You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে নলডাঙ্গা উপজেলা (নাটোর) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে নলডাঙ্গা উপজেলা (নাটোর)

নলডাঙ্গা উপজেলা (নাটোর) ১৯৭১ সালে নাটোর সদর থানার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০১৩ সালের ২৭শে মে এটি একটি স্বতন্ত্র থানার মর্যাদা লাভ করে। নাটোর সদর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। ১৯৭১ সালে নাটোর সদর থানাকে কেন্দ্র করেই নলডাঙ্গায় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়।
১৯৭১ সালের ৮ই মার্চ কানাইখালি মাঠে এক বিশাল জনসভায় শংকর গোবিন্দ চৌধুরী এমপিএ, আশরাফুল ইসলাম মিয়া এমপিএ, রফিক উদ্দিন সরকার (আওয়ামী লীগ), খন্দকার আবু আলী (ন্যাপ), হেদায়েত উল্লাহ প্রমুখ নেতা সাধারণ জনগণকে পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে আহ্বান জানান। বিক্ষুব্ধ জনতা সেদিন থেকেই কোথাও সংগ্রাম কমিটি, কোথাও জয় বাংলা বাহিনী গঠন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। নলডাঙ্গার মানুষ নাটোর শহরের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে প্রতিটি কর্মসূচিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। ১৩ই মার্চ দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা এবং পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ সম্পর্কে নলডাঙ্গায় একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় দেশকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে নলডাঙ্গার ছাত্র-যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানানো হয়। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে চিন্তা রায় (হাঁপানিয়া; পিপরুল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য), মনছুর দেওয়ান (হাঁপানিয়া) প্রমুখের নেতৃত্বে আবদুস সামাদ দেওয়ান, চিন্ময় রায়, চিত্তরঞ্জন রায় (পিতা চিন্তা রায়), খোরশেদ আলী, অপরেশ লাহিড়ী, জিতেন্দ্র নাথ, আবদুস সাত্তার প্রমুখ নাটোরে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তাঁরা ভারত থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা দেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে গেরিলা হামলা চালিয়ে পাকবাহিনীর মনে ভীতির সঞ্চার করেন। তাঁদের মধ্যে নাটোরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাক হোসেন উলফাতের ছোটভাই আহম্মদ হোসেন চম্পা ছিলেন অন্যতম। উপর্যুক্ত নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের সময় নলডাঙ্গায় সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন এবং কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন চিত্তরঞ্জন রায়।
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- কতৃর্ক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকেই নলডাঙ্গার মানুষ পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নেয়। ৩০শে মার্চ লালপুরের ময়নার প্রতিরোধযুদ্ধ নলডাঙ্গার মানুষকে দারুণভাবে উৎসাহিত করে এবং তাদের মনে সাহস যোগায়। উৎসাহী জনতা নলডাঙ্গার রেললাইন তুলে ফেলতে উদ্যত হয়।
১৩ই এপ্রিল পাকবাহিনী নাটোর শহরে প্রবেশ করে। এর পরদিন তারা দিঘাপতিয়ার জমিদার বাড়ির পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে নলডাঙ্গার দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু রাস্তা খারাপ থাকায় কিছুদূর এসে ফিরে যায়। নলডাঙ্গায় পাকবাহিনীর কোনো স্থায়ী ক্যাম্প ছিল না। তবে তারা হাঁপানিয়ার বটতলায় একটি রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করে এবং নলডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন ও রেলওয়ে ব্রিজ পাহারার দায়িত্ব দেয় রাজাকার বাহিনীর ওপর।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নলডাঙ্গায় পাকবাহিনীর সহযোগী শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী বেশ তৎপর ছিল। শান্তি কমিটির কুখ্যাত দালাল ও রাজাকারদের মধ্যে আবু সাইদ সরদার (নলডাঙ্গা), ডা. নাছির উদ্দিন তালুকদার (রামসা কাজিপুর), সেনভাগের আব্দুল করিম শিকদার, আলিম উদ্দিন মণ্ডল, আহসান খোন্দকার, মোন্তাজ আলী (অবাঙালি), জামাল শিকদার, ইয়াকুব আলী মাস্টার, পূর্ব মাধনগরের হাবিবুর রহমান, মায়েন উদ্দিন, আব্দুল খালেক, পশ্চিম মাধনগরের মোখলেসুর রহমান, রমজান আলী, ছলিমউদ্দিন, আইয়ুব আলী, বাঁশিলার আবদুল কাদের খান, কছিম উদ্দিন, খাদেমুল ইসলাম (শিবপুর) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
নাটোর দখলের পর পাকবাহিনী মালঞ্চি বাজারে গুলি চালিয়ে ত্রাসের সৃষ্টি করে। এ-সময় পালাতে গিয়ে তাদের গুলিতে তিনজন সাধারণ মানুষ আহত হয়। পাকসেনারা বাজারের অধিকাংশ দোকানে অগ্নিসংযোগ করে। মে মাসের প্রথমদিকে পাকবাহিনী রাজাকারদের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দু সন্দেহে চারজন যুবককে বাসুদেবপুর হাইস্কুলে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের লুঙ্গি খুলে দেখে তারা কোন ধর্মের। চারজনের মধ্যে একজন ছিল হিন্দু। অতঃপর চারজনকেই গুলি করে হত্যা করে। রাজাকাররা নলডাঙ্গার
আশপাশের গ্রাম থেকে নিরীহ মানুষদের জোরপূর্বক ধরে এনে পালাক্রমে নলডাঙ্গা রেলওয়ে ব্রিজ পাহারায় নিয়োজিত করত। কেউ অন্যথা করলে তাদের ওপর নির্যাতন চালাত। তবে এসব লোক ব্রিজ পাহারা দিলেও গোপনে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও সহযোগিতা দান করত। আগস্ট মাসে পাকবাহিনী পিপরুল ইউনিয়নের বাঁশবাগের একজন গৃহবধূকে জোরপূর্বক পার্শ্ববর্তী তিলক্ষেতে নিয়ে তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এতে তিনি সেখানেই মারা যান। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হেদায়েত উল্লাহকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে আব্দুল করিম শিকদার (পিপরুল ইউনিয়নের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান) ও আব্দুল কাদের খান (বাঁশিলা) হত্যা করে।
নলডাঙ্গা উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের বিরুদ্ধে চারটি অপারেশন পরিচালনা এবং পাকবাহিনীর সঙ্গে দুটি সম্মুখ যুদ্ধ করেন। সেগুলো হলো- নওপাড়া রেলওয়ে ব্রিজ অপারেশন, ব্রহ্মপুর হাট অপারেশন, খোলাবাড়িয়ার যুদ্ধ আগদিঘা বিদ্যালয় অপারেশন নলডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন যুদ্ধ এবং মহিষমারী রেলওয়ে ব্রিজ অপারেশন। নওপাড়া রেলওয়ে ব্রিজ অপারেশন পরিচালিত হয় আগস্ট মাসে মুক্তিযোদ্ধা জামাল খলিফার নেতৃত্বে। খোলাবাড়িয়া ও বাঁশিলার মাঝামাঝি এ ব্রিজে রাজাকাররা সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকত এবং মাঝে-মাঝে তারা গ্রামে ঢুকে সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালাত। ঘটনার দিন মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজে পাহারারত রাজাকারদের ওপর আক্রমণ চালালে তারা পালিয়ে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজটি উড়িয়ে দেন। ব্রহ্মপুর হাট অপারেশন পরিচালিত হয় অক্টোবর মাসের শেষদিকে আহম্মদ হোসেন চম্পার নেতৃত্বে। হাটের দিন রাজাকাররা প্রায়শই দোকানিদের নিকট থেকে বিনামূল্যে জিনিসপত্র নিয়ে যেত। না দিতে চাইলে কিংবা প্রতিবাদ করলে তারা তাদের মারধর করত। অনেক সময় হাটুরেদের কাছ থেকেও রাজাকাররা জিনিসপত্র কেড়ে নিত। তাদের এই অত্যাচার বন্ধ করার উদ্দেশ্যে আহম্মদ হোসেন চম্পা ছদ্মবেশে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাসহ হাটের ক্লাবঘর সংলগ্ন একটি চায়ের দোকানে অবস্থান নেন এবং কৌশলে রাজাকারদের অস্ত্র হস্তগত করেন। এ-সময় ১৫-১৬ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। খোলাবাড়িয়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৪ঠা থেকে ৭ই নভেম্বর পর্যন্ত। নেতৃত্বে ছিলেন কমান্ডার চিত্তরঞ্জন রায়। এ-যুদ্ধে আব্দুর রাজ্জাক পাঠান নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অপরদিকে ১৫-২০ জন পাকসেনা নিহত হয়। এ ঘটনার পর পাকবাহিনী ঐ গ্রামের ৬ জন বৃদ্ধকে গুলি করে হত্যা করে এবং লুণ্ঠন শেষে গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়।
আগদিঘা বিদ্যালয় অপারেশন পরিচালিত হয় ১০ই নভেম্বর সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধা ফিরোজ মিয়ার নেতৃত্বে। বিদ্যালয়ে শান্তি কমিটি আহুত একটি সভায় রাজাকাররা উপস্থিত হলে সেখানে গোপনে এম্বুশে থাকা দুই প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা তাদের অতর্কিতে আক্রমণ করেন। এতে ১১ জন রাজাকার নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আত্মসমর্পণ করে। ৮ই ডিসেম্বর খোলাবাড়িয়া যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা হন। নলডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৫ই ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জন রায়ের নেতৃতে। এতে আত্রাই থানার অহিদুর রহমানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীও যোগ দেয়। এ- যুদ্ধে অনেক পাকসেনা হতাহত হয়।
মহিষমারী রেলওয়ে ব্রিজ অপারেশন পরিচালিত হয় ১৩ই ডিসেম্বর ব্রিজে পাহারারত রাজাকারদের হটানোর জন্য। এতে অংশগ্রহণ করেন চিত্তরঞ্জন রায়, কাউসার হোসেন, আব্দুস সাত্তার, রিয়াজ উদ্দিন, কাজী কালাম, আবু বকর সিদ্দিক, দিলীপ সরকার প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা। রিয়াজ উদ্দিন প্রথমে একজন কৃষকের বেশে রাজাকারদের কাছে যান এবং অন্য মুক্তিযোদ্ধারা অনতিদূরে মাছ বিক্রেতার ছদ্মবেশে নৌকায় সশস্ত্র এম্বুশে থাকেন। রিয়াজ উদ্দিন রাজাকারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে কৌশলে রাইফেল চালানো শেখার ভান করেন। এক পর্যায়ে তিনি অপেক্ষমাণ মুক্তিযোদ্ধাদের ইশারা করলে তাঁরা নৌকা থেকে ব্রিজের কাছে এসে নামেন। সঙ্গে- সঙ্গে রিয়াজ উদ্দিন এক রাজাকারের রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে ‘হ্যান্ডস আপ’ বলতেই মুক্তিযোদ্ধারা এসে রাজাকারদের ঘিরে ফেলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় দিশেহারা রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে এবং ব্রিজটি রাজাকারমুক্ত হয়। ১৮ই ডিসেম্বর নলডাঙ্গা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
নলডাঙ্গা উপজেলায় একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তিনি হলেন আব্দুর রাজ্জাক পাঠান (পিতা আব্দুল আজিজ পাঠান, মাইজদিঘা)। তিনি খোলাবাড়িয়ার যুদ্ধে বাঙ্কারে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন এবং খোলাবাড়িয়া গ্রামেই তাঁকে কবরস্থ করা হয়। তাঁর মা পাতু বিবি সেই যুদ্ধে খুবই সাহসী ভূমিকা
পালন করেন।
নলডাঙ্গায় ‘শহীদ নাজমুল হক কলেজ’ রয়েছে। শহীদ নাজমুল হক সরকারের স্মরণে এটি প্রতিষ্ঠিত। নাজমুল হক সরকার ১৯৭০ সালে রাজশাহী-৮ আসন (চারঘাট) থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমএনএ নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। ১৯৭১ সালের মে মাসে পাকবাহিনী তাঁকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর তাঁর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাঁর বন্ধু নলডাঙ্গার এডভোকেট সাইফুল ইসলাম তাঁর নামে এই কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭২ সালের ১লা জানুয়ারি কলেজটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন জাতীয় নেতা এ এইচ এম কামারুজ্জামান। [এস এম জি মহিউদ্দিন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড