You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে নলছিটি উপজেলা (ঝালকাঠি)

নলছিটি উপজেলা (ঝালকাঠি) ঝালকাঠি সদর থেকে ১২ কিমি পূর্বে অবস্থিত। এ উপজেলার উত্তরে ঝালকাঠি সদর ও বরিশাল সদর উপজেলা, পূর্বে বরিশাল সদর ও বাকেরগঞ্জ উপজেলা, পশ্চিমে রাজাপুর ও ঝালকাঠি সদর উপজেলা ও দক্ষিণে বাকেরগঞ্জ উপজেলা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এখানে আওয়ামী লীগ মনোনীত আবদুল মান্নান এমএনএ এবং কবির উদ্দিন আহমেদ চান্দু মিয়া এমপিএ নির্বাচিত হন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিলে সারা দেশের ন্যায় এখানকার মানুষ ক্ষুব্ধ হয়। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণে নলছিটি উপজেলার সর্বস্তরের জনগণ স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়। তারা কবীর উদ্দিন আহমেদ চান্দু মিয়া এমপিএ-র নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়। ৮ই মার্চ তাঁর নেতৃত্বে উপজেলা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সংগ্রাম কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- মৌজে আলী সরদার, ডা. বাসেত লস্কর, মোক্তার হোসেন, রুস্তম আলী, জেন্নাত আলী, মফেজ মোল্লা, মতি খান, তাহের উদ্দিন প্রমুখ। অচিরেই কবীর উদ্দিন আহমেদ চান্দু মিয়া এমপিএ পাকিস্তানি বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করলে সংগ্রাম কমিটির কার্যক্রম কিছুটা শিথিল হয়ে পড়ে। এ-সময় অধ্যক্ষ এম এ বায়েজিদ উপজেলা সংগ্রাম পরিষদের কার্যক্রম চালিয়ে যান।
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর সংগ্রাম কমিটির তত্ত্বাবধানে নলছিটি মার্চেন্টস হাইস্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক তোফাজ্জেল হোসেন আকন এবং সূর্যপাশা গ্রামের পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার আবদুল মজিদের নেতৃত্বে পুরাতন বাজারস্থ খেলার মাঠে কাঠের তৈরি ডামি রাইফেল ও বাঁশের লাঠি দিয়ে দেড় শতাধিক ছাত্র-যুবককে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। যশোর সেনানিবাসের ২৫নং বেলুচ রেজিমেন্টে কর্মরত মো. সেকান্দার আলী মিয়া গ্রামে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মো. খলিলুর রহমান (শংকরপাশা), আবদুর রব (কুশঙ্গল), আবদুল ওয়াহেদ শরীফ (ভবানীপুর), আবদুল হক ব্যাপারী (দক্ষিণ কামদেবপুর), আবদুর রশিদ হোসেন (দক্ষিণ কামদেবপুর), শরীফ আলাউদ্দিন আলো (দক্ষিণ কামদেবপুর), আবদুল আউয়াল (কাঠিপাড়া), মো. অলিউল ইসলাম (উত্তমাবাদ) প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরো জোরদার করা হয়। বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম মঞ্জু এমএনএ প্রশিক্ষণ কাজে ব্যবহারের জন্য দশটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ও দুই কার্টুন গুলি বরিশাল থেকে নলছিটিতে নিয়ে আসেন। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ফয়রা গ্রামের আলতাফ মাহমুদের বাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয়। এছাড়া সুবিদপুর গ্রামের আলাউদ্দিন হাওলাদারের বাড়ি, সেকেন্দার আলী মানপাশার আবদুল হামিদ মল্লিকের (চেয়ারম্যান) বাড়ি, মো. অলিউল ইসলামের নেতৃত্বে চাচৈর
প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মানপাশা হাইস্কুলে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে নলছিটির অনেক মুক্তিযোদ্ধা উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারত গমন করেন। তাঁদের একজন নলছিটির সমীরলাল দত্ত কলকাতার সল্ট লেক ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মো. সেকেন্দার আলী মিয়া (বিরঙ্গল)। সিভিল চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ছাত্রনেতা আলতাফ মাহমুদ। এছাড়া অধ্যক্ষ এম এ বায়েজিদ, ডা. বাসেত লস্কর, মোক্তার হোসেন, রুস্তম আলী, জেন্নাত আলী, মতি খান, তাহের উদ্দিন, খলিলুর রহমান (শংকরপাশা), আলতাফ মাহমুদ (কুশঙ্গল) প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ছাত্রলীগ-এর সহ-সভাপতি ছিলেন কুশঙ্গল গ্রামের আলতাফ মাহমুদ (ঝালকাঠি কলেজের বিএ শ্রেণির ছাত্র)। তিনি তাঁর বড়ভাই মজিবুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। জুন মাসে থানা কমান্ডার মো. সেকেন্দার আলী মিয়াকে নিয়ে তাঁরা স্থানীয় একটি বাহিনী গড়ে তোলেন, যা সেকান্দার-আলতাফ বাহিনী নামে পরিচিত। এ বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে কয়েকটি সফল অভিযান পরিচালনা করে। ৯ই আগস্ট সেকান্দার- আলতাফ বাহিনীর সদস্যরা কাঁঠালিয়া থানা আক্রমণ করে এবং পুলিশের সকল অস্ত্র কেড়ে নেয়। ঐসব অস্ত্র পরবর্তীতে তাঁরা প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধে ব্যবহার করেন।
২৫শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকাসহ সারা দেশে গণহত্যা শুরু করলে ঝালকাঠিসহ নলছিটির মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় ছাত্র- যুবকদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও নদী পথে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ঝালকাঠি ও বরিশালের জন্য গাবখান চ্যানেল গুরুত্বপূর্ণ জলপথ। এ পথে হানাদাররা গানবোটে খুলনা থেকে আসা-যাওয়া করত। ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা একটি ভাসমান ফ্লাট ডুবিয়ে গাবখান চ্যানেলে পাকবাহিনীর যাতায়াতে বাঁধার সৃষ্টি করেন। এছাড়া স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বরিশাল-নলছিটি সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। ২৭শে এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী ঝালকাঠি দখল করে। পরবর্তীতে তারা নলছিটি উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে। নলছিটিতে পাকবাহিনী স্থায়ীভাবে না থাকলেও নলছিটি থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে সেখানে পাকিস্তানি পুলিশ, মিলিশিয়া এবং রাজাকাররা অবস্থান করত। এছাড়া মার্চেন্টস হাইস্কুল রোডস্থ আমির গাজীর বাড়িতে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ঝালকাঠি-বরিশাল যাওয়া-আসার পথে তারা সুগন্ধা নদীতে গানবোট থামিয়ে নলছিটি শহর ও তার আশপাশের গ্রামে আক্রমণ করত।
হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তাদানের জন্য নলছিটি উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। শান্তি কমিটির সভাপতি ছিল আমির গাজী এবং সম্পাদক ছিল এহসান আলী খান। মাহমুদ চৌধুরী অনুরাগ, মাওলানা গোলাম মোস্তফা ও আবদুল মালেক মৃধা, ইউসুফ আহম্মেদ খান (কুড়িপট্টি), হাতেম হাওলাদার (ক্ষিরাপট্টি), ছোবহান মোল্লা (গোদন্ডা), হাতেম খান (কৌকিলা) ছিল শান্তি কমিটির উল্লেখযোগ্য সদস্য। রাজাকারদের মধ্যে বজলু মোল্লা (তৌকাঠী), আবদুল খালেক ফকির (কাঠীপাড়া), এনসান আলী খান (মালিপুর) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। তারা পাকবাহিনীর গণহত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনে সহায়তা করত। তারা মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দু পরিবারের সদস্যদের ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন করে এবং অনেক নারীকে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। ১৩ই মে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার অভিযোগে নলছিটি বন্দরের কয়েকজন ব্যবসায়ীকে থানা ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে যায়। দুদিন আটকে রাখার পর ১৫ই মে রাতে নলছিটি তামাক পট্টি খালের (বর্তমান থানার খাল) পশ্চিম পাড়ে সুগন্ধা নদীর তীরে গুলি করে তাদের হত্যা করে, যা সুগন্ধা নদীতীর গণহত্যা নামে পরিচিত। এ বধ্যভূমিতে আরো অনেককে হত্যা করা হয়। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা এদের পরিবার-পরিজনদের ওপরও অমানুষিক নির্যাতন চালায় এবং তাদের বাড়িঘর লুট করে। ১লা জুন বিরাট গ্রাম থেকে পুলিশ ও রাজাকার বাহিনী বরিশাল বারের আইনজীবী জিতেন্দ্রলাল দত্ত, তাঁর দুই পুত্র সাংবাদিক মিহিরলাল দত্ত ও সুধীরলাল দত্তসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজনকে ধরে ঝালকাঠি নিয়ে আসে। ৩রা জুন ঝালকাঠির ওসি সেকেন্দার আলীর নির্দেশে সুধীরলাল দত্তসহ ১১ জনকে পৌরসভার সম্মুখের বধ্যভূমিতে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। পরবর্তীতে ১৫ই অক্টোবর রাজাকার বাহিনী এডভোকেট জিতেন্দ্রলাল দত্ত এবং মিহিরলাল দত্তকে বরিশালের বাসা থেকে ধরে সিএন্ডবি ১নং পুল বধ্যভূমিতে নিয়ে যায়। সেখানে গুলিতে এডভোকেট জিতেন্দ্রলাল দত্ত শহীদ হন এবং মিহিরলাল দত্ত গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বেঁচে যান। শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা নলছিটি বন্দরে দশরথ কুণ্ডু, কৃষ্ণ মোহন নন্দী, সিদ্ধকাঠী ইউনিয়নের অভয়নীল গ্রামের কাঞ্চন আকন, অরুণ নাগ, দেওপাশার মহিউদ্দিন খান বাচ্চু ও বাদশাহ খান, কুশঙ্গল ইউনিয়নের ভাউমহল গ্রামের কার্তিক বাড়ৈ ও জিতেন বাড়ৈ এবং ফয়রা গ্রামের তাহের উদ্দিনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন করে। এছাড়া কুশঙ্গল বাড়ৈ বাড়ি, নিতাই সাহার বাড়ি, চিত্তরঞ্জন ঠাকুর বাড়ি, পরমপাশা যুগী বাড়ি ও তৌকাঠী হয়বাতপুর তালুকদার বাড়ি রাজাকাররা লুটপাট করে।
উপজেলার চাচৈর, প্রেমহার, বিন্দুঘোষ, বিহঙ্গল, দেওপাশা, অভয়নীল, মালোয়ার প্রভৃতি গ্রামে পাকবাহিনী নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালায়।
নলছিটি থানা, মাচেন্টস মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শান্তি কমিটির সভাপতি আমির হোসেন গাজীর বাসভবন, মিউনিসিপ্যালিটির পরিত্যক্ত ভবন এবং মোহাম্মদিয়া অয়েল মিল ভবন ছিল হানাদার বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির।
সুগন্ধা নদীতীর ও নলছিটি-ষাটপাইকা ফেরিঘাটের পাশে নদীতীরের পানের বরজ ছিল হানাদার বাহিনীর বধ্যভূমি। এছাড়া কাঠিপাড়া এবং মানপাশায় তাদের বধ্যভূমি ছিল। নলছিটি উপজেলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি যুদ্ধ ও সংঘর্ষ হয়। সেগুলোর মধ্যে নলছিটি থানা যুদ্ধ, চাচৈর যুদ্ধ এবং দরগাবাড়ি যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। ১৭ই মে মুক্তিযোদ্ধারা নলছিটি থানা আক্রমণ করেন। দুঘণ্টাব্যাপী এ-যুদ্ধে বাড়ইআরা গ্রামের মিনহাজ উদ্দিনের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউনুস শহীদ এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। ২৩শে জুন দ্বিতীয়বার মুক্তিযোদ্ধারা নলছিটি থানা আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে তাঁরা টিকতে না পেরে পিছু হটেন। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আক্কেল আলী -শহীদ হন এবং মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন গুলিবিদ্ধ হয়ে ধরা পড়েন। পাকিস্তানি সৈন্যরা পরে তাঁকে হত্যা করে। ২২শে আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় নলছিটি থানা আক্রমণ করেন। সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় নলছিটি থানা আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটলে হানাদার বাহিনী থানার চারপাশে অনেকগুলো বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
১৪ই নভেম্বর শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নলছিটি থানা আক্রমণ করে রাজাকার ও পুলিশ বাহিনীকে পরাস্ত করেন। কয়েকজন রাজাকার এক দারোগার বাসায় আত্মগোপন করে। তাদের বের করে আনার সময় রাজাকারদের গুলিতে সুবিদপুর গ্রামের আলাউদ্দিন আহম্মেদ আলো, আজিমপুর গ্রামের আ. মালেক আকন ও বরিশাল গোরস্থান রোডের ফজলুল করিম (পিতা মমতাজউদ্দিন) শহীদ এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। অকস্মাৎ এ হতাহতের ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। এ-সময় শান্তি কমিটির সদস্য মাহমুদ চৌধুরীর এক মেয়ে থানায় নিহত হয়।
৯ম সেক্টরের অন্যতম বৃহৎ এবং সফল যুদ্ধ ছিল চাচৈর যুদ্ধ। ১৩ ও ১৪ই নভেম্বর তা সংঘটিত হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর, বীর উত্তম নেতৃত্ব দেন। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে ছিল ক্যাপ্টেন আজমত এলাহী। প্রথমদিন হানাদার বাহিনী পরাজিত হয়ে পরেরদিন তারা পুনরায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করে। এ-যুদ্ধে বহু সংখ্যক পাকসেনা নিহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার মোস্তফা, আবদুল আউয়াল (পিতা আবদুর রশিদ খান, কাঠিপাড়া) এবং প্রমহর গ্রামের ৫ জন শহীদ হন। চাচৈর যুদ্ধে পরাজয়ের পর হানাদার বাহিনী ক্যাম্পের বাইরে আর কোনো অভিযান পরিচালনা করেনি।
১৩ই নভেম্বর নলছিটির দরগাবাড়িতে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সেকেন্দার-আলতাফ বাহিনীর অর্ধশতাধিক সদস্য এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ-যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে সেকেন্দার-আলতাফ বাহিনীর সাহসী মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ মাহমুদ ও কবির হোসেন শহীদ হন। ডিসেম্বর মাসের প্রথমদিকে কমান্ডর সেকেন্দার আলী মিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা নলছিটি থানা আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতায় হানাদার বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ৬ই ডিসেম্বর সকালে পাকিস্তানি বাহিনী গানবোটে করে ঝালকাঠি ছেড়ে বরিশালের দিকে পালিয়ে যায়। এতে রাজাকাররা মনোবল হারিয়ে ফেলে। ৭ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা নলছিটি থানা ঘেরাও করেন। ৮ই ডিসেম্বর খুব সকালে নলছিটি থানার সি আই সিদ্দিক হোসেনসহ পুলিশ ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা সম্মলিতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। এদিন নলছিটি থানা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন— আলতাফ হোসেন খান, বীর প্রতীক (পিতা সুলতান হোসেন খান, বোয়ালিয়া)। নলছিটি উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. ইউনুস (পিতা মিনহাজ উদ্দিন, বাড়ইআরা; ১৭ই মে নলছিটি থানা যুদ্ধে শহীদ), মো. আলতাফ মাহমুদ (পিতা মো. তাহের উদ্দিন হাওলাদার, ফয়রা; ১৩ই নভেম্বর দরগাবাড়ি যুদ্ধে শহীদ), কবির হোসেন (১৩ই নভেম্বর দরগাবাড়ি যুদ্ধে শহীদ), মো. আবদুল আউয়াল (পিতা আবদুর রশিদ, কাঠিপাড়া; ১৩ই নভেম্বর চাচৈর যুদ্ধে শহীদ), মো. আলাউদ্দিন হাওলাদার (পিতা. মোতাহার উদ্দিন হাওলাদার, সুবিদপুর), ওসমান শেখ (পিতা কালু শেখ, বৈচণ্ডী), ইপিআর সদস্য আবদুল্লাহ (পিতা জয়নাল আবেদীন মোল্লা, হাসপাতাল রোড), আ. মালেক আকন (পিতা আজাহার আলী আকন, বিন্দুঘোষ), করম আলী আকন (পিতা আজাহার আলী আকন, বিন্দুঘোষ), আ. মান্নান জোমাদ্দার (পিতা মোতালেব জোমাদ্দার, মালোয়ার), সিপাহি আ. খালেক (নং ১৮৭৩০) (পিতা চেরাগ আলী তালুকদার, সূর্যপাশা), ল্যান্স নায়েক আ. রব (পিতা বরজুক আলী তালুকদার, সূর্যপাশা), ফকর উদ্দিন হাওলাদার (পিতা মোকছেদ আলী হাওলাদার, মগড়), ল্যান্স নায়েক মাহাবুব আলী দেওয়ান (পিতা রজব আলী দেওয়ান, মগড়), শাহ আলম সিকদার (পিতা সুজাদ্দিন সিকদার, ধারনারায়ণ, অভয়নীল), আ. আজিজ গাজী (পিতা মজিদ গাজী, নাংগুলী), আফতাব উদ্দিন (পিতা হাসান উদ্দিন, তিমিরকাঠী), এস এম আলী চৌধুরী (পিতা মিলন চৌধুরী, কাঠীপাড়া), ফজলুর রহমান (পিতা আ. ওহাব মল্লিক, মল্লিকপুর), পুলিশ সদস্য হাবিবুর রহমান (এএসআই নং ৪০৫) (পিতা আ. আজিজ খান, দপদপিয়া; ছাতক যুদ্ধে শহীদ), নায়েক সুবেদার আনসার আলী খান (পিতা আফতাব আলী খান, মির্জাপুর), মোস্তফা কামাল মঞ্জু (পিতা সৈয়দ আবেদ আলী, চাচৈর), পুলিশ সদস্য আনিসুর রহমান ইউনুস (পিতা লেহাজউদ্দিন, চাচৈর), আবদুল্লাহ (পিতা মৌলবী মো. জয়নাল আবেদীন, নান্দিকাঠী; কুমিরা যুদ্ধে শহীদ), সৈয়দ নজরুল ইসলাম (পিতা সৈয়দ আশরাফ আলী, চাচৈর), আ. খালেক (পিতা আজাহার আলী, অভয়নীল), কামালউদ্দিন সরদার (পিতা আদেল উদ্দিন সরদার, বেরকাঠী), পুলিশ সদস্য মাহবুব আলী (নলছিটি সদর; চট্টগ্রামের দেওয়াননগর যুদ্ধে শহীদ), মোহাম্মদ আলী (লেসপ্রতাপ; দিনাজপুর যুদ্ধে শহীদ), আক্কেল আলী (নলছিটি সদর; ২৩শে জুন নলছিটি থানা আক্রমণে শহীদ), আবুল হোসেন হাওলাদার (বরিশাল সদর; ২৩শে জুন নলছিটি থানা আক্রমণে শহীদ) ও ফজলুল করিম (পিতা মমতাজউদ্দিন, গোরস্থান রোড, বরিশাল; ১৪ই নভেম্বর নলছিটি থান আক্রমণে শহীদ)।
নলছিটি বাসস্ট্যান্ডে ‘বিজয় উল্লাস ৭১’ নামে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের দপদপিয়া গোল চত্বর ও ষাটপাকিয়া বাসস্ট্যান্ডে মুক্তিযুদ্ধ স্মরণে পৃথক দুটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া নলছিটি থানার খালের পশ্চিম পাড়ে বধ্যভূমিতে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিফলক উন্মোচন করা হয়েছে। উপজেলার চন্দ্রকান্দা থেকে মালোয়ার রাস্তার নাম শহীদ আ. মান্নানের নামে, দরগাবাড়ি থেকে তেওলা পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ সিপাহি আ. খালেকের নামে, তালতলা থেকে সুবিদপুর পর্যন্ত রাস্তার নাম শহীদ মো. আলাউদ্দিনের নামে, মানপাশা থেকে মুখিয়া পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ মো. আলতাফ মাহমুদের নামে, তালতলা থেকে মুখিয়া পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ আ. মালেক আকনের নামে, শিমুলতলা থেকে সিদ্ধকাঠী পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ করম আলী আকনের নামে, বৈচণ্ডী থেকে শিমুলতলা পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ ওসমান খানের নামে, ষাটপাকিয়া খেয়াঘাট থেকে ওয়াপদা খাল পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ আবদুল আউয়ালের নামে, পৌরসভার নরসিংহপুর ব্রিজ থেকে নলছিটি সরকারি কলেজ পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ সিপাহি আবদুল্লাহ (ইপিআর)-র নামে, মল্লিকপুর ব্রিজের পুর্ব পাশে থেকে সূর্যপাশা স্কুল পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ ল্যান্স নায়েক আ. রবের নামে এবং মল্লিকপুর ব্রিজের পশ্চিম পাশ থেকে দরগাবাড়ি পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ ফজলুর রহমান সড়ক নামে নামকরণ করা হয়েছে। [মো. মশিউর রহমান ও ভোলানাথ দাস]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!