You dont have javascript enabled! Please enable it!

নবীনগর থানা যুদ্ধ (নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া)

নবীনগর থানা যুদ্ধ (নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) ১০ থেকে ১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত হয়। এ-যুদ্ধের মাধ্যমে নবীনগর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা ৬ই ডিসেম্বর নবীনগর উপজেলা হানাদারমুক্ত করার ব্যাপারে চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পরিকল্পনামতো নবীনগরের দক্ষিণ মহল্লায় আ. হক মাস্টারের বাড়িতে আ. লতিফ, রৌশন আলী, নাছির, আক্তার, কবীর আহমেদ, ডা. আমজাদ হোসেন, সার্জেন্ট সফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া, সুবেদার মজিদ প্রমুখসহ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা সমবেত হন এবং কড়ইবাড়ি গ্রামের দক্ষিণ পাড়ার নির্জন একটি বাড়িতে অবস্থান নেন। ৭ই ডিসেম্বর রাতে খাইরুল আলম ভূঁইয়া, মো. তোফাজ্জল, রাধাবল্লভ প্রমুখ গ্রুপ কমান্ডার মহেশপুর থেকে কড়ইবাড়ি এসে পৌঁছান। এ- সময় এ টি এম সলিমুল্লাহ (বলিবাড়ি), মিজানুর রহমান এবং হাবিলদার মোসলেমের গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারাও তাঁদের সঙ্গে যোগদান করেন।
৮ই ডিসেম্বর কড়ইবাড়ি থেকে অগ্রসর হয়ে সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধারা ইব্রাহিমপুর সুদন মিয়ার বাড়িতে মিলিত হন। পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকাররা তখন নবীনগর হাইস্কুল ও থানা ভবন এলাকায় বাংকারে এবং বেশকিছু রাজাকার নবীনগর জমিদার বাড়ির (পুরাতন) দোতলায় অবস্থান করছিল। সুবেদার আ. মজিদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা নবীনগর থানা সদরে অবস্থানরত পাকসেনাদের তিনদিক থেকে ঘেরাও করে আক্রমণ শুরু করার পরিকল্পনা করেন। মুক্তিবাহিনীর এফএফ ও বিএফ সদস্যরা থানা ভবনের উত্তর দিক থেকে এবং বিএলএফ ও নিয়মিত বাহিনী দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। খবর পেয়ে বলিবাড়ি গ্রামে অবস্থানরত সৈয়দ মো. তফাজ্জল হোসেন এবং শামছুদ্দিন আহম্মদ তাঁর সদস্যদের নিয়ে আলমনগর গ্রামে ডা. আমজাদ হোসেনের বাড়িতে সুবেদার আ. মজিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
৯ই ডিসেম্বর মধ্যরাতে এফএফ ও বিএফ বাহিনীর শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা আলমনগর, নরসিংপুর, মনতলা প্রভৃতি এলাকায় চক্রাকারে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অবরোধ সৃষ্টি করেন। উত্তর দিকে এ দলে তখন আলমনগরের মো. ইউনুছ, শাহ মো. জিকরুল আহমেদ খোকন, নবীনগর সদরের গ্রুপ কমান্ডার আজহারুল ইসলাম লালু, বড়িকান্দির মনির হোসেন, রসুল্লাবাদের আলী আজম, শামছুল হক সাহন (পরর্তীতে সহ- উপজেলা কমান্ডার), মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল ইসলামসহ প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা সমবেত হন। এছাড়া দক্ষিণ দিকে মাঝিকাড়া গ্রামে সুবেদার মুছলেম, সুবেদার মজিদ, আ. লতিফ ও ছালামের গ্রুপসহ প্রায় ৭৫ জন বিএলএফ ও নিয়মিত বাহিনীর সদস্য সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মুক্তিযোদ্ধা কাজী আনোয়ার হোসেন তাঁর দল সাহাজুল আলম (নবীনগর কলেজের ভিপি), জিয়াউল হক সরকার, সার্জেন্ট সফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া, কবীর আহমেদ (জিনোদপুর) প্রমুখকে নিয়ে থানার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে আলীয়াবাদ গ্রামের কবরস্থানের পাশে একটি ছাইয়ের গাদার মধ্যে অবস্থান নেন। এখান থেকেই তাঁরা থানা মুক্ত করার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
১০ই ডিসেম্বর ভোরে উত্তর-দক্ষিণ দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে এক সঙ্গে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ করা হয়। আক্রমণের প্রথম দিনেই পাকবাহিনী মর্টার নিক্ষেপ করে মাঝিকাড়ার সবগুলো কাঠের দোকান জ্বালিয়ে দেয়।
মুক্তিযোদ্ধারাও তাদের নিজ-নিজ অবস্থান থেকে আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। ভোরে নবীনগরের উত্তরপাড়া দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ক্রলিং করে থানার দিকে অগ্রসর হয়।এ দলের মধ্যে রৌশন আলী, আজহারুল ইসলাম লালু, মোবারক, রতন, বাবুল, সিদ্দিক, জাহাঙ্গীর, জুলমত, মুখলেছ, সাত্তার, আ. রউফ, নুরুল ইসলাম, আলী আজম, আক্তার হোসেন, কালা মিয়া, শাহ জিকরুল আহমেদ খোকন প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। অগ্রবর্তী এ কমান্ডোর সঙ্গে জমিদার বাড়িতে অবস্থানরত রাজাকারদের সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন রাজাকার নিহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার কালা মিয়া ও মোবারক গুরুতর আহত হন। ১০ই ডিসেম্বর রাতে ছদ্মবেশে একজন পাকিস্তানি সৈন্য আকবর আলী একটি চিঠি নিয়ে নবীনগর থেকে পায়ে হেঁটে ভৈরববাজার যাবার পথে মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমানের কাছে ধরা পড়ে।
১১ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী – নবীনগর থানা ভবন দখল করে। থানার পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা নবীনগর হাইস্কুলের বাংকারে গিয়ে অবস্থান নেয়। থানার ওসি সালাহ উদ্দিন বোরকা পড়ে পালিয়ে যায়। এ- সময় নবীনগর হাইস্কুল ছাড়া সমগ্র নবীনগর মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। ঐদিন ১৩ জন রাজাকার পালিয়ে যাবার সময় আলমনগর ও নবীপুর গ্রামের সাধারণ মানুষের গণপিটুনিতে নিহত হয়।
১১ই ডিসেম্বর দুপুরে আটককৃত পাকিস্তানি সৈন্য আকবর আলীকে সদ্য দখলকৃত নবীনগর থানা ভবনে নিয়ে আসা হয়। থানা ভবনের ছাদে দাঁড় করিয়ে তাকে দিয়ে নবীনগর হাইস্কুল এলাকায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। পাকবাহিনীর একাংশ তখন আত্মসমর্পণে সম্মত হয় এবং পরদিন ১২ই ডিসেম্বর সকাল ৭টায় আত্মসমর্পণ করবে বলে জানায়। এরপর উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি বন্ধ হয়। ১১ই ডিসেম্বর নবীনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
১২ই ডিসেম্বর সকালে আত্মসমর্পণের ব্যাপারে পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়। একদল মুক্তিবাহিনীর কাছে, অন্যদল মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণে আগ্রহী। তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ তৃতীয় দলটি বঙ্গোপসাগরে অগ্রসরমাণ মার্কিন সপ্তম নৌবহর এন্টারপ্রাইজ-এর সম্ভাব্য উদ্ধার অভিযানের প্রত্যাশায় আত্মসমর্পণ না করে তখনো ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া তখন শত্রুমুক্ত। এ অবস্থায় কমান্ডার সুবেদার মজিদ নবীনগর থেকে ওয়ারলেসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় খবর পাঠান যে, নবীনগর মুক্ত করার জন্য ভারী আর্টিলারি শেল নিক্ষেপ প্রয়োজন।
১৩ই ডিসেম্বর দুপুরে মিত্রবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার নবীনগর সদরের ওপর চক্কর দিতে থাকে এবং ওয়ারলেসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে দুরপাল্লার ভারী আর্টিলারির গোলা নিক্ষেপের নির্দেশের সংকেত প্রদান করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হরণ এলাকা থেকে নিক্ষিপ্ত কামানের গোলায় সেদিন নবীনগর বাজারের অধিকাংশ দোকানঘর ভস্মীভূত হয়ে যায়। এ হেলিকপ্টার জমিদার বাড়িতে অবস্থানরত রাজাকারদের জন্য এসেছে মনে করে তারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে।
পরদিন ১৪ই ডিসেম্বর দুপুরে মুক্তিযোদ্ধারা নারায়ণপুর মাদ্রাসার নিকট ক্যাম্প স্থাপন করে পজিশন নেন এবং এখানে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়। নেতৃত্বে ছিলেন আ. লতিফ, সফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া, মিজানুর রহমান, কাজী আকবর উদ্দিন সিদ্দিক, দেওয়ান আবুল আব্বাস, অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান, মসিউজ্জামান মুসা প্রমুখ। ভারতীয় সৈন্যদল নারায়ণপুর থেকে ৩ ইঞ্চি বোরের মর্টার শেল চার্জ করে। পাকবাহিনীকে মাইকের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়। ধৃত পাকিস্তানি সৈন্য আকবর আলীকে থানা ভবনের ছাদে তুলে নেয়া হয়। তার অনুরোধে হানাদার কমান্ডার হাবিলদার মেজর সফি জানতে চায় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য আছে কি-না। থাকলে তার নাম কী এবং সেনাবাহিনীতে তার নম্বর কত? সুবেদার আ. মজিদের নাম ও নম্বর দেয়া হলে তখন তারা আলোচনায় বসতে রাজি হয়।
১৫ই ডিসেম্বর প্রস্তাব অনুসারে সকাল ৮টায় তিতাস নদীর পাড়ে আলোচনার স্থানে সুবেদার মজিদ, গ্রুপ কমান্ডার সৈয়দ তফাজ্জল হোসেনসহ মোট ৫ জন ও হানাদারদের পক্ষে সুবেদার মেজর সফিসহ দুজন হাজির হয়। তাদের প্রস্তাব তারা মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। কেউ কাউকে আক্রমণ করবে না। আলোচনা শেষে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের ডিফেন্সে চলে যান। পূর্বসিদ্ধান্ত মোতাবেক আ. লতিফ ও সফিকুল ইসলামের ওপর ভারতের কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে ওয়ারলেসে যোগাযোগ করে এয়ার এটাকের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দেয়া হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ করে খবরটা সকালে মিত্রবাহিনীর নিকট পৌঁছানো হয়। এ খবর পেয়ে দুপুর ১২টার দিকে মিত্রবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে কামানের গোলা নিক্ষেপ করলে তা মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্সে এসে পড়তে থাকে। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। এদিকে পাকহানাদার বাহিনী ধারণা করে যে, তাদের বাঁচানোর জন্যই শেলিং শুরু হয়েছে। তাই তারা সারেন্ডার না করে স্কুলের ছাদে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করে। শেলিং বন্ধ হয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা আবার ডিফেন্সে এসে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। মিত্রবাহিনীও নারায়ণপুর ক্যাম্পে জড়ো হতে থাকে। পরক্ষণেই হানাদারদের ভুল ভেঙ্গে গেলে ৫টার দিকে সাদা পতাকা উত্তোলন করে তারা ১৭ই ডিসেম্বর সকাল ১০টায় আত্মসমর্পণ করবে বলে জানায়। এদিন সকাল ১০টায় হানাদার বাহিনী মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। সুবেদার আ. মজিদ ও মিত্রবাহিনী স্কুলের দোতলা থেকে ১৭ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে বন্দি করে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। ৭২ জন রাজাকারকে উদ্ধার করে হত্যা করা হয়। এ- সময় হানাদারদের ক্যাম্প থেকে ৫২ জন নির্যাতিত নারীকে উদ্ধার করা হয়। [মো. শাহজাহান সোহেল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!