You dont have javascript enabled! Please enable it!
জয়দেবপুর-তেলিয়াপাড়ার প্রতিরােধ যুদ্ধ

সাক্ষাৎকার ও ক্যাপ্টেন গােলাম হেলাল মােরশেদ খান  ২৫শে মার্চ সকালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এবং টঙ্গী টেলিফোন একচেঞ্জের সঙ্গে যােগাযােগ করি এবং খবরাখবর নিই। জয়দেবপুরের জনসাধারণ তখন দারুণভাবে উত্তেজিত। তারা টেলিফোনে আমাদের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্য দারুণভাবে চাপ দিতে থাকে। দুপুর বারােটার সময় টঙ্গী টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে জানতে পারি যে, পাঞ্জাবী কমাণ্ডো ব্যাটালিয়ানের কিছু সাধারণ পােশাকধারী সৈন্য টঙ্গী ব্রীজ দখল করে জনসাধারণের উপর গােলাগুলি চালাচ্ছে। তখন আমরা বুঝতে পারি এবং ধারণা করি যে পরবর্তী আক্রমণ হয়ত বা আমাদের উপর করবে।  রাতে আমরা পাঞ্জাবীদের দ্বারা আক্রান্ত হব মনে করে জয়দেবপুর প্যালেসের চতুর্দিক পরিখা খনন করে পাহারা দিই। আমি কর্তব্যে থাকাবস্থায় রাত প্রায় সাড়ে বারােটার সময় ঢাকা থেকে টেলিফোন গেল এবং সে টেলিফোন করেছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান স্বয়ং। তিনি আমার অফিসার কমাণ্ডিং লেঃ কঃ রকীবকে ডাকতে বলেন। আমি লেঃ কঃ রকীবের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করি এবং টিক্কা খানের টেলিফোনের কথা জানাই। লেঃ কর্নেল রকীব অফিসে আসবার পূর্বেই পুনরায় টিক্কা খানের এডিসি টেলিফোন করেন। তিনি আমার কাছে জয়দেবপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীর খবর জানতে চান।

অর্থাৎ জয়দেবপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরী জনসাধারণ আক্রমণ করে অস্ত্রশস্ত্র নিতে পারে। কাজেই তাকে রক্ষা করার জন্য আমরা কিরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করছি সে কথা জানতে চান। তার জবাবে আমি বললাম যে, জয়দেবপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীর খবর পুরােপুরি জানি না। তবে আমাদের সঙ্গে দু’টি অয়ারলেস সেট আছে। তাদের সঙ্গে যােগাযােগ করে পরিস্থিতির কথা জানাব। এমন সময় লেঃ কর্নেল রকীব আমার অফিসে চলে আসেন এবং আমি তাকে টিক্কা খান ও তার এডিসির টেলিফোনের কথা জানালাম। তিনি তখন আমাকে একজন অফিসারের নেতৃত্বে এক প্লাটুন সৈন্য জয়দেবপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীতে পাঠাতে বলেন এবং অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীতে খবর দিতে বলেন। আমি তার নির্দেশমতাে কাজ করলাম। কিছুক্ষণ পর কয়েকজন অফিসার আমার ডিউটি কক্ষে এলেন। তাদের সঙ্গে সারারাত পরিস্থিতির উপর আলােচনা হয়।  ২৫শে মার্চ সকাল আটটায় রেডিওতে সামরিক আইনের ঘােষণা শুনি। এরপর থেকে আমরা সবাই অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়ি এবং কি করতে পারি সে বিষয়ে আলােচনা করি। এবং শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে, আমরা জয়দেবপুর থেকে বেরিয়ে পড়ব।
কিন্তু বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে আমরা অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীতে দু’প্লাটুন সৈন্য এবং রাজেন্দ্রপুর এমুনিশন ডিপােতে এক প্লাটুন সৈন্যের কথা চিন্তা করি। এভাবে ২৬শে মার্চ জয়দেবপুরেই কাটাই। ২৭শে মার্চ সকালে সবাই মিলে লেঃ কর্নেল রকীবকে কিছুটা জোর করে অয়ারলেসে ময়মনসিংহে অবস্থিত কোম্পানীকে জানাতে বললাম যে, তারা যেন জনসাধারণের সঙ্গে যােগ দেয় এবং সম্মিলিতভাবে কাজ করে। লেঃ কর্নেল রকীব তখন অয়ারলেসে ময়মনসিংহে মেজর (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) নূরুল ইসলামকে আমাদের কথা জানাতে বাধ্য হলেন এবং তাদেরকে জনসাধারণের সঙ্গে মিশতে বলেন। ২৮শে মার্চ ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) আজিমকে সকালে পাঠানাে হল রাজেন্দ্রপুর মুনিশন ডিপােতে এবং সেখানে তিনি গিয়ে আমাদের বাঙালি কোম্পানীকে খবর দেবেন কিভাবে তারা বের হবে এবং আমাদের সিগন্যাল পাওয়া মাত্র যেন বের হয়। এ খবর নিয়ে ক্যাপ্টেন আজিজ চলে গেলেন।
সকাল দশটার সময় ৪টা ট্রাক ও ৩টা জীপ নিয়ে আমরা এক কোম্পানী অগ্রসর হলাম ময়মনসিংহের দিকে। আমি টাঙ্গাইলে থেকে গেলাম। পুরাে কোম্পানী নিয়ে মেজর শফিউল্লাহ ময়মনসিংহ চলে যান। যাবার পথে বহুলােক পথের মধ্যে হাত তুলেও জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে আমাদেরকে স্বাগত জানায়।  আমি টাঙ্গাইল পৌছেই জানতে পারলাম যে টাঙ্গাইলে অবস্থিত বাঙালি কোম্পানী পূর্বেই জনসাধারণের সঙ্গে যােগ দিয়ে কাজ শুরু করেছে। তখন আমার সঙ্গে কাদের সিদ্দিকী আলাপ করতে আসেন। কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করার পর তাকে কয়েকটি গাড়ি সংগ্রহ করতে বললাম। এবং গাড়ি রাতে প্রয়ােজন হবে সে কথাও বুঝিয়ে বললাম, কাদের সিদ্দিকী গাড়ি সংগ্রহ করার প্রতিশ্রুতি দিল।
আমি আমার কোম্পানীর সৈন্যদের নিকট গিয়ে তাদেরকে আমার আয়ত্বে নিলাম। উক্ত কোম্পানীর কোম্পানী কমাণ্ডার ছিলেন মেজর কাজেম কামাল (পাঞ্জাবী)। তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বললাম ভয় না করার জন্য। সন্ধ্যায় ডাক-বাংলােতে কাজেম কামালের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করি। পরে আমি আমার ড্রাইভার ও গার্ডকে নিয়ে জীপে রাস্তায় বেরুলাম জয়দেবপুর থেকে আমাদের কোম্পানী আসছে কিনা দেখবার জন্য। কিছুদূর যাবার পর অনেক দূরে একটি গাড়ির আলাে দেখতে পাই। মনে হল আমাদের সৈন্যরা জয়দেবপুর থেকে আসছে। আমি ডাকবাংলােতে ফিরে আসছি এমন সময় ডাকবাংলােতে গােলাগুলির শব্দ শােনা গেল। সােজা ডাকবাংলােতে না পৌছে আমি আমার সুবেদারকে ডেকে ব্যাপারটি জিজ্ঞেস করলাম। সুবেদার বলল, স্যার কিছু না, সব ঠিক আছে। গােলাগুলি শেষ হবার পর ডাকবাংলােয় গিয়ে দেখি মেজর কাজেম কামাল ও তার সাথে আরও ৫/৭ জন পাঞ্জাবী সৈন্য আহত ও নিহত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মেজর কাজেম কামাল ও তার পাঞ্জাবী সৈন্যরা আমার অনুপস্থিতিতে পালানাের চেষ্টা করে এবং গুলি শুরু করে। আমাদের সৈন্যরা পাল্টা গুলি করলে তারা আহত ও নিহত হয়। এমন সময় আমাদের জয়দেবপুরের সৈন্যরা টাঙ্গাইল পৌঁছে। জয়দেবপুরের সৈন্যরা টাঙ্গাইল পৌছলে তারা আমাকে আমার কোম্পানীসহ ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হতে বলে এবং তারাও ময়মনসিংহের দিকে রওনা দেয়। আমি তখন নিহত পাঞ্জাবী সৈন্যদের সরিয়ে ফেলার জন্য জনসাধারণকে অনুরােধ করি । আমার গাড়ি তখনও সংগ্রহ না হওয়ায় আমি নিজেই কয়েকটি গাড়ি তাড়াতাড়ি সংগ্রহ করি।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!