে ৪৫ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল ২৫শে জুলাই সন্ধ্যায় নাজিরপুর বাজারে পৌঁছে। সন্ধ্যার মধ্যে আবদুর রহিম খান রতন, নুরুজ্জামান দ্বিজেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস, ইয়ার মামুদ, ভবতোষ চন্দ্র দাস, জামাল উদ্দিন, জাহান আলী, খলিলুর রহমান, ডা. আবদুল আজিজ, সুভাষ চন্দ্র রক্ষিত, আবুল কালাম আজাদ, হাবিবুর রহমান বাবুল, রঞ্জিত কুমার রায়, গোলাম মোস্তফা, আইয়ুব আলী, আবদুস সোবহানসহ ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নাজিরপুর বাজার সংলগ্ন নদীপথে এম্বুশ নেয়। সেকশন কমান্ডার রহমত উল্লাহর নেতৃত্বে শামসুল হক সরুজ আশরাফ উদ্দিন সরকার, মমতাজ আলী, এস কে চন্দ্র, আবদুল খালেক, মানিক সিকদার, মহর আলী, আ ফ ম ইয়াহিয়া খান, মতিউর রহমান, ইউসুফ আলী, পরেশ চন্দ্র শীল, হাফিজ উদ্দিন, জামানসহ ১৪ জনের অন্য একটি দল কলমাকান্দা-নাজিরপুর সড়কের গজারমারী নামক স্থানে অবস্থান নেয়। প্লাটুন কমান্ডার আব্দুল জব্বারের নেতৃত্বে আবদুল হেকিম, সিরাজুল ইসলাম, বিপ্লব ভট্টাচার্য, শামসুল ইসলাম, মমতাজ শেখ, আজগর আলী, আবুল কাসেম মিল্কি, মোস্তাফিজুর রহমান, আবুল হোসেন খান মিলন, শিবু দাস, লিয়াকত আলী, বজলুর রহমান, শেখ সামছুদ্দীন আহমেদসহ ১৪ জনের অপর দলটি কলমাকান্দা- কাস্তপুর নদীপথে এম্বুশ নেয়। এসব দল নাজিরপুর বাজারের সবকটি প্রবেশপথে অবস্থান গ্রহণ করে। অন্য একটি দলকে কভারেজ দেয়ার জন্য লেঙ্গুড়া বাজার এলাকায় রাখা হয়।
২৫শে জুলাই রাত পেরিয়ে পরদিন সকাল ৯টার পর এম্বুশ প্রত্যাহার করে ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় নাজিরপুর কাচারির কাছে তিন রাস্তায় মোড়ে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর মুখোমুখি হন। মুহূর্তেই কমান্ডার নাজমুল হক তারা স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ার করেন। পাকসেনারাও পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। ফলে দুপক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়। অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হওয়া সত্ত্বেও হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দুপুর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাধান্য বজায় রাখতে সক্ষম হন। হঠাৎ এক পর্যায়ে পাকসেনারা ক্রলিং করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষাবূহ্যের ভেতর ঢুকে পড়ে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের এলএমজি পজিশন নির্দিষ্ট করে। এলএমজিম্যান অকুতোভয় জামাল উদ্দিনকে লক্ষ করে প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করে। এক পর্যায়ে হানাদারদের গুলিতে জামাল উদ্দিন ঘটনাস্থলে শহীদ হন। এখানে ৩ জন পাকসেনা নিহত ও অনেকে আহত হয়। এ-যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতা-পরবর্তী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক জামাল উদ্দিন ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত হন।
এদিকে লেঙ্গুড়া বাজার এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের কভারেজ দলটি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্ধারের জন্য অগ্রসর হয়। অন্যদিকে পাকহানাদারদের উদ্ধারে নেত্রকোনা থেকে একটি হেলিকপ্টার আসে। বিকেল ৫টার দিকে নিহত পাকসেনাদের লাশ ও আহতদের তুলে হেলিকপ্টারটি দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। টানা ৮ ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। এ-যুদ্ধে ডা. আবদুল আজিজ (নেত্রকোনা), ফজলুল হক (নেত্রকোনা), ইয়ার মামুদ (মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ), ভবতোষ চন্দ্র দাস (মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ), নুরুজ্জামান (মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ), দ্বীজেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস (মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ), জামাল উদ্দিন (জামালপুর) ও স্থানীয় পথচারী কালাচান মিয়া শহীদ হন। কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল হক তারা গুরুতর আহত হন। তাঁর কণ্ঠনালী ছিঁড়ে যায়। নাজিরপুরের কমলাকান্দায় একটি স্মৃতিসৌধ ও ৭ শহীদের সমাধি রয়েছে। [জুলফিকার আলী শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড