You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা (বান্দরবান)

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা (বান্দরবান) পার্বত্য জেলা বান্দরবান ও কক্সবাজার বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। নাইক্ষ্যংছড়ি মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বান্দরবানের সর্বশেষ উপজেলা, যা কক্সবাজারের রামু ও উখিয়া উপজেলার পাশ ঘেঁষে সমান্তরালভাবে অবস্থান করছে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এ নাইক্ষ্যংছড়ির জনগণ উজ্জীবিত ও উদ্দীপ্ত হয়। তারা স্বাধীনতা ও জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হতে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের মতো নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। আগে থেকেই এখানে সক্রিয় ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধিতাকারী সংগঠন পুরুখ্যা বাহিনী। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের এখানে পাকবাহিনীর পাশাপাশি তাদের দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার এবং আরএসও এই তিন বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়৷
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত ও প্রশিক্ষণের জন্য পার্শ্ববর্তী উখিয়া ও কক্সবাজার আওয়ামী লীগ নেতা শমসের আলম চৌধুরী এগিয়ে আসেন। তিনি নাইক্ষ্যংছড়ি ও উখিয়া অঞ্চলের সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হন এবং এ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর নির্দেশে পরিমল বড়ুয়া (ভালুকিয়া, উখিয়া) উখিয়ার পাশাপাশি নাইক্ষ্যংছড়ির দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ, প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন, মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা, অস্ত্র সংগ্রহ, শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ঘুমধুম হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. ইলিয়াস মাস্টার স্কুলের ছাত্রদের নিয়েও সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পরিমল বড়ুয়া শমসের আলম চৌধুরীর কাছ থেকে ১০টি রাইফেলসহ বেশকিছু দেশীয় অস্ত্র, লাঠিসোঁটা আর গোলাবারুদ সংগ্রহ করে ফাত্রাঝিরিস্থ যোগেন্দ্রলাল বড়ুয়ার সিকদারের খামার বাড়ির পাশে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করেন। স্থানীয় জনগণের মধ্য থেকে মুক্তিযোদ্ধা বাছাই করে তাদের তিনি সংগঠিত করেন। এ ক্যাম্পে উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকা থেকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন মো. আলী আকবর, রাজেন্দ্র প্রসাদ বড়ুয়া, কিরণ বিকাশ বড়ুয়া, নজির আহমদ, মুধুসূদন দে, সুরেশ বড়ুয়া, আবদুস শুক্কুর, পরিমল দাশ, মোহন বড়ুয়া, অক্যচিং চাকমা, লালপ্রু চাকমা, ব্ল্যাচু চাকমা, যতীন্দ্র চাকমা, ক্য থোয়াই চাকমা, রি খ্যু মারমা, অংচাচিং চাকমা, ছিদ্দিক আহমদ প্রমুখ। কিরণ বিকাশ বড়ুয়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে অনন্য ভূমিকা রাখেন। এছাড়া ইপিআর সদস্য ইদ্রিস মোল্লা, আবদুল জলিল, ওহাব মিয়া, মোজাম্মেল হক ও নায়েক সালাম, সেনা সদস্য মো. রাজা মিয়া, ফয়েজ আহমেদসহ ১২ জন এই ক্যাম্পে যোগ দেন। নাইক্ষ্যংছড়ি মুক্তিবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ফাত্রাঝিরি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যোগেন্দ্রলাল বড়ুয়া প্রায় ছয় মাস মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করেন। পরবর্তীতে এ ক্যাম্প নাইক্ষ্যংছড়ির আরেক পাহাড়ি এলাকা সোনাইছড়ির ওপরের পাড়া ও নিচের পাড়া নামক স্থানে আলাদাভাবে স্থাপন করা হয়। ওপরের পাড়া ক্যাম্পের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন হাবিলদার আবদুস সোবহান এবং নিচের পাড়া ক্যাম্পের দায়িত্ব পালন করেন ইদ্রিছ মোল্লা। পরিমল বড়ুয়া উভয় ক্যাম্পের টুআইসি-র দায়িত্ব পালন করেন।
ফাত্রাঝিরির ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ চলাকালে পার্শ্ববর্তী ভালুকিয়া পালং মৌলভীর দোকান এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর ৪ ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধ হয়। পরবর্তীতে মুক্তিবাহিনীর তথ্য সেল এবং গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে কৌশলগত কারণে সোনাইছড়ি থেকে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প বাইশারীর কামিরছড়াস্থ মুরংপাড়ায় স্থানান্তর করা হয়। এছাড়া ত্রিশঢেবা এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা নাইক্ষ্যংছড়ি ও উখিয়ার মধ্যবর্তী কচুবনিয়াতে প্রতিরোধ ক্যাম্প স্থাপন করেন।
চট্টগ্রামের কালুরঘাট যুদ্ধ-এ বাঙালি সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন হারুন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় ফাত্রাঝিরি ক্যাম্পে যোগ দেন। মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে তাঁকে সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। এসময় পাকবাহিনী কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যাওয়ার পথে ভালুকিয়া গ্রাম আক্রমণ করবে এমন খবর প্রচারিত হলে কৌশলগত কারণে শমসের আলম চৌধুরী প্রায় সাড়ে তিনশ লোকসহ ক্যাপ্টেন হারুনকে নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বার্মার (মিয়ানমার) ফকিরাবাজার চলে যান। কিছুদিন সেখান থেকেই তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। মিয়ানমারে অবস্থানকালীন ক্যাপ্টেন হারুনের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী, সেনাসদস্য, ইপিআর ও পুলিশ সদস্যরা নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ক্যাপ্টেন হারুন তাঁদের এ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ, মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা ও তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিকনির্দেশনা দেন।
আওয়ামী লীগ নেতা ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী এমপিএ, নুরুল ইসলাম চৌধুরী (ঠাণ্ডা মিয়া চৌধুরী), বাদশাহ্ মিয়া চৌধুরী, এ কে এম মোজাম্মেল হক, মোস্তাক আহমদ চৌধুরী, ডা. শামসুদ্দিন, নুর আহমেদ এমএনএ, আলী আহমদ বিএ এবং ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোস্তাক আহমদ নাইক্ষ্যংছড়ি ও উখিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, পরিচালনা এবং সংগঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। স্থানীয় জনগণের মধ্যে যোগেন্দ্রলাল বড়ুয়া সিকদার, রাধাকান্ত বড়ুয়া সিকদার, সর্বানন্দ বড়ুয়া সিকদার, হাজী মকবুল আহমদ, মাথাই চাকমা, নীলাপ্রু চাকমা হেডম্যান, অরবিন্দ বড়ুয়া, সুদর্শন বড়ুয়া, রাজেন্দ্র প্রসাদ বড়ুয়া, আলী আকবর মেম্বার ও নজির আহমদ, মন্টু চৌধুরী, তেজেন্দ্র চৌধুরী, বক্তার আহমদ চৌধুরী প্রমুখ অত্র অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন।
কমান্ডার হিসেবে বিভিন্ন সময় দায়িত্ব পালন করেন- পরিমল বড়ুয়া, ইদ্রিছ মোল্লা, হাবিলদার আবদুস সোবহান, নুর আহমদ, মো. রাজা মিয়া ও মংশৈ প্রু চৌধুরী প্রমুখ। সহযোদ্ধা হিসেবে বিভিন্নভাবে দায়িত্ব পালন করেন— ইদ্রিছ মোল্লা, আবদুল জলিল, ওহাব মিয়া, আজিজুল হক মাস্টার, রতন কুমার দাশ, মো. রাজা মিয়া, মুধুসূদন দে, মোজাম্মেল হক, নায়েক সালাম, নায়েক ফয়েজ, অলি আহমদ সিপাহী, নজির আহমদ, আবদুস শুক্কুর, পরিমল দাশ, জয়সেন বড়ুয়া, দুদু মিয়া, নায়েক সামাদ, মো. হাছান, রাজেন্দ্র প্রসাদ বড়ুয়া, অরবিন্দ বড়ুয়া, কিরণ বিকাশ বড়ুয়া, রশিদ আহমদ, সুরেশ বড়ুয়া, বেলাল আহমদ, মো. নজু মিয়া, প্রমথেশ বড়ুয়া, অংক্যচিং চাকমা, আলী আকবর, ক্যামরাউ চাকমা, মংচা থোয়াই, যতীন্দ্র চাকমা, ক্যা থোয়াই চাকমা, চাতাই মগ, মংবাছা মারমা, উচা থোয়াই মারমা, হ্যাচু চাকমা, লামাপ্রু মারমা, নোয়ামোহন তঞ্চঙ্গ্যা, কালীচরণ তঞ্চঙ্গ্যা, অংচাচিং তঞ্চঙ্গ্যা, অংবুরু তঞ্চঙ্গ্যা, অংক্য তঞ্চঙ্গ্যা, অংচিং তঞ্চঙ্গ্যা, লালপ্রু চাকমা, নিলকধন তঞ্চঙ্গ্যা, কিনামোহন চাকমা, রিখ্য মারমা, ছিদ্দিক আহমদ, মনোরঞ্জন আইচ, নিরঞ্জন কুমার ধর, রেবতী কুমার শীলসহ আরো অনেকে।
মুক্তিযুদ্ধে নাইক্ষ্যংছড়ি-রামু-উখিয়া অঞ্চলে কয়েকটি বাহিনী ছিল, যার সদস্যরা পাকবাহিনীর ওপর গেরিলা আক্রমণসহ বিভিন্নভাবে আক্রমণ চালান। তাঁরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অপারেশন চালিয়ে পাকবাহিনীর অনেককেই পরাভূত করেন। এ ধরনের বাহিনীর মধ্যে পরিমল বড়ুয়া বাহিনী, ইদ্রিস মোল্লা বাহিনী, সুবাদার নুর আহমদ বাহিনী, মংশৈ প্রু চৌধুরী বাহিনী উল্লেখযোগ্য। এসব বাহিনী দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে অংশ নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা উপজেলার কচুবনিয়ার রাস্তায় ব্যারিকেড স্থাপন করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ রচনা করেন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ইপিআর সদস্য আবদুল জলিল, মো. মোজাম্মেল হোসেন, ফয়েজ আহমদ, নুরুল ইসলাম, আবদুল খালেক, মোহাম্মদ হোছাইন, এম এ ওহাব (রাজা), গোলাম সোবহান, নজির আহমদ, পরিমল দাশ, খায়রুল বশর, আবুল খায়ের, লব কুমার শীল, মুধুসূদন দে, কামাল হোসেন, আলী আকবর, গোলাম সোবহান, নজির আহমদ, কিরণ বিকাশ বড়ুয়া, সুরেশ বড়ুয়া, সংঘদত্ত বড়ুয়া, বঙ্কিম বড়ুয়া, রাজেন্দ্র প্রসাদ বড়ুয়া, অক্যচিং চাকমা, উদিনা চাকমা, কিনামোহন চাকমা, পোয়া মোহন চাকমা, লালপ্রু চাকমা, হ্যাচু চাকমা, যতীন্দ্ৰ চাকমা, চাতাই চাকমা, কালীচরণ চাকমা, উচাথোইন মারমা, মংবাছা, মং চাহ্লা, অং চাহ্লা, রিখ্য মারমা, দুলাল চন্দ্র সেন প্রমুখ অংশ নেন।
১৪ই মে পাকবাহিনী নাইক্ষ্যংছড়িতে অনুপ্রবেশ করে এবং বাইশারী, ঘুমধুম, তুমব্রু, ফাত্রাঝিরিতে ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশ ও ক্যাম্প স্থাপনে মিয়ানমার ভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরএসও সহযোগিতা করে।
পাকবাহিনীকে সহায়তা দানের জন্য নাইক্ষ্যংছড়ি সদর এবং অন্যান্য ইউনিয়নে শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। এছাড়া পূর্ব থেকেই রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন সক্রিয় ছিল।
মো. ছালেহ আহমদকে চেয়ারম্যান করে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হলো— মো. শফিউল আলম, মকবুল আহমদ, মজিদ উল্লাহ, কুদ্দুস মৌলভী, নুরুল হক (চেয়ারম্যান, বাইশারী), আবদুর রহিম (চেয়ারম্যান), রকিম আলী (চেয়ারম্যান), বাচা মিয়া (চেয়ারম্যান), খলিল সিকদার, আরএসও সদস্য আবু সিদ্দিক, বিএ জাফর, আবদুর রশিদ, এজাহার মিয়া প্রমুখ। এছাড়া গোলাম রসুল, মনোয়ার খান, মহসিন প্রমুখকে নিয়ে ঘুমধুম ইউনিয়ন শান্তি কমিটি গঠিত হয়।
রাজাকার কমান্ডার বদিউল আলম ও মো. হারুন, মো. জাকারিয়া, শের আলী, খুইল্যা মিয়া, আমির হোছাইন, ফজর রহমান, হাবিব উল্লাহ, হাজী মোস্তাক, ফজর রহমান মিয়াজী, মকবুল আহমদ, লক্ষ্মীধন তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখকে নিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। এছাড়া ছাব্বির আহমদকে কমান্ডার, মো. কালু, শফিউল আলম, নুরুল হক, জাফর আলম, কালা জব্বার, খেপুরী চাকমা প্রমুখকে সদস্য করে বাইশারী ইউনিয়ন রাজাকার বাহিনী এবং রাজাকার কমান্ডার কাদের মেম্বার ও গুরা মিয়া, নজির আহমদ খলিফা, বদিউর রহমান, আনোয়ার মেম্বার, নজির আহমদ (টুটাইয়া) আরএসও, মোহছেন মিস্ত্রি, নুরুল ইসলাম, দুদু মিয়া, আমির হোসেন, সুলতান আহমদ, কবির আহমদ, হোসেন আহমদ, – হোসেন আহমদ, জাকির আহমদ, ফরিদ আলম, বশির আহমদ, পেয়ার আলী, সুলতান আহমদ, আবদুল জলিল, ওমরা মিয়া প্রমুখকে নিয়ে ঘুমধুম ইউনিয়ন রাজাকার বাহিনী গঠন হরা হয়। মকবুল আহাম্মদকে কমান্ডার এবং আবু ছিদ্দিক, আবদুল জলিল প্রমুখকে নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের সমর্থক রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন-এর সদস্যরা পাকবাহিনীকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এমনSিavedয়ে সহায়তা করে। এ বাহিনীর উল্লেখযোগ্য সদস্যদের মধ্যে ছিল আবু ছিদ্দিক, বি এ জাফর, ং আবদুর রশীদ, এজাহার মিয়া, মো. শফিউল আলম, মকবুল আহমদ, ছালেহ আহমদ, আবু ছিদ্দিক, মছিউদ্দৌলা, মজিদ উল্লাহ, মৌলভী ফরিদুল আলম, নুরুল ইসলাম, দিল মোহাম্মদ, ফরিদুল আলম, মাস্টার দলিল বখ্শ প্রমুখ। তারা শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সঙ্গে মিলে একত্রে কাজ করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা, নির্যাতন, মানুষের ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ইত্যাদি অপকর্মে লিপ্ত ছিল। তারা পাকবাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ও তাদের ঘর-বাড়ি দেখিয়ে দিত। রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার কাদের মেম্বার (সভাপতি, ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়)-এর নির্দেশে বিহারি গোলাম রসুল, মনোয়ার খান ও মহসিন এদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধা মো. ইলিয়াস মিয়া (ইলিয়াস মাস্টার)-কে উখিয়া থানায় ধরে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁকে অমানুষিক নির্যাতন করে কক্সবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে তারা হত্যা করে।
পাকবাহিনী তুমব্রু যাওয়ার পথে রুইজ্যা বেগম নামে এক নারীকে ধর্ষণ করে। এছাড়া রত্নদর্শী বড়ুয়া, করুণাময়ী বড়ুয়া, গোল বাহার ও কমলাজান বিবি পাকবাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত হন।
১৪ই মে পাকবাহিনী তুমব্রুতে স্থানীয় আজিজুল হক মাস্টারের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। ১৭ই মে তারা রাজাকার কমান্ডার কাদের মেম্বরের সহায়তায় তুমব্রু বাজার এলাকার মনোরঞ্জন আইচ, নিরঞ্জন ধর, অশ্বিনী ধর, দুর্গাচরণ ধর, মহেন্দ্র ধর, বসন্ত কর্মকার, রমণী ধর, লব কুমার শীল, দুলাল চন্দ্র সেনের বাড়ি এবং নজির আহমদের দোকানে অগ্নিসংযোগ করে। মুক্তিযোদ্ধা লাব্রে মুরং-এর ঘরবাড়িতে তারা লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা ফাত্রাঝিরির পার্শ্ববর্তী ভালুকিয়ার জমিদার কালাচাঁদ সিকদারের সেগুনকাঠের ঐতিহ্যবাহী ঘরটিও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এছাড়া তারা ভালুকিয়া, রত্নাপালংসহ পাশ্ববর্তী গ্রামসমূহের শমসের আলম চৌধুরীর বাড়ি, যোগেন্দ্রলাল বড়ুয়া সিকদারের বাড়ি, যতীন্দ্রলাল সিকদার, সর্বানন্দ সিকদার, সুদর্শন বড়ুয়া, রাজেন্দ্র প্রসাদ বড়ুয়া, রাধাকান্ত সিকদার, বেলাল আহমদ মেম্বার, বাদশাহ্ মিয়া চৌধুরী, নূর আহমদ চৌধুরী, বদিয়ার রহমান সিকদার, আলী আহমদ বিকম প্রমুখের বাড়ি-ঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়া পাকবাহিনীর হাতে আবুল হোসেন, ভট্ট বড়ুয়া মহাজন, নূর আহমদ, নির্মল শীল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এ টি এম জাফর আলম নির্মমভাবে নিহত হন।
দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে নাইক্ষ্যংছড়ির মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মুক্তিকামী মানুষকে ধরে পাকবাহিনী কক্সবাজারের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবিরে নিয়ে এসে অমানুষিক নির্যাতন করত। টেকনাফের সেনাক্যাম্প ছিল এ অঞ্চলে পাকবাহিনীর বন্দিশিবির। বাইশারীর কামিরছড়া এবং কক্সবাজারে বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে।
ভৌগোলিকভাবে ঘন জঙ্গলাকীর্ণ দুর্গম পাহাড় আর অরণ্যঘেরা নাইক্ষ্যংছড়িতে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সে-সবের মধ্যে মুরংপাড়ার যুদ্ধ, ভালুকিয়া রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ, বাইশারী আরএসও ঘাঁটি আক্রমণ, বালুখালী রাজাকার ক্যাম্প, শান্তি কমিটির নেতা বুজুরুচ মিয়ার বাড়ি আক্রমণ ও হলদিয়া পালং পাতাবাড়ি আক্রমণ উল্লেখযোগ্য। ২৫শে নভেম্বর বাইশারী ইউনিয়নের কামিরছড়া এলাকার মুরংপাড়ায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ৬ ঘণ্টাব্যাপী সম্মুখ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকবাহিনীর ৮ জন সদস্য নিহত হয়। পাকবাহিনীর ৯ জন সদস্য আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা লাৱে মুরং শহীদ হন। পাকসেনারা লাব্রে মুরং-এর বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়।
বাইশারীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাজাকারদের যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে। পরিমল বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা বাইশারী আরএসও ঘাঁটি আক্রমণ করেন। এ যুদ্ধে ৪৫টি অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা বালুখালী শান্তি কমিটির নেতা বুজুরুচ মিয়ার বাড়ি এবং রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। আক্রমণে বুজুরুচ মিয়া নিহত হয়। তুমব্রুতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে রাজাকারদের যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে রাজাকাররা পিছু হটে এবং আত্মসমর্পণ করে। ঘুমধুম কচুবনিয়ার পাহাড়ে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। সোনাইছড়িতে রাজাকারদের পেট্রল পার্টির সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এছাড়া, নাইক্ষ্যংছড়ির মুক্তিযোদ্ধারা পার্শ্ববর্তী লামা, উখিয়া ও কক্সবাজারের বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেন। ১৬ই ডিসেম্বর নাইক্ষ্যংছড়ি হানাদারমুক্ত হয়। তবে পাকবাহিনীর সহযোগী আরএসও বাহিনী স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আরো কিছুদিন নাইক্ষ্যংছড়িতে সক্রিয় ছিল।
নাইক্ষ্যংছড়ির শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. ইলিয়াস মাস্টার (প্রধান শিক্ষক, ঘুমধুম হাই স্কুল; স্কুলের সভাপতি কাদের মেম্বর ছিল রাজাকার কামন্ডার। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় ইলিয়াস মাস্টার কাদের মেম্বরের রোষদৃষ্টিতে পড়েন। পাকিস্তানের সমর্থক বিহারি গোলাম রসুল, মনোয়ার খান ও মো. মহসিনের সহযোগিতায় কাদের মেম্বার তাঁকে ধরে উখিয়া থানায় নিয়ে আসে। সেখানে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে অমানুষিক নির্যাতনের পর কক্সবাজার বধ্যভূমিতে তাঁকে হত্যা করে পাকবাহিনী) ও লাব্রে মুরং (মুরংপাড়ার যুদ্ধে শহীদ)। মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদরে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। [অনির্বাণ বড়ুয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!