মুক্তিযুদ্ধে নবীনগর উপজেলা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
নবীনগর উপজেলা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর নিরঙ্কুশ জয়লাভের পরেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১লা মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এর ফলে সারাদেশের মতো নবীনগরের জনগণও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ২রা মার্চ ইব্রাহিমপুর হাইস্কুল মাঠে (বাঁশবাজারের মাঠ) স্থানীয় সুদন মিয়ার সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তৃতা করেন কাজী আকবর উদ্দিন আহমেদ এমপিএ, নবীনগর কলেজের অধ্যক্ষ শামছুল হক, সাধন দেব, শহীদুল্লাহ প্রমুখ। সভায় প্রতিবাদী কবিতা আবৃত্তি করেন নবীনগর পাইলট হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক মুখলেছুর রহমান। বিভিন্ন এলাকা থেকে সর্বস্তরের সহস্রাধিক মানুষ ‘সব কথার শেষ কথা, বাংলার স্বাধীনতা’ স্লোগান সহকারে এ সভায় যোগদান করে। সভাশেষে পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানো হয়। একইদিন ফতেহপুর হাইস্কুলের ছাত্ররা এলাকাবাসীর সহযোগিতায় জিনোদপুর বাজারস্থ তহশীল অফিসটি দখল করে নেয় এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অফিস হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। নবীনগরবাসী ২-৬ই মার্চ হরতালসহ কেন্দ্রীয়ভাবে ঘোষিত আন্দোলন-সংগ্রামের সকল কর্মসূচি স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করে।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর এডভোকেট আহমেদ আলী এমপিএ-এর সভাপতিত্বে শিবপুর হাইস্কুল মাঠে একটি প্রতিবাদ সভা হয়। উক্ত সভা শেষে এডভোকেট আহমেদ আলী এবং শামছুল হক মোল্লার নেতৃত্বে পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানো হয়। এ-সময় প্রত্যেকটি ইউনিয়ন ও গ্রামে সভা-সমাবেশ ও বাঁশের লাঠি নিয়ে মিছিল করা হয়। এ- সকল আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন আ. লতিফ, মিজানুর রহমান (বাড়িখলা), জিয়াউল হক সরকার, কাজী আকবর উদ্দিন সিদ্দিক এমপিএ, আ. রউফ (গোপালপুর), অজন্ত ভদ্র (বিদ্যাকুট মেরকুটা), আ. ওয়াদুদ, শামছুল হক সাহন, জহিরুল হুদা, শাহ জিকরুল আহমেদ খোকন, আবুল হাছান মাস্টার (ফতেহপুর), মুজিবুর রহমান ভূঁইয়া (হুরুয়া), আবুল হাছান ভূঁইয়া দানু (গুড়িগাঁও), মোখলেছুর রহমান ওরফে রোকন মাস্টার, শৈলেন দেব, নারায়ণচন্দ্র সাহা (সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ), ফ্লাইট সার্জেন্ট (অব.) আ. মোত্তালেব (আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান), মমতাজ বেগম (শাহপুর), গীতা ভট্টাচার্য প্রমুখ। মে মাসের প্রথম দিকে সার্জেন্ট সফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া (হুরুয়া) পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় ছুটি নিয়ে বাংলাদেশে এসে এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ও সাংগঠনিক কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
৩রা মার্চ জিনোদপুর বাজারে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আবুল হাছান মাস্টারের নেতৃত্বে সুবেদার মতিউর রহমান জিনোদপুর গ্রামের মাঠে বাঁশের লাঠি দ্বারা ৩০জন যুবককে নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। পরে কাঠালিয়া গ্রামের ধোপাবাড়ির দক্ষিণ পার্শ্বে শুকনা পুকুরে রাইফেলের মাধ্যমে তাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ১৫ই মার্চ পর্যন্ত এ প্রশিক্ষণ চলে। এ স্থানটি পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও শরণার্থী ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সুবেদার লাল মিয়া (সেমন্তগর, মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট ‘নানাভাই’ হিসেবে পরিচিত) প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ফতেহপুর কে জি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, নবীনগর পাইলট হাইস্কুল মাঠ, আদালত প্রাঙ্গণ, শিবপুর হাইস্কুল মাঠ, বিদ্যাকুট হাইস্কুল মাঠ, বিটঘর হাইস্কুল মাঠ, বিটঘর উলারা বটতলা, টিয়ারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পূর্ব পাশের মাঠ, শ্যামগ্রাম হাইস্কুল মাঠ, সাতমোড়া কালীবাড়ি মাঠ প্রভৃতি এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ফতেপুর হাইস্কুল মাঠ, রতনপুর হাইস্কুল মাঠ ও সাতমুড়াসহ বিভিন্ন গ্রামে গড়ে উঠেছিল গেরিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
নবীনগর থানার বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর ট্রানজিট ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল। সেসব ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠানো হতো। প্রশিক্ষণের পর ভারত থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ মুক্তিযোদ্ধারা কসবা ও আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেন। অনেক সময় নবীনগরের ওপর দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় গেরিলা অপারেশনের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা যাতায়াত করতেন। তাছাড়া শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সংগ্রহ, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও এ-সকল ক্যাম্পে করা হতো। এসব কাজের নেতৃত্বে ছিলেন মো. কবীর আহমেদ, আবুল বাশার, মো. সহিদুল ইসলাম, সফিকুল ইসলাম (মেরকুটা) প্রমুখ। যুদ্ধকালীন সময়ে নবীনগরে ছাত্র নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তখন ছাত্রলীগ-এর নেতৃত্বে ছিলেন আ. লতিফ, আব্দুস সামাদ খন্দকার (জিনোদপুর মেরকুটা), মাহবুবুল আলম, জিয়াউল হক সরকার, সাহাজুল আলম (নবীনগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং নবীনগর কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি), এমদাদুল হক (বিটঘর), তাজুল ইসলাম (ছাত্র ইউনিয়ন- নেতা), আখতার হোসেন সাঈদ, আজাহারুল ইসলাম, রওশন আলম, এ টি এম সলিমুল্লাহ প্রমুখ। নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর ও মুরাদনগর থানার দক্ষিণাঞ্চলের যুবকদের নিয়ে মুক্তি সংগ্রাম আঞ্চলিক কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন মিজানুর রহমান (বাড়িখোলা), যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন গোলাম মোরশেদ (শাহপুর), রওশন আলম ওরফে কালু মাস্টার (দাড়কান্দি) এবং বি রহমান (গাজীপুর)। এ কমিটি এলাকার ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে। ইডেন কলেজে অধ্যয়নরত নারীনেত্রী মমতাজ বেগম (শাহপুর) মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেন এবং আগরতলায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ডে নানাভাবে সহযোগিতা করেন।
নবীনগর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাঁরা হলেন- দেওয়ান আবুল আব্বাস এমএনএ (বাঞ্ছারামপুর, বঙ্গশার্দূল ক্যাম্পের ক্যাম্প প্রধান), কাজী আকবর উদ্দিন আহমেদ এমপিএ (শ্রীরামপুর, তিতাস ক্যাম্পের প্রধান), এডভোকেট আহমেদ আলী এমপিএ (কাজলিয়া, যুবশিবির উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান), সাজেদুল হক ভানু মিয়া (সভাপতি, নবীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগ), আবু তাহের সরকার (সাধারণ সম্পাদক, নবীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগ), ডা. আমজাদ হোসেন (আলমনগর, ন্যাপ, মোজাফ্ফর) প্রমুখ।
নবীনগর ছিল মুক্তিযুদ্ধের ৩নং সেক্টরের অধীন। এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম। ২নং সেক্টরের আখাউড়া ও মুরাদনগরের কিছু অংশসহ নবীনগরের গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন সুবেদার আবদুল আউয়াল। ১৭ই সেপ্টেম্বর থেকে সুবেদার আ. মজিদ নবীনগরের গ্রুপ কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।
১৪ই এপ্রিল পাকবাহিনীর একটি জাহাজ লালপুর থেকে বড়িকান্দি ও মানিকনগর হয়ে নবীনগরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এ খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন আ. গাফ্ফার (গোকর্ণঘাট)- এর নেতৃত্বে আ. হালি (আলীয়াবাদ), আ. লতিফসহ ৮-৯ জন মুক্তিযোদ্ধা দড়িলাপাং নামক স্থানে জাহাজটি আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে জাহাজটি পিছু হটে। কিছুক্ষণ পর পাকবাহিনীর দলটি আবার ফিরে আসে এবং জাহাজ ও বিমান থেকে উপর্যুপরি হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি বিমান আক্রমণে পিছু হটে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। এ বিমান হামলায় সোনা মিয়া (নবীনগর পশ্চিম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান) ও আব্দু মিয়াসহ নরসিংহপুর, নবীপুর, চরলাপাং গ্রামের ১০জন লোক নিহত হয়। পাকবাহিনীর দলটি ফিরে যাওয়ার সময় চরলাপাং গ্রামে হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং অনেককে আহত করে।
মে মাসের প্রথম দিকে পাকবাহিনী স্টিমারযোগে ঢাকা থেকে নরসিংদী হয়ে নবীনগরে আসে। নবীনগর বাজারে পৌঁছেই তারা এলোপাতাড়ি কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে এবং দোকান ও বাড়িঘরে আগুন দেয়। গুলির শব্দ শুনে বাজারের লোকজন ভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। এ-সময় তারা নবীনগর বাজারের পূর্ব-উত্তর পাশে মনুবাবুর পরিত্যক্ত বাড়ির দোতলায় ক্যাম্প স্থাপন করে। ৬ই জুলাই তারা নবীনগর পাইলট হাইস্কুল, নবীনগর থানা এবং ডাকবাংলোতে ক্যাম্প স্থাপন করে। এসব ক্যাম্প থেকেই তারা থানার বিভিন্ন গ্রামে নির্যাতন ও অত্যাচার চালায়।
স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী-র নেতৃত্বে নবীনগরে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। আ. করিম (চেয়ারম্যান, শ্রীরামপুর)-কে আহ্বায়ক করে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলো- সেকান্দার হাজী (চেয়ারম্যান, বগডহর ইউনিয়ন; সভাপতি, নবীনগর সদর শান্তি কমিটি), শিশু মিয়া (চেয়ারম্যান, রতনপুর), সিরাজুল ইসলাম ওরফে পেয়ারা মিয়া (রতনপুর), গিয়াস উদ্দিন আহমদ (বড়াইল মসজিদের ইমাম), আব্দুস সাত্তার চৌধুরী, (আহ্বায়ক, বিদ্যাকুট ইউনিয়ন শান্তি কমিটি), দাগু মেম্বার (বাশারুক) প্রমুখ। বাসু মিয়াকে কমান্ডার করে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এখানকার উল্লেখযোগ্য রাজাকাররা হলো- সরল খাঁ (পূর্ববড়াইল), মন মিয়া (মনিপুর), খোরশেদ আলম (খলাপাড়া), সিরাজ মিয়া (বড়াইল, এর নেতৃত্বে বাজারের পশ্চিম পাশে বড়াইলের ৮ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়), ফটিক মিয়া (নারায়ণপুর), মালী ডাকাত (ইব্রাহিমপুর, ১৫ জন রাজাকারের কমান্ডার), শাহেদ মিয়া (বগডহর), শিরু মিয়া (বগডহর), হানিফ মেম্বার (নরসিংহপুর), এডভোকেট খলিলুর রহমান (নবীনগর পশ্চিমপাড়া) প্রমুখ। নবীনগরের শান্তি কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে জনগণকে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করে। তারা পাকবাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়াসহ গণহত্যায় সহায়তা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে তাঁদের পিতা-মাতা, গ্রামবাসী এবং নারীনির্যাতনে সহায়তা করে।
স্থানীয় পর্যায়ে পাকিস্তানিদের সহযোগীদের মধ্যে আরো ছিল এ কে রফিকুল হোসেন ওরফে খায়ের মিয়া (থানাকান্দি), আরফান আলী (বানিয়ারচর) প্রমুখ। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম (পিতা মাওলানা গোলাম কবির, বীরগাঁও) এবং পাকিস্তানি বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় সহযোগী পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল)-এর সেক্রেটারি জেনারেল এ কিউ এম শফিকুল ইসলাম (পিতা আব্দুস সোবহান, বীরগাঁও)- এর জন্ম এ এলাকায়।
পাকবাহিনী নবীনগরের বিভিন্ন গ্রামে হামলা চালিয়ে গণহত্যা ও নির্যাতনের পাশাপাশি অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। ২০শে জুন পাকবাহিনীর একটি টহল দলের গুলিতে আলীয়াবাদ গ্রামের আফরোজা বেগম সিতু নামে এক শিশু নিহত হয়। তারা ফতেহপুর গ্রামের হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার কালীমোহন তলাপাত্রকে তাঁর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে বটতলী বাজারের নিকট হত্যা করে। বড়াইল গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে তারা একজন মহিলাসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের ৯ জন লোককে ধরে নিয়ে যায়। একদিন পর মহিলাকে ছেড়ে দিলেও বাকিদের আশুগঞ্জে নিয়ে হত্যা করে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেয়, যা আশুগঞ্জ গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। ২৫শে মার্চ রাতে হানাদার বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান শেষবর্ষের ছাত্র অত্র এলাকার ননী গোপাল দেবনাথ (শ্যামগ্রাম)-কে জগন্নাথ হল থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। ১৪ই ডিসেম্বর ঢাকায় বসবাসরত নাসিরাবাদ গ্রামের আ. হালিমের চার পুত্র মুক্তিযোদ্ধা মো. বখতিয়ার হাসান মাখন, মো. কামরুল হাসান রতন, মো. রকিবুল হাসান লাকি ও মো. ইকবাল হাসান সাহারকে রাজাকার পরেশ এবং আলবদর নেতা মহিউদ্দিনের সহায়তায় পাকবাহিনী ঢাকার তেজতুরি বাজারস্থ বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে।
১০ই অক্টোবর খারঘর-বরাইল গণহত্যা সংঘটিত হয়। এদিন পাকবাহিনী খারঘর-বড়াইল গ্রামে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ৪৬ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। গণহত্যায় নিহতদের পাগলী নদীর তীরে গণকবর দেয়া হয়। পাকবাহিনী দাউরা গ্রামে ১৩ জনকে হত্যা করে, যা দাউরা গণহত্যা নামে পরিচিত। বাঘাউড়া-সেমন্তঘর গ্রামে পাকবাহিনীর গুলিতে ২২ জন গ্রামবাসী নিহত হন। এটি বাঘাউড়া-সেমন্তঘর গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। দড়িলাপাং গ্রামে তারা ৯ জনকে হত্যা করে, যা দড়িলাপাং গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। দক্ষিণ লক্ষ্মীপুর গ্রামে পাকবাহিনী ৭ জনকে হত্যা করে। এটি দক্ষিণ লক্ষ্মীপুর গণহত্যা নামে পরিচিত। বিদ্যাকুট গ্রামে হামলা চালিয়ে তারা ৭ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে, যা বিদ্যাকুট গণহত্যা নামে পরিচিত।
বিভিন্ন সময়ে পাকসেনারা তাদের দোসরদের সঙ্গে নিয়ে নবীনগরের বিভিন্ন পাড়ায়, বিশেষ করে মাঝিকাড়া, আলমনগর, নারায়ণপুর, আলীয়াবাদ প্রভৃতি গ্রামে হামলা চালিয়ে হাস-মুরগি, গরু-ছাগল ইত্যাদি নিয়ে আসত। এছাড়া তারা নারায়ণপুর, রসুল্লাবাদ, সলিমগঞ্জ, বড়াইল, বড়িকান্দি, মানিকনগর, নাসিরাবাদ, শ্যামগ্রাম, সাহেবনগর, গোপালপুর, রেয়াজতপুর, আলীয়াবাদ, চিত্রি, নবীপুর, বগডহর, সেমন্তঘর, বাঘাউরা, শিবপুর, নারুই, সোহাতা, ওয়ারুক, কড়ইবাড়ি, জিনোদপুর, বাড়িখলা, পাকবাঙ্গরা, টানচারা, ফতেহপুর, কাঠালিয়া, গোঁসাইপুর, কৃষ্ণনগর প্রভৃতি গ্রামে হানা দিয়ে নির্যাতন ও লুণ্ঠন চালায়।
নবীনগরের গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং নির্যাতনের ঘটনায় সাদেকপুর পশ্চিম ইউনিয়নে বহু লোক নিহত হয়, রতনপুর ইউনিয়নে অনেক লোক নিখোঁজ হয় এবং ইব্রাহিমপুর ইউনিয়নে সর্বাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক হিসেব অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকবাহিনীর হাতে এসব এলাকায় নিহত হয়েছেন ৪২০ জন, নিখোঁজ রয়েছেন ৯৮ জন এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫,৯৭৩টি ঘরবাড়ি।
নবীনগরের তিতাস নদীর পাড়ে ডাকবাংলো এবং নবীনগর পাইলট হাইস্কুলের বোর্ডিং পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল। দিনের পর দিন এখানে আটকে রেখে বহু নারী-পুরুষকে নির্যাতন করা হয়। নবীনগর এলাকার বাইরে থেকেও নারী-পুরুষদের ধরে এনে এখানে নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়।
নবীনগরে বেশ কয়েকটি গণকবর আছে। সেগুলো হলো— পাগলী নদীর তীর গণকবর (খারঘর-বড়াইল গণহত্যার শিকার ৪৬ জনের গণকবর), সেমন্তঘর গণকবর (সেমন্তঘর গণহত্যার শিকার ১০ জনের গণকবর), দড়িলাপাং গণকবর (দড়িলাপাং গণহত্যার শিকার ৯ জনের গণকবর), দক্ষিণ লক্ষ্মীপুর গণকবর (দক্ষিণ লক্ষ্মীপুর গণহত্যার শিকার ৭ জনের গণকবর) এবং বিদ্যাকুট গণকবর (বিদ্যাকুট গ্রামে হত্যার শিকার ৫ জনের গণকবর)। এছাড়াও শ্রীরামপুর, গোপালপুর, খাজানগর, বাঘাউড়া, থানা কম্পাউন্ড, নবীনগর পাইলট হাইস্কুল মাঠ এবং আলীয়াবাদ মসজিদের সম্মুখে গণকবর রয়েছে।
২২শে সেপ্টম্বর হিন্দুপ্রধান বিদ্যাকুট গ্রামে লুটতরাজের জন্য পাকবাহিনী আক্রমণ করলে বিদ্যাকুট যুদ্ধ- সংঘটিত হয়। গ্রুপ কমান্ডার হুমায়ুন কবির, এডভোকেট এস এম ইউছুফ এবং কমান্ডার আবদুল মজিদের নেতৃত্বে সংঘটিত এ-যুদ্ধে অনেক পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয় এবং অনেকগুলো অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। ১০ই অক্টোবর পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের খারঘর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ-যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয় এবং তারা পশ্চাদপসারণ করে। যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন গ্রুপ কমান্ডার আল মামুন সরকার, সেকশন কমান্ডার সারওয়ার্দী, কাশেম, হারুন, খায়ের, গোলাপ, তাজুল প্রমুখ। ১০-১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত হয় নবীনগর থানা যুদ্ধ। এ-যুদ্ধে একজন রাজাকার নিহত হয় এবং দুজন মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার কালা মিয়া ও মোবারক আহত হন। ১৪ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী নবীনগরে পৌঁছে এবং ১৭ই ডিসেম্বর ১৭জন পাকসেনার আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে নবীনগর থানা হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— মান্নান, বীর বিক্রম (পিতা আব্দুল লতিফ, নোয়াগ্রাম, শ্যামগ্রাম), আব্দুস সালাম, বীর বিক্রম (পিতা মুন্সি আজগর আলী, আলীয়াবাদ), মো. শাহজাহান সিদ্দিকী, বীর − (পিতা আলহাজ আব্দুর রাজ্জাক সিদ্দিকী, সাতমোড়া), শামসুল হক, বীর বিক্রম- (পিতা সৈয়দ আলী মুন্সি, বালিবাড়ি), আব্দুল লতিফ, বীর প্রতীক (পিতা লিল মিঞা, মহেশপুরে), আবুল হাসেম, বীর প্রতীক (পিতা সুরুজ মিয়া, শাহবাজপুর), কাজী মো. আকমল আলী, বীর প্রতীক (পিতা কাজী আকামত আলী, যশাতুয়া, রতনপুর), নজরুল ইসলাম, বীর প্রতীক (পিতা মো. ওয়ালি মিয়া, বাংগরা), ফোরকান উদ্দিন, বীর প্রতীক (পিতা আব্দুস ছাত্তার মিয়া, থোল্লাকান্দি), মাহবুব-উল-আলম, বীর প্রতীক (পিতা আবু মুসা মো. মসিহা; আহমেদপুর), মিজানুর রহমান, বীর প্রতীক (পিতা আব্দুল খালেক খান), মোফাজ্জেল হোসেন, বীর প্রতীক (পিতা মো. তোফাজ্জেল হোসেন, বড়িকান্দি) ও মোহাম্মদ হাফিজ, বীর প্রতীক (পিতা মুন্সি রহমত উল্লাহ, রতনপুর)।
নবীনগরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুল মান্নান, বীর বিক্রম (৬ই অক্টোবর চট্টগ্রামের মদুনাঘাট যুদ্ধে শহীদ), আব্দুল লতিফ, বীর প্রতীক (২৩শে অক্টোবর সালদা নদী যুদ্ধে শহীদ), সিপাহি আব্দুল মান্নান (পিতা কেনু মিয়া, শ্রীরামপুর; ২৭শে মার্চ চট্টগ্রামের দামপাড়া পুলিশ লাইনে শহীদ), মো. মোকাদ্দেছ আলী (পিতা আব্দুল আজিজ, সাহেবনগর, শ্যামগ্রাম), নূর মিয়া (পিতা জমির মিয়া, কুড়িঘর, নাটঘর), আব্দুল কুদ্দুছ (পিতা তালেব হেসেন, যশাতোয়া, রতনপুর), মো. ফরিদ মিয়া (পিতা নায়েব আলী, নবীনগর পূর্ব), ফরিদ উদ্দিন আহমদ (পিতা খবির উদ্দিন আহমদ, বাউচাইল, সাতমোড়া), মো. আমির হোসেন (পিতা আবদুর রাজ্জাক, নবীনগর পূর্ব), নায়েব সুবেদার নজির আহমদ (পিতা ছলিম উদ্দিন, বড়হিত, নাটঘর), ল্যান্স নায়েক আ. মালেক (পিতা মুন্সি কলিম উদ্দিন, নবীনগর পূর্বপাড়া), নায়েক আব্দুল হাকিম (পিতা আব্দুল হালিম, রসুল্লাবাদ), আবদুল্লাহ (পিতা মো. নবী, সেমন্তঘর, বিদ্যাকুট), আবুল হোসেন (পিতা ধন মিয়া, মাঝিকাড়া, শ্রীরামপুর), আব্দুল জব্বার (পিতা মো. দৌলত ব্যাপারী, মোল্লাকান্দি, বড়িকান্দি), শহীদুল্লাহ (পিতা সাহেব আলী, গুড়িগ্রাম; ৫ই জুলাই মিরপুর যুদ্ধে শহীদ), আবদুল আওয়াল (পিতা গোলাম রসুল, কনিকাড়া, শিবপুর), নূরুল হুদা (পিতা জুলফিকার আলী, দাপুনিয়া, শিবপুর), আবদুস সাত্তার (পিতা আফছার উদ্দিন, ইব্রাহিমপুর), সিপাহি আবু তালেব (পিতা খন্দকার তাহির উদ্দিন, সাহার পাড়া, শিবপুর), নায়েক হুমায়ুন কবীর চৌধুরী (পিতা অকিল উদ্দিন চৌধুরী, রুদ্রাক্ষবাড়ি, নাটঘর), মো. আক্কাছ আলী (পিতা রুপা মিয়া, রতনপুর), আ. মান্নান (পিতা ফেলু মিয়া, থোল্লাকান্দি, বড়িকান্দি), আব্দুল হামিদ (পিতা অহাব আলী, খারঘর, বড়াইল), আব্দুল জলিল (পিতা রৌশন আলী খন্দকার, জালশুকা, বড়াইল), বিনন খাঁ (পিতা সুজাত খাঁ, মালাই, জিনোদপুর), মো. তঞ্জব আলী (পিতা মো. দেওয়ান আলী, চরগোসাইপুর, বড়াইল), ফরিদ উদ্দিন আহমদ (পিতা কবির উদ্দিন আহমদ, কাইতলা), নায়েক আ. গণি (পিতা সোনা মিয়া, বাড়িখলা, লাউর-ফতেহপুর), আবদুস ছালাম (পিতা হাজী সেকান্দার আলী, বাঘাউরা, শিবপুর), আ. হাকিম (পিতা আজমত আলী, থোল্লাকান্দি, বড়িকান্দি), ইসমাইল সরকার (পিতা আবদুস সামাদ সরকার, মালাই, জিনোদপুর), সহিদ মিয়া (পিতা মানিক মিয়া, নুরজাহানপুর; রাঙ্গামাটিতে শহীদ), আবদুস সামাদ (বাঘাউরা, শিবপুর), গোলাপ মিয়া (জালশুকা; ১০ই অক্টোবর খারঘর যুদ্ধে শহীদ), এস এম ইসহাক সেলিম (পিতা মো. ইসমাইল, সেলিমনগর/ রামচন্দ্রনারায়ণ, বিদ্যাকুট; ৭ই ডিসেম্বর বিদ্যাকুটে মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ), আবদুস সালাম সরকার (পিতা আ. খালেক সরকার, কনিকাড়া, শিবপুর; ১২ই ডিসেম্বর নবীনগর যুদ্ধে শহীদ), মো. বখতিয়ার হাসান মাখন (পিতা আ. হালিম, নাসিরাবাদ), মো. কামরুল হাসান রতন (পিতা আ. হালিম, নাসিরাবাদ), মো. রকিবুল হাসান লাকী (পিতা আ. হালিম, নাসিরাবাদ) ও মো. ইকবাল হাসান সাহার (পিতা আ. হালিম, নাসিরাবাদ)। শেষের চারজন সহোদর। ১৪ই ডিসেম্বর স্থানীয় রাজাকাদের সহায়তায় পাকবাহিনী তাঁদের ঢাকার তেজতুরী বাজারের বাসা থেকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
নবীনগর উপজেলার আদর্শ গুড়িগ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সিপাহি মো. শহীদুল্লাহর স্মরণে বিটঘর রাধানাথ হাইস্কুলের পাশে সামাধিস্থলে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।
এছাড়া তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে বিটঘরের মহেশরোড থেকে আদর্শ গুড়িগ্রাম পর্যন্ত রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ স্মৃতি রোড’। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এস এম ইসহাক সেলিমের নামে বিদ্যাকুট ইউনিয়নের রামচন্দ্রনারায়ণ (রামচরাইল) গ্রামের একটি অংশের নামকরণ করা হয়েছে ‘সেলিমনগর’। এছাড়া তাঁর সমাধিস্থলে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা গোলাপ মিয়ার স্মরণে জালশুকা থেকে বড়াইল বাজার পর্যন্ত রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে “শহীদ মুক্তিযোদ্ধা গোলাপ মিয়া সড়ক’। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালাম সরকার স্মরণে তাঁর সমাধিস্থল নবীনগর পাইলট হাইস্কুল প্রাঙ্গণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া নবীনগর থানা গেইট থেকে উপজেলা অফিস পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালাম সরকার সড়ক’। [মো. শাহজাহান সোহেল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড