You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে নাচোল উপজেলা (চাঁপাইনবাবগঞ্জ)

নাচোল উপজেলা (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) ঐতিহাসিক তেভাগা-আন্দোলন-খ্যাত একটি রাজনীতি-সচেতন এলাকা। এ উপজেলা ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। ইউনিয়নগুলো হলো— কসবা, নাচোল, ফতেহপুর ও নিজামপুর।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ-এর কাছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকলে বাঙালিদের মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ভুট্টোর সহযোগিতায় ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ইয়াহিয়া খান সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করায় বাঙালিদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন। পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য স্থানের মতো নাচোলের সাধারণ মানুষও এ আন্দোলনে যোগ দেয়। ‘জয় বাংলা’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’ ইত্যাদি স্লোগান সৰ্বত্ৰ উচ্চারিত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের দিকনির্দেশনামূলক ভাষণের পর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নাচোল শাখার সভাপতি মো. মেহের আলী (পিতা সোহরাব আলী)-র নেতৃত্বে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ ও সশস্ত্র যুদ্ধের কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়৷
৮ই মার্চ নাচোল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের কর্মী এবং আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে
মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রথম পর্যায়ে নাচোল থানা থেকে প্রাপ্ত ২টি রাইফেল, নাচোলের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগৃহিত ১০০টি একনলা ও দুইনলা বন্দুক নিয়ে ৮ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত একটানা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। পরে নাচোল ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ভারতে যাওয়ার পর নাচোলের ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বিএলএফ – বা মুজিব বাহিনী-র কেন্দ্রীয় নেতাদের যোগাযোগ হয়। নাচোলের ছাত্রনেতাদের অনেকে মুজিব বাহিনীর সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এখানকার ছাত্রনেতাদের মধ্যে যাঁরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন, তাঁরা হলেন- মো. মেহের আলী, মো. আতাউর রহমান (পিতা হানিফ), আব্দুল লতিফ, আব্দুর রাজ্জাক, আ হ ম আব্দুল্লাহ (পিতা রহমতুল্লাহ; সম্প্রতি সরকারের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন), মো. সাইফুল ইসলাম প্রমুখ। নাচোলের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন আনোয়ার হোসেন (শালালপুর)।
পাকবাহিনী যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য নাচোলের প্রায় ২০০ প্রতিরোধযোদ্ধা নাচোল-আমনুরা রেললাইনের ৩টি সেতু ধ্বংস করে দেন। নাচোল-আমনুরা সড়ক পথের কয়েকটি সেতুও ধ্বংস করা হয়। এসবের ফলে নাচোলে পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশ বিলম্বিত হয়। পরে হানাদারদের প্রবল আক্রমণে সকল প্রতিরোধ চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
নাচোলে পাকবাহিনী কোনো ক্যাম্প স্থাপন করেনি। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও অন্যান্য উপজেলা থেকে নাচোলে এসে তারা নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড চালাত।
নাচোলে যারা পাকবাহিনীর সহযোগী ও রাজাকার হিসেবে কাজ করে, তারা হলো- জহুর মাস্টার (মুরাদপুর), খোদা বকস (ইউপি সদস্য), আব্দুল মান্নান (ইউপি চেয়ারম্যান), লুৎফর রহমান (ইউপি মেম্বার), মতিউর . রহমান (ইউপি মেম্বার), লালচান্দ মণ্ডল (ইউপি মেম্বার), মুরশেদ মিয়া, গিয়াস উদ্দিন (নিজামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান), জমসেদ আলী (নিজামপুর), আব্দুর রহমান মাস্টার (নাচোল), আব্দুল হাফিজ (নাচোল), লুকু (নাচোল), মো. আজাহার আলি (ইসলামপুর), মো. রাব্বিল, করিম বিহারী, তৈয়ব উকিল প্রমুখ।
১৯শে এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে পাকবাহিনী আমনুরায় এসে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। হানাদারদের আক্রমণ ও গুলিবর্ষণে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ২৮শে এপ্রিল পাকবাহিনী নাচোল থানা আক্রমণ করলে উভয় পক্ষে যুদ্ধ হয়। এটি নাচোল থানা যুদ্ধ নামে পরিচিত। এতে তিনজন বাঙালি সিপাহি শহীদ হন। যুদ্ধের পর পাকবাহিনী থানার দখল নিয়ে থানা ভবন পুড়িয়ে দেয়। পরে তারা থানার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে আক্রমণ করে। তারা আব্দুল মালেক চৌধুরী, আব্দুল জাব্বার মণ্ডল, মেহের আলী, নুহ আলম, নাজিম, ডা. জামাল শেখ ও মুজিবুর রহমানের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। থানার হিন্দু-প্রধান গ্রামগুলোতে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা নিয়মিত অত্যাচার অগ্নিসংযোগ করত। হিন্দু সম্প্রদায়ের ৬০ শতাংশ মানুষের বাড়ি তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
নাচোলের রাজাকাররা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়ি থেকে নগদ অর্থ, সোনা ও গবাদি পশু ছিনিয়ে নিত। করিম বিহারি ও অন্য রাজাকাররা অসহায় নারীদের ধরে নিয়ে মোনাকোষা (গোমস্তাপুর থানা) ক্যাম্পে পাঠাত।
নাচোলে কাদিকলা পাড়ার খাজা নামে এক নারীকে জহুর মাস্টার ও লুকু রাজাকার রহনপুরের পাক ক্যাম্পে পাঠায়। সেখানে তার ওপর নির্মম পাশবিক নির্যাতন করা হয়। রাজাকাররা সব সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্যাদি পাকসেনাদের সরবরাহ করত। করিম বিহারির দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নাচোলের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আমিরুল ইসলাম (নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের ছাত্র, শিশু কন্যাকে দেখতে বাড়িতে এসেছিলেন)-কে পাকবাহিনী আটক এবং পরে হত্যা করে। তাঁর লাশ পাওয়া যায়নি। নাচোলের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন ও সাধারণ মানুষদের ধরে উপজেলার আমনুরা ও পার্শ্ববর্তী গোমস্তাপুর থানার রহনপুর ও মোনাষায় নিয়ে বন্দি করে রেখে নির্যাতন করা হতো। নাচোল থানার পাশে একটি গণকবর রয়েছে। সেখানে নাচোল থানা যুদ্ধে শহীদ ৩ জন পুলিশ সদস্যের কবর রয়েছে।
নাচোলে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের একাধিক যুদ্ধের ঘটনা ঘটে। ২৮শে এপ্রিল পাকবাহিনী নাচোল থানা আক্রমণ করে। থানার বাঙালি পুলিশ সদস্যরা তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ করেন। এ যুদ্ধে থানার সিপাহি মো. আব্দুল মালেক, মেছের আলী ও সিরাজুল ইসলাম শহীদ হন।
নাচোল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান ও তাঁর অধীনস্থ গেরিলারা বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র পাহারায় থাকতেন। এলাকার রাজাকাররা প্রায়ই তাঁর বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হতো। প্রতিরাতে রাজাকারদের বাড়ির আশেপাশে গুলি করে তাঁরা তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে রাখতেন। ১৫ই ডিসেম্বর নাচোল উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
নাচোলের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- সিপাহি আবুল কাসেম, সিপাহি মো. সিরাজুল ইসলাম, কনস্টেবল মেছের আলী, কনস্টেবল মো. আব্দুল মালেক, আনিসুর রহমান (নাচোল কলেজের ছাত্র, সদর উপজেলার মহানন্দা নদীর তীরে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সহযোগী যোদ্ধা হিসেবে শহীদ হন) এবং মো. আমিরুল ইসলাম।
নাচোলে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে কিছু প্রতিষ্ঠান, স্মৃতিসৌধ ও স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। সেগুলো হলো— শহীদ স্মৃতি কলেজ, নাচোল ডিগ্রি কলেজ স্মৃতিসৌধ এবং নাচোল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় স্মৃতিস্মারক। [মো. মেহেদি হাসান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!