মুক্তিযুদ্ধে নাগরপুর উপজেলা (টাঙ্গাইল)
নাগরপুর উপজেলা (টাঙ্গাইল) ১৯৫২ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে নাগরপুরবাসীর কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ১৯৭০-এর নির্বাচনেও তাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে <আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় সারা দেশের মতো নাগরপুরবাসীদের মনেও তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। তারা উপলব্ধি করতে পারে যে, শাসন ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে লাভের জন্য তাদের আরো সংগ্রাম করতে হবে। এমনই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর ঘোষণা এল। ঐ ভাষণ থেকে তারা বুঝতে পারে যে, শুধু শাসন ক্ষমতা নয়, এবার দেশের স্বাধীনতার জন্যই সংগ্রাম করতে হবে। এ লক্ষ্যেই তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর কোনড়া গ্রামের খন্দকার আব্দুল বাতেনের নেতৃত্বে এলাকার ছাত্র-যুবকরা মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের প্রস্তুতি নেয়। ২৬শে মার্চের পরে সাটুরিয়ার তিল্লি গ্রাম, নাগরপুরের লাউহাটি ও শাহাজানির চরে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ২রা এপ্রিল কোনড়া গ্রামের মীর শামছুল আলম শাহজাদার নেতৃত্বে একটি প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অন্যান্য সদস্য ছিলেন জিয়ারত আলী, শাহজাহান ওরফে গেন্দা, সমন্দ শাহ, লাল মিয়া, ঠান্ডু, রোমেজ, আবদুল খালেক প্রমুখ। একই দিন আরেকটি কমিটি গঠিত হয়, যার সদস্য ছিলেন হুরমুজ, জিন্নাহ, আবদুল করিম প্রমুখ। এঁরা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তরুণদের উদ্বুদ্ধ ও অস্ত্র সংগ্রহ করতে থাকেন। ইতোমধ্যে খন্দকার আব্দুল বাতেন একটি নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলেন, যা পরবর্তীকালে বাতেন বাহিনী নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়। মে মাসে উপর্যুক্ত দুটি কমিটির সদস্যরা বাতেন বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। নাগরপুর উপজেলায় যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তাঁদের মধ্যে এ কে এম শামসুল হক খান (আখতারাইল, কুমিল্লার সাবেক জেলা প্রশাসক), এ কে শামসুদ্দিন আহমেদ (গয়হাটা, সিরাজগঞ্জের সাবেক এসডিও), অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ, খন্দকার আব্দুল বাতেন, -আবিদুর রহমান আবিদ, বীর বিক্রম- (তেবাড়িয়া), মোহাম্মদ ভূঁইয়া, বীর প্রতীক, উপেন্দ্রনাথ সরকার বিএসসি, খন্দকার আবদুস ছালাম (কোনড়া), মীর শামসুল আলম শাহজাদা (কোনড়া), সিদ্দিক বিএসসি (শাহাজানির চর), মো. নাসির উদ্দিন, বীর প্রতীক (আন্দিবাড়ি), আবদুল হাকিম (চৌধুরী ডাঙ্গা), এম এ ছালাম (আরড়া), আশরাফ হোসেন (সিংজোড়া), সুজায়েত হোসেন (বেতবাড়ি), ওয়াজেদ আলী মাস্টার (নাগরপুর), সুবেদার মাঈন উদ্দিন (মাকোরকোল), আলমগীর হোসেন ভূঁইয়া (গয়হাটা), আবদুস সাত্তার খান আলমগীর (গয়হাটা), আবুল কালাম আজাদ (কোনড়া), জয়নাল আবেদীন (সুটাইন), আরফান আলী খান (ঘোনাপাড়া), আবদুল গফুর বেপারী (পুকুড়িয়া), সুবেদার আবদুল বারী (ধল্লা), ফজলুল হক মল্লিক (আগদিঘুলিয়া), নজরুল ইসলাম (সিংজোড়া), গৌতম চক্রবর্তী (নাগরপুর), হামিদুর রহমান (তেবাড়িয়া), সুলতান উদ্দিন (কোকাদাইর), জসিম উদ্দিন (নাগরপুর), জনাব আলী (বনগ্রাম) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
১২ই মে পাকবাহিনী নাগরপুর উপজেলায় প্রবেশ করে এবং নাগরপুর থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
নাগরপুরে যারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল, তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়রা হচ্ছে- আবদুল জুব্বার মোক্তার, হুমায়ুন হোসেন খান, মো. আইন উদ্দিন, মো. লেবু মিয়া প্রমুখ।
পাকবাহিনী ১২ই মে নাগরপুরে প্রবেশ করে সত্যব্রত সাহা (বাকা), কালিপদ সাহা, চিন্তাহরণ দাসসহ ১৬ জন নিরীহ ব্যক্তিকে হত্যা করে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে তারা সারাংপুর গণহত্যা, নাগরপুর বাজার গণহত্যা, বনগ্রাম গণহত্যা এবং বৈন্যাপাড়া গণহত্যা সংঘটিত করে। ৬ই জুলাই সারাংপুরে ৭ জন, আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে নাগরপুর বাজারে ৬ জন এবং ২৫শে অক্টোবর বনগ্রামে ৫৩ জন ও বৈন্যাপাড়ায় ৫৬ জন মানুষ গণহত্যার শিকার হয়। পাকবাহিনী বিভিন্ন গ্রাম ও হাট-বাজারে বহু সংখ্যক বাড়িঘর ও দোকান-পাটে অগ্নিসংযোগ করে এবং নিরীহ মানুষদের ওপর নির্যাতন চালায়। নাগরপুর থানা ভবনে পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল।
নাগরপুর উপজেলায় নাগরপুর থানা মসজিদ বধ্যভূমি, বনগ্রাম গণকবর, সারাংপুর গণকবর ও কেদারপুর গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছে।
নাগরপুর উপজেলায় কাদেরিয়া বাহিনী- ও বাতেন বাহিনী খুবই শক্তিশালী ছিল। উভয়ই ছিল স্থানীয় পর্যায়ে গড়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধে এ দুই বাহিনীর অবদান অবিস্মরণীয়। নাগরপুর উপজেলায় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। সেগুলোর মধ্যে নাগরপুর থানা অপারেশন, ঘাসকাউলিয়ার যুদ্ধ, বনগ্রামের যুদ্ধ, কেদারপুর যুদ্ধ ও কোনড়ার যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। নাগরপুর থানা অপারেশন হয় তিন দফায়। প্রথমে ২৫শে জুন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বিনা রক্তপাতে থানা দখল করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পাকসেনারা তা পুনর্দখল করে। দ্বিতীয়বার অপারেশন চলে ১২ই অক্টোবর। এদিন মুক্তিযোদ্ধারা থানার এক মাইলের মধ্যে পৌঁছতেই হানাদার বাহিনী আক্রমণ করে। তৃতীয়বার ৩০শে নভেম্বর মুক্তযোদ্ধারা আবার থানা আক্রমণ করেন এবং পরের দিন ১লা ডিসেম্বর থানা দখল করেন। ২৮শে জুন ঘাসকাউলিয়ার যুদ্ধে কমান্ডারসহ ৮ জন রাজাকার নিহত হয়। ২৫শে অক্টোবর বনগ্রামের যুদ্ধে ৪ জন পাকসেনা ও একজন রাজাকার নিহত হয় এবং ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ২৯শে নভেম্বর কেদারপুর যুদ্ধে কোনো পক্ষই সফল হয়নি। ৪ঠা ডিসেম্বর কোনড়ার যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং পাকবাহিনীর বেশ কয়েকজন সেনা নিহত হয়। এক পর্যায়ে পাকবাহিনী বহু অস্ত্র ফেলে ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়। ৯ই ডিসেম্বর নাগরপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. আবিদুর রহমান, বীর বিক্রম- (পিতা সফিকুর রহমান, সলিমাবাদ), গুল মোহাম্মদ ভূঁইয়া, বীর প্রতীক (পিতা একাব্বর আলী, তেবাড়িয়া পাড়া) ও মো. নাসির উদ্দিন, বীর প্রতীক (পিতা মো. গেদু মিঞা, আন্দিবাড়ি)।
নাগরপুর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— গুল মোহাম্মদ ভূঁইয়া, বীর প্রতীক (২৯শে এপ্রিল ঠাকুরগাঁও ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স শত্রুমুক্ত করার যুদ্ধে শহীদ), এ কে এম শামসুল হক খান সিএসপি (পিতা হাসান খান, আখতাড়াইল), এ কে শামসুদ্দিন সিএসপি (পিতা আফাজ উদ্দিন, গয়হাটা), তোফাজ্জল হোসেন (পিতা বাকাত আলী মিয়া, বনগ্রাম), আবুদল কাদের মিয়া (পিতা সৈয়দ আলী মিয়া, তেবাড়িয়া), লাবিব উদ্দিন (পিতা কমর উদ্দিন মণ্ডল, পাচুলিয়া), আয়নাল মিয়া (পিতা সলেম উদ্দিন মিয়া, স্বল্পনারু), আবদুল বারেক ভূঁইয়া (পিতা পাঞ্জু ভূঁইয়া, পাঁচতারা), জিয়ারত আলী মিয়া (পিতা মোহাম্মদ আলী মিয়া, শশিনারা), আবদুল গনি (পিতা চান মিয়া বেপারী, মিরকুটিয়া), নজরুল ইসলাম (পিতা আবদুল মান্নান, বেতারাইল), চান দেওয়ান মিঞা (পিতা দুদু দেওয়ান মিঞা, তেবাড়িয়া), বাদশা মিঞা (পিতা জমসের আলী মিঞা, পাঁচতারা), মুকুল খান (পিতা সাহেব খান, গোনাপাড়া), আবু তাহের (পিতা আবদুল আজিজ, মিরকুটিয়া), আবদুর রউফ (পিতা এছাক মিয়া, কোনড়া), এবং আহসান উদ্দিন চৌধুরী (পিতা দিদার আলী চৌধুরী, আগতাড়াইল)।
নাগরপুর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো হলো— নাগরপুর কেন্দ্রীয় স্মৃতিসৌধ স্মারক-৭১, বনগ্রাম গণহত্যায় শহীদদের নামফলক, শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ, সলিমাবাদে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতোরণ, আবিদুর রহমান আবিদ বীর বিক্রম সড়ক, শহীদ তোফাজ্জল হোসেন সড়ক, শহীদ গুল মোহাম্মদ ভূঁইয়া বীর প্রতীক সড়ক, মো. নাসির উদ্দিন বীর প্রতীক সড়ক, শহীদ শামসুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়, শহীদ শামসুল হক খান পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এবং শহীদ মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়। [মামুন তরফদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড