মুক্তিযুদ্ধে নরসিংদী সদর উপজেলা
নরসিংদী সদর উপজেলা ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচনের ফল অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে এটাই ছিল স্বাভাবিক কথা। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১লা মার্চ স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এ- খবর প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সারা দেশের মতো নরসিংদীর ছাত্র-জনতাও তীব্র বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। স্বল্প সময়ের মধ্যে নরসিংদী কলেজ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত সংগ্রাম পরিষদের সভায়ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। ৩রা মার্চ নরসিংদী শহরের মিতালী সিনেমা হলের সামনে অনুষ্ঠিত জনসভায় আওয়ামী লীগ নেতা মোসলেম উদ্দিন ভূঁইয়া এমপিএ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এদিন থেকে ৬ই মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী নরসিংদীতে সকাল ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। স্বতঃস্ফূর্ত এ হরতালে সমস্ত দোকানপাট ও যানবা বন্ধ থাকে। কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। অবিরাম মিটিং-মিছিল ও জনসভা চলতে থাকে। ৬ই মার্চ নরসিংদী কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় স্থানীয় নেতৃবৃন্দ অধিকার আদায়ে যে-কোনো ত্যাগ স্বীকারে সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। এসব কর্মসূচিতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে আন্দোলন ক্রমশ জঙ্গিরূপ ধারণ করে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ন্যাপ- (ভাসানী ও মোজাফফর), ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর মেনন ও মতিয়া উভয় গ্রুপের নেতৃবৃন্দ এসব কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন।
সাতই মার্চের ভাষণ-এ বঙ্গবন্ধু শত্রুর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতির নির্দেশনা দিয়ে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তাঁর এ ঘোষণা ও নির্দেশনা তড়িৎ গতিতে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং সারা দেশের মতো নরসিংদীর লোকজনকেও উজ্জীবিত করে তোলে। উক্ত জনসভায় যোগদানকারী নরসিংদীর হাজার-হাজার মানুষ বাড়ি ফেরার পথে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে স্লোগান দেয় “বীর বাঙালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যেও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে ওঠে। নরসিংদীর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি- বেসরকারি অফিস-আদালত বন্ধ হয়ে যায়। আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে নরসিংদীবাসী সরকারকে খাজনা-ট্যাক্স দেয়া বন্ধ করে দেয়। শহর ও হাট-বাজার এলাকার সমস্ত ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। এরই মধ্যে ১৯শে মার্চ পাক সামরিক বাহিনী জয়দেবপুরে গুলিবর্ষণ করে নিরীহ মানুষ হত্যা করলে নরসিংদীতে তার প্রতিবাদে মিছিল ও বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয় এবং জনসভার আয়োজন করা হয়। ২৩শে মার্চ ‘পাকিস্তান দিবস’-এর পরিবর্তে ‘প্রতিরোধ দিবস’ পালিত হয় এবং প্রতিটি ঘরে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৫শে মার্চ রাতে -অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে পাকবাহিনীর নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে আক্রোশে ফেটে পড়ে নরসিংদীর সর্বস্তরের মানুষ।
জনগণের এসব আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন কাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ এমপিএ, মোসলেম উদ্দিন ভূঁইয়া এমপিএ, আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া, মতিউর রহমান ভূঁইয়া, সিরাজুল ইসলাম ভূঁইয়া, লোকমান প্রধান, সফর আলী ভূঁইয়া, ডা. মোছলেহ উদ্দিন, এডভোকেট কফিল উদ্দিন, এডভোকেট বজলুর রহমান, বিজয় চ্যাটার্জী, হাবিবুল্লাহ বাহার প্রমুখ।
ছাত্রনেতাদের মধ্যে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, জানে আলম ভূঁইয়া, সাখাওয়াৎ হোসেন মিয়া (ইয়ার মোহাম্মদ), নারায়ণ চন্দ্র সাহা, আপেল মাহমুদ, শামসুল হুদা বাচ্চু, হারাধন চন্দ্র সাহা, মো. আলী আকবর, আব্দুর রশিদ ভূঁইয়া, বীথিকা চ্যাটার্জী, যুথিকা চ্যাটার্জী, নুরুল ইসলাম প্রমুখ। এছাড়া আন্দোলনে শ্রমিক নেতাদের মধ্যে গিয়াস উদ্দিন, মাহমুদুল হক, মোজাফফর হোসেন, এম আর খান, কাজী হাতেম আলী প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এঁদের নেতৃত্বে জনগণ স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়। অতীতের সংগ্রামী ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও নরসিংদী উপজেলার সংগ্রামী জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে।
২৫শে মার্চ ঢাকায় হানাদার পাকবাহিনীর বর্বরোচিত হামলার কয়েকদিন পর ক্যাপ্টেন মতিউরের নেতৃত্বে ইপিআর বাহিনীর একটি দল নরসিংদীতে এসে ঘাঁটি স্থাপন করে। তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ স্থানান্তর, খাওয়া-দাওয়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ ইত্যাদি ব্যাপারে মোসলেম উদ্দিন ভূঁইয়া এমপিএ এগিয়ে আসেন। তাঁকে যাঁরা সহযোগিতা করেন তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া, আবুল হাসিম মিয়া, আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া, কফিল উদ্দিন ভূঁইয়া, আব্দুল মজিদ ভূঁইয়া, আদম আলী মাস্টার, মৌলভী আব্দুস সামাদ, আব্দুল মান্নান মিয়া, সিরাজুল ইসলাম ভূঁইয়া, জয়নাল মিয়া, রমেশ সাহা, রশিদ মিয়া, নেপাল সাহা, কুলেন্দ্র বাবু এবং ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের শামসুল হুদা বাচ্চু, নুরুল ইসলাম গেন্দু, মো. আলী আকবর, আপেল মাহমুদ, বাবুল ভূঁইয়া, আবুল হায়াত সরকার, আব্দুল মতিন ভূঁইয়া, হারাধন সাহা, মেজবাহ উদ্দিন ইরান প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণের জন্য প্রবীণ ন্যাপ নেতা আবুল হাসিম মিয়াকে আহ্বায়ক ও মোসলেম উদ্দিন ভূঁইয়া এমপিএ-কে সদস্য সচিব করে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদের সদস্যরা হলেন- আওয়ামী লীগের আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া, মো. মতিউর রহমান ভূঁইয়া, আতাউর রহমান ভূঁইয়া, হাবিবুল্লাহ বাহার প্রমুখ। ছাত্রলীগ নেতা শামসুল হুদা বাচ্চুকে আহ্বায়ক ও ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ)-এর নুরুল ইসলাম গেন্দুকে সদস্য সচিব করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর সদস্য ছিলেন ছাত্রলীগের আব্দুল মতিন ভূঁইয়া, হারাধন চন্দ্র সাহা, মো. আলী আকবর (ছাত্রলীগ, নরসিংদী কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি), ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ)-এর শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া, বজলুর রহমান, আব্দুল আলী মৃধা (ছাত্র ইউনিয়ন- মেনন গ্রুপ, নরসিংদী কলেজের ছাত্র সংসদের জিএস), আজিজ আহমেদ খান (ছাত্র ইউনিয়ন— মতিয়া গ্রুপ), বি এ রশীদ প্রমুখ। এপ্রিল মাসের প্রথমদিকে ছুটিতে আসা নৌবাহিনীর সৈনিক ও ইউনিট কমান্ডার সিরাজ উদ্দিন আহমেদ, বীর প্রতীক (ন্যাভাল সিরাজ) এবং থানা কমান্ডার মুহম্মদ ইমাম উদ্দিনের তত্ত্বাবধানে এলাকার প্রায় দুশ ছাত্র-যুবক প্রথমে পাঁচদোনা ইউনিয়নের নেহাব প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে বাঁশের লাঠি ও ডামি রাইফেল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু করে। পর্যায়ক্রমে ১ নং ইউনিটের মুক্তাঞ্চলে ২১টির অধিক কেন্দ্র খোলা হয়। তার মধ্যে দুটি মহিলা কেন্দ্রসহ ১৭টি ছিল নরসিংদী উপজেলায়। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো হলো— নেহাব প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ (প্রশিক্ষক ন্যাভাল সিরাজ ও আনসার শাহাবুদ্দিন), আখালিয়ার ইয়াকুব মাস্টারের বাড়ি (প্রশিক্ষক ইপিআর সদস্য মোখলেছুর রহমান), বড়টেক পাথরপাড়া (প্রশিক্ষক সাবেক সেনাসদস্য নুরুজ্জামান বাদশা মিয়া), আলগী তারিনী ভূঁইয়ার বাড়ি (প্রশিক্ষক আনসার কমান্ডার মোহর আলী), আলগী মহিলা ক্যাম্প (প্রশিক্ষক ন্যাভাল সিরাজ), কাঠালিয়া (প্রশিক্ষক ইপিআর আব্দুর রহিম), নুরালাপুর (প্রশিক্ষক ইপিআর সদস্য রাজ্জাক), ভূঁইয়ম (প্রশিক্ষক ইপিআর সদস্য লুৎফর রহমান), ভূঁইয়ম মহিলা ক্যাম্প (প্রশিক্ষক মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন), পাকুরিয়া (প্রশিক্ষক সিপাহি হাসান), ঢাকশাল (প্রশিক্ষক ফ্লাইট সার্জেন্ট ওমেদ আলী), মূলপাড়া (প্রশিক্ষক সিপাহি শাজাহান মোল্লা), ধর্মপুর (প্রশিক্ষক মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন ও মো. আব্দুল হাকিম), ডাঙ্গা (প্রশিক্ষক হাওলাদার আব্দুল আজিজ), মৈশাদী (প্রশিক্ষক সিপাহি নুরে আলম), ডৌকাদি (প্রশিক্ষক হাওলাদার আব্দুল হাকিম) এবং বালাপুর জমিদার বাড়ি (প্রশিক্ষক ন্যাভাল সিরাজ)। এসব কেন্দ্রে দেড় হাজারেরও অধিক মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে পনেরজন ছিলেন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা হলেন- শামসুন্নাহার মিনা (পিতা জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ভূঁইয়ম), জেসমিন আক্তার দিলা (পিতা জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ভূঁইয়ম), রওশন আক্তার বিন্দু (পিতা জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ভূঁইয়ম), জাকিয়া সুলতানা মৌলুদা (পিতা মঞ্জুরুল হক ভূঁইয়া, ভূঁইয়ম), শরীফুন্নেছা ঝিনু (পিতা গাজী আব্দুর রহমান, আলগী), মমতাজ বেগম (পিতা আব্দুল মালেক, আলগী), সখিনা বেগম (পিতা আব্দুল আহাদ, আলগী), খোদেজা বেগম (পিতা হাজী নোয়াব আলী, আলগী), সুরাইয়া বেগম (পিতা মজিদ ভূঁইয়া, আলগী), মোহছেনা বেগম (পিতা মজিদ ভূঁইয়া, আলগী), আফজল বেগম (পিতা আব্দুল খালেক, আলগী), রোকেয়া বেগম (পিতা আব্দুল খালেক, আলগী), দিলরুবা বেগম (পিতা আব্দুল খালেক, আলগী), নূরজাহান বেগম (পিতা আজিম উদ্দিন মোল্লা, আলগী) এবং রওশন আরা বেগম (পিতা আবু সিদ্দিক ভূঁইয়া, বালাপুর)।
কিছুদিন পরে ন্যাভাল সিরাজ ভারতে গিয়ে ২নং সেক্টরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে দেশে ফিরে আসেন। এরপর গেরিলা যুদ্ধের জন্য অপরিহার্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য কয়েকজন যুবককে ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। ৩রা মে মুহম্মদ ইমাম উদ্দিনের নেতৃত্বে ১৩ জন যুবক ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘর ক্যাম্পে গিয়ে নাম লেখায়। অপর ১২ জন যুবক হলো- মো. আবদুল হাকিম, ছালাম সরকার, আবুল কালাম আজাদ, সুলতান আহমেদ, হারিছ খান, ইব্রাহিম, আবু তোরাব, কবির, আবদুর রশিদ, আমজাদ হোসেন, আনোয়ার হোসেন ও নওশের আলী। পরে আরো অনেককেই প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠানো হয়।
ন্যাভাল সিরাজ প্রেরিত দলটি দুমাস মেলাঘরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। প্রশিক্ষণশেষে দলের কয়েকজন দেশে ফেরার পথে কালিগঞ্জের নাগরীর সমর কষ্টা ও হাসান তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ন্যাভাল সিরাজের বাহিনীতে যোগ দেন। তিনি তাঁদের নিয়ে সমগ্র এলাকাকে সংগঠিত করে জনগণের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। এরপর জুলাই মাসের প্রথম দিকে তিনি মেলাঘরে চলে যান। সেখানে তাঁর ওপর শিবপুর, নরসিংদী, রূপগঞ্জ ও আড়াই হাজার থানা নিয়ে গঠিত ১নং ইউনিটের কমান্ডারের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় এবং প্রত্যেকটি থানাকে একটি সাব-ইউনিট করে শিবপুর থানায় মো. মান্নান খান, নরসিংদী থানায় মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন, রূপগঞ্জ থানায় আব্দুল জব্বার পিনু এবং আড়াইহাজার থানায় আব্দুস সামাদকে কমান্ডারের দায়িত্ব দিয়ে ৫ই জুলাই বাংলাদেশে পাঠানো হয়। ৬ই জুলাই তাঁরা স্ব-স্ব এলাকায় পৌঁছে যান। সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স থেকে মুহম্মদ ইমাম উদ্দিনের ওপর প্রধানত নরসিংদী থানার কমান্ডারের দায়িত্ব অর্পিত হলেও ন্যাভাল সিরাজ ও তাঁর বাড়ি একই গ্রামে হওয়ায় ন্যাভাল সিরাজের সেকেন্ড-ইন- কমান্ড হিসেবে ১নং ইউনিটের প্রশাসনিক দায়িত্বসহ যাবতীয় দায়িত্বও তাঁর ওপর অর্পিত হয় এবং তাঁরা যৌথভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। আব্দুল হাকিম মুহম্মদ ইমাম উদ্দিনের কাজে সহায়তা করেন। পাঁচদোনা ইউনিয়নের নেহাব গ্রামে তাঁরা হেডকোয়ার্টার্স স্থাপন করেন। তারপর ৭ই জুলাই থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মতৎপরতা শুরু হয়। একে-একে চলতে থাকে নানা রকমের অপারেশন। জনগণের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনা, মুক্তাঞ্চলে যুবকদের জন্য প্রশিক্ষণকেন্দ্র খোলা, গেরিলা পদ্ধতিতে শত্রুঘাঁটিতে হামলা করা, শত্রুদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়া, তাদের রসদ সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করা প্রভৃতি কাজ পূর্ণোদ্যমে চলতে থাকে।
পূর্বোল্লিখিত নেতৃবৃন্দ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরে থেকে আরো যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন- ডা. আবদুর রফিক ভূঁইয়া (বালাপুর), মো. মোকসেদ আলী (নেহাব), আব্দুল মালেক মেম্বার (নেহাব), মো. আব্দুর রশিদ ভূঁইয়া (ছনপাড়া), ডা. মোসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া (মাধবদী), মো. আবদুস সামাদ (শেকেরচর), সন্তোষ চন্দ্র দাস (মাধবদী), হাছান আলী (মাধবদী), গাজী আবদুর রহমান (আলগী), অহিবুর রহমান (কাকশিয়া), মো. মানিক মিয়া (গোয়ালদী), বাহাউদ্দিন ভূঁইয়া (ভূঁইয়ম), সুলতান উদ্দিন আহমেদ (সুলতান মাস্টার) (মূলপাড়া), এডভোকেট সিরাজুল হক (মূলপাড়া), আব্দুল আজিজ মেম্বার (মেহেরপাড়া), পরিমল চন্দ্র দাস (পাঁচদোনা), মো. মহব্বত আলী (কাকশিয়া), কাজী হাতেম আলী (নবীপুর), এমদাদ মাস্টার (বাগহাটা), মোছলেম (সাটিরপাড়া), মলি হোসেন চেয়ারম্যান (মাধবদী), হোসেন আহমেদ (মাধবদী), মো. ইউসুফ (উপাধ্যক্ষ, নরসিংদী কলেজ) এবং আব্দুল আজিজ মেম্বার (মেহেরপাড়া)। আর ভারতে যাঁরা সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন তাঁরা হলেন- মো. মোসলেম উদ্দিন ভূঁইয়া এমপিএ (সার্বিক দায়িত্বে), মো. রাজ্জাক ভূঁইয়া (নরসিংদী), বিজয় ভূষণ চ্যাটার্জী (জিনারদী) এবং এনাজুর রহমান চৌধুরী (ছনপাড়া)।
সিরাজ উদ্দিন আহমেদ, বীর প্রতীক ছিলেন ইউনিট কমান্ডার (৪টি থানা নিয়ে গঠিত ১নং ইউনিটের সার্বিক দায়িত্বে, এপ্রিল-ডিসেম্বর)। উপজেলার অন্যান্য কমান্ডাররা হলেন- মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন (নেহাব; এফএফ, সাব ইউনিট কমান্ডার অর্থাৎ থানা কমান্ডার এবং তৎসহ ১নং ইউনিটের সেকেন্ড-ইন-কমান্ডের দায়িত্বে, এপ্রিল- ডিসেম্বর), মতিউর রহমান ভূঁইয়া (ভাগদী; গ্রুপ কমান্ডার, আগস্ট-ডিসেম্বর), মো. আব্দুল মান্নান মিয়া (আনন্দী; গ্রুপ কমান্ডার, সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর), মনির উদ্দিন আহমেদ (দীঘিরপাড়; গ্রুপ কমান্ডার, অক্টোবর-ডিসেম্বর), মো. মেহের উদ্দিন (দীঘিরপাড়; গ্রুপ কমান্ডার, অক্টোবর- ডিসেম্বর), আলী আকবর সরকার (আলোক বালি; গ্রুপ কমান্ডার, অক্টোবর-ডিসেম্বর), মো. তাইজউদ্দিন মাস্টার (মেহেরপাড়া; গ্রুপ কমান্ডার, নভেম্বর-ডিসেম্বর), মীর ইমদাদুল হক (নরসিংদী; গ্রুপ কমান্ডার, নভেম্বর- ডিসেম্বর), হারাধন চন্দ্র সাহা (নরসিংদী; গ্রুপ কমান্ডার, নভেম্বর-ডিসেম্বর), মো. এনামুল হক চৌধুরী (বেলাব; গ্রুপ কমান্ডার, নভেম্বর-ডিসেম্বর) এবং মো. আলী আকবর (নরসিংদী; বিএলএফ, সাব-ইউনিট কমান্ডার, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ)। সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স মেলাঘর থেকে কমান্ডারদের দায়িত্ব বণ্টন করা হয় এভাবে: ন্যাভাল সিরাজ – ইউনিট কমান্ডার, মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন সাব ইউনিট বা থানা কমান্ডার, নরসিংদী থানা, মো. আব্দুল হাকিম – গোয়েন্দা কর্মকর্তা, মো. আনোয়ার হোসেন – অর্থ অফিসার, মো. ইব্রাহিম মিয়া – যোগাযোগ কর্মকর্তা এবং মীর সিরাজুল ইসলাম (মামা সিরাজ) ইউনিট অর্গ্যানাইজার। ন্যাভাল সিরাজ ও ইমাম উদ্দিন তাঁদের বিশাল বাহিনীকে ট্রেনিং ক্যাম্পের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দেন এবং প্রত্যেক ক্যাম্পে একজন করে প্রশিক্ষক নিযুক্ত করেন। জনগণকে সংগঠিত ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার জন্য তাঁরা প্রতিটি ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত সংগঠক নিয়োগ করেন। এভাবে এক সুশৃঙ্খল দক্ষ বাহিনী গড়ে তুলে তাঁরা পাকবাহিনীর মোকাবেলা করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
ভৌগোলিক ও কৌশলগত উভয় দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকবাহিনীর নিকট নরসিংদী অঞ্চলটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নরসিংদী দখল করতে পারলে পাকবাহিনী যেমন অতি সহজেই ঢাকা থেকে এ অঞ্চলে তাদের সৈন্য, রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে এবং পুরো অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারবে, অন্যদিকে তেমনি মুক্তিযোদ্ধারাও নরসিংদী নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে হানাদারমুক্ত এলাকায় থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজ নির্বিঘ্ন, হানাদার বাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে এলাকাবাসীকে মুক্ত রাখা এবং ঢাকার ওপর আক্রমণ জোরদার করা সম্ভব হবে।
নরসিংদীতে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধের ব্যাপারে প্রথম দিকে রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ বাঙালি সৈনিক, তরুণ ছাত্র-কর্মী এবং সাধারণ মানুষের ভূমিকাই ছিল বেশি। তারা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী দেশ রক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। পরে রাজনৈতিক দলগুলো এগিয়ে আসে।
নরসিংদী যেহেতু ভৌগোলিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ এবং যোগাযোগের দিক থেকেও সুবিধাজনক, তাই অন্য উপজেলাগুলোর পূর্বে পাকবাহিনী এখানেই প্রবেশের চেষ্টা করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এখানে সর্বাগ্রে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। এতে নেতৃত্ব দেন ঢাকা থেকে আগত ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সৈনিকরা। ২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনীর বর্বরোচিত হামলার পর ৩১শে মার্চ ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (পরে ব্রিগেডিয়ার)-এর নেতৃত্বে কয়েকজন বিদ্রোহী বাঙালি ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক অস্ত্রসহ নরসিংদী পৌঁছান। ৩রা এপ্রিল আকাশবাণী থেকে প্রচার করা হয় যে, প্রায় চার হাজার বাঙালি সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধা নরসিংদী থেকে ঢাকা আক্রমণের জন্য রওনা হয়েছে। এ খবর প্রচারিত হওয়ার পরপরই পাকবাহিনী ৪ঠা ও ৫ই এপ্রিল নরসিংদী শহরে বিমান হামলা চালায়। এতে অনেক দোকানপাট পুড়ে যায় এবং ৪-৫ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। এ ঘটনার পর ন্যাভাল সিরাজ, ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান এবং তাঁদের সৈন্যরা স্থানীয় জনতার সঙ্গে মিলে ৮ই এপ্রিল ঢাকা-নরসিংদী সড়কের বাগবাড়ি নামক স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পরের দিন ৯ই এপ্রিল হানাদার বাহিনী নরসিংদীতে প্রবেশের চেষ্টা করলে বাগবাড়িতে উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চলার পর উভয় পক্ষই আত্মরক্ষার্থে পশ্চাদপসরণ করে।
৯ই এপ্রিল ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার পর ১০ই এপ্রিল পাকবাহিনী ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুনরায় নরসিংদীর দিকে অগ্রসর হয়। এদিন পাঁচদোনা মোড়ের কাছে পৌঁছলে সেখানে পূর্ব থেকে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের গতিরোধ করেন। ফলে উভয় পক্ষে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। বিকেল অবধি মরণপণ যুদ্ধ করেও পাকবাহিনী সামনে এগুতে ব্যর্থ হয়ে বাবুরহাটে ফিরে যায়। কিছুক্ষণ পরে ঢাকা থেকে অতিরিক্ত সৈন্য এসে যোগ দিলে তারা পুনরায় নরসিংদী অভিমুখে অগ্রসর হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আবার যুদ্ধ শুরু করে। কিন্তু সীমিত শক্তি নিয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হন। ফলে পাকবাহিনী নরসিংদী দখল করে নেয় এবং টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনে প্রধান ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীতে তারা ডাকবাংলো, রেলস্টেশন, মিতালী সিনেমা হল, বদরপুর রেলব্রিজ, খাটেহারা ব্রিজ, পাঁচদোনা ব্রিজ, মাধবদী বাজার, পালবাড়ি, জিনারদী বাজার ও নরসিংদী থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। পাঁচদোনার এই প্রতিরোধযুদ্ধে পাকবাহিনীর বেশ কয়েকজন সৈনিক হতাহত এবং তাদের ট্রাক বহরের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। মুক্তিবাহিনীর একজন যোদ্ধা আহত হন।
নরসিংদী সদর উপজেলায় কনভেনশন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র সংঘ এবং এনএসএফ স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল। কনভেনশন মুসলিম লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিল মৌলভী মো. তোফাজ্জেল হোসেন ও আবদুর রহমান ভূঁইয়া, জামায়াতে ইসলামীর অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী ও অধ্যাপক মো. খলিল উল্লাহ, ইসলামী ছাত্র সংঘের আবুল হোসেন, মতিউর রহমান ও আবেদ আলী এবং এনএসএফ- এর আবু দাইয়ান, মাহবুব, খন্দকার গোলজার হোসেন, ভুলু ও নিতাই। এদের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি- ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল মিয়া আব্দুল মজিদ (নরসিংদী সদর) এবং সদস্য মাহতাব উদ্দিন (নরসিংদী সদর), আবদুল কুদ্দুছ মিয়া (নরসিংদী সদর), অধ্যাপক খলিল উল্লাহ (নরসিংদী সদর), ডা. আবদুস শহীদ (নরসিংদী সদর), আবদুল জব্বার চেয়ারম্যান (নরসিংদী সদর), রমিজ উদ্দিন ভূঁইয়া (ঘোড়াদিয়া), লাল মিয়া (পুরান পাড়া) প্রমুখ। হানাদার বাহিনীর সহায়তায় এরা জুলাই মাস থেকে নির্যাতন, হত্যা, গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। ১৪ই আগস্ট পাকসেনারা চরপাড়া গ্রামের ২৫টি বাড়িতে আগুন দেয় এবং ৭ জন লোককে হত্যা করে। ১৬ই আগস্ট পাঁচদোনার যুদ্ধের পর পাকবাহিনী পার্শ্ববর্তী এলাকায় ব্যাপক নির্যাতন চালায়। পাঁচদোনা বাজারে আগুন লাগিয়ে সম্পূর্ণ বাজারটি ভস্মীভূত করে দেয়। এতে ৩৭ জন দোকানি নিঃস্ব হয়ে যান। বাজারের নিকটবর্তী মেহেরপাড়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকায় সেখানে হানা দিয়ে বেশ কয়েকজন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। আগস্ট মাসে মুক্তিযোদ্ধারা আড়িয়ালখাঁ নদীর ওপর নির্মিত বাদুয়ারচর রেল ব্রিজটি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিলে পরের দিন হানাদার বাহিনী ব্রিজের দক্ষিণ পাশের বাদুয়ারচর গ্রামে হামলা করে। তারা প্রথমেই গয়াবালী নামে একজন নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে এবং তার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এরপর তারা বাদুয়ারচর, কান্দাপাড়া ও চরহাজীপুর গ্রামের অর্ধশতাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পরবর্তী সময়ে নেহাব, বেলাব, চরপাড়া, আলগী ও আলীপুর গ্রামেও বহু বাড়িতে আগুন দেয়। সব মিলিয়ে তারা এ উপজেলায় দেড়শতাধিক বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়।
নরসিংদী সদর উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা বহুসংখ্যক সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। তাদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন গণহত্যায় শহীদ হন চরপাড়া গণহত্যায় ১১ জন, নলুয়া-সৈকাদি গণহত্যায় ১৬ জন, ঘোড়াদিয়া গণহত্যায় ১২ জন, শীলমান্দি গণহত্যায় ২১ জন, মেহেরপাড়া গণহত্যায় ২১ জন, কান্দাপাড়া গণহত্যায় ১৭ জন এবং ঘোড়াশাল ন্যাশনাল জুট মিলস গণহত্যায় শতাধিক।
নরসিংদী সদর উপজেলায় স্থাপিত সবগুলো ক্যাম্পই পাকবাহিনী নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করত। তবে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবন ও ডাকবাংলো ছিল তাদের প্রধান নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। বিভিন্ন এলাকা থেকে সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে এসব ক্যাম্পে নির্যাতন চালাত এবং হত্যা করত। মহিলাদের ধরে এনে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাত।
উপজেলায় তিনটি গণকবর ও দুটি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে – কান্দাপাড়া দেবালের টেক গণকবর, পাঁচদোনা ব্রিজ বধ্যভূমি ও গণকবর এবং এ খাটারা বধ্যভূমি ও গণকবর। ৯ই এপ্রিল বাগবাড়ি প্রতিরোধযুদ্ধে পশ্চাদপসরণের সময় হানাদাররা কান্দাপাড়া গ্রামের ১৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। তাদের সবাইকে দেবালের টেকের সুখাই প্রধানের বাড়ির কাছে একই কবরে সমাহিত করা হয়।
নরসিংদী সদর উপজেলায় ন্যাভাল সিরাজ এবং মুহম্মদ ইমাম উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী গড়ে ওঠে, যার নাম ন্যাভাল সিরাজ বাহিনী। প্রধানত সিরাজ উদ্দিনের শৌর্য-বীর্য ও যুদ্ধকৌশলের কারণে এ বাহিনী অত্যন্ত খ্যাতি লাভ করে এবং যুদ্ধের দিনগুলোতে পাকবাহিনীর কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে দেখা দেয়। এ বাহিনী বহু স্থানে সফল অভিযান পরিচালনা করে।
নরসিংদী জেলায় মোট ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা বীরত্বের জন্য খেতাব প্রাপ্ত হন। তাঁদের মধ্যে নেহাবের সিরাজ উদ্দিন আহমেদ, বীর প্রতীক (ন্যাভাল সিরাজ) অন্যতম। সদর উপজেলার অন্য বীর মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নেহাবের মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন, আবদুল হাকিম, আবুল কালাম আজাদ, সুলতান আহমেদ, ইব্রাহিম, কফিল উদ্দিন, রুহুল আমিন, সাহাবুদ্দিন, রশিদ ভূঁইয়া, লতিফ, শফি, মোহাম্মদ আলী, বিল্লাল, ছাবেদালী, ফজলু, বেলাবোর তোরাব, সিরাজ, সোহরাব, জিলন, এনাম, ভরসাঙ্গানের তাইজউদ্দিন, কুলাহাটের হাছেন আলী, চাকশালের মান্নান, আজিজ, তাইজউদ্দিন পাঠান, মূলপাড়ার শাজাহান, ভাটপাড়ার নূরে আলম, বাগদীর বাদশা, আমিনুল, নূরুল ইসলাম, মরতুজ আলী, ইব্রাহিম, ডাঙ্গার মো. আলী, নাসির, ইমান উদ্দিন, পাঁচদোনার পবিত্র রঞ্জন দাস, মহাদেব, মৈশাসুরার হারুন, তোফাজ্জল, মেহেরপাড়ার কাশেম, হাসেম, মোহাম্মদ আলী, ফিরোজ, রোকন, আবেদালী, হাবিবুর, শেখেরচরের আনোয়ার, হান্নান, অলিউল্লাহ, নলুয়ার নুরুল ইসলাম, আসমান্দির চরের ওসমান, ইব্রাহিম, বৈলানের রশিদ, আমজাদ, মাথরার শাজাহান, সুলতান, পাকুরিয়ার লতিফ, রফিক, হযরত আলী, সিরাজ, নিয়াজ উদ্দিন, ডরিরটেকের সোনামিয়া, চানগাঁওয়ের ফজলু, মজিবর, কান্দাইলের শাজাহান, ভাগদীর মতিউর রহমান, শিবপুরের ইব্রাহিম (যুদ্ধে শহীদ), খান মোহাম্মদ, কবির, আড়াইহাজারের বিল্লাল, পাবনার ঝন্টু প্রমুখ। এছাড়া অন্য গ্রুপের মধ্যে মাধবদী এলাকার মান্নান, মনির, মোজাম্মেল, মোতালিব পাঠান এবং নরসিংদীর লে. কর্নেল (অব.) মো. নজরুল ইসলাম, বীর প্রতীক, মেজর (অব.) শামসুল হুদা বাচ্চু ও হাবিবুল্লাহ বাহারের নাম উল্লেখযোগ্য।
নরসিংদী সদর উপজেলায় যাঁরা এলাকায় থেকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে ছাত্ররাই ছিল প্রধান। তারাই সর্বাগ্রে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে এগিয়ে আসে। যুদ্ধকালীন সময়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বেশির ভাগই ভারতে চলে যান। সেখানে অবস্থান করে তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা, খাওয়া ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ভূমিকা পালন করেন।
প্রথমে নরসিংদী ছিল ২নং সেক্টরের অধীন এবং মেলাঘর ছিল ২নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্স। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ এবং মেজর এ টি এম হায়দার (ভারপ্রাপ্ত)। কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন ছাত্রনেতা এম এ আজিজ। পরবর্তীতে নরসিংদী ৩নং সেক্টরের অধীনস্থ হয়। এ সময় সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ এবং মেজর এ এন এম নূরুজ্জামান (ভারপ্রাপ্ত)।
নরসিংদী সদর উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধ হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা একাধিক সফল অপারেশন পরিচালনা করেন। সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য পাঁচদোনার যুদ্ধ, জিনারদী যুদ্ধ, মূলপাড়া যুদ্ধ, তিতাস গ্যাস লাইন অপারেশন, ছনপাড়া-বাগহাটা কালভার্ট অপারেশন, নেহাব গ্রামের যুদ্ধ, মাধবদী যুদ্ধ, ঘোড়াশাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অপারেশন- এবং পাটুয়া যুদ্ধ। পাঁচদোনার যুদ্ধ সংঘটিত হয় তিনবারে ১০ই এপ্রিল, ১৬ই আগস্ট এবং ১০ই অক্টোবর। প্রথমবারের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পরাজিত করে পাকবাহিনী নরসিংদী সদরে প্রবেশ করে। দ্বিতীয়বারে মুহম্মদ ইমাম উদ্দিনের নেতৃত্বে সংঘটিত যুদ্ধে ৭-৮ জন পাকসেনা নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। হারুন ও মোতালেব নামে দুজন মুক্তিসেনা শহীদ এবং ২ জন আহত হন। তৃতীয়বারের যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন ন্যাভাল সিরাজ। এ- যুদ্ধে আনজত আলী নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও চারজন আহত হন।
ব্রাম্মন্দী হাইস্কুল অপারেশন পরিচালিত হয় হাবিলদার মজনু মৃধার নেতৃত্বে এপ্রিল-মে মাসে এসএসসি পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে। পাক দখলদারদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এ পরীক্ষা বন্ধের উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধারা নরসিংদী শহরের ব্রাম্মন্দী হাইস্কুল কেন্দ্রে অতর্কিতে হামলা চালান। এতে কয়েকজন পাঞ্জাবি সেনা মারাত্মকভাবে আহত হয়। সিরাজ বাহিনী মূলত আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য শহরের কয়েকটি স্থানে গ্রেনেড চার্জ করে। এর ফলে কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম।
জিনারদীর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৩ই আগস্ট ন্যাভাল সিরাজের নেতৃত্বে। এ-যুদ্ধে দুজন পাকসেনা নিহত হয় এবং অবশিষ্ট ১৫ জনের সকলে আত্মসমর্পণ করে। ইব্রাহিম নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং শত্রুদের প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। মূলপাড়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৪ই আগস্ট ন্যাভাল সিরাজ ও ইমাম উদ্দিনের নেতৃত্বে। এ-যুদ্ধে দুজন পাকসেনা নিহত ও কয়েকজন আহত হয়।
তিতাস গ্যাস লাইন অপারেশন পরিচালিত হয় ২০শে আগস্ট গভীর রাতে। কমান্ডার ইমাম উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিমসহ তিনজনের একটি দল চিনিশপুরে অবস্থিত গ্যাস পাইপ লাইনটি বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয়। এতে একদিকে যেমন এলাকার পাকসেনারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, অন্যদিকে তেমনি বেশ কয়েকদিন যাবৎ সিদ্ধিরগঞ্জ- ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থাকে।
ছনপাড়া-বাগহাটা কালভার্ট অপারেশন পরিচালিত হয় কমান্ডার ইমাম উদ্দিনের নেতৃত্বে আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে। এ অপারেশনে দু-পাশের দুটি কালভার্ট ভেঙ্গে দিয়ে পাঁচদোনা ব্রিজটি পাকসেনাদের ব্যবহারের অনুপযোগী করে দেয়া হয়। নেহাব গ্রামের যুদ্ধ সংঘটিত হয় জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনবার। মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিশালী ঘাঁটি নেহাবে পাকবাহিনীর প্রতিটি আক্রমণ ইমাম উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সফলতার সঙ্গে প্রতিহত করেন।
আনন্দী বিদ্যুৎ টাওয়ার অপারেশন পরিচালিত হয় সেপ্টেম্বরের কোনো এক রাতে সিরাজ বাহিনীর নেতৃত্বে। মাধবদী বাজারের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত এ টাওয়ারটি বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিলে মাধবদী ও শেখেরচর এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। মাধবদীর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৮ই অক্টোবর কমান্ডার মনির উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে। এ- যুদ্ধে এ বি এম সামসুল হক (বাবুল মাস্টার) নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং দুজন মুক্তিযোদ্ধা ও কয়েকজন পাকসেনা আহত হয়। আলগী ক্যাম্প রেইড পরিচালিত হয় ১৫ই অক্টোবর ভোর রাতে। এদিন পাকসেনারা অতর্কিতে মুক্তিবাহিনীর এ ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ ঘটনায় ৬ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ কয়েকজন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। নরসিংদী টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অপারেশন পরিচালিত হয় ১১ই ডিসেম্বর মজনু মৃধার নেতৃত্বে। এদিন মুক্তিযোদ্ধারা নরসিংদী শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবন আক্রমণ করে এক্সচেঞ্জটি উড়িয়ে দেন। এ অপারেশনের ফলে নরসিংদীর সঙ্গে সারা দেশের টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং নরসিংদী সদর উপজেলা শত্রুমুক্ত হওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়। ঘোড়াশাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অপারেশন পরিচালিত হয় ১ শে নভেম্বর। এর ফলে সারাদেশের সঙ্গে এ অঞ্চলের টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পাটুয়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১২ই ডিসেম্বর ন্যাভাল সিরাজ ও ইমাম উদ্দিনের নেতৃত্বে। ঘণ্টাকাল ব্যাপী এ-যুদ্ধে ২১ জন পাকসেনার সকলে আত্মসমর্পণ করে। ফলে নরসিংদী সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- খন্দকার মতিউর রহমান, বীর বিক্রম- (পিতা খন্দকার সদর উদ্দিন আহমেদ, ভোলানগর) ও সিরাজ উদ্দিন আহমেদ, বীর প্রতীক (পিতা মো. জবেদ আলী, পাঁচদোনা, নেহাব)। মুক্তিযুদ্ধে সমগ্র নরসিংদী জেলায় ১১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে ২২ জন ছিলেন সদর উপজেলার। তাঁরা হলেন- মো. আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া (পিতা আব্দুল হেকিম ভূঁইয়া, বৌয়াকুড়; সীমান্ত এলাকায় সমাহিত), মো. হারুনুর রশীদ ভূঁইয়া (পিতা আব্দুল হামিদ ভূঁইয়া, মহিষাসুরা; ১৬ই আগস্ট পাঁচদোনার দ্বিতীয় যুদ্ধে শহীদ, পারিবারিক গোরস্তানে সমাহিত), এ বি এম সামসুল হক (বাবুল মাস্টার) (পাকুরিয়া; ৮ই অক্টোবর মাধবদীর যুদ্ধে শহীদ, পারিবারিক গোরস্তানে সমাহিত), মো. আনজত আলী (পিতা মো. হাছেন আলী, নেহাব; ১০ই অক্টোবর পাঁচদোনার তৃতীয় যুদ্ধে শহীদ), মো. জামাল উদ্দিন (পিতা মো. রহিম উদ্দিন, তুলশীপুর; পাঁচদোনার যুদ্ধে শহীদ), মো. তাইজউদ্দিন পাঠান (পিতা মো. হাবিজ উদ্দিন, চাকশাল; ১৬ই অক্টোবর আলগী ক্যাম্প রেইডে শহীদ, পাইকারচর গোরস্তানে সমাহিত), মো. আওলাদ হোসেন ভূঁইয়া (পিতা মো আসাদুজ্জামান, ভাগদী; আলগী ক্যাম্প রেইডে শহীদ, পাইকারচর গোরস্তানে সমাহিত), মো. আবদুস ছালাম (পিতা মোহাম্মদ আলী, কামারগাঁও; আলগী ক্যাম্প রেইডে শহীদ, পাইকারচর গোরস্তানে সমাহিত), মো. আনোয়ার হোসেন (পিতা মো. মিজানুর রহমান, শেকেরচর; আলগী ক্যাম্প রেইডে শহীদ, শেকেরচর ঈদগাহ গোরস্তানে সমাহিত), মোহাম্মদ আলী (পিতা মো. আলতাফ আলী, নেহাব; আলগী ক্যাম্প রেইডে শহীদ, পাইকারচর গোরস্তানে সমাহিত), মো. চান মিয়া (পিতা মো. আহম্মদ উল্লাহ, পাকুরিয়া; নিখোঁজ), মো. শফিকুল ইসলাম দুলাল (পিতা আবদুল হাসিম মিয়া, চৌয়ালা), মো আবদুল মোতালিব (পিতা মো. কালাই ভূঁইয়া, পাইকারচর; পারিবারিক গোরস্তানে সমাহিত), মো. আবদুল করিম (পিতা মো ছামির উদ্দিন, ভূঁইয়ম), মো. নাজিম উদ্দিন (পিতা মো. আবদুল কাদির, ভূঁইয়ম), অনিল কুমার দাস (পিতা যোগেন্দ্র চন্দ্র দাস, মূলপাড়া), মো. মতিউর রহমান (পিতা মো. আদম আলী মাস্টার, ভেলানগর; বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়, পারিবারিক গোরস্তানে সমাহিত), মো. মারফত আলী (পিতা মো. রহমত আলী, গনেরগাঁও; শেকেরচর ঈদগাহ গোরস্তানে সমাহিত), মো. মফিজ উদ্দিন (পিতা মো. সামসুদ্দিন মাস্টার, নজরপুর; নিখোঁজ), মো. মহিউদ্দিন ভূঁইয়া (পিতা মো. কান্দু ভূঁইয়া (বদরপুর; ঢাকার আজিমপুরে সমাহিত), মো. খলিলুর রহমান (পিতা. ওহাব মিয়া, শালিধা; ঢাকার মিরপুরে সমাহিত) এবং সাদেকুল হক ফটিক (পিতা মো. জানু মাস্টার, বাখর নগর; পারিবারিক গোরস্তানে সমাহিত)।
নরসিংদী সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিরক্ষার্থে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ২০০৬ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে নির্মিত হয়েছে কেন্দ্রীয় স্মৃতিসৌধ। ২০০৮ সালে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের অর্থায়নে পাঁচদোনা মোড়ে নির্মিত হয়েছে ‘অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ’ নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। নরসিংদী পৌরসভার সামনের বটতলা নামে সমধিক পরিচিত চৌরাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে ‘স্বাধীনতা চত্বর। ২০০৮ সালে এই স্বাধীনতা চত্বরে নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন স্বাধীনতা চত্বর স্মৃতিস্তম্ভ। নরসিংদী পৌরসভার উদ্যোগে ২০১০ সালে বাসাইল নামক স্থানে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে নির্মিত হয়েছে একটি ‘শাপলাফুল’। এর ফলে ঐ স্থানটি ’শাপলা চত্বর’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। নরসিংদী পৌরসভা ২০১০ সালে নতুন বাসস্ট্যান্ডের পূর্ব-উত্তর পাশের শালিধা চৌরাস্তার নতুন নামকরণ করে মুক্তিচত্বর। এখানে একটি ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ’ নির্মিত হয়েছে। ২০১১ সালে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উদ্যোগে আলগী ক্যাম্প রেইডে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে আলগী তারিণী ভূঁইয়া বাড়ী স্মৃতিফলক। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তারের স্মরণে নরসিংদী শহরের একটি সড়কের নতুন নামকরণ করা হয়েছে শহীদ আব্দুস সাত্তার সড়ক। [মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন ও নুরুল ইসলাম গেন্দু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড