নরিংপুর বাজার যুদ্ধ (শাহরাস্তি, চাঁদপুর)
নরিংপুর বাজার যুদ্ধ (শাহরাস্তি, চাঁদপুর) সংঘটিত হয় দু-দফায় ৫ই জুলাই ও ১৫ই জুলাই। এতে ২০ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং বাকিরা নরিংপুর ক্যাম্প ছেড়ে পলায়ন করে। ক্যাম্প থেকে পালানোর সময় হানাদাররা তাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্র নরিংপুর বাজার সংলগ্ন পুকুরে ফেলে দিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধকালে মে-জুন ও জুলাই-র দিকে ডাকাতিয়া নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে বিশেষ করে সূচীপাড়া, চিতোষী ও খিলাবাজার এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা বিশেষভাবে বেড়ে যায়। চিতোষী রেলস্টেশন থেকে চিতোষী বাজার, উঘারিয়া বাজার ও নরিংপুর বাজার হয়ে নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জ পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চলাচল নির্বিঘ্ন করার জন্য পাকসেনারা নরিংপুর বাজারে পাকা বাঙ্কার তৈরি এবং স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। মুক্তিযোদ্ধারা এ ক্যাম্পটি ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন। পাকিস্তানিরা এ ক্যাম্পে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর গতিবিধি সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। ৫ই জুলাই সুযোগ বুঝে মুক্তিযোদ্ধারা উঘারিয়া স্বেতীনারায়ণ পুরের কাছে পাকসেনাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম টেলিফোনের লাইন কেটে দেন। এতে পাকিস্তানি হানাদাররা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। পরদিন সকালে তারা টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন হওয়ার স্থান পরিদর্শনে আসে। রাস্তায় চলাচলকারী সাধারণ জনগণের ওপর নির্যাতন চালাতে শুরু করে এবং পার্শ্ববর্তী ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এরই মধ্যে এম্বুশ করে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা পাকহানাদারদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালান। এতে ঘটনাস্থলেই ১১ জন পাকসেনা নিহত হয়। আক্রমণে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. হারেছ মিয়া, কমান্ডার আ. গফুর, আ. মতিন, অনন্ত রায়, মো. সেলিম মিয়া, গোলাম সরোয়ার, মো. শাহজাহান, আ. ওহাব, হাফেজ আহমেদ প্রমুখ। এ ঘটনার পর ১৫ই জুলাই সুবেদার জহিরুল হক পাঠানের নেতৃত্বে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা রাতের বেলা পাকসেনাদের ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। এ অভিযানে সুবেদার আলী আকবরকে কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। ঐদিন রাত ৮টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা নরিংপুর বাজার সংলগ্ন পুলের গোড়ায় অবস্থানরত পাকবাহিনীর ওপর অতর্কিতে ত্রিমুখী আক্রমণ চালান। পাকসেনারাও পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। এ আক্রমণে ৯ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ২ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎ বরণ করেন। ৪৮ ঘণ্টা তুমুল লড়াই শেষে পাকসেনারা নরিংপুর সেনা ক্যাম্প ছেড়ে পলায়ন করে। ক্যাম্প থেকে পালানোর সময় হানাদাররা তাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্র বাজার সংলগ্ন পুকুরে ফেলে দিয়ে যায়।
১৫ই জুলাইর এ দুঃসাহসিক অভিযানে মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্ব দেন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডর মো. জহিরুল হক পাঠান, বি এম কলিম উল্লাহ, রামগঞ্জের মো. গোফরান ভূঁইয়া প্রমুখ। যুদ্ধ শেষে পাকিবাহিনীর ক্যাম্প থেকে ১৫ জন যুবতী ও বিপুল পরিমাণ লুটের মালামাল উদ্ধার করা হয়। ঐদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-এর সান্ধ্যকালীন সংবাদে এ অভিযানের সাফল্যের কথা প্রচারিত হয় এবং ১৬ই জুলাই ভোর থেকে শঙ্কামুক্ত গ্রামবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আনন্দোল্লাস করে।মো. মিজানুর রহমান
নরিয়া গণহত্যা (মৌলভীবাজার সদর) সংঘটিত হয় ৯ই মে। এ গণহত্যায় অন্তত ৫০ জন নিরীহ মানুষ নিহত হন। এখানে অনেক নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কনকপুর ইউনিয়নের কনকপুর বাজার থেকে ২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে হিন্দু অধ্যুষিত নরিয়া গ্রাম। এ গ্রামের বাসিন্দাদের অধিকাংশ দাস এবং নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ। শেরপুর প্রতিরোধযুদ্ধে এ গ্রামের অনেকে অংশগ্রহণ করেন। গ্রামের বড় গৃহস্থ কামিনীরাম দেব প্রচুর জমির মালিক ছিলেন। তখন তার বাড়িতে ৪টি ধানের গোলা ছিল। এ বাড়ির প্রতি স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধীদের দৃষ্টি ছিল। এ বাড়ির সম্পদ লুট করার জন্য তারা পাকসেনাদের নিয়ে আসে। ৯ই মে এ বাড়িতেই অধিকাংশ মানুষকে হত্যা করা হয়।
বাহাদুরপুরের মদরিছ আলী পাকিস্তানিদের দোসরদের একজন। নরিয়া গ্রামের নিকটবর্তী মিঠুপুর গ্রামে তার ভাতিজিকে বিয়ে দেয়। এ গ্রামের প্রভাবশালী ধনী আক্তার উল্লা তার নিকটাত্মীয়। মদরিছ আলী নিজে আতর উল্লা, তোরাব উল্লা, বাদশা মিয়া, আলফু মিয়া, আছকির আলী, ইছব উল্লা, মফিজ উল্লা, আম্বর উল্লা প্রমুখ স্বাধীনতাবিরোধীকে নিয়ে এলাকায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ড ও সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাত। এরা মুসলিম লীগ করত। এরা পাকসেনাদের নরিয়া গ্রামে নিয়ে আসতে সহযোগিতা করে। মদরিছ আলী কামিনীরাম দেবের কাছে প্রস্তাব দেয় যে, গ্রামবাসীর সকল গরু-মহিষ তাদের দিতে হবে। রাজাকারদের সঙ্গে কথাবার্তার সময় কামিনীরাম দেবের ভাতিজা শ্রীধর দেব তাদের ধমক দেয়। এতে রাজাকাররা খুবই ক্ষিপ্ত হয়। প্রতিশোধ নিতে মদরিছ আলী ৯ই মে পাকসেনাদের নিয়ে নরিয়া গ্রামে আসে। ভয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষ পালাতে থাকে। মদরিছ আলী তখন আতর উল্লা মাজন, নাইওর মিয়া ও তোরাব উল্লাকে নিয়ে কামিনীরাম দেবকে আটক করে। তারা কামিনীরামকে পালিয়ে যাওয়া লোকদের ফিরিয়ে আনার জন্য চাপ দেয়। কামিনীরাম তার লোক পাঠিয়ে কিছু মানুষকে ফিরিয়ে আনেন। ফিরে আসা সবাইকেই পাকসেনারা এলএমজি দিয়ে গুলি করে কামিনীরাম দেবের বাড়িতে হত্যা করে। অনেক দিন পড়ে থাকায় এসব মৃতদেহ শেয়াল- কুকুরের খাদ্যে পরিণত হয়। পরে গ্রামের মানুষ হাড়গুলো খালের পাশে পুঁতে রাখে।
নরিয়া গ্রামে নিহতদের মধ্যে যাদের পরিচয় জানা গেছে, তারা হলেন- কামিনীরাম দেব (পিতা শরৎচন্দ্র দেব), প্রসন্ন কুমার দেব (পিতা শরৎচন্দ্র দেব), যোগেন্দ্র কুমার দেব (পিতা শরৎচন্দ্র দেব), কুন্তিবালা (স্বামী কামিনীরাম দেব), শ্রীধর দেব (পিতা প্রসন্ন কুমার দেব), অখিল চন্দ্র দেব (পিতা সরধন দেব), দয়ানন্দ দেব (পিতা সূর্যমণি দেব), সোনাচাঁন দেব (পিতা চিন্তারাম দেব), গঙ্গাচরণ দেব (পিতা কান্ত দেব), রেবতী দেব (পিতা হৃদয় দেব), রাকেশ চন্দ্র দেব (পিতা হৃদয় দেব), অধর দেব (পিতা হৃদয় দেব), নকুল চন্দ্র দেব (পিতা রবীন চন্দ্র দেব), সহদেব চন্দ্র দেব (পিতা রবীন চন্দ্র দেব), গৌরচরণ দেব (পিতা জ্ঞানরাম দেব), উমেশ চন্দ্র দেব, গজেন্দ্র বৈদ্য, উমেশ দেব (পিতা হৃদয়রাম বৈদ্য), যতীন্দ্র দেব (পিতা বকরাম দেব), সোনাচাঁন বৈদ্য (পিতা বকরাম বৈদ্য), পঁচা বৈদ্য (পিতা গগনরাম বৈদ্য), হরিবল বৈদ্য (পিতা বিপিনরাম বৈদ্য), হরেন্দ্র বৈদ্য (পিতা বিপিনরাম বৈদ্য), নিখিল বৈদ্য (পিতা কৈলাশ বৈদ্য) ও রসিকরাম বৈদ্য (পিতা কাশিরাম বৈদ্য)। এ গ্রামের অনেক নারী পাকসেনা ও রাজাকারদের দ্বারা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। এখানে ৬ জন বীরাঙ্গনার সন্ধান পাওয়া গেছে। [আবদুল হামিদ মাহবুব]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড